নিজের লেখা বই সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর বক্তব্য

লিখেছেন লিখেছেন আধা শিক্ষিত মানুষ ০৬ মার্চ, ২০১৫, ১০:৩৭:৩৭ সকাল



উলামা ও কুরআন গবেষকদের প্রয়োজন পূর্ণ করা এ তাফসীরটির উদ্দেশ্য নয়। অথবা আরবী ভাষা ও দীনী তা’লীমের পাঠ শেষ করার পর যারা কুরআন মজীদের গভীর অনসন্ধানমূলক অধ্যয়ন করতে চান তাদের জন্যও এটি লেখা হয়নি। ইতিপূর্বে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ তাদের এ প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম। এ তাফসীরটির মাধ্যমে আমি যাদের খেদমত করতে চাই তাঁরা হচ্ছেন মাঝারি পর্যায়ের শিক্ষিত লোক। আরবী ভাষা ও সাহিত্যে তাদের তেমন কোন দখল নেই। কুরআনী জ্ঞানের যে বিরাট ভাণ্ডার আমাদের এখানে গড়ে উঠেছে তা থেকে লাভবান হবার সামর্থ ও যোগ্যতা তাদের নেই। সর্বাগ্রে তাদের প্রয়োজনই আমাদের সামনে রয়েছে। এ কারণে তাফসীর সংক্রান্ত অনেক গভীর তত্ব-আলোচনায় আমি হাত দিইনি। ইল্‌মে তাফসীরের দৃষ্টিতে সেগুলো অত্যধিক গুরুত্ববহ কিন্তু এই শ্রেণীটির জন্য অপ্রয়োজনীয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমার সামনে রয়েছে সেটি হচ্ছে, একজন সাধারণ পাঠক যেন এ কিতাবটি পড়ার পর কুরআনের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য ও লক্ষ দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝতে ও উপল পারেন। কুরআন তার উপর যে ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে চায় এ কিতাবটি পড়ার পর তার ওপর যেন ঠিক তেমনি প্রভাব পড়ে। কুরআন পড়তে গিয়ে যেখানে তার মনে সন্দেহ-সংশয় জাগবে এবং প্রশ্ন ভেসে উঠবে সেখানে এ কিতাবটি সাথে সাথেই তার জবাব দিয়ে যাবে এবং সকল প্রকার সন্দেহের কালিমা মুক্ত করে তার মনের আকাশকে স্বচ্ছ, সুন্দর ও নির্মল করে তুলবে। সংক্ষেপে এতটুকু বলতে পারি, এটা আমার একটা প্রচেষ্টা। এতে আমি কতটুকু সফল হয়েছি তা বিদগ্ধ পাঠকগণই বলতে পারবেন।

কুরআনের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশ

কুরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি এখানে শাব্দিক অনুবাদের পদ্ধতি পরিহার করে স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশের পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। এর পেছনে আমার শাব্দিক অনুবাদ পদ্ধতিকে ভুল মনে করার মত কোন ধারণা কার্যকর নেই। বরং মিল্লাতে ইসলামিয়ার বড় বড় মনীষী এবং শ্রেষ্ঠ ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন আলেমগণ বিভিন্ন ভাষায় এ দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। তাই এ পথে নতুন করে অগ্রসর হবার তেমন কোন প্রয়োজন আমি দেখিনি। তবে এমন কিছু প্রয়োজন আছে যা শাব্দিক অনুবাদে পূর্ণ হয় না এবং হতে পারে না। স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাব প্রকাশের মাধ্যমে আমি সেগুলোকে পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি। শাব্দিক অনুবাদের আসল লাভ হচ্ছে এই যে, পাঠক কুরআনের প্রতিটি শব্দের মানে জানতে পারে। প্রতিটি আয়াতের নীচে তার অনুবাদ পড়ে তার মধ্যে কি কথা বলা হয়েছে তা জানতে পরে। কিন্তু এই পদ্ধতিটির এই লাভজনক দিকের সাথে এর মধ্যে এমন কিছু অভাব রয়ে গেছে যার ফলে একজন আরবী অনভিজ্ঞ পাঠক কুরআন মজীদ থেকে ভালোভাবে উপকৃত হতে পারে না।

১. শাব্দিক অনুবাদ পড়তে গিয়ে সর্বপ্রথম রচনার গতীশীলতা, বর্ণনার শক্তি, ভাষার অলংকারিত্ব ও বক্তব্যের প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতার অভাব অনুভূত হয়। কুরআনের প্রতিটি ছত্রের নীচে শাব্দিক অনুবাদের আকারে পাঠক এমন একটি নিষ্প্রাণ রচনার সাথে পরিচিত হয়, যা পড়ার পর তার প্রাণ নেচে উঠে না, গায়ের পশম খাড়া হয়ে যায় না, চোখ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয় না এবং তার আবেগের সমুদ্রে তরংগও সৃষ্টি হয় না। কতকগুলো নিষ্প্রাণ বাক্য পড়ার পর সে মোটেও অনুভব করে না যে, কোন বস্তু তার বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তিকে জয় করে হৃদয় ও মনের গভীরে নেমে যাচ্ছে। এই ধরনের কোন প্রতিক্রিয়া হওয়া তো দূরের কথা বরং অনুবাদ পড়ার সময় অনেক সময় মানুষ ভাবতে থাকে, এটি কি সেই গ্রন্থ যার একটি বাক্যের অনুরূপ একটি বাক্য রচনা করার জন্য সারা দুনিয়াবাসীকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছিল? এর কারণ, শাব্দিক অনুবাদ সবসময় নিরস হয়। এর মাধ্যমে মূল বিষয়ের রসাস্বাদন কোনক্রমেই সম্ভব হয় না। কুরআনের মূল রচনার প্রতিটি বাক্য যে গভীর সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ অনুবাদে তার সামন্যতম অংশও অন্তরভুক্ত হতে পারে না। অথচ কুরআনের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তার পবিত্র ও নিষ্কলুষ শিক্ষা এবং তার উন্নত বিষয়বস্তুর অবদান যতটুকু তার সাহিত্যের অবদানও সে তুলনায় মোটেই কম নয়। কুরআনের এ বস্তুটিই তো পাষাণ হৃদয় মানুষের দিলও মোমের মতো নরম করে দেয়। এটিই বজ্রপাতের মতো আরবের সমগ্র ভূখণ্ডকে কাঁপিয়ে তোলে। এর চরম শত্রুরাও এর প্রভাব বিস্তারের যাদুকরী ক্ষমতার স্বীকৃতি দিতো। তারা এর ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকতো। কারণ তারা মনে করতো, যে ব্যক্তি একবার এই যাদুকরী বাণী শুনবে সে এই বাণীর কাছে তার হৃদয়-মন বিক্রি করে বসবে। কুরআনের মধ্যে যদি এই সাহিত্যের অলংকার না থাকতো এবং অনুবাদের ভাষার মতো নিরস ও অলংকারহীন ভাষায় তা নাযিল হতো, তাহলে কুরআনের পরশে আরববাসীদের হৃদয় কোন দিন উত্তপ্ত হতো না, কোন দিন তাদের দিল নরম হতো না।

২. শাব্দিক অনুবাদ প্রভাবহীন হবার আর একটি কারণ হচ্ছে এই যে,সাধারনত এই অনুবাদ মূলের প্রতিটি লাইনের নীচে বসানো হয়। অথবা নতুন স্টাইল অনুযায়ী পাতাকে মাঝখান থেকে ডানে বামে দু’ভাগে ভাগ করে একদিকে আল্লাহর কালাম এবং অন্যদিকে তার অনুবাদ বসানো হয়। শাব্দিক অনুবাদ পড়ার ও শেখার জন্য এ ব্যবস্থা তো ভালই । কিন্তু অন্যান্য বই একনাগাড়ে পড়ে মানুষ যেমন প্রভাবিত হয় এখানে তেমনটি হওয়া সন্ভব পর হয় না। কারণ এখানে ধারাবাহিকভাবে একটি বক্তব্য পড়ার সুযোগ নেই। বার বার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। ইংরেজী অনুবাদগুলোয় এর চাইতেও বেশী প্রভাবহীনতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। কারণ সেখানে বাইবেলের অনুকরণে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের অনুবাদ নন্বর ভিত্তিক করা হয়েছে। আপনি কোন একটি চমৎকার প্রবন্ধের প্রত্যেকটি বাক্য আলাদা আলাদা করে লিখুন । তারপর ওপরে নীচে তার গায়ে নন্বর লাগিয়ে পড়ুন । আপনি নিজেই অনুভব করবেন,সুবিন্যাস্ত ও ধারাবাহিকভাবে লিখিত রচনাটি যেভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতো , এই পৃথক পৃথক বাক্যগুলোর জন্য তার অর্ধেক প্রভাবও আপনার ওপর পড়েনি ।

৩. শাব্দিক অনুবাদের প্রভাবহীন হবার তৃতীয় একটি বড় কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআন একটি রচনার আকারে নয় বরং ভাষণের আকারে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই ভাষান্তরিত করার সময় রচনার ভাষাকে যদি বক্তৃতার ভাষায় রূপান্তরিত না করা হয় এবং যেখানে যেমন আছে ঠিক তেমনিটি রেখে হুবহু অনুবাদ করা হয় তাহলে সমস্ত রচনাটিই অসংলগ্ন এবং বক্তব্যগুলো পারস্পারিক সন্পর্কহীন হয়ে পড়বে।

৪. সবাই জানেন, কুরআন মজীদ শুরুতে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়নি। বরং ইসলামী দাওয়াত প্রসংগে প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি ভাষণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করা হতো এবং তিনি ভাষণ আকারে তা লোকদের শুনিয়ে দিতেন। প্রবন্ধের ভাষা ও বক্তৃতার ভাষার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে অনেক বড় পার্থক্য থাকে।যেমন প্রবন্ধ লেখার সময় পাঠক সামনে থাকে না।তাই সেখানে কোন সংশয়ের উল্লেখ করে তার জবাব দেয়া হয়। কিন্তু বক্তৃতার সময় শ্রোতা তথা সংশয়ী নিজেই সামনে হাজির থাকে। তাই সেখানে সাধারনত এভাবে বলার প্রয়োজন হয় না যে,”লোকেরা এ কথা বলে থাকে।“ বরং বক্তা তার বক্তকৃতার মাঝখাখে প্রসংগক্রমে এমন একটি কথা বলে যায় য সন্দেহ পোষণকারীর সন্দেহ দূর করতে সাহায্য করে। প্রবন্ধের বেলায় বক্তব্যের বাইরে কিন্তু তার সাথে নিকট সন্পর্ক রাখে এমন কোন কথা বলতে হলে তাকে প্রসংগক্রমে উল্লেখ করে কোন না কোনভাবে প্রবন্ধের মূল বক্তব্য থেকে আলাদা করে লিখতে হয় যাতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন না হয়।অন্যদিকে বক্তৃতার মধ্যে শুধুমাত্র বক্তৃতার ধরন ও ভংগী পরিবর্তন করে একজন বক্তা বিরাট বিরাট প্রাসংগিক বক্তব্য বলে যেতে পারেন। শ্রোতারা এই বক্তব্যের মধ্যে কোথাও সন্পর্কহীনতা খুঁজে পাবেনা। প্রবদ্ধে পরিবেশের সাথে বক্তব্যের সর্ন্পক জোড়ার জন্য শব্দের সাহায্য গ্রহণ করা হয় । কিন্তু বক্তৃতায় পরিবেশ নিজেই বক্তব্যের সাথে নিজের সন্পর্ক জুড়ে নেয়। সেখানে পরিবেশের দিকে ইংগিত না করেই যেসব কথা বলা হয় তাদের মধ্যে কোন শূন্যতা অনুভুত হয় না। বক্তৃতায় বক্তা ও শ্রোতার বারবার পরিবর্তনহয়। বক্তা নিজের শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনোএকটি দলের উল্লেখ করে তৃতীয় পুরুষ হিসেবে। কখনো তাকে মধ্যম পুরুষ হিসেবে উপস্থাপিত করে সরাসরি সম্বোধনকরে। কখনো বক্তব্য পেশ করে এক বচনে। আবার কখনো বহুবচন ব্যবহার করতে থাকে। কখনো বক্তা নিজেই সরাসরি বলতে থাকে , আবার কখনো অন্যের পক্ষ থেকে বলতে থাকে। কখনো সে উচ্চতর ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে আবার কখনো সেই উচ্চতর ক্ষমতা নিজেই তার মুখ দিয়ে বলতে থাকে। এ জিনিসটি বক্তৃতায় একটি সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রবন্ধে এসে এটি সম্পূর্ণ একটি অসম্পর্কিত বস্তুতে পরিণত হয় । এ কারণে কোন বক্তৃতাকে প্রবন্ধ আকারে লিখলে পড়ার সময় তার মধ্যে বেশ সম্পর্কহীণতাঅনুভূত হতে থাকে । মূল বক্তৃতার পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে পাঠকের দূরত্ব যতই বাড়তে থাকে এই সম্পর্কহীণতারঅনূভূতিও ততই বাড়তে থাকে। অজ্ঞ লোকেরা কুরআন মজীদে যে অসংলগ্নতার অভিযোগ করে তার ভিত্তিও এখানেই। সেখানে ব্যাখ্যামূলক টীকার মাধ্যমে বক্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্পষ্ট করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কারণ কুরআনের আসল বাক্যের মধ্যে কোন প্রকার কম-বেশী করা হারাম। কিন্তু অন্য কোন ভাষায় কুরআনের অর্থ প্রকাশ করার সময় বক্তৃতার ভাষাকে সতর্কতার সাথে প্রবন্ধের ভাষায় রূপান্তরিত করে অতি সহজে এ অসংলগ্নতা দূর করা যেতে পার।

৫. কুরআন মজদের সূরাগুলো আসলে ছিল এক একটি ভাষণ। ইসলামী দাওয়াতের বিশেষ একটি পর্যায়ে একটি বিশেষ সময়ে প্রতিটি সূরা নাযিল হয়েছিল । প্রতিটি সূরা নাযিলের একটি বিশেষ অবস্থায় এই ধরনের বক্তব্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তখন এগুলো নাযিল হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপট ও নাযিলের উপলক্ষের সাথে কুরআনের সূরাগুলো এত গভীর সম্পকর‌্যুক্ত যে, সেগুলো থেকে আলাদা হয়ে নিছক শাব্দিক অনুবাদ কারোর সামনে রাখা হলে অনেক কথা সে একেবারেই বুঝতে পারবে না। আবার অনেক কথার উল্টো অর্থ বুঝবে। কুরআনের পূর্ণ বক্তব্য সন্ভবত কোথাও তার আয়ত্তাধীন হবে না। আরবী কুরআনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দূর করার জন্য তাফসীরের সাহায্য নিতে হয়। কারণ মূল কুরআনের কোন কিছু বৃদ্ধি করা যেতে পারে না। কিন্তু অন্য ভাষায় কুরআনের ভাব প্রকাশ করার সময় আমরা আল্লাহর কালামকে তার প্রেক্ষাপট ও নাযিলের অবস্থার সথে সম্পর্কিত করতে পারি। এভাবে পাঠক তার পরিপূর্ণ অর্থ গ্রহণ করতে পারবে ।

৬. কুরআন সহজ সরল আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হলেও সেখানে একটি বিশেষ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন প্রচলিত শব্দকে তার আভিধানিক অর্থে ব্যবহার না করে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছে। শাব্দিক অনুবাদ করার সময় তার মধ্যে এই পারিভাষিক ভাষার ভাবধারা ফুটিয়ে তোলা বড়ই কঠিন ব্যাপার। এই ভাবধারা ফুটিয়ে না তোলা হলে অনেক সময় পাঠকরা বিভিন্ন সংকট ও ভুল ধারনার সম্মুখীন হয়। যেমন কুরআনে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হচ্ছে “কুফর” । কুরআনে এ শব্দটি যে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে মূল আরবী অভিধানে এবং আমাদের ফকীহ ও ন্যায় শাস্ত্রবিদদের পরিভাষায় ব্যবহৃত অর্থের সাথে তার কোন মিল নেই। আবার কুরআনেও সর্বত্র এটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ।কোথাও এর অর্থ পরিপূর্ণ ঈমানবিহীন অবস্থা। কোথাও এর অর্থ নিছক অস্বীকার। কোথাও একে অকৃতজ্ঞতা ও উপকার ভুলে যাওয়ার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোথাও ঈমানের বিভিন্ন দাবীর মধ্যে থেকে কোন দাবী পূরণ না করাকে কুফরী বলা হয়েছে । কোথাও আকীদাগত স্বীকৃতি কিন্তু কর্মগত অস্বীকৃতি বা নাফরমানী অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোথাও বাহ্যিক আনুগত্য কিন্তু প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাসকে কুফরী বলা হয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন জায়গায় যদি আমরা “কুফরী” শব্দের অর্থ “কুফরী” লিখে যেতে থাকি বা এর কোন একটি প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে থাকি থাহলে নিসন্দেহে অনুবাদ সঠিক হবে। কিন্তু পাঠকগণ কোথাও এর সঠিক অর্থ থেকে বঞ্চিত থাকবেন, কোথাও তারা ভুল ধারণার শিকার হবেন, আবার কোথাও সন্দেহ-সংশয়ের সাগরে হাবুডুবু খাবেন । শাব্দিক অনুবাদের পদ্ধতিতে এই ত্রুটি ও অভাবগুলো দূর করার জন্য আমি মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাবার্থ প্রকাশের পথ বেছে নিয়েছি । কুরআনের শব্দাবলীকে ভাষান্তরিত করার পরিবর্তে কুরআনের একটি বাক্য পড়ার পর তার যে অর্থ আমার মনে বাসা বেঁধেছে এবং মনের ওপর তার যে প্রভাব পড়েছে , তাকে যথাসন্ভব নির্ভুলভাবে নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। লেখ্য ভাষায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ভাষনের মধ্যকার পারস্পরিক সন্পর্ক তুলে ধরেছি। আল্লাহর কালামের অর্থ , উদ্দেশ্য ও লক্ষ দ্ব্যর্থহীনভাবে সুস্পষ্ট করার সাথে সাথে তার রাজকীয় মর্যাদা ও গান্ভীর্য এবং ভাব প্রকাশের প্রচন্ড শক্তিকে যথাসন্ভব উপস্থাপন করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এই ধরনের মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদের জন্য শব্দের শৃংখলে বন্দী না থেকে মূল অর্থ ও তাৎপর্য প্রকাশের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা চালানোই ছিল অপরিহার্য । কিন্তু যেহেতু আল্লাহর কালামের ব্যাপার, সে জন্য আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে এ পথে পা বাড়িয়েছি। আমার পক্ষ থেকে যতদুর সতর্কতা অবলন্বন করা সম্ভবতা করেছি । কুরআন তার বক্তব্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যতটুকু স্বাধীনতা দেয় তার সীমা অতিক্রম চেষ্টা করিনি ।

আবার কুরআনকে পুরোপুরি বুঝার জন্য তার প্রতিটি বাণীর পটভূমি পাঠকের সামনে থাকা প্রয়োজন । মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ এবং ভাবার্থ প্রকাশের মাধ্যমে তা পুরোপুরিসম্ভবনয়। তাই প্রতিটি সূরার শুরুতে আমি একটি ভূমিকা সংযুক্ত করেছি। সেখানে সম্ভাব্যসকল প্রকার অনুসন্ধান চালিয়ে আমি বিভিন্ন বিষয় নির্দিষ্ট ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি । যেমন, সংশ্লিষ্ট সূরাটি কোন সময় নাযিল হয়েছিল। তখন কি অবস্থা ছিল? ইসলামী আন্দোলন তখন কোনপর্যায়েছিল? এ ছাড়াও কোথাও কোন বিশেষ বিশেষ আয়াতের অথাবা সমষ্টির নাযিলের কোন পৃথক উপলক্ষ থাকলে সেখানেই টীকার মধ্যে তা বলে দিয়েছি ।

টীকায় এমন কোন কথা আমি আলোচনা করিনি যার ফলে পাঠকের দৃষ্টি কুরআন থেকে সরে গিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে পারে । যেখানে আমি অনুভব করেছি সাধারণ পাঠক এখানে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ চান অথবা তার মনে কোন প্রশ্ন দেখা দেবে বা তিনি কোন সন্দেহ –সংশয়ের শিকার হবেন, সেখানে আমি টীকা লিখেছি এবং ব্যাখ্যা সংযোজন করেছি। আবার যেখানে আমার মনে আশাংকা জেগেছে যে, পাঠক এখানে কোন গুরুত্ব না দিয়ে সোজা এগিয়ে যাবে এবং কুরআনের বাণীর মর্মার্থ তার কাছে অস্পষ্ট থেকে যাবে সেখানে আমি টীকা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছি।

যারা এই কিতাবটি থেকে ফায়দা হাসিল করতে চান তাদেরকে আমি কয়েকটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে সূরার শুরুতে সংযোজিত ভূমিকা তথা প্রসংগ ও পূর্ব আলোচনাটি গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে নিন । যতক্ষন, ঐ সূরাটি অধ্যয়ন করতে থাকেন। তারপর প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কুরআন মজীদের যতটুকু পড়েন তার প্রতিটি আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ প্রথমে পড়ে নিন । এ উদ্দেশ্যে মাতৃভাষায় বা অন্য কোন ভাষায় আপনার পছন্দসই যে কোন অনুবাদের সাহায্যে নিন । এভাবে কুরআনের ঐ অংশের বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য একই সময় আপনার মনে ভেসে উঠবে । এরপর প্রত্যেকটি আয়াতকে বিস্তারিতভাবে বুঝার জন্য টীকা ও ব্যাখ্যা পড়তে থাকুন । এভাবে পড়তে থকলে আমি মনে করি একজন সাধারণ পাঠক কুরআন মজীদ সন্পর্কে একজন আলেমের সমপর্যায়ে জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম না হলেও একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে ইনশাআল্লাহ্ যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারবেন ।

আমি ১৩৬১ হিজরীর মুহাররম (ফেব্রুয়ারী, ১৯৪২খৃHappy মাসে এ গ্রন্থের কাজ শুরু করি । ৫ বছরের অধিককাল ক্রমাগত এ কাজ চালু থাকে এবং সূরা ইউসুফ –এর তরজমা ও ব্যখ্যা পর্যন্তহয়ে যায় । অতপর কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে পরিস্থিতিতে আমার না কিছু লেখার সুযোগ হয়েছে আর না এমন অবকাশ হয়েছে যে, পূর্বের কাজটুকু দ্বিতীয়বার দেখে গ্রন্থাকারে প্রকাশের উপযুক্ত করে তুলতে পারি । একে সৌভাগ্যই বলুন অথবা দুর্ভাগ্যই বলুন ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের অষ্টোবর মাসে হঠাৎ এমন সুযোগ এসে গেল যে, আমাকে জননিরাপত্তা আইনে (ঢ়ঁনষরপ ঝধভবঃু অপঃ) গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হলো, আর এখানেই আমি সে অবকাশ পেয়ে গেলাম যা এ গ্রন্থকে প্রকাশের উপযোগী করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল । আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া করি যেন আমার শ্রমের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং আল্লাহর বান্দাদের কুরআন বুঝায় এ গ্রন্থ সহায়ক প্রমাণিত হয় ।

আবুল আ’‌লা

নিউ সেন্ট্রাল জেল, মুলতান

১৭ যিলকদ ১৩৬৮ হি: (১১ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ খৃHappy

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৬ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

307511
০৬ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৫:২৮
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
249254
আধা শিক্ষিত মানুষ লিখেছেন : Good Luck
307513
০৬ মার্চ ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:১২
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

টার্গেট গ্রুপের কাছে আলকুরআনের মর্মবানী পৌঁছে দিতে তিনি সফল হয়েছেন নিঃসন্দেহে..

আল্লাহতায়ালা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করুন,
এবং আলকুরআনের অনুসারীদেরও..

জাযাকুমুল্লাহ..
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
249255
আধা শিক্ষিত মানুষ লিখেছেন : Good Luck Good Luck
307551
০৬ মার্চ ২০১৫ রাত ১১:৪৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
ইসলাম কে খৃষ্টধর্মের মত কেবল নির্দিষ্ট যাযক গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রন থেকে রক্ষা করতে এই ধরনের একটি তাফসির জরুরি ছিল।
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
249256
আধা শিক্ষিত মানুষ লিখেছেন : Good Luck
307568
০৭ মার্চ ২০১৫ রাত ০২:৫৬
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
১০ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
249257
আধা শিক্ষিত মানুষ লিখেছেন : Good Luck
351144
২৪ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ০৮:৪০
শেখের পোলা লিখেছেন : কোরআন বোঝার এটিই সহজতম উপায়৷ মোওদুদী সাহেব অনুকরনে একে আরও সংক্ষিপ্ত আরও সরল করে ডাঃ ইসরার আহমদ সাহেব বয়ানুল কোরআন ১০৮ ঘণ্টায় ভিডিও আকারে করেছেন৷ যার বাংলা অনুবাদ করে আমি ব্লগে পোষ্ট করি ও অনেক কে ইমেইলেও দিয়েছি৷ ধন্যবাদ আপনাকে৷
351478
২৫ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪০
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ভালো লাগলো. অনেক ধন্যবাদ..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File