তারাবীহ নামায যারা ২০ রাকাত পড়েন, তাদের জন্য কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন আধা শিক্ষিত মানুষ ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০১:৫২:৪০ দুপুর
ইদানিং কালে আমাদের তারাবীহ নামাযের রাকাত সংখ্যা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করেন, তারা সাধারণতঃ ৮ রাকাআতে তারাবীহ নামায পড়তে দেখা যায়। সেই ৮ রাকাতের পক্ষে ইদানিং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে আর পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উনারা যখন বলেন যে, ২০ রাকাতের তারাবীহ-এর কথা হাদীসে নাই। তখন আমরা যারা ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়ি এবং আমাদের দাদা-নানাদেরকে ২০ রাকাআত পড়তে দেখেছি, তারা রীতিমতো আঁতকে উঠি। ইত্যাদি বিতর্কের মাঝে হঠাত্ করে এই বিষয়ে পড়া লেখার সুযোগ হয়ে গেলো। সামান্য পড়া লেখা দিয়েতো আর সিদ্ধান্ত দেয়া যায়না। তাই বলা যেতে পারে এটি আধা শিক্ষিত মানুষের পড়ালেখার প্রসবন। এই বিষয়ে যাদের পয়েন্ট ভিত্তিক ভিন্নমত আছে, তারা যদি তাদের সেই ভিন্নমতটা পত্রস্ত করেন, তাহলে পাঠক মহল সঠিক তথ্য জানার সুযোগ পাবেন। তবে শুরুতেই নিয়ম লংঘন করে লেখাটার উপসংহার জুড়তে চাই এই বলে যে, ইসলামী শরীয়াতে ২০ রাকাআত তারাবীহ যেমন আছে, ০৮ রাকাআত তারাবীহ তেমন আছে। যেখানে ২০ রাকাআতের প্রচলন রয়েছে, সেখানে ০৮ রাকাআত চালু করার জিহাদে (?) শুরু করার কোন প্রয়োজন নাই। একই ভাবে যেখানে ০৮ রাকাআত চালূ আছে, সেখানে জোর করে ২০ রাকাআত চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নাই। আর এই বিষয়ে বিতর্ককে ফিতনার পয্যায়ে নিয়ে আম-জনতাকে বিভ্রান্তির মাঝে ফেলারও কোন সুযোগ নাই।
উমর রা. ও উসমান রা. এর যুগঃ
আল্লাহর রাসূলের উপরোক্ত ২জন সম্মাণিত সাহাবী খোলাফায়ে রাশেদার অন্তর্ভূক্ত। আর একজন ছিলেন আরেকজনের ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। হযরত উমর রা. এর শাহাদাতের পর হযরত উসমান রা. খলিফাতুল মুসলিমীন হিসাবে তদানিন্তন মুসলিম সাম্রাজ্যের নায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এই দুইজন সাহাবী আল্লাহর রাসূলকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রা. এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত উমর রা. এবং হযরত উসমান রা. এর জামানায় তারাবীহ এর নামায ২০ রাকাত ছিল।
عن السائب بن يزيد قال: كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب رضـ في شهر رمضان بعشرين ركعة. قال: وكانوا يقرءون بالمئين، وكانوا يتوكئون على عصيهم في عهد عثمان بن عفان رضـ من شدة القيام.
“হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর বিন খাত্তাব রা. এর যুগে সাহাবায়ে কিরাম ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। হযরত উসমান রা. এর যুগে তারাবীহ নামাযে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হওয়ার কারণে লাঠিতে ভর করে দাড়াতেন।” (বায়হাকী)
আল্লাহর রাসূল বলেছেন বা করেছেন একভাবে, আর উল্লেখিত সম্মাণিত সাহাবীগন করেছেন অন্যভাবে-এটা আমরা যেমন কল্পনাও করতে পারিনা। আর ০৮ রাকাআতের হাদীস গুলো উনারা জানতেননা-এটাও আমরা তেমন কল্পনা করতে পারিনা।
হযরত আলী রা. এর যুগঃ
হযরত আলী রা.। কনিষ্ঠদের মাঝে যারা সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেছেন, তাদের প্রথম হচ্ছেন হযরত আলী রা. আল্লাহর রাসূলের একদম ঘরের লোক। আপন চাচাত ভাই এবং চাচার মৃত্যুতে চাচাত ভাইয়ের অভিভাবক এবং সবশেষে তিনি রাসূলের ছোট জামাই-হযরত ফাতেমা রা. এর স্বামী। হযরত আলী রা. খোলাফায়ে রাশেদার ৪র্থ। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর তিনিই ছিলেন ইসলামী সাম্রাজ্যের অধিপতি। যার সম্পর্কে আরবী একটি উক্তি প্রসিদ্ধ আছে যে, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেনঃ أنا مدينة العلم، وعلي بابها (আমি ইলমের শহর, আর আলী সেই শহরের প্রবেশদ্বার)। সেই আলী রা. এর যামানায় চলা তারাবীহ সম্পর্কে হযরত শুতাঈর বিন শাকাল রাহ. জানাচ্ছেন যে,
عن شتير بن شكل، وكان من أصحاب علي رضـ أنه كان يؤمهم في شهر رمضان بعشرين ركعة.
“হযরত আলী রা. এর ছাত্র হযরত শুতাইল ইবনে শাকাল রাহ. তারাবিহ এর ইমাম ছিলেন এবং তিনি তারাবিহ নামায ২০ রাকায়াত পড়াতেন।”(বায়হাকী)
হযরত শুতাইল ইবনে শাকাল রাহ. আরো বলেনঃ
عن علي (رضـ) قال: دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلان يصلي بالناس عشرين ركعة.
“হযরত আলী রা. এক ব্যক্তিকে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।” (বায়হাকী)
হযরত আলী রা. এর দারুল হুকুমাত এর আওতায় ছিল ইরাক, কুফা ও বসরা। আর হযরত আলী রা. ছিলেন ২০ রাকাতের পক্ষে। তাই ঐ সব এলাকাতে ২০ রাকাতের আমল চালু আছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর তারাবীহঃ
ইসলামের পন্ডিত বলে পরিচিত ছিলেন ৪জন আব্দুল্লাহ। যে কোন দ্বীনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চার খলিফার সকলেই ঐসব আব্দুল্লাহদের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। এই চার আব্দুল্লাহ হচ্ছেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা., আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা, এবং (সম্ভবতঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.। ঐ সব সম্মাণিত আব্দুল্লাহগন সর্বদা আল্লাহর রাসূলের সাথে থেকে দ্বীনের নিগুড় তত্ব সম্পর্কে জেনেছেন।
হযরত উমর রা. এর যামানায় ইসলাম সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কুফা থেকে একদল প্রতিনিধি হযরত উমর রা. এর কাছে এসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে দ্বীনের ইলম প্রচারের জন্য কূফায় প্রেরণের আবেদন করেন। আবেদন বিবেচনা করে হযরত উমর রা. সেদিন বলেছিলেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতো পন্ডিত ব্যক্তির আমার পাশে থাকা খুবই জরুরী ছিল। কিন্তু তোমাদের প্রয়োজনটাকে বিবেচনা করে তাকে আমি কূফায় পাঠাচ্ছি, তোমরা তার কদর করো।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, কূফা ইলমের নগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর জ্ঞান পিপাসু হযরত আলী রা. এর আকর্ষণে নিজ রাজধানীকে সেই এলাকায় স্থানান্তর করে নিয়ে আসেন।
সেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ছিলেন তারাবীহের ইমাম। তিনি কুফাতে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়াতেন। এখন যারা কূফাতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তারা দেখবেন যে, সেখানে ২০ রাকাআত তারাবীহ এখনো চালু আছে।
মক্কা মদীনা বাসীর তারাবীহ এর আমলঃ
চার আব্দুল্লাহর একজন হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.। হযরত উমরা রা. এর গুণধর পুত্র। তার তারাবীহ এর আমল সম্পর্কে হযরত নাফে’ রাহ বলেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. মক্কায় বিশ রাকাআত তারাবিহ পড়তেন। তবে মক্কাবাসীরা প্রতি ৪ রাকাআত পর বিরতিকালে তাওয়াফ করে অধিক সওয়াব অর্জন করতেন। মদীনাবাসীরা এটা শুনে মক্কাবাসীদের অনুরূপ সওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতি ৪ রাকাআত পর ৪ রাকাআত করে বাড়িয়ে দেন। তাই ২০ রাকাআত ৩৬ রাকাআতে পরিণত হয়। (তিরমিযি)
ইমাম মালিক রাহ. এর মতে তারাবীহঃ
চার ইমামের একজন হযরত ইমাম মালিক রাহ. বলেনঃ হাররা যুদ্ধের আগে থেকে আজ অবধি ৩৬ রাকাআত তারাবিহ নামাযের আমল চালু রয়েছে।
ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী ও আহমদ রাহ. এর তারাবীহঃ
বিভিন্ন মাসআলা মাসায়িল সম্পর্কে চার ইমামের মাঝে আমরা অনেক মতভেদ লক্ষ্য করি। ইতিমধ্যে আমরা এদেরই একজন হযরত ইমাম মালিক রাহ. এর তারাবীহ সম্পর্কে জেনেছি। এখন জানবো বাকী ৩ ইমামের তারাবীহ সম্পর্কে।
قول أبي حنيفة والشافعي وأحمد أن صلاة التراويح في شهر رمضان عشرون ركعة وإنها في الجماعة أفضل مع قول مالك في إحدى الرواية عنه إنها ست وثلاثون ركعة.
তারাবিহের রাকাত সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ রাহ. এর উক্তি হলোঃ রামাদ্বান মাসে তারাবিহের নামায ২০ রাকাত। আর তা জামায়াতের সাথে আদায় করা উত্তম। ইমাম মালিক এর উক্তি হচ্ছে, তারাবিহের নামায ৩৬ রাকাআত। (আল মিযান)
ইমাম তিরমিযির বিবেচনায় তারাবীহঃ
সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থের মাঝে অন্যতম একটি হলোঃ জামে তিরমিযী। ইমাম তিরমিযী যার রচয়িতা। হাদীসের সংকলকগন তাদের যামানা অবধি চলা সকল মাসআলা মাসায়িল নিয়ে হাদীস সমূহ অনুসন্ধান করে তা সংকলিত করেছেন। ইমাম তিরমিযী থেকে আমরা তারাবীহ সম্পর্কে যা জানিঃ
ক. ইমাম তিরমিযি বলেন, ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ী রাহ. তারাবিহের নামায বিশ রাকাত বলে মত ব্যক্ত করেন। ইমাম মালেক রা. বলেনঃ তারাবিহের নামায বিতির সহ ৩৯ রাকাআত।
খ. ইমাম তিরিমিযি তার আলোচনায় ৮ রাকাআত সম্পর্কিত কোন উক্তি করেননি। কারণ সে যুগে ৮ রাকাত তারাবিহ ছিলনা এবং ৮ রাকাআতের বিষয়টা ছিল কল্পনাতীত বস্তু।
ইমাম শাফিয়ী রাহ. এর অনুসারীদের তারাবীহঃ
ইমাম শাফেয়ী রাহ. আয়িম্মাহ আরবাআ বা ৪ ইমামের মাঝে দ্বিতীয়। আর মক্কা-মদীনার অধিবাসীরা বেশীর ভাগ ইমাম শাফেয়ীর অনুসারী। তাই তার মতানুসারে মক্কা মদীনাতে ২০ রাকাত তারাবিহ প্রচলিত ছিল।
ইমাম শাফেয়ীর অনুসারী যেখানেই ছিল বা আছে, সেখানে ২০ রাকাত তারাবিহ এর প্রচলন আছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বিবেচনায় তারাবীহঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.কে বলা হয় আহলে হাদীসের ইমাম। ২০ রাকাআতের কম তারাবীহ এর কথা যারা বলেন, তাদের অধিকাংশই আহলে হাদীসের অন্তর্ভূক্ত। সেই ইমাম বলছেনঃ
فإنه قد ثبت أن أبَي بن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث، فرأى كثير من العلماء أن ذلك هو السنة، لأنه أقامة بين المهاجرون والأنصار ولم ينكره منكر.
“সহীহ হাদীস দ্বারা প্রামাণিত যে, হযরত উবাই ইবনে কাআব রা. মানুষদেরকে নিয়ে ২০ রাকাআত তারাবীহ ও তিন রাকাআত বিতির পড়তেন। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটি সুন্নত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ হযরত উবাই ইবনে কাআব রা. সকল মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের উপস্থিতিতেই ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়েছেন। কোন সাহাবী তার প্রতিবাদ করেননি। অতএএটা সুন্নাত হওয়ার প্রমাণ”। (আল বায়হাকী)
একথা চিরসত্য যে, হযরত উবাই ইবনে কাআব রা. হযরত উমর রা. এর যুগে ২০ রাকাআত তারাবীহ ও ৩ রাকাআত বিতির পড়তেন। আর এটা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের দ্বারা প্রমাণিত। এ কাজে সকল মুহাজির আনসার শরীক ছিলেন। কেউ অস্বীকার করেননি। বরং সাদরে বরণ করে নিয়েছেন। (মাজমুউল ফাতাওয়া-ইমাম ইবনে তাইমিয়া)
মুহাদ্দিস ইবনে কুদামা রাহ. এর সিদ্ধান্তঃ
তাবাবীহ সম্পর্কে বহু হাদীস পর্য্যালোচনার পর মুহাদ্দীস ইবনে কুদামা রাহ. বলেনঃ হযরত উমর রা. এর বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করার উপর সকল সাহাবার ইজমা সংঘটিত হয়েছে। এটা আমাদের সকলকে মানতে হবে। (আল মুগনী-ইবনে কুদামা)
বিশিষ্ট ফিকাহবিদ মুল্লা আলী আল কারী রাহ. তাই সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন যে,
أجمع الصحابة على أن التراويح عشرون ركعة.
“সকল সাহাবায়ে কিরাম ২০ রাকাআত তারাবীহের উপর একমত পোষন করেছেন।” (মিরকাতুল মাফাতিহ)
এখন প্রশ্ন হলো, উপরোক্ত কথামালা থেকে আল্লাহর রাসূল সা. কত রাকাআত তারাবীহ পড়েছেন, তা প্রমাণিত হয় কিনা? তারাবীহ ২০ রাকাআত নয়, বরং ০৮ রাকাআত বলে যারা বর্ণনা করবেন, তারা হযরত আয়িশা বর্ণিত হাদীসকে দলীল হিসাবে পেশ করবেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসকে এর পক্ষে দাড় করাবেন। কিন্তু যদি এই সব হাদীসের বক্তব্য যদি একই হয় অথবা তা যদি এমন হয় যে, হযরত আয়েশা থেকে অনেক অনেক জন বর্ণনা করেছেন, তাহলে আমরা সকল হাদীস গুলোকেই একটি হাদীস বলে গন্য করবো। এখন দ্বিতীয় পয্যায়ের প্রশ্ন হলোঃ আমরা হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী নামায পড়বো, না আল্লাহর রাসূল সা. যেভাবে নামায পড়েছেন, সেভাবে পড়বো? রাসূল সা. বলেছেনঃ আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখো, সেভাবে নামায পড়ো।
আল্লাহর রাসূল কিভাবে নামায পড়েছেন, সেটা আবার প্রশ্ন দাড় করাবে যে, বর্ণিত হাদীসটি রাসূল সা. এর প্রথম জীবনের আমল না শেষ জীবনের আমল। আর আধা শিক্ষিত মানুষের পক্ষে তা যাচাই করা খুবই কষ্টকর ও দূঃসাধ্য। তাই একটি সহজ সমাধানের দিকে আমরা যেতে পারি। আর তাহলোঃ রাসূল সা. এর নামায সরাসরি দেখেছেন সাহাবায়ে কিরাম। আর সাহাবীদের নামায সরাসরি দেখেছেন তাবিয়ীরা, আর তাবিয়ীদের নামায সরাসরি দেখেছেন তাদের পরবর্তীরা। এই ভাবেই নামায পৌছেছে আমার বাবা বা উস্তাদের কাছে। আমার উস্তাদও কিন্তু ৭ বছর বয়সে রাসূলের নির্দেশ মতো নামায পড়া যখন শুরু করেন, তখন তার হাদীস জানা ছিলনা, যেমন ছিলনা আমার। তাই আমরা উস্তাদ বা মা-বাবার দেখানো তরিকা অনুযায়ী নামায পড়ি। আর তা শিখে আসা হয়েছে দেখে দেখে বংশপরম্পরায়, যা গিয়ে মিলেছে আসহাবে রাসূল তক।
আর আমরা কল্পনাই করতে পারিনা যে, হযরত উমর, উসমান ও আলী রা. রাসুলের দেখানো তরিকামতে নামায পড়েননি।
বিষয়: বিবিধ
২১৭৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
২০ রাকাআত তারাবীহ ইজমায়ে সাহাবা ও ইজমায়ে আয়িম্মাহের মাধ্যমে তাওয়াতুর রূপে প্রমাণিত।
যারা ৮ রাকাআত তারাবীহর কথা বলেন এবং উম্মাহাতুল মু'মিনীন আয়িশা রাযি.-এর বুখারিতে বর্ণিত হাদীসটি ও সমমনা ২-৩টি হাদীসকে দলীল হিসেবে মানেন, তারা কি একটু চিন্তা করে দেখেছেন, ১৪ হিজরী থেকে ৫৩ হিজরী পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪০ বছর আম্মাজান আয়িশার হুজরার পাশেই ২০ রাকাআত তারাবীহ জামাআতের সাথে পড়া হতে থাকলো, অথচ তার কাছে এর বিপরীত আমলের হাদীস মওজুদ থাকা স্বত্ত্বেও তিনি কোন প্রতিবাদ করলেন না? এই্ আয়িশা তো সেই আয়িশা যিনি প্রয়োজনে হযরত আলীর সাথে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন (প্রেক্ষাপট যাই হোক, এটা তার হকপসন্দীর দিকটাই তুলে ধরে)!!!
আর শত শত সাহাবাও, যাদের মধ্যে কয়েকজন আবার রাসুল (সাঃ)থেকে ৮ রাকাআতের হাদিসও পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন, তারাও নিরবতা পালন করলেন। এই নিরবতা কি অর্থহীন?
নাকি আমরা সাহাবায়ে আজমাঈন (রাযি.)-থেকে বেশি দ্বীন বুঝে ফেলেছি?
জাযাকাল্লাহ খইর
১. আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য নয় যে, ২০ রাকাআতকে প্রতিষ্ঠিত করা আর ৮ রাকাআতকে ছুড়ে ফেলা। আমি ২০ রাকাআতের পক্ষে যে দলীল আছে, তা বুঝাতে চেয়েছি। তাই বলে ৮ রাকাআতের পক্ষে দলীল নাই এমন নয়। ৮ রাকাআতের পক্ষে আরেকটি পোষ্ট লিখার ইচ্ছা আছে।
২. হযরত আয়েশা রা, এর সম্পর্কে আপনার মতামতের সাথে একমত হতে পারলাম না। বিষয়টা "ধান ভানতে শিবের গীত" এর মতো মনে হয়েছে।
৩. আমরা আসহাবে রাসূলদের মাঝে সংঘটিত ইখতিলাফ নিয়ে কথা বলতে এমন ভাষা ব্যবহার উচিত নয়, যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মা আয়িশা (রাযি.) সম্পর্কে আমার মন্তব্য কেন যে আপনার কাছে তথাকথিত উপমার মতো মনে হলো তা আমার বুঝের বাহিরে। আমি উপমা দিয়ে কথা বলি না, বুঝিও না। এখানে কথাটি সরাসরি, ৮ রাকাআতের পক্ষে উম্মাহাতুল মু'মীনিনের যে হাদীসটি তারাবিহর দলীল হিসেবে বলা হয়, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে "রাসুলুল্লাহ(সঃ) রমাযান ও অন্যান্য মাসেও রাত্রে ১১ রাকাতের বেশী নফল আদায় করতেন না।" (বুখারী-১১৪৭, মুসলিম- ৬/১৬)লক্ষ্যনীয় ১. রাসূল (সাঃ) কি রমাদ্বানের বাহিরেও তারাবীহ আদায় করতেন নাকি ২. সর্বক্ষেত্রেই শুধু সলাতুল তাহাজ্জুদের দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তাহলে রাসূল (সাঃ)-কি তারাবীহ পড়তেন না, নাকি ৩. তাহাজ্জুদই রমাদ্বানে তারাবীহ হয়ে যায়। এই হাদীসটি গ্রহন করতে হলে এই মুআমালা আগে মেটাতে হবে। তারপরও সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে, কেন মা আয়িশা (রাযি.) হাদীস জানা থাকতেও ২০ রাকাআত তারাবীর বিপক্ষে কথা বললেন না।
এরপর যে হাদীসটিকে দলীল নেয়া হয় 'সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ‘"খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হযরত উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীমদারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে ১১ রাক‘আত ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায়েরনির্দেশ প্রদানকরেন। এই ছালাতফজরের প্রাক্কাল (সাহারীরপূর্ব) পর্যন্ত দীর্ঘ হ’ত’।" মজার বিষয় হলো এই হাদীসটি জা'মে ও ইসনাদ শ্রেণীর কোন গ্রন্থেই নেই। সুতরাং, মুহাদ্দিসে কিরাম হাদীসটিকে গঈরে মাশহুর ও যঈফ সাব্যস্ত করে ছেড়েছেন। উপমহাদেশের হাদীস শাস্ত্রের দিকপাল আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী তার বিখ্যাত গ্রন্থ "আনওয়ারুল বারীতে" সলাতুল লাইলেল আলোচনায় এই হাদীসটি উল্লেখ পূর্বক বলেছেন ১১ রাকাআত কথাটি পরবর্তীতে কোন রাবীর নিজের বৃদ্ধি করা।
ইখতিলাফটা আসলো কই? অস্পষ্ট ও বিচ্ছিন্ন কিছু রাওয়াতের বিপরীতে তাওয়াতুর আমলের দলিল। এটা কি স্পষ্ট দলীল নয়?
যারা তারাবীহ ২০ রাকাআতের বাহিরে অন্য কোন পদ্ধতির কথা ভাবেন, তাদের অনুরোধ করবো অন্তত একবার হলেও ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (রহ.)-এর ইলামুল মুআক্কিয়ীন ও শাইখ হাবিবুর রহমান আজমী (রহ.)-এর রাকাআতে তারাবীহ গ্রন্থ দুটোতে নজর বুলাতে।
আমি খুব কম সময় নেট-এ দেই তাই সাধারণতঃ পোষ্ট বা কমেন্ট করি না। এক্ষেত্রে করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার পরিচয়, আমি মধ্যপ্রাচ্যের একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, এবং আমার স্পেশালাইজেশন হচ্ছে হাদীস।
তারাবীর সালাতের কোন নির্ধারিত রাক'আত সংখ্যা নেই। রাসুল(সাঃ) থেকে ৮(+৩) রাক'আত পড়া প্রমাণিত, আর এর বেশী পড়ার কোন সহীহ প্রমাণ নেই। আবার, রাসুল(সাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে - "রাতের সালাত দুই-দুই রাক'আত করে, যখন রাত শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকা কর তখন এক রাক'আত বেতর পড়ে নিও।" তার মানে, এর কোন উপরের লিমিটও নেই, যে যত পড়তে পারে, তার ইচ্ছা, তাতেও কোন বাধা নেই। ঊমার(রাঃ) যেমন উবাই ইবনে কাব(রাঃ)-কে ৮ রাক'আত তারাবী পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন (মুয়াত্তা ইমাম মালিক), ঠিক তেমনি এটাও প্রমাণিত যে, তার সময়ের শেষের দিকেই ২০ রাক'আতও পড়া হয়েছে যা চালু থেকেছে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে। আর মদীনায় ৩৬ রাক'আতও পড়া হত। তাছাড়া, এটা নফল সালাত (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা-অধিকাংশ স্কলারের মতে), ওয়াজিব নয়, আর যেহেতু দুই দুই রাক'আত করে যত পড়া যায়, কোন লিমিট নেই, সেহেতু ২০ বা ৩৬ রাক'আতে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। রাক'আত সংখ্যা বাড়ানোর একটা কারণ ছিল ক্বীরাতের (কিয়ামের) দীর্ঘতা কমিয়ে আনা যাতে দূর্বল বা রোগীদের কষ্ট কম হয়, এবং যাতে তারা চাইলে ৮ রাক’আত পড়ে অন্ততঃ রাসুল(সাঃ) এর সুন্নাতটুকু পালন করতে পারে।
৮ রাক’আত রাসুল(সাঃ) এর সুন্নাহ, আর ২০ রাক’আত খোলেফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ (মনে রাখতে হবে যে – “আলাইকুম বি সুন্নাতী ওয়া সুন্নাতে খোলেফায়ে রাশেদ” – আমাদের জন্য পালনীয় দুটোই) এক্ষেত্রে একটা অপরটার বিপরীত নয়, বরং ইনক্লুসিভ। যে ৮ রাক’আত পড়ল (রাসুল(সাঃ)-এর কথা ভেবে) সে যেমন ভাল করল, ঠিক তেমনি যে ২০ রাক’আত পড়ল (দুই দুই রাক'আত করে যত পড়া যায় এই ভেবে) সেও তেমনি ভাল করল (-ইবন তাইমিয়া)।
এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে বরং আমাদের উচিৎ প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা, আর ইসলামের হাতকে শক্তিশালী করা। আর নিজেকে প্রশ্ন করা, আমি যা করছি তা কি শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যই করছি, নাকি আমি যা বিশ্বাস করি তা ঠিক প্রমাণের জন্যই করছি?
আল্লাহ্ সুবহানাহা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে ইসলামের বিজয়ের দিকে অগ্রসর করুন; আর নিজেদের মাঝে, পরিবারের মাঝে, সমাজের মাঝে, দেশের মাঝে, সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
তবে শেষ কথাঃ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সকল প্রচেষ্টাকে ইবাদত হিসাবে কবুল করেন। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন