Roseমাওলানা নিজামীর বর্ণনা: তায়েফে রাসূল সা: এর উপর নির্যাতনে লোমহর্ষক ঘটনাRose

লিখেছেন লিখেছেন আধা শিক্ষিত মানুষ ০৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:২৭:৪৬ রাত

(প্রিয় পাঠক! আগামীকাল তায়েফ সফর নিয়ে একটি ছবি ব্লগ পোষ্ট করার পরিকল্পনা। তাই তায়েফ সম্পর্কে আপনারদের সদয় অবগতির জন্য এই পোষ্ট। সম্পূর্ণন কপি পেষ্ট)



নবুওয়াতের দশম বছর ছিল আল্লাহর রাসূলের (সা.) জন্য শোকের বছর। এই বছরে তিনি তার অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক চাচা আবু তালিবকে হারান। অল্প ব্যবধানে হারান তার জীবন সঙ্গিনী সুখে-দুঃখের বিশ্বস্ত সাথী বিবি খাদিজা (রা.)-কে। দু’জন ছিলেন রাসূলের রেসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দু’ধরনের অবলম্বন এবং সহায়ক শক্তি। হযরত আবু তালিব জাগতিক ও বৈষয়িক দিক দিয়ে কাফের-মুশরিকদের মুকাবিলায় রাসূলের (সা.) জন্যে ছিলেন একটি বিরাট অবলম্বন। বিবি খাদিজা (রা.) বৈষয়কি এবং মানসিক উভয় দিক দিয়েই ছিলেন রাসূলের (সা.) একটি বড় অবলম্বন। এই দু’টো অবলম্বন থেকে বঞ্চিত হবার ফলে মনের উপর বিরাট একটা চাপ সৃষ্টি হওয়া ছিল একান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। তার উপর কাফের-মুশরিকদের বেপরোয়া আচরণ, অসহায় মনে করে জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া ছিল একটা বাড়তি চাপের শামিল। এই পটভূমিতে কুরাইশদের নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে এবং তাদের ব্যাপারে অনেকটা হতাশ হয়েই আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কা থেকে ৫০ মাইল দূরে তায়েফে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্যে। কারণ এই সময়ে কুরাইশ সর্দারদের নেতৃত্বে মক্কার কাফের-মুশরিকগণ বাধা প্রতিবন্ধকতার মাত্রা যেভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর করছিল তাতে তারা দাওয়াত কবুল করবে এ আশা করার সুযোগ তো ছিলই না উপরন্তু এ দাওয়াতের কাজ কোন ক্রমেই চলতে দিবে না এটাই অনুমিত হচ্ছিল অবস্থার প্রেক্ষেতে।

নবী (সা.)-এর তায়েফ সফরের লক্ষ্য ছিল ওখানকার লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা সেই সাথে তায়েফের প্রভাবশালী শক্তিশালী গোত্র বনী সাকিফকে অন্তত এতটুকুতে রাজী করাবেন যে তারা সেখানে নবীকে (সা.) আশ্রয় দেবে এবং ইসলামের দাওয়াতের ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। মক্কা থেকে সুদূর তায়েফের এই সফরে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন জায়েদ ইবনে হারেছা। তিনি এই সফরে বিশ দিন পর্যন্ত তায়েফবাসীদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন এবং আবদে ইয়ালীলের সাথে সাক্ষাতের পর সেখানে দশ দিন অবস্থান করেন।

তায়েফের নেতৃত্ব ছিল আমর বিন ওমাইর বিন আওফের তিন পুত্র আবদে ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবিবের হাতে। এদের কোন একজনের ঘরে কুরাইশ বংশের সুফিয়া বিনতে জুমাহী নাম্নী এক মহিলা ছিল। রাসূল (সা.) তায়েফের এই তিনজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে দেখা করে তদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, আমি ইসলামের কাজে আপনাদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় এখানে এসেছি। সেই সাথে আমার কওমের যারা আমার বিরোধিতা করছে তাদের মোকাবিলায় আমি আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতাও কামনা করি। রাসূলে পাক (সা.)-এর বক্তব্য শুনার পর তাদের একজন বললো, আল্লাহ যদি তোমাকে নবী বানিয়ে থাকেন তাহলে আমি কাবা ঘরের পর্দা ছিঁড়ে ফেলবো। অপর একজন ঠাট্টার স্বরে বললো আল্লাহ বুঝি তোমাকে ছাড়া নবী বানানোর জন্যে আর কোন লোক খুঁজে পাননি। তৃতীয় ব্যক্তি বললো, আমি কিছুতেই তোমার সাথে কথা বলবো না, কারণ যদি তুমি সত্যিই নবী হয়ে থাক তাহলে আমার মতো লোকের পক্ষে তোমার কথার জবাব দেয়া মানায় না কারণ তুমি তো আমার তুলনায় অনেক মহান। আর যদি তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে মিথ্যা দাবি করে থাক, তাহলে তুমি এমন যোগ্য নও যে, তোমার সাথে কথা বলা যায়। তাদের তিনজনের কথার ধরন প্রকৃতি দেখে আল্লাহর রাসূল (সা.) নিশ্চিত হলেন যে, এদের থেকে ভাল কিছুই আশা করা যায় না। তাই তিনি উঠে পড়লেন। তবে বিদায়ের পূর্বে তিনি তাদের প্রতি একটি অনুরোধ রাখলেন। তাহলো তোমরা আমার সাথে যে ব্যবহার করছো তাতো করছোই কিন্তু তোমরা অন্তত আমার এখানে আসার কথাটা গোপন রাখ, প্রচার করো না। তাদেরকে এই ব্যাপারে অনুরোধ করার মূল কারণ ছিল কুরাইশগণ এটা জানলে আরো বেপরোয়া এবং সাহসী হয়ে উঠবে। তাদের বিরোধিতা আরও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তায়েফের ঐ পাষান্ড নেতৃবৃন্দ সেই অনুরোধটুকুও রাখল না। বরং তাদের সমাজের দুষ্ট ও গুন্ডা প্রকৃতির যুবকদেরকে লেলিয়ে দিল মুহাম্মদ (সা.)-কে উত্ত্যক্ত করার জন্যে। তায়েফের ধুরন্ধর ঐ নেতৃবর্গ এটা ধরে নিয়েছিল যে নবী মুহাম্মদ (সা.) -এর সুদর্শন চেহারা দেখে, তার মুখের সুন্দর কথা শুনে যুবসমাজ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে। অতএব সেই পরিস্থিতি যাতে আদৌ সৃষ্টি হতে না পারে এ জন্যেই তারা এই নোংরা কৌশল অবলম্বন করে যাতে নবী মুহাম্মদ (সা.) কথা শোনার সুযোগ কারো জন্যেই না হতে পারে।

তায়েফের নেতৃবৃন্দের নির্দেশ মোতাবেক গুন্ডা ও দুষ্ট প্রকৃতির যুবকেরা রাসূলের (সা.) পিছে লাগল। প্রথমে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকল, ঠাট্টা-মশকারা করতে শুরু করল। তাদের হৈ চৈ শুনে লোক জড়ো হতে লাগল এবং আল্লাহর রাসূলকে (সা.) তাড়া করে একটি বাগান পর্যন্ত নিয়ে ছেড়ে দিল। উক্ত বাগানের মালিক ছিল উতবা বিন রাবিয়া (রা.) ও শায়বা বিন রাবিয়া (রা.)।

রাসূলে পাক (সা.) তার এই তায়েফ সফরকালীন সময়ে বনী সাকিফের দলপতি ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু কেউ তার এ আহবানে সাড়া দিল না। মুহাম্মদ (সা.) তাদের যুবকদের বিগড়িয়ে দিতে পারেন, এ আশঙ্কায় তারা বললো, হে মুহাম্মদ (সা.) তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও। পৃথিবীর অন্য কোথাও তোমার বন্ধু থাকলে তার সাথে গিয়ে মিলিত হও। অতঃপর তারা তাদের ভবঘুরে যুবকদেরকে লেলিয়ে দিল মুহাম্মদ (সা.)-এর উপরে। তারা চিৎকার করে এবং গালাগালি করে লোক জড়ো করে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর ঢিল পাথর নিক্ষেপ শুরু করে দিল। পাষন্ড ঐ গুন্ডা প্রকৃতির গোলাম ও যুবকেরা তাক করে রাসূলের (সা.) পায়ের গোড়ালি এবং টাকনুতে পাথর মেরে মেরে আল্লাহর রাসূলের (সা.) শরীরকে অসাড় করে তোলে। তারা রাস্তার দু’ধারে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে যায়। রাসূলের (সা.) চলার সাথে সাথে পাথরের পর পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। রক্ত ক্ষরণের ফলে রাসূল (সা.) ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লে তারা ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আবার পাথর ছুড়তে শুরু করে। রক্ত ঝরতে ঝরতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে জমাট রক্তে রাসূলের পায়ের জুতা আটকে যায় এবং খুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এক পর্যায়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) কিছু সময়ের জন্যে বেহুঁশ হয়েও যান। রাসূলের বিশ্বস্ত সাথী হযরত যায়েদ (রা.) নিজেকে ঢালতুল্য বানিয়ে তাকে হেফাজতের চেষ্টা করেন। পাথরের আঘাতের পর আঘাতে এক পর্যায়ে হযরত যায়েদের (রা.) মাথা ফেটে যায়।

অবশেষে আল্লাহর রাসূল (সা.) তায়েফ থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং ঐ সব দুষ্ট গুন্ডা পাষন্ড প্রকৃতির লোকেরাও ফিরে গেল। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নবী মুহাম্মদ (সা.) ওতবা এবং শায়বার আংগুর বাগানের প্রাচীরের গা ঘেঁষে আংগুর লতার ছায়ার নিচে বসে পড়েন এবং তার রবের দিকে মুখ করে এক মর্মস্পর্শী ভাষায় দোয়া করলেন যা সীরাতের বিভিন্ন কিতাবে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে :

‘‘হে আল্লাহ আমি তোমারই দরবারে নিজের অসহায়ত্বের এবং মানুষের দৃষ্টিতে আমার মর্যাদাহীনতার অভিযোগ পেশ করছি। এ তুমি কার কাছে আমাকে সোপর্দ করছো? এমন অপরিচিত বেগানাদের কাছেই কি আমাকে সোপর্দ করছো যারা আমার সাথে এমন কঠোর ও নিষ্ঠুর আচরণ করবে। অথবা এমন কার কাছে যাকে তুমি আমার উপর জয় লাভ করার শক্তি দিয়েছো। যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট না হয়ে থাক, তাহলে আমি কোন বিপদের পরোয়া করি না। কিন্তু যদি তোমার পক্ষ থেকে আমি নিরাপত্তা লাভ করি তাহলে তা হবে আমার জন্যে অধিকতর আনন্দদায়ক। আমি পানাহ চাই তোমার সত্তার সে নূরের কাছে যা অন্ধকারে আলো দান করে এবং দুনিয়ায় ও আখেরাতের সব কিছু সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করে। তোমার গজব ও শাস্তির যোগ্য হয়ো থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমি যেন তোমার মর্জির উপর রাজি থাকতে পারি আমাকে সে তাওফিক দাও। আর তুমিও আমার উপর সদা রাজি থাক। তুমি ছাড়া আর কোন শক্তি নেই।’’

রহমাতুল্লিল আ’লামীন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর এই মর্মস্পর্শী দোয়া হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আপস্নুত কণ্ঠের দোয় আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়। জালেম তায়েফবাসীর এহেন অপকর্মের জন্যে রাসূল (সা.) চাইলে দু’দিক থেকে তাদের পাহাড় চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দিতেও তারা প্রস্ত্তত বলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ফেরেশতা নবী মুহাম্মদকে (সা.) এই মর্মে অবহিত করেন। বোখারী, মোসলেম ও নাসায়ী হাদীস গ্রন্থে হযরত আয়েশার (রা.) বরাত দিয়ে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে;

হযরত আয়েশা (রা.) হুজুর (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ওহুদের যুদ্ধের চেয়েও কি কোন কঠিন অবস্থার সম্মুখীন আপনি কখনও হয়েছেন? জবাবে রাসূল (সা.) তায়েফের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমি (তায়েফবাসীর নির্মম অত্যাচারের ফলে) এতটাই পেরেশান হয়ে পড়েছিলাম যে কোন দিকে যাব ঠিক পাচ্ছিলাম না। তাই যে দিকে তাকাতাম সেদিকেই ধাবিত হতাম। এ অবস্থা থেকে আমি রেহাই না পেতেই হঠাৎ দেখলাম যে, আমি ‘কারনোস সায়ালেব’ নামক স্থানে আছি। উপরে তাকিয়ে দেখি একখন্ড মেঘ আমার উপর ছায়া দান করছে। উক্ত মেঘ খন্ডের মদ্যে হযরত জিব্রাইলকে (আঃ) দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে সম্বোধন করে বললেন, আপনার কওম আপনাকে যা কিছু বলেছে, আপনার দাওয়াতের জবাব তারা যেভাবে দিয়েছে, আল্লাহ তায়া তা সবই অবগত আছেন। তিনি আপনার জন্যে পাহাড়সমূহের ফেরেশতাদেরকে পাঠিয়েছেন, আপনি আপনার ইচ্ছামত যে কোন হুকুম তাদের করতে পারেন। অতঃপর পাহাড়ের ফেরেশতাগণ আমাকে সালাম করে বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) আপনার কওমের বক্তব্য এবং আপনার দাওয়াতের জবাব কিভাবে তারা দিয়েছে আল্লাহ তা শুনেছেন। আমি পাহাড়ের ফেরেশতা, আপনার রব আমাকে আপনার খেদমতে পাঠিয়েছেন যাতে আপনি আমাকে হুকুম করেন। বোখারীতে কথাটি এভাবে এসেছে, হে মুহাম্মদ আপনি যা কিছু চান বলার এখতিয়ার আপনার আছে। আপনি চাইলে তাদের উপর মক্কার দু’দিকের পাহাড় একত্র করে চাপিয়ে দিব। নবী (সা.)-এর জবাবে বলেন না-না। আমি আশা করি আল্লাহ তায়ালা তাদের বংশে এমন লোক পয়দা করবেন যারা লাশরীক এক আল্লাহর দাসত্ব করবে।

একটু আগে আমরা উল্লেখ করেছি হুজুর (সা.) ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় ওতবা বিন রাবিয়া এবং শায়বার আঙ্গুরের বাগানের প্রাচীর সংলগ্ন আঙ্গুর লতার ছায়ার নিচে বসেছিলেন। তখন তায়েফের দুই সর্দার ঐ বাগানে রাসূল (সা.) এ অবস্থায় দেখতে পায় এবং তাদের মনে হুজুরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ও সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। এখানে একথারও উল্লেখ আছে যে, বনী জুহামের যে মহিলাটি তায়েফের জনৈক সর্দারের বাড়িতে ছিল সেও হুজুরের সাথে দেখা করে। নবী করিম (সা.) তাকে বললেন, তোমার শ্বশুরকুলের লোকেরা আমার সাথে এ কী আচরণ করল? ওতবা বিন রাবিয়া ও শায়বা ইতোমধ্যে তাদের এক ঈসায়ী গোলামের মাধ্যমে রাসূলের (সা.) জন্যে একটি বড় পাত্রে করে কয়েক গোছা আঙ্গুর পাঠালো এবং মুহাম্মদকে (সা.) তা খাওয়ার জন্যে অনুরোধ করতে বলল। ঐ গোলামটির নাম ছিল আদ্দাস। সে রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলল, খোদার কসম এদেশে তো এ কালেমা বলার কেউ নেই। হুজুর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথাকার অধিবাসী? সে বলল, আমি ঈসায়ী এবং নিনাওয়ার অধিবাসী। এরপর রাসূল (সা.) তার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, তুমি কি মর্দে সালেহ ইউনুস বিন মাত্তার বস্তির লোক। আদ্দাস বলল, আপনি তাকে কিভাবে জানেন? হুজুর (সা.) উত্তরে বললেন, তিনি তো আমার ভাই, তিনিও নবী ছিলেন, আমিও নবী। একথা শুনামাত্র আদ্দাস নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ঝুঁকে পড়ল এবং তার হাত, পা, মাথায় চুমু দিতে লাগল এবং কালেমায় শাহাদাত উচ্চারণ করে ঈমানের ঘোষণা দিল।

দূরে থেকে রাবিয়ার (রা.) পুত্রদ্বয় ওতবা ও শায়বা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে এবং একে অপরকে বলতে থাকে দেখ তোমাদের নিজস্ব গোলামকেও এ লোকটি বিগড়ে দিল। আদ্দাস নবী (সা.)-এর নিকট থেকে ফিরে আসার পর তাকে বলা হল, তোমার কি হল যে তার মাথা ও হাত পায়ে চুমু দিতে লাগলে? সে তার মালিকদের সম্বোধন করে বলল, প্রভু আমার! তার চেয়ে ভাল মানুষ এই পৃথিবীতে আর নেই। তিনি আমাকে এমন এক বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন, যা নবী ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না, জানার কথা নয়। তারা তাদের গোলাম আদ্দাসকে বলল, তোমার দীন থেকে ফিরে যেয়ো না। তার দীন থেকে তোমার দীন উত্তম। তায়েফে আল্লাহর রাসূল (সা.) এসেছিলেন মক্কাবাসির ব্যাপারে হতাশ হয়ে। কিন্তু সেই তায়েফের লোকেরা তার সাথে যে ব্যবহার করল তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা একটু আগেই আমরা করেছি যা আল্লাহর রাসূলের (সা.) নিজের জবানীতে, ওহুদের চেয়েও ভয়াবহ। এরপর রাসূলের (সা.) সামনে তার নিজের জন্মস্থান মক্কায় ফিরে আসার কোন বিকল্প ছিল না। কিন্তু কিভাবে ফিরে যাবেন সে বিষয়ে তাকে ভাবতে হয়েছে, অনেকবার। তিনি তায়েফ থেকে ফেরার পথে নাখলা নামক স্থানে কিছু দিন অবস্থান করেন। মক্কায় কি করে, কিভাবে ফিরে যাবেন এ নিয়ে রাসূলের (সা.) মনে ছিল দারুণ পেরেশানী। কারণ তায়েফের ঘটনা মক্কাবাসীর কাছে পৌঁছার পর তাদের সাহস আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। এই পেরেশানীসহ আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কায় ফিরে যাওয়ার উপায় উদ্ভাবনের চিন্তাভাবনায় নিমগ্ন। ঠিক সেই মুহূর্তে আল্লাহর রাসূল (সা.) নামাযরত অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এ সময়ে জ্বীনদের একটি দল এ দিক দিয়ে আসার পথে রাসূলের (সা.) কণ্ঠের এই তেলাওয়াত শুনে আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) প্রতি ঈমান আনে এবং নিজেদের কওমের কাছে গিয়ে এর দাওয়াত দেয়া শুরু করে দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর নবীকে এই খবরটি প্রদান করেন অহির মাধ্যমে। যার লক্ষ্য ছিল রাসূলের (সা.) মনে সান্ত্বনা প্রদান করা। মানুষ নবীর এই দাওয়াত প্রত্যাখান করলেও জ্বীনদের একটি অংশ এ দাওয়াত কবুল করে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে এটা প্রচার করাও শুরু করে দেয়।

নাখলায় অবস্থানকালে আল্লাহর রাসূল (সা.) যখন মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, তখন তার সফর সঙ্গী হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কিভাবে মক্কায় ফিরে যাবেন, তারা তো আপনাকে সেখান থেকে বের করেই দিয়েছে। রাসূল (সা.) যায়েদ বিন হারেসাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি যে অবস্থা দেখছো আল্লাহ এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। তিনিই তো তার দীনের সহায় ও তাঁর নবীকে বিজয়ী করতে সক্ষম। এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কায় ফিরে যাবার কৌশল নির্ধারণের চিন্তাভাবনা করেন।

হেরায় পৌঁছার পর তিনি আবদুল্লাহ বিন আল ওরায়কেতকে পর পর তিনজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাছে পাঠান তারে আশ্রয় এবং সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়ার জন্যে। প্রথমে আবদুল্লাহ বিন পাঠানো হল আখনাস বিন শুরায়েকের নিকট যেন সে রাসূলকে (সা.) আশ্রয় প্রদান করে। আখনাস বিন শরায়েক বলল, সে কুরাইশদের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ থাকার কারণে আশ্রয় দিতে পারবে না। অতঃপর হুজুর আবদুল্লাহ বিন ওরায়কেতকে সুহাইল বিন আমরের নিকট পাঠান। তার পক্ষ থেকে বলা হল বনি আমার বিন লুসাই বনি কা’বের মোকাবিলায় তো কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না। এরপর রাসূল (সা.) বনি আবদে মানাফের একটি শাখা বনি নওফেলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুতয়েম বিন আদির নিকট আবদুল্লাহ বিন ওরায়কেত পাঠালেন।

আমাদের মনে থাকার কথা কুরাইশের যে পাঁচজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শিআবে আবি তালিবের বন্দী জীবনের অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে মুতয়েম বিন আদি তাদেরই একজন। আবদুল্লাহ বিন ওরায়কেত তার নিকট গিয়ে বললেন, মুহাম্মদ (সা.) তোমার কাছে জানতে চেয়েছেন, তুমি কি তাকে আশ্রয় দিতে রাজি আছ যাতে তিনি তার রবের পয়গাম পৌঁছাতে পারেন। জবাবে মুতয়েম বিন আদি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলল, তাকে মক্কায় আসতে বল। অতএব রাসূল (সা.) শহরে গিয়ে বাড়িতেই রাত কাটালেন। সকালে মুতয়েম তার পুত্রদেরকে অস্ত্র সজ্জিত করে হুজুরকে (সা.) হারাম শরীফে নিয়ে যায় এবং হুজুরকে (সা.) তাওয়াফ করার জন্যে অনুরোধ করে। হুজুরের (সা.) তওয়াফের সময় মুতয়েম ও তার পুত্রগণ তার নিরাপত্তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে। এ অবস্থা দেখে আবু সুফিয়ান আবদুল্লাহ বিন মুতায়েম (রা.) ও তার সন্তানদেরকে জিজ্ঞাস করল, তোমরা কি আশ্রয়দাতা না তার আনুগত্যকারী? মুতয়েম বলল, না শুধু আশ্রয় দানকারী। অতঃপর আবু সুফিয়ান (রা.) বলল, তোমাদের আশ্রয় ভঙ্গ করা যায় না, তোমরা যাকে আশ্রয় দিয়েছ আমরাও তাকে আশ্রয় দিয়েছি।

মুতয়েম বিন আদির এই বদান্যতা আল্লাহর রাসূল (সা.) মনে রেখেছিলেন। তাই বদর যুদ্ধ শেষে বন্দীদের ব্যাপারে বলেছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মুতয়েন (রা.) যদি বেঁচে থাকত আর এই লোকদের জন্যে সুপারিশ করতো তাহলে আমি এদেরকে ছেড়ে দিতাম। মুতয়েম বিন আদি (রা.) সম্পর্কে আরো জানা যায়, রাসূল (সা.) এবং হযরত আবু বকর (রা.) দু’জনের কাছে তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি। সেই বিশ্বাসেই হযরত নবী করিম (সা.) মক্কায় ফিরে যাবার জন্যে যে তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কথা চিন্তা করেছিলেন, তার মধ্যে মুতয়েম বিন আদিও শামিল ছিল। অন্য দু’জন তাদের চুক্তিবদ্ধতার কারণে রাজি হতে পারেনি। কিন্তু মুতয়েম বিন আদি রাজি হয়ে যান।

এখানে লক্ষ্যণীয় মক্কার পরিস্থিতিকে চরম প্রতিকূল মনে করে রাসূল (সা.) তায়েফ গেলেন। তায়েফের জমিনে পাষাণ দুর্বৃত্তদের চরম দুর্ব্যবহার ও নির্মম জুলুম নির্যাতনের মুখে আবার মক্কায় ফিরে আসার জন্যে যে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত।

এখানে একদিকে আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও ভরসা, যে তিনি তার দীনের বিজয়ের পথ সুগম করবেনই; চরম প্রতিকূলতাকে তিনি অবশ্যই অনুকূল বানাতে সক্ষম। এ আস্থা এ ভরসাই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের প্রকৃত অর্থ যার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বাস্তব কর্মকান্ডের মাধ্যমে। সেই সাথে ঈমান না আনলেও কিছু মানুষের মনে সত্যের স্বীকৃতি থাকতে পারে, সত্যের পথিকদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে। এ সাহায্য সহযোগিতা আদায় করে নেয়ার মত কর্মকৌশল উদ্ভাবনে দায়ীকে অবশ্যই বাস্তবসম্মত চেষ্টা তদবির করতে হবে। প্রান্তিক চিন্তা বা চরমপন্থার স্থান যেহেতু ইসলামে নেই, এ জন্যেই সর্বশেষ নবীর (সা.) মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সংলাপ, সমঝোতা ও সহযোগিতামূলক কর্মপন্থা গ্রহণের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তায়েফ থেকে মক্কা ফেরার ক্ষেত্রে গৃহীত এই কর্মকৌশলের মাধ্যমে।

তথ্যসূত্র:জানতে ক্লিক করুন।

বিষয়: বিবিধ

১৮৪২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

204734
০৮ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১০:২৪
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : কি সুন্দর দোয়া তিনি করেছিলেন । দোআর কথাগুলি যত পড়ি অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যাই "যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট না হয়ে থাক, তাহলে আমি কোন বিপদের পরোয়া করি না।" আমি যেন তোমার মর্জির উপর রাজি থাকতে পারি আমাকে সে তাওফিক দাও। আর তুমিও আমার উপর সদা রাজি থাক। তুমি ছাড়া আর কোন শক্তি নেই।’’"
শেয়ারের জন্য অনেক ধন্যবাদ










০৮ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:০৮
153772
আধা শিক্ষিত মানুষ লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও।
204822
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০১:২৯
বুঝিনা লিখেছেন : ধন্যবাদ বিস্তারিত জানানোর জন্য.। Rose Rose Rose Rose
204837
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৩:০৫
204990
০৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
এতকিছুর পরও রাসুল (সাঃ)তায়েফবাসিদের ক্ষমা করেছিলেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File