কোরীয় দ্বীপে উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হুমকি ,পাল্টা হুমকির কিছু নমুনা

লিখেছেন লিখেছেন শরীফযিকাওসার ১০ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:২৪:৪৭ সকাল

















































[img]http



























উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ঝড় তুলেছে। বলা বাহুল্য দুই কোরিয়ার মধ্যে চলমান সামরিক মহড়া এবং পাল্টা মহড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গন্ডিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিককালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে এবং বিপক্ষে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের যে সম্মুখ অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অতি সম্প্রতি জাপান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিসহ অন্যান্য সামরিক ঘাঁটিতে হামলার হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া উপদ্বীপে বি-৫২ বোমারু বিমান ওড়ালে এ হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল দেশটি। উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি (কেসিএনএ) জানিয়েছে, 'যুক্তরাষ্ট্রের ভুলে যাওয়া উচিত না যে, গুয়ামের অ্যান্ডারসন বিমানঘাঁটি, যেখানে বি-৫২ বোমারু বিমান ওঠানামা করছে এবং ওকিনাওয়া দ্বীপসহ জাপানে অবস্থিত অন্যান্য মার্কিন ঘাঁটি, যেখানে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েন আছে এবং নৌঘাঁটি আছে-সেগুলো সবই উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে।' এর আগে উত্তর কোরিয়া উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম বি-৫২ বোমারু বিমান উড়লে কঠিন জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। পরমাণু অস্ত্রের হুমকির জবাবে আরও শক্তিশালী পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেয় উত্তর কোরিয়া। এছাড়া তারা হামলার মহড়াও চালিয়েছে, পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ায় চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) হামলা চালানোর মহড়া দেয় উত্তর কোরিয়া।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্ব মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে অনেকটাই লক্ষণীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। আমেরিকা সবসময়ই চায় এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় রাখতে। আর দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে বারাক ওবামা যে "এশিয়া পিভোট" নীতি গ্রহণ করেছেন তা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট আর তা হলো মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং এশিয়াই এবার মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। শুরু থেকেই আমেরিকা পিয়ংইয়ং-এর পরমাণু কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র । এ বিষয়ে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অবরোধ জারি করার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচির ইতি টানতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তর কোরিয়াকে ঠেকাতে আমেরিকার সঙ্গে নয়া সামরিক পরিকল্পনা স্বাক্ষর করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের হামলা হলে ওই পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই দেশ যৌথভাবে এর জবাব দেবে।

দক্ষিণ কোরিয়া এ বিষয়ে বলেছে, উত্তর কোরিয়ার উস্কানির জবাবে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কিম মিন সিউক বলেছেন, নয়া সামরিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে উত্তর কোরিয়ার উস্কানির জবাব দিতে পারবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া নেতৃত্ব দেবে এবং আমেরিকা সমর্থন করবে। এছাড়াও তিনি সামরিক পরিকল্পনাটি স্বাক্ষর করা হয়েছে বলে জানান ।

সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তর কোরিয়া তৃতীয় পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালানোর পর দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করেছে উত্তর কোরিয়া। পাশাপাশি সিউলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে পিয়ংইয়ং।

উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি চুক্তি ও দুর্ঘটনাবশত সামরিক সংঘর্ষ রোধ চুক্তি করে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিলের ফলে এ চুক্তিও বাতিল হয়ে গেছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কাও বেড়ে গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান এবং স্নায়ুযুদ্ধকালীন শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত প্রভাব যাতে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেই ধারণা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরীয় দ্বীপের দক্ষিণ অংশে তার আধিপত্য বজায় রাখার পাশাপাশি তার সৈন্য মোতায়েন করেছিল। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই ১৯৫০ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে বলে রাখা ভালো মার্কিন বাহিনী ১৯৫০ সালে কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরই দুই কোরিয়ার মাঝে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও আরো যে বিষয়টি দেখা যায় আদর্শের দিক থেকে উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো এবং দক্ষিণ কোরিয়া পশ্চিমা ধারায় পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার মাঝে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এছাড়াও ৩৮ তম সমান্তরাল অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ার দুটি অংশ একটি বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়। যুদ্ধের পরবর্তীতে দ্বিমেরু কাঠামোতে যখন বিশ্ব পরিচালিত হতে থাকে ১৯৫৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে উওর কোরিয়ার ১৯৫৯ সালে একটি পরমাণু সহায়তার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ইয়ংবিয়ন এ একটি ৫ মেগাওয়াট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হয়, যার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু বিশ্বে পথ চলা শুরু হয়। আর এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান কখনোই ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচিকে বরাবরই বিরোধিতা করে এসেছে। বলা ভালো উত্তর কোরিয়া কখনোই তার পরমাণু কর্মসূচিকে বন্ধ রাখেনি এমনকি তার দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার পরিদর্শককে তার দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে। যা বরাবরই এই কোরীয় উপদ্বীপের জন্য একটি হুমকি ছিলো। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া তার পরমাণু অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় তা পশ্চিমারা কখনোই বিশ্বাস করেনি। ফলশ্রুতিতে ২০০৭ সালে উত্তর কোরিয়া তার কর্মসূচির প্রমাণ বিশ্বের নিকট তুলে ধরে। বর্তমানে সর্বশেষ সফল পরীক্ষা চালায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, যা মূলত উত্তর কোরিয়ার বিরোধী পক্ষগুলোর নিকট একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১১ সালের উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং লি মৃত্যুবরণ করলে তারই উওরসূরি হিসেবে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। গত ফেবু্রয়ারিতে যে পরমাণু পরীক্ষা চালানো হয়েছিল তার প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। তবে পিয়ংইয়ং বরাবরই দাবি করে আসছিল তাদের এ পরীক্ষা 'আত্মরক্ষার কর্মসূচি', যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত শত্রুতার কারণে জরুরি হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার জাতিসংঘে নিয়োজিত পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ভিতালি চুরকিন মনে করেন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে এই অবরোধ জরুরি এবং তা উত্তর কোরিয়ার কর্মসূচিকে ব্যাহত করতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়া-আমেরিকার যৌথ মহড়ার অংশ হিসেবে বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান আকাশে উড়িয়েছে আমেরিকা। মার্কিন বিমান বাহিনীর মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের হোয়াইটম্যান ঘাঁটি থেকে একজোড়া বোমারু বিমান দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে উড়ে যায়। বিমান দুটি ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর কোথাও না থেমে সাড়ে ছয় হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপ হয়ে আবারও মিসৌরির বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছায়। স্টিলথ বিমান দুটি মার্কিন বিমান বাহিনীর বোমারু বিমান শাখার অন্তর্ভুক্ত। কোরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, 'বি-২ বোমারু বিমান দুটি আমেরিকার দীর্ঘ দূরত্বে যুদ্ধের ক্ষমতা প্রকাশ করে।' পরমাণু বোমাবাহী বি-২ বিমানগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ সময় আকাশে উড়ে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম। এমনকি বিমানগুলো উড়ন্ত অবস্থায় জ্বালানি গ্রহণ করতে পারে। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার আকাশে বি-৫২ পরমাণু বোমাবাহী বিমান ওড়ায় আমেরিকা। এর প্রতিবাদে উত্তর কোরিয়া মার্কিন স্থাপনায় হামলা চালানোর হুমকি দেয়। পাল্টা হুমকি হিসেবে বি-২ বোমারু বিমান ওড়ায় আমেরিকা।

যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার চলমান মহড়ায় বোমারু বিমান দুটি অংশ নেয়। উত্তর কোরিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে সর্বাত্মক পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেয়। স্টিলথ জঙ্গি বিমান কোরীয় দ্বীপপুঞ্জে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল টেলিফোনে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে বলেন, 'পরমাণু অস্ত্রসহ প্রচলিত অস্ত্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ও সব মার্কিন সামরিক শক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহার করা হবে।' এছাড়াও দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সামরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনাকে গঠনমূলক নয় বলে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র প্যাট্রিক ভেনট্রিল বলেন, 'উত্তরের সামরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও উস্কানি দ্বীপ দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আদৌ গঠনমূলক নয় বলে তিনি মনে করেন'।

এর আগে উত্তর কোরিয়া হামলা চালালে তার কঠিন জবাব দেয়া হবে জানায় ওবামা প্রশাসন। এক বিবৃতিতে বলা হয়, পিয়ংইং-এর হুমকি এবং গলাবাজির পরিণতি মোটেও ভালো হবে না। এছাড়া সংবাদ মাধ্যম সিএনএন এ তথ্য জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, 'এ ধরনের হুমকিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় শক্তিই হচ্ছে মূল প্রাধান্যের বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাস্তববাদীরা যে শক্তির লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন, সাম্প্রতিককালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে চলমান সংকট তারই প্রতিফলন

বিষয়: বিবিধ

১৯৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File