স্বাধীনতার বিজয় উল্লাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই দুর্ঘটনার তদন্তের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি বোধ করেনি
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ২৪ নভেম্বর, ২০১৮, ০১:১৪:০৯ দুপুর
জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী : {কলকাতায় প্রথম সপ্তাহে যা দেখলাম জানলাম}
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর প্রকাশ পেল ২৭ মার্চ ১৯৭১ বিবিসি সংবাদে। ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থাকা বিবিসি সাংবাদিক মাইকেল কেøটন তথ্য ও ছবি প্রকাশ করলেন। একই দিন জেনারেল ইয়াহিয়ার পাকিস্তানিদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ উদ্ধৃতি করে করাচি থেকে কেনেথ ক্লার্ক লিখলেন ‘জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়েমুছে গেছে’। ২৭ মার্চ ৭১ তারিখের লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তরুণ বাঙালি মেজর জিয়ার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। শেখ মুজিবুরের তুলনায় খর্বকায় কিন্তু সাহস ও দৃঢ়তার চিহ্ন মুখমণ্ডলে। তার উচ্চারিত দুই শব্দ-‘ডব জবাড়ষঃ’ শুনে চমকিত হলেন বিলেতের বাম রাজনৈতিক কর্মীরা। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, পাকিস্তানের আয়ু শেষ হয়ে গেছে। নতুন দেশ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন। একাধারে প্রসব বেদনার যাতনা, অপর পক্ষে শুভ সংবাদের জন্য অপেক্ষমাণ প্রবাসী বাঙালিরা। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করলাম মিডলসবরোতে আমার বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমান বাবলু ও তার স্ত্রী ডা. সাবেরাকে। বাবলুর মা মিসেস জহুরা রহমান খুবই মিশুক দানশীল মহিলা এবং সুগায়িকা, বাবলুর বাবা অধ্যাপক লুৎফর রহমান ছিলেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক এবং প্রখ্যাত যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, অতীব নিরীহ ভদ্রলোক ঠিক বাবলুর মার বিপরীত। তারা উভয়ে আমাকে সন্তানসম স্নেহ করতেন। তারাই পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সাভারে তাদের পুরো জমি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দান করেছিলেন।
দ্রুত যোগাযোগ করলাম ডা. মসিহুজ্জমানের সঙ্গে। মসিহ খুব ভালো ছাত্র ছিল। মসিহ ও আমি একই দিনে একই সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিলাম। মসিহর বাবা পুলিশ ইনসপেক্টর আকতারুজ্জামান আমার পাকিস্তানি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উনার সিদ্ধেশরীর টিনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ভবিষ্যতের শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে বসবাস করেছেন।
১৯৭১ সালে এক হাজারের বেশি বাঙালি ডাক্তার আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টিতে কর্মরত ছিলেন, মূলত উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে আগত।
এছাড়া এক লাখের অধিক বাঙালি ছিলেন যাদের অধিকাংশই সিলেটের। বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র ছিল কয়েক হাজার। বি এন পির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাদের অন্যতম।
লন্ডন, গ্লাসগো, এডিনবরা, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, লিডস, নিউক্যাসেল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও অন্যান্য ছোট-বড় শহরে শনি-রোববারে পূর্ব পাকিস্তানের চিকিৎসক ছাত্র ও অন্য পেশাজীবীরা জড়ো হতে থাকলেন শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে।
সম্ভবত ২৭ মার্চ ৭১ ছিল শনিবার। লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হতে থাকল পুরনো কমিউনিস্ট কর্মী তাসাদ্দুক হোসেনের ‘দি গ্যানজেস রেস্টুরেন্টে’। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের আড্ডাখানা। এখানে শুক্রবার সন্ধ্যা ও শনি রোববারে বহু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য সপরিবারে ভারতীয় খাবারের স্বাদ নিতে আসতেন।
৩০ মার্চ ৭১ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার সর্বত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতার চিত্র প্রকাশ করল তাদের রিপোর্টার সাইমন ড্রিঙ্কের বরাতে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পূর্বে ইয়াহিয়া ভুট্টো ও শেখ মুজিবের আলোচনা পর্যবেক্ষণের জন্য আগত বিভিন্ন দেশের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। বিবিসির মাইকেল ক্লেটন ও ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ছাদে লুকিয়ে থাকেন ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দি পিপলের সম্পাদক আবিদুর রহমানের পরামর্শে। পরে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্টকে নিয়ে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতে বর্বরতা ও নির্মমতার স্বাক্ষরের চিত্র ধারণ করে সুকৌশলে পরের দিন ব্যাংকক পৌঁছে সেখান থেকে ডিসপ্যাচ পাঠান। যা ৩০ মার্চ ৭১ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে।
বহুল প্রচারিত রক্ষণশীল দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যস্থ পূর্ব পাকিস্তানিরা স্তম্ভিত ও বেদনায় নীল হয়ে যায়। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পরিচিত ও নিকটজনের চিন্তায়।
স্মরণ প্রয়োজন যে, শেখ মুজিবের ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ , ৯ মার্চে পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর ‘স্বাধীনতার দাবিতে আপসহীন’ থাকার আহ্বান, এবং ১২ মার্চ ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার সপক্ষে অবিচল থাকার পুনঃ আহ্বানকে বিলেতের বাঙালি পেশাজীবী ও ছাত্ররা খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি ১৯৫৭ সালে বাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীরা পাকিস্তানকে ‘ওয়ালাইকুমস্ সালাম’ খুব বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেনি। এসব বক্তব্যকে তারা দরাদরির রাজনৈতিক স্টান্ট বলে ধরেছিলেন। তবে এবার প্রবাসী বাঙালি ধাক্কা খেলেন আইটিএন, বিবিসি এবং টাইমস ও টেলিগ্রাফের সচিত্র সংবাদে ।
অধিকতর সংবাদ প্রত্যাশায় তারা জড়ো হতে থাকেন সপ্তাহ শেষে শনি রোববারে ৩ ও ৪ এপ্রিল লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে। জমে ওঠে বক্তৃতা ও পাকিস্তানিদের প্রতি ধিক্কার । অধিকতর সংবাদ সংগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের ধারণা ও চিন্তার তথ্য জানার জন্য স্কটল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে ‘ল’ হাসপাতালের ডা. মবিন ও আরও অনেকে এসে যোগ দেন হাইড পার্কের সমাবেশে। মবিন ঢাকার ছেলে কিন্তু পাস করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে।
হাইড পার্কে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমিও তাদের অনুসরণ করি। আমরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হই।
ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন : বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিডিএমএ
১৯৭১ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সম্ভবত ১০ তারিখে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ১০০ পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি চিকিৎসক লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে এক কমিউনিটি হলে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম বি এম এ (BMA) বিধায় নবগঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম ঠিক করা হয় বি ডি এম এ (BDMA)। ৫ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি মনোনীত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন লন্ডনের উপকণ্ঠে সারেতে কর্মরত চক্ষু চিকিৎসক আবু হেনা সাইদুর রহমান যিনি ‘খসরু ভাই’ ডাকে বেশি পরিচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা, আমার কয়েক বছর সিনিয়র পূর্ব লন্ডনে কর্মরত রংপুরের এম এ হাকিম, এম আর সিপি সহসভাপতি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আলতাফুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক। আলতাফ নিকটবর্তী ল্যাঙ্কাশায়ারের একটি শহরে ডাক্তারি করতেন। আলতাফ পরবর্তীতে ঐ শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলতাফই ব্রিটেনে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি মেয়র।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েসন গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন মোস্তফা ও তার স্ত্রী ডা. মমতাজ বেগম কহিনুর। তারা সবাই স্কটল্যান্ডে থাকতেন। প্রয়াত ডা. মোয়াজ্জেম মোস্তফা ছিলেন অ্যানেসথেসিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এফ এফ এ (Fellow of Faculty of Anaaesthesia, Royal College of surgeon)। মমতাজ ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। অপর উদ্যোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক কাজী কামরুজ্জমান উলভার হ্যাম্পটনে অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। অপর সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ মবিন। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
আমি ইয়র্ক শহরে জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির রেজিস্ট্রারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে এসেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করার উদ্দেশ্যে। আস্তানা গেড়েছি চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্সির ছাত্র রকি নুরুল আলম, লুৎফি জাহান চৌধুরী ও মাহবুবদের সঙ্গে, তাদের উত্তর লন্ডনের ক্রিকলউডের বাসায়।
স্থির হয় প্রত্যেক সাধারণ সদস্য চিকিৎসক মাসে ন্যূনতম দশ পাউন্ড চাঁদা দেবেন ব্যাংক স্ট্যান্ডিং অর্ডারের মাধ্যামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। কয়েক জন অনেক বেশি চাঁদা দিতেন। স্কটল্যান্ডের ডা. কাজী ফজলুল হক এবং সারে/সাসেক্সের ডা. এম বখত মাজমাদার তাদের অন্যতম। উভয়ের বিদেশি স্ত্রী। মানচেস্টার এলাকার ড. সালেহ আহমদ, নুরুল আলম, জর্জিসুর রহমান, সুশান্ত বিশ্বাস, খুলনার তৈয়বুর রহমান, নজরুল (যিনি ১৯৭২ সালে লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমানের পিত্তথলি অপারেশনে প্রধান সহকারী ছিলেন) চট্টগ্রামের আবদুর রহিম, চক্ষু চিকিৎসক নুর হোসেন ও আরও অনেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক উৎসাহ ও সহযোগিতা দেন নিউইয়র্কের চিকিৎসক ডা. খন্দকার মো. আলমগীর । ঢাকা শহরে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য মিরপুরে তার একখণ্ড জমি ও দুই কোটি টাকা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তিনি দান করেছেন।
‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একাউন্ট খোলা হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকে যা বর্তমানে এইচ এস বি সি নামে পরিচিত।’
পরের সপ্তাহে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, যত দ্রুত সম্ভব, মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।
সকল সদস্যকে অনুরোধ করা হয় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিষয় ব্রিটেনের স্থানীয় জনসাধারণকে জ্ঞাত করার জন্য এবং ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের কাপড়-চোপড় ও ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। কয়েকটি ভ্যান নিয়ে চিকিৎসকদের ৪/৫টি দল প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়তেন জড়ো করা সংগৃহীত সাহায্যসমূহ লন্ডনে নিয়ে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিভিন্ন প্যাকেট করার জন্য। সংগৃহীত ওষুধসমূহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্যাকেট করা হতো। অনেক চিকিৎসকের স্ত্রীরা এ কাজে সহায়তা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণে যাত্রা, দামেস্ক বিমানবন্দরে পাকিস্তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ
হাইড পার্ক কর্নারে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়ে যোগাযোগ করি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দফতরে। সেখান থেকে আমাদের দেয়া হয় ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ একটি এক পৃষ্ঠার প্রত্যয়নপত্র। ওটা দেখিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করি ভারতীয় ভিসা। নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্বদিন হঠাৎ ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে সাদা পোশাকের এক অফিসার দেখা করে আমাদের সতর্ক থাকতে সাবধান করে জানালেন যারা বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে পাকিস্তান দূতাবাস। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিলেতের ‘হোম’ মিনিস্ট্রিকে অনুরোধ করেছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত।
আমরা লন্ডন হিথরো বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি সম্ভবত ১৬ মে ১৯৭১ রোববারে। প্লেন ছাড়ার পর আমি টানা ঘুম দিলাম। এক ঘণ্টার বিরতি দামেস্ক বিমানবন্দরে। স্বল্প বিরতির কারণে আমরা প্লেন থেকে নামলাম না। এক ঘণ্টার জায়গায় চার ঘণ্টা পার হলো, কিন্তু প্লেন ছাড়ে না। সবাই উসখুস করছে, বিরক্ত। আমি বিমানবালাকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, দেরি কেন হচ্ছে? প্লেনে কি কোনো যান্ত্রিক বিপত্তি ধরা পড়েছে? আর কতক্ষণ লাগবে ? নিরস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিমানবালা আমাদের দুজনকে দেখিয়ে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের কারণে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের দামেস্ক থেকে নয়াদিল্লি যাত্রা বিঘিœত হয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের দুই নাগরিককে গুরুতর অপরাধের বিচারের জন্য পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছে। দামেস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানালেন, প্লেনে কোনো পাকিস্তানি নাগরিক নেই। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দাবি করলেন, ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন পাকিস্তানি নাগরিক, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের বিচারের জন্য সিরিয়া ও পাকিস্তান দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের চুক্তি অনুসারে সিরিয়া তাদেরকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য। সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ জানালেন ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যয়ন অনুযায়ী এই দুজন রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক, পাকিস্তানি নন।
দ্বিতীয়ত তারা সিরিয়ার ভৌগোলিক এলাকা দামস্কে অবতরণ করেননি। তারা প্লেনে অবস্থান করছেন যা আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন সিরিয়ার আইনের বহির্ভূত এলাকা। তাই তাদের পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। শেষ অবধি, পাকিস্তান সিরিয়ার আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মেনে নিয়ে প্রস্থান করলে বিমান নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
পরের দিন সোমবার আমরা দিল্লি পৌঁছি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিনিধি আমাদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, দামেস্ক বিমানবন্দরে পাকিস্তানি তৎপরতায় তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সম্ভবত লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাত করিয়েছিলেন।
আমাদের ভারতে তৈরি অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে একটি সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হলো। শুরু হলো বিভিন্ন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, এদের অনেকেই বাঙালি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন সময়ে আগত। দিল্লির রাস্তায় বিদেশি গাড়ির বাহুল্য চোখে পড়েনি। বিপরীত ঘটনা পাকিস্তানের সকল বড় শহরে বিদেশি গাড়ির ভিড়। দেখা হলো বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আনুগত্য প্রকাশ করা দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন ছেড়ে আসা সাহসী সেকেন্ড সেক্রেটারি শেহাবুদ্দিন ও প্রেস সচিব আমজাদুল হকের সঙ্গে। তাদের মনে ভীতি নেই, শঙ্কা নেই। তাদের একমাত্র কামনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দিলেন ভারতীয় পুলিশের অনুমতি ছাড়া কলকাতার বাইরে না যেতে, কলকাতার আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়। কিছু ‘দুষ্কৃতকারী’ নকশাল সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আরও বললেন, কয়েকদিন কলকাতায় থেকে ফিরে যেতে, বিলেতে ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় যা সংগৃহীত হবে তা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিলে তারা ভারতীয় জাহাজে করে এনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে দেবেন, চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৌঁছে দেবেন।
কলকাতায় প্রথম সপ্তাহে যা দেখলাম জানলাম
দুই দিন পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে রাতে কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। উৎসাহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ধারণা ছিল যুদ্ধ যখন চলছে তখন নিশ্চয়ই সারা রাত কমিশন খোলা, সবাই ব্যস্ত, কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। পৌঁছে চমকে দেখলাম হাইকমিশন নীরব নিষ্প্রভ ।
অনেক চেষ্টার পর খবর পৌঁছালাম পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হোসেন আলীর কাছে। তিনি আমাদের কথা শুনে বিরক্ত মনে বললেন, আপনারা কষ্ট করে কেন এসেছেন, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যান, রাতটা নিকটবর্তী লিটন হোটেলে কাটান, তাদের এয়ারকন্ডিশন রুম আছে। ধাক্কা খেলাম, এয়ারকন্ডিশন রুমে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য তো আমরা লন্ডন থেকে কলকাতায় আসিনি। হাইকমিশনের মেঝেতে শয়ন ব্যবস্থা করলে বেশি খুশি হতাম। এসি হোটেলে অর্থ ব্যয় না করে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সে টাকা ব্যয় তো সঠিক কাজ।
পরের দিন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী। সবার একই কথা তারা ভয়ানক কষ্টে আছেন, আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই, একই প্রশ্ন, ‘প্রাণের তাগিদে আমরা দেশ ছেড়েছি, আপনারা কেন এসেছেন’? কেউ কেউ বললেন বিদেশে যাবার জন্য আমরা সাহায্য করতে পারব কিনা?
দেখা হলো ব্যারিস্টার মওদুদ, আমীরুল ইসলাম ও প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে। চাষী আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে ৮নং থিয়েটার রোডে। প্রথমে সাক্ষাৎ করালেন কর্নেল (অব.) মহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে। ছাত্র জীবনে তার সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। তিনি ১৯৬২/৬৩ সালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য। তিনি সিলেটি ভাষা ভালো বলেন, আলাপনে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি বলেন।
আমরা লন্ডন থেকে এসেছি শুনে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম ইয়ংম্যান। হাউ ইজ লন্ডন নাও এ ডেইজ, হাউ ইজ তাসাদ্দুক? গ্যানজেস কেমন চলছে? সিলেটিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, আমার কথা বলবেন, সব সিলেটবাসী আপনাদের সাহায্য করবে অকাতরে’।
তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে। তখন তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। বসতে বলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী কেমন আছেন, বাঙালিদের বিভেদ, দলাদলি কিভাবে সামাল দিচ্ছেন? বাম রাজনৈতিক দলগুলো চেীধুরী সাহেবের সঙ্গে আছে তো? নিজেরা গিয়ে দেখুন, বিলেতের প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধভাবে সাহায্য করতে বলবেন। বিলেতের ডাক্তারদের তো অনেক আয়’।
পরের দিন গেলাম যশোর সীমান্তে। ক্যাপ্টেন হাফিজ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিছু হটে ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন কিন্তু ক্লান্তি বা হতাশার চিহ্ন নেই। অধিকতর উদ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ছাত্র ও শ্রমিকদের রণকৌশল শেখাচ্ছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নিজের জন্য কিছু চাইলেন না, বললেন, তরুণ গেরিলাদের কাপড়চোপড় ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করুন।
সপ্তম দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে কলকাতা থেকে আগরতলা। পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহরের চেয়েও ছোট। হোটেলের সন্ধানে শহরের প্রবেশ পথে প্রথম দেখা হলো ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে। ছাত্র জীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে মনির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই একটু শঙ্কিত হয়ে তাকাতেই মনি বললেন, ‘ডাক্তার, আমি জানতাম আপনি আসবেন, কমিউনিস্টরা লন্ডনে বসে থাকবে না’। হাসিমুখে ভালো ব্যবহার করলেন। জিজ্ঞেস করলেন কলকাতায় কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হক মনি হঠাৎ রেগে গেলেন, বললেন কোথাকার প্রধানমন্ত্রী? কে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন? তাজউদ্দীন, নিজে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আওয়ামী লীগের ভিতরে লুকিয়ে থাকা কমিউনিস্ট’। আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম যুদ্ধের সময় যদি এরূপ বিভেদ থাকে ভবিষ্যতে কী হবে ? নিশ্চয়ই তাজউদ্দীন সাহেবের জীবনটা সুখের হবে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাই প্রমাণিত হয়েছিল। ‘কৃতঘ্ন’ শব্দটা অন্য ভাষায় নেই। ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনির সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে বিএলএফ- বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমান্তরাল অপর একটি বাহিনী হিসেবে।
দেখা হলো চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। তিনি ঐ রাতে তাদের সঙ্গে আগরতলা সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন ভোরেই রওনা হলাম দুই নম্বর সেক্টরের উদ্দেশে মেলাঘরের পথে। সাক্ষাৎ হলো মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, শফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার পর খালেদ বললেন, ‘আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন অস্ত্র এবং বুলেট অ্যান্ড বুলেটস। আপনারা লন্ডন ফিরে গিয়ে ওজঅ এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের জন্য রাতে দেখা যায় এরূপ বাইনোকুলার, ছোট ডুবুরি যান মিডগেট এবং ছোট ছোট অস্ত্র যোগাড় করে পাঠান। চেকোশ্লেভাকিয়ায় অল্পমূল্যে স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র পাওয়া যায়’।
কয়েকদিনের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেলে মেজর খালেদ তার মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে আনারস বাগানে ৪৮০ বেডের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।
প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বেশির ভাগ খরচ ও সব যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিল লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। হাসপাতাল তৈরির মূল কৃতিত্ব ডা. মবিনের। এই হাসপাতালে ২২ অক্টোবর তারিখে মাথায় গুলিবিদ্ধ মেজর খালেদ মোশাররফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন, পরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন লক্ষেèৗতে ভারতীয় সেন্ট্রাল কমান্ডের বড় মিলিটারি হাসপাতালে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন থেকে অপর চারজন চিকিৎসক ডা. কাজী কামরুজ্জমান, বরকত আলী চৌধুরী, আলতাফুর রহমান ও মাহফুজ অক্টোবর মাসে ভারতে এসে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেন। বিজয় প্রাক্কালে বিলেত থেকে আসেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার যার ঢাকায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। ডা. বরকত চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ, আলহাইজাইমার রোগে আক্রান্ত, ডা. কাজী কামরুজ্জমান বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ঢাকায় মগবাজারস্থ কমিউনিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। ডা. মাহফুজ একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট হিসেবে বিলেতে অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের এন আর বি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ডা. আলতাফ লন্ডনে অবসর জীবনযাপন করছেন। মধ্যে মধ্যে বেরাতে দেশে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর অজ্ঞাতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারতের সঙ্গে চুক্তি
ফরাসি কবি সাহিত্যিক, রোমান্টিক রাজনীতিবিদ ও ফরাসি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁন্দ্রে মালরোঁ স্প্যানিস সিভিল ওয়্যারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৬০ দশকে নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধে মালরোঁ বিয়াফ্রার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় তার কাছে বহু অব্যবহৃত অস্ত্র ছিল।
মালরোঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী সাহেব আমাকে ফ্রান্সে যাবার জন্য নির্দেশ করেন। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারতীয় পুলিশ আমার ডায়েরিটি এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দামি ক্যামেরাটা রেখে দেন।
প্যারিসের উপকণ্ঠে আঁন্দ্রে মালরোঁর প্রাসাদসম বাড়ি। আমার সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মালরোঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য ওসমানী সাহেব একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন যা ভারতীয় পুলিশ পরীক্ষার নিমিত্তে রেখে দিয়েছিলেন। বিষয়টি জেনে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস চক্রান্ত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফ্রান্স যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। আমি একলা আঁন্দ্রে মালরোঁর সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎ কাহিনী পরে কখনো লেখার চেষ্টা করব।
প্যারিস থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পরপরই ওসমানী সাহেব আমাকে লক্ষ্নৌতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসতে অনুরোধ করেন। খালেদ মোশাররফ নিজে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। খালেদ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অত্যন্ত প্রিয়জন। কলকাতা থেকে সরাসরি লক্ষ্নৌ ফ্লাইট না পাওয়ায় দিল্লি হয়ে লক্ষ্নৌ যাত্রা করি। দিল্লিতে বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা সাক্ষাতে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা ডিসেম্বরে ঢাকা ফিরতে পারবেন। প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে।’ আশ্চর্য হলাম, ওসমানী সাহেব আমাকে কিছুই বলেননি।
লক্ষেèৗ সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে খালেদ মোশাররফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমাকে লন্ডনে নিয়ে চলুন, ভারতীয়রা আমাদের ভুটান সিকিম বানাবে। তারা আমাদের চাইনিজ অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য’। আপনার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা তো আমিই করতে পারি কিন্তু ভারতীয়রা আপনাকে ভারত ছাড়ার অনুমতি দেবে তো? বিষয়টি আমি সর্বাধিনায়ককে জানাব।
ফেরার পথে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দিল্লি-কলকাতার একটা ফ্লাইট লক্ষ্নৌ হয়ে যায়। প্লেনে ওঠার পর দেখি আমার পাশে আবদুস সামাদ আজাদ এম এন এ। তিনি দিল্লি থেকে উঠেছেন। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। উনি ন্যাপ-ভাসানী দল করতেন। বহুদিন জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসলে, উনার পুলিশ গার্ডকে আমাদের ক্যান্টিনে বসিয়ে ভালো করে খাওয়াতাম এবং সামাদ ভাইকে গোপনে তার আগামসিহ লেনের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে জেলে ফেরত যেতেন। তার চিকিৎসাপত্রে পুনরায় পরের সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য আসার নির্দেশ লিখে দেবার ব্যবস্থা করতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমার দোর্দণ্ড প্রতাপ, আমি সবার প্রিয়। সামাদ ভাই বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখনি। কাউকে বলবে না। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, সেটা নিয়ে তুমি চলে যেও। আমার জন্য অন্য আর একটি গাড়ি থাকবে’। তুমি আমার কথা কাউকে বলো না। আমার অনুসন্ধিৎসা বাড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি’? উনি উত্তর দিলেন না। আমার মনে সন্দেহ দৃঢ় হলো। কলকাতা পৌঁছে সোজা থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের রুমে। রেগে বললাম, দেশ বেঁচে দিয়েছেন। উনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি খালেদ মোশাররফ ও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা বললাম। আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তাদের সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তথ্য জানালাম। আরও জানালাম দিল্লির বিশিষ্টজনেরা আমাকে কী বলেছেন।
ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চস্বরে বললেন, ‘You sold the country, I will not be a party to it.’ তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।
কয়েকদিন পরে উভয়ের মধ্যে পুনরায় বাগবিতণ্ডা ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইনশৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি IAS ও IPS বাংলাদেশের সব বড় শহরে একটা মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি, CSP, PSP আছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। এরা তো নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।
ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরও সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তারা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারত কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হলো।
১৬ ডিসেম্বরের বিমান দুর্ঘটনা কি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে হত্যার ষড়যন্ত্র?
পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশি গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অতর্কিতে সরাসরি যশোর সীমান্তে আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। যৌথ কমান্ড বাহিনীর অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ককে যশোর পরিদর্শনে বাধা সৃষ্টি করা হলে, জেনারেল (অব.) ওসমানী ছাত্র নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান ও আমাকে ৫ ডিসেম্বর ৭১ যশোরের অবস্থা দেখে আসার জন্য নির্দেশ দেন। ঐ দিনই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে হতভম্ব হয়ে যাই। ভারতীয় সেনারা একের পর এক অফিসারদের বাসস্থানের এসিসহ বিভিন্ন সামগ্রী, অস্ত্রাগার, এমন কি যশোর সি এম এইচের যন্ত্রপাতি লুট করছে। বলছে, ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট এত বৈভব ও আরাম আয়েশে ছিল, কেন বিদ্রোহ করেছ? বিষয়টা ফোনে ওসমানী সাহেবকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ৭ ডিসেম্বর আমি কলকাতা ফিরে আসি। ওবায়দুর রহমান তার জেলা ফরিদপুরের পথে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কলকাতায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো বিষয়টি ওসমানী সাহেবকে জানানোর পর, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদকে অবহিত করেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তাহলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তফাৎ কোথায়’? ওসমানী সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছেন, ভারতীয়রা আমাকে কেন সরাসরি সমরাঙ্গনে যেতে দিচ্ছে না, তাদের উদ্দেশ্য ভালো না’।
কয়েকদিন অক্লান্ত চেষ্টার পর, কুমিল্লা হয়ে সিলেট পরিদর্শনের জন্য একটি বড় হেলিকপ্টার সম্ভবত এম-৮ দেয়া হলো ব্রিগেডিয়ার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে। ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে কুমিল্লা পৌঁছি। বিশ্রামের জন্য কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পৌঁছে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। ওসমানী সাহেবকে হাত বাড়িয়ে ‘রিসিভ’ করছেন কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি। একে একে পরিচয় দিলেন, ‘আমি মুখার্জি, IAS, আমি গাংগুলি IPS, ইত্যাদি। বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে গতকাল এখানে পৌঁছেছি কুমিল্লা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা দেবার জন্য। অবশ্যি এখনও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধ চলছে’। ওসমানী সাহেব ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করতে রাজি না হওয়ায়, আমরা ওয়াপদা গেস্ট হাউসে যাই। পরের দিন ভোরবেলা থেকে ওসমানী সাহেব কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পরিদর্শনে বিভিন্ন পথে গেরিলাদের পাঠান এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর সেনাদের সম্মুখ আক্রমণে উৎসাহিত করতে থাকেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। পরের দিন তারা আত্মসমর্পণ করে। খবর পাই, ঢাকার পতন আসন্ন। আমরা ঢাকা যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকি।
১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন, আজ ঢাকায় পাকিস্তান সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। ভাবলাম নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের কাছে। আশ্চর্য, ওসমানী সাহেব একবারে চুপ, কোনো কথা বলছেন না, বিষয়টাতে খটকা লাগল।
জেনারেল ওসমানীর এডিসি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুরের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবে, তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন। অধীর আগ্রহে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি’। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন, ‘I have not yet received PM’s order to move to Dhaka,’ ‘ঢাকার পথে রওনা হবার জন্য কলকাতা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের কোনো নির্দেশ পাইনি’।
আমি বললাম, ‘আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’। ওসমানী বললেন, I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’
যুদ্ধক্ষেত্রে আমি সর্বেসর্বা কিন্তু মূল আদেশ আসে মন্ত্রিসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের বরাতে। কথাগুলো বললেন অত্যন্ত বিষণ মনে। পরিষ্কার হলো উনি আসন্ন ঢাকা পতনের সংবাদ জানেন এবং প্রবাসী সরকারের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন।
আমাদের অস্থিরতা দ্রুত বাড়ছে আর বাড়ছে।
ঘণ্টাখানেক সময় পরে, পুনরায় ওসমানী সাহেবের সামনে দাঁড়ানোর পর পরই জেনারেল ওসমানী অত্যন্ত বেদনাতারিত কণ্ঠে যা বললেন তার মমার্থ হলো, ‘আমার ঢাকার পথে অগ্রসর হবার নির্দেশ নেই। আমাকে বলা হয়েছে পরে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একযোগে ঢাকা যেতে, দিনক্ষণ তাজউদ্দীন সাহেব জানাবেন। গণতন্ত্রের আচরণে যুদ্ধের সেনাপতি প্রধানমন্ত্রীর অধীন, এটাই সঠিক বিধান’।
মনে হলো, উনি জেনেশুনে বিষপান করছেন। পরে ব্রিগেডিয়ার গুপ্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিলেটের কী অবস্থা’? ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন ‘সিলেট ইজ ক্লিয়ার’। ওসমানী বললেন, ‘তাহলে চলুন আমরা সিলেট যাই, সেখানে গিয়ে আমার পিতামাতার কবর জিয়ারত করব, শাহজালালের পুণ্য মাজারে আমার পূর্ব পুরুষরা আছেন’।
আধাঘণ্টার মধ্যে আমরা আকাশে, নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় এম-৮ বিমানে সিলেটের পথে চলেছি। পরিষ্কার আকাশ। প্লেনের যাত্রী জেনারেল ওসমানী ও মুক্তিবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল এম এ রব, এম এন এ, রিপোর্টার আল্লামা, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ভারতীয় দুই পাইলট এবং আমি। কেউ কথা বলছে না, সবাই নীরব।
অতর্কিতে একটি প্লেন এসে চক্কর দিয়ে চলে গেল। হঠাৎ গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ভিতরে জেনারেল রবের আর্তনাদ, পাইলট চিৎকার করে বলল, ‘উই হ্যাভ বিন অ্যাটাকড্’। রবের উরুতে আঘাতের পরপরই তার কার্ডিয়াক এরেস্ট হলো। আমি এক্সটার্নাল কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করি।
পাইলট চিৎকার করল, অয়েল ট্যাংক হিট হয়েছে, তেল বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি বড় জোর ১০ মিনিট উড়তে পারবো বলে গুনতে শুরু করল ওয়ান, টু, থ্রি……..টেন……..টুয়েন্টি……….থার্টি………ফোরটি……….ফিফটি……..নাইন সিক্সটি-ওয়ান মিনিট গান (এড়হব), এভাবে মিনিট গুনছে উদ্বিগ্ন চিন্তিতসহ পাইলট।
ধীরস্থিরভাবে পাইলটের আসনে বসা অন্য পাইলট। ওসমানী সাহেব লাফ দিয়ে উঠে, অয়েল ট্যাংকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘জাফরুল্লাহ্, গিভ মি ইয়োর জ্যাকেট’। আমি আমার দামি জ্যাকেটটা ছুড়ে দিলে, ওসমানী সাহেব ওটা দিয়ে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধের চেষ্টা করতে থাকলেন। বললেন, Do not worry my boys, I know Sylhet like the palm of my hands.’
ভয় পেয়ো না আমি সিলেটকে আমার হাতের তালুর মতো চিনি।
কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেবার ফাঁকে ফাঁকে আমি ভাবছিলাম, আজ ১৬ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু আজ আমরা সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাব। আগামীকাল পত্রিকায় শোক সংবাদ (Obituary) কলামে কী লেখা হবে? বীরের মৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু? কার গোলাতে এই দুর্ঘটনা ? পাকিস্তানের সব বিমান তো কয়েকদিন পূর্বে ধ্বংস হয়েছে কিংবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। তাহলে আক্রমণকারী বিমানটি কাদের ? গোলা ছুড়ে কোথায় গেল ? গৌহাটির পথে ? চিন্তা বিগ্নিত হলো ওসমানী সাহেবের চিৎকারে।
নিচে একটা জায়গার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ‘Land here’ এখানে নামো। আরও বললেন, ‘Let me land first to taste the enemy attack if there is one’ শত্রুর গুলির স্বাদ নেবার জন্য আমাকে প্রথম নামতে দাও, যদি কোনো শত্রু এখনও থেকে থাকে।
উনি লাফ দিয়ে নামলেন, ধরুন বলে আমি জেনারেল রবকে ছুড়ে দিলাম, সঙ্গে নামলাম আমি। আমার পিছনে পিছনে অন্যরা লাফিয়ে নামলেন। প্লেনটা আমাদের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে।
হঠাৎ গ্রামবাসী এসে ওসমানী সাহেবকে ঘিরে ধরল ‘দুষমন আইছে রে বা দুষমন আইছে, দুষমনরে ধর। পর পরই ভালো করে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল ‘আমাদের, কর্নেল সাব রে বা’ এবং তারপর তাকে নিয়ে নাচতে শুরু করল।
জনতার বিজয় উল্লাসে যেন জেনারেল রবের ঘুম ভাঙল, উনি চোখ খুলে তাকালেন, দেখলেন আমার মুখে হাসি। জেনারেল রব সবাইকে বলতেন, ডা. জাফরুল্লাহ্ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কখনো এই ঘটনার তদন্ত প্রকাশ করেননি। ভারত সরকার সবসময় এই ঘটনায় নীরব, মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন।
স্বাধীনতার বিজয় উল্লাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই দুর্ঘটনার তদন্তের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি বোধ করেননি।
[লেখক: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি] [উৎসঃ সাপ্তাহিক; বর্ষ ১০ সংখ্যা ২৭]
বিষয়: বিবিধ
১২১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন