বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও বর্তমান কাল্পনিক আদিম হিংস্রতা

লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ১৪ এপ্রিল, ২০১৮, ০১:৫২:৫৮ দুপুর



ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাংলা সনের সৃষ্টি হয় ফসল তোলার সময় লক্ষ্য করে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সৌর বৎসর অবলম্বনে এই নতুন সন গণনা শুরু হয়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ‘ফসলী সন’ নামে অভিহিত হতো। ‘বাংলা’র জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিহ্নিত হয়।


বিজ্ঞানসম্মত এবং মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত হিজরী ভিত্তিক এই ‘বাংলা সন’ নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব।সম্রাট আকবরের আমলে সুবা-এ-বাংলা (বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) মোগল শাসনের আওতাভুক্ত হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। নাগরিকদের কাছ থেকে খাজনা ফসলের মাধ্যমে আদায় করতে হলে বছরে একটি সময় নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে কালের রাজকীয় সন অর্থাৎ হিজরী সন চন্দ্র সন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে নাগরিক খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। ফলে, সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উল্লেখ্য, চন্দ্র বৎসর ৩৬৫ দিনের না হয়ে ৩৫৪ দিনের হয়ে থাকে।

পুরাতন অর্থবছরের সব হিসাব চুকিয়ে ফেলার নিয়ম। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা বন্ধুদের দাওয়াত করে মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়িক লেনদেনের পুনঃসূচনা করতেন 'হালখাতা' বা হিসাবের নতুন খাতা খোলে। হালখাতার লুপ্তপ্রায় এই ধারাটা সোনা-ব্যবসায়ীরা আজও ধরে রেখেছে। সম্রাট আকবরের আমলে সর্বভারতে নাগরিক খাজনা আদায়ের নতুন বছরের সূচনা হলেও, আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের নামে বানোয়াট হিংস্রতা যেন আদিম বর্বরতার মিছিল।

হটাৎ করে ব্রিটিশদের তোষামোদী করার নেশায় ব্রিটিশদের কাছে নতজানু হিন্দু জমিদারদের মদদে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। সেই পূজার রীতি এখন বাংলাদেশের মানুষের উপর একটি চক্র নীরবেই চাপিয়ে দিচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য ঐসব চক্রের ফাঁদে বাংলাদেশের কতিপয় হুতুম পেঁচা গুষ্ঠি বেশ ভালোই টেবলেট হিসাবে জনগণকে খাওয়াচ্ছে। বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি বর্ষ বরণের কোন অংশ কোন কালেই ছিল না। আদিম বর্বরতাকে কি বাংলাদেশের কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ? যদি উত্তর না হয় তাহলে কেন হিংস্রতা , মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল ।

একটি পক্ষ সরাসরি দাবি করে , পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই “ছায়ানট” ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে।

কিন্তু কেউ তাদের জিজ্ঞেস করে না , কেন রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” নামের কাল্পনিক কাহিনী ? কোথায় শত শত বছরের ঐতিহ্য ?



সৌর বৎসর হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ সেকেন্ড। চান্দ্র বৎসরের স্থিতি হলো ৬৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড-এর। চন্দ্র (চাঁদের ) বৎসরের সময়কাল সৌর বৎসর অপেক্ষা প্রায় ১১ দিন কম হওয়ার ‘হিজরী সন’ ‘বাংলা সন’ অপেক্ষা ১১ দিন প্রতিবৎসর এগিয়ে যায়। ফলে ৯৬৩ থেকে ১৪১৮ বাংলা সনের মধ্যে হিজরী সন এগিয়ে গিয়েছে ১৪ বৎসরেরও বেশি। স্বভাবতই, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৮ সনের এই পার্থক্য হচ্ছে ১৪৩২-১৪১৮=১৪ বৎসর।


নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে।

১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবে যোগ করা হিংস্রতা এবং বানোয়াট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ঐতিহ্য ধ্বংস করে কাল্পনিক উল্কি আঁকা সহ শতভাগ বানোয়াট কিছু অনুষ্ঠান। নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উপর সরাসরি আক্রমের এসব কর্মকান্ডের ভিত্তি কোথায় সহজেই প্রশ্ন আসে বিবেকবান মানুষের মনে।

সম্রাট আকবর তার সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নিয়ে কেউ কি কিছু বলে ? কেন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বিলীন করে কাল্পনিক আদিম হিংস্রতার মিছিল ? কেউ কি নেই এসব নিয়ে কথা বলার ?


পাঞ্জাবি পরিহিত ছেলেদের পাশে খোঁপায় বেলি ফুলের মালায় সজ্জিত হয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ির রমণীরা মেতে ওঠে 'ইলিশ- পান্তা উৎসবে। এসব বাংলা বর্ষ বরণের নামে বাংলা বর্ষের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে চূড়ান্ত প্রতারণা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

ঐতিহাসিক ভাবেই শতভাগ তথ্য যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় , সম্রাট আকবর তার সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে হিজরি সাল এবং বাংলার ভৌগোলিক অবস্থায় 'বাংলা বছর'-এর প্রচলন করেন, যা 'ফসলী সন' নামে ১৫৮৪-এর মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বাংলা সাল , বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়। সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নতুন বছরাগমনের অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিন।

বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন নামে শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ বানোয়াট কাহিনী এখন আগাছার মতোই জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে হাল খাতা , হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা বর্ষ বরণের উজ্জ্বল ঐতিহ্যও।

বিষয়: বিবিধ

১৯৭৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385107
১৪ এপ্রিল ২০১৮ রাত ০৯:২৮
চেতনাবিলাস লিখেছেন : চমৎকার লেখা! অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File