৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক দিন।সত্য ইতিহাসকে ভয় কেন ?
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ০৭ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:৪৩:২৪ দুপুর
শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। আর সেইজন্য মানুষের বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যার মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল গঠন করে বিভীষিকাময় শাসন চালু করা হয়।একদলীয় বাকশালী সরকার চরম অগণতান্ত্রিক, নির্মম নারকীয় ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় মানুষের ন্যায়সংগত অধিকারগুলোকে হরণ করে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় অক্টোবরেই অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করা হয়। ৩ নবেম্বর থেকে সেনাবাহিনীতে শুরু হয় এক ভয়ানক আত্মঘাতী সংঘাত।রাষ্ট্র বিরোধী এবং সেনা আইনের বিরোধী একটি গোপন সংগঠন তৈরী করে জাসদের লেবাসে । যার নেতা ছিলেন সেনা বাহিনী থেকে বহিস্কৃত তাহের। তাহের ছিলেন একদিকে ক্ষমতা লোভী অন্যদিকে আওয়ামীলীগের নীলনকশার লিপিকার সিরাজুল আলম খানের নাচের পুতুল। আরেকটি চক্র ছিল ভারতের দাসত্ব পন্থী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের অনুসারী। এই ২ চক্রই সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে সংঘটিত হয় ব্যর্থ অভ্যুত্থান, ভেঙ্গে ফেলা হয় সেনাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড'। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় অফিসার ও জওয়ানদের।
১৯৭৫ সালের এ দিনে আধিপত্যবাদী শক্তির নীল নকশা প্রতিহত করে এদেশের বীর সৈনিক ও জনতা। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নরকম হতে পারতো। একদলীয় নারকীয়তার মদদে চলতো হয়তো নাম মাত্র একটি দেশ।
’৭৫-এর ৭ নভেম্বর সৈনিক-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চক্রান্তকারীদের খপ্পর থেকে দেশকে উদ্ধার করে। রুশ-ভারতের অক্ষশক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যগণ গর্জে ওঠেছিল সেদিন।
সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভন্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র।অতঃপর ৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ডেপুটি চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া দায়িত্বগ্রহণের পর প্রথমেই দক্ষতার সাথে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
৭ নভেম্বর খুব ভোরের দিকে ঢাকার রাজপথে ট্যাংকের চাকার আওয়াজ ছাপিয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠা ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহ আকবর’ ধ্বনির কথা। ট্যাংকের ওপর সেদিন অনেক উৎসাহিত জনতাকে লাফিয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে কোলাকুলি করতেও দেখা গেছে। সিপাহী-জনতার কণ্ঠে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হয়েছে ‘সিপাহী-জনতা ঐক্য অমর হোক, জিন্দাবাদ', ‘সিপাহী-জনতা ঐক্য গড়ো, বাংলাদেশ রক্ষা করো।’
৬ নভেম্বর কর্নেল তাহের চক্রের গোপন নির্দেশে সেনাবাহিনীতে জাসদ সমর্থিত একটি পক্ষ কয়েকজন সেনাকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে শুধু মাত্র সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেয়।
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাসদের বহিষ্কৃত ( কথিত অবসর ) তাহেরের অপর বড় ভাই আবু ইউসুফ এর বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দিকের শুলশানের বাড়িতে সিপাহী–জনতার বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের অপারেশনাল পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। সৈনিক সংস্থার সংগঠকরা কিছু সংখ্যক সাধারণ সৈনিক, সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে ইউনিফর্মের উপর লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের উদ্যোগ না নিলে খালেদ মোশারফ ও অন্যান্য অফিসাররা মারা যেতেন না। অবৈধ এবং রাষ্ট্র বিরোধী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে খালেদ–হায়দার– হুদা হত্যাকান্ড ঘটেছিল।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : লেখা ‘মিশ্র কথন’ বইয়ের ১৪৬ থেকে ১৯৩ পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য, সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়েছিল তৎকালীন জাসদ। যার কুফল পরবর্তী পাঁচ বছর তো বটেই, ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত লক্ষ করা গেছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে যে কয়টি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান বা বিমান বাহিনীর অভ্যুত্থান হয়, প্রতিটির সঙ্গে জাসদ কর্তৃক শিক্ষা দেয়া শ্রেণীবিহীন সমাজব্যবস্থা, অফিসারবিহীন সামরিক ব্যবস্থা এবং অফিসারদের হত্যা করার মন্ত্র কাজ করেছে।
১৯৭২-এর শেষাংশ এবং ১৯৭৩-এ জাসদ তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত থাকে। অপরপক্ষে সরকারের পুলিশ ও জাতীয় রক্ষীবাহিনী ব্যস্ত থাকে জাসদ কর্মীদের আটক, গুম, আহত ও খুন করায়।
জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হল সেনানিবাসের বাসায়, পদচ্যুত করা হল সেনাপ্রধানের পদ থেকে। খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম নিজে প্রমোশন নিয়ে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান হলেন। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সায়েম।
সে যাক - মুক্ত জিয়া পড়লেন এক বিপদে। জাসদপন্থী সৈনিকরা চাইলেন জিয়াকে নিয়ে যেতে এলিফ্যান্ট রোডে। সাধারণ সৈনিকরা চাইলেন জিয়াকে সেনানিবাসে নিরাপদ জায়গায় রাখতে। জিয়া এলিফ্যান্ট রোডে গেলেন না। জাসদের পরিকল্পনা বড় ধরনের হোঁচট খেল। সম্ভবত জাসদ চেয়েছিল জিয়াকে দিয়ে বিভিন্ন ঘোষণা দেয়াতে, যেমন- সরকারের কাঠামো সমাজতান্ত্রিক করা, সরকারের পররাষ্ট্রনীতি পুনরায় রুশ-ভারতমুখী করা, অফিসারবিহীন সৈনিকের কাঠামো গঠন ইত্যাদি। সাধারণ সৈনিকরা ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুত্ব আছে এমন গোপন সৈনিক সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে অনেক কথাই জানতে পেরেছিল। জাসদপন্থী এবং সাধারণ সৈনিকরা সেনানিবাসের বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হয়ে গেলেন। ওই রাতে বিদ্যুৎবিহীন সেনানিবাসে এক অকল্পনীয় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভোর হতেই জিয়া আবার দায়িত্ব নিলেন সেনাবাহিনীর।
ইতিমধ্যে রাত ২টার পরপরই সাধারণ সৈনিকদের একটি বড় দল বঙ্গভবন ঘেরাও করল। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম ও তার জ্যেষ্ঠ সঙ্গীরা গোপনে বা ছদ্মবেশে বঙ্গভবন ত্যাগ করলেন জীবন বাঁচানোর জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লে. কর্নেল এটিএম হায়দার এক গাড়িতে দ্রুতগতিতে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন।
কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর’ গ্রন্থে এ ভয়াবহ ও ষড়যন্ত্রের স্বরূপ তিনি নিজেই উন্মোচন করেছেন তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পঁচাত্তরের ৩ নবেম্বর কিভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলো, কারা করলো, কিভাবে তাকে বন্দী করা হলো এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পর কিভাবে জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হলো, কারা সহযোগিতা করলো, কারা করলো না, কিভাবে সিপাহী বিপ্লবের লিফলেট ছড়িয়ে পড়লো এবং কেন তারা ব্যর্থ হলেন। একজন অভ্যুত্থানকারী সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তার ভাষায় উক্ত গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তবে এ শে ৩ নবেম্বর থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত অরাজক পরিস্থিতির একটি বিবরণ পাওয়া যায়।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভন্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামেও পৌঁছে যায়।
মুলত ১৯৭২ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে কর্নেল তাহের ও তাদের বিদেশী চক্রের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বুকে চালানো হয় তান্ডবের লেলিহান রক্তের হেলি খেলা। ঈদের দিন আওয়ামীলীগের নেতাদের ঈদের জামায়াতে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার কাজটিও তারা করে। একদিকে জাসদের জঙ্গি গণ বাহিনী অন্য দিকে রক্ষী বাহিনী। সারা দেশে রাট দিন লেগে থাকে যুদ্ধের মারামারি।
১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল ৪৬ ব্রিগেডের সৈন্যদের নিয়ে সেনা অভুত্থান ঘটান, তিনি নিজেকে সেনা প্রধাণ ঘোষনা করেন এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। উচ্চাভিলাষী খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল , তাহের চক্র তিনদিন ধরে রেডিও-টিভি বন্ধ ও পুরো জাতিকে অন্ধকারে রেখে ক্ষমতার ভাগ-বন্টন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।
সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীন সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থ্যার কিছু সদস্য কর্নেল আসাদুজ্জামানের নিকট খালেদ মোশারফ ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার জন্য কর্নেল তাহেরের নির্দেশ পৌছে দেয় এবং কর্নেল আসাদুজ্জামান নিজে এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন।
সূত্র ( মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি (২০১১)। পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ। আফসার ব্রাদার্স )
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় - জেনারেল জিয়ার প্রতি সেনা ও জনগণের ভালোবাসা থেকে সেনা সদস্যদের মধ্যে রিরাজমান এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং মেজর জিয়ার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তৎকালিন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা কর্নেল (অব তাহের একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন। জাসদের গণবাহিনীর সদস্যরা সামরিক বাহিনীর মধ্যে লিফলেট ছড়িয়ে তাদের উত্তেজিত করে তুলে, যার মধ্যে ক্ষতিকর দিকটি ছিলো সামরিক বাহিনীকে অফিসারশূন্য করার মত দিকভ্রষ্ট্র পোপাগান্ডা যেমন, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই’।
সূত্র ( Anthony Mascarenhas (1986). Bangladesh: A Legacy of Blood. Hodder and Stoughton.
শাহাদুজ্জামান ক্রাচের কর্নেল। নীলুফার হুদা ( কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ।লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ । তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা।
সেনাপ্রধানের আদেশ ও নিশ্চয়তা পেয়ে কর্নেল নওয়াজেশ খালেদ মোশারফ এবং তার দুই সঙ্গীর জন্য নাস্তার আয়োজন করেন।
সূত্র -লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ (২০১৩)। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা।
তাদেরকে নাস্তা পরিবেশনের কিছুক্ষণের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর খাকি পোষাক পরিহিত কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থ্যার বেশ কিছু সদস্য গান পয়েন্টে সেই রুমে প্রবেশ করে এবং এই তিন অফিসারকে অস্ত্রের মুখে বাইরে এনে গুলি করে হত্যা করে। The war waged by a heroic woman, ‘‘The Daily Star’’, August 25, 2012
জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের যে কোন মূল্যে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। শাফায়াত জামিল এই নির্দেশের কথা তার ব্রিগেড মেজর হাফিজের কাছ থেকে জেনে তা বঙ্গভবনে অবস্থানরত খালেদ মোশারফকে অবহিত করেন। ক্যান্টনমেন্টে ফোন করে খালেদ মোশারফ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গভবনে অবস্থান করতে বলে কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। ভোর রাতে জেনারেল জিয়া বঙ্গভবনে অবস্থানরত কর্নেল শাফায়ত জামিলকেও আর কোন রক্তপাত না ঘটানোর এবং শান্তিপূর্ন সমাধানের জন্য মিমাংসার অনুরোধ করেন।
সূত্র (কর্নেল শাফায়াত জামিল (১৯৯৮)। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সাহিত্য প্রকাশ। নীলুফার হুদা (২০১২)। কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ। প্রথমা প্রকাশনী )
ইনুর ভাষায়, “৬ নভেম্বর দিবাগত রাত একটায় প্রথম গুলি ছুড়ে বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। আমরা রাত ১২টায় প্রথম গুলি করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম নায়েব সুবেদার মাহবুবুর রহমানকে। কিন্তু তিনি গ্রেপ্তার হন।” এই বক্তব্যে সত্যের সাথে মিথ্যা মেশানো আছে। সুবেদার মাহাবুব গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৩ নভেম্বর। তার নেতৃত্বেই জাসদের গণবাহিনীর খুনীরা ৭ নভেম্বর সকালে সেনাবাহিনীর দুইজন মহিলা ডাক্তারকে হত্যা করেছিল। ৬ নভেম্বর মাঝ রাতের আগে গ্রেফতার হলে তো ৭ নভেম্বর এই কাজ করতে পারার কথা নয়।
৭ নভেম্বর নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মিথ্যাটা হচ্ছে- লে. কর্নেল (অব আবু তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাস্তব সত্যটা তাহেরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হাসানুল হক ইনু ২০১০ সালে প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মিজানুর রহমান খানকে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, “তাহের ও আমার মূল পরিকল্পনায় জিয়াকে গ্রেপ্তার করে আনার নির্দেশ ছিল। হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদারের দায়িত্ব ছিল বন্দী জিয়াকে মুক্ত করা এবং তাঁকে ৩৩৬ নম্বর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় নিয়ে আসা। সেখানে তাহের ও আমি জিয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আমাদের এ পরিকল্পনা সফল হয়নি।”
সূত্র (প্রথম আলো, ০৭-১১-২০১০)
মেজর জিয়া কাউকে খুন করতে নিষেধ করেন।
কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ টেলিফোনে জেনারেল জিয়াকে তার ক্যাম্পে খালেদ মোশারফের উপস্থিতির বিষয়টি জানান। এটা জানার পর জেনারেল জিয়া খালেদ মোশারফ এর নিরাপত্তার সকল ধরণের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কর্নেল নওয়াজেশকে নির্দেশ প্রদান করেন, এবং তাদের সাথে যেন কোনরূপ দুর্ব্যবহার না করা হয় সেই বিষয়েও নির্দেশনা দেন। তিনি তাদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত হতে নিষেধ করেন এবং নওয়াজেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রেজিমেন্টের অন্য অফিসার মেজর জলিলের সাথে কথা বলে তাকে নির্দেশ দেন যেন তিনি এই অফিসারকে রক্ষার কাজে কর্নেল নওয়াজেশকে সাহায্য করেন।
সূত্র ( কর্নেল শাফায়াত জামিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর।
নীলুফার হুদা (২০১২)। কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি - পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ - তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা।
জহিরুল ইসলাম - মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্তক বিদায়।
কর্নেল তাহেরের এই ঝোপ বুঝে কোপ মারার বিষয়টি সেনানিবাসের ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানরা ঠিকই বুঝতে সমর্থ হয়েছিলো তাই ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রাত ১২টা ১মিনিটে অভ্যুত্থান শুরুর মূহূর্তেই ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর জওয়ানরা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা খালেদ মোশারফের অনুগত সৈন্যদের হটিয়ে দিয়ে তাঁকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন। তিনি সেখানে পৌছেই তাঁকে মুক্তকারী সৈনিকদের বলেন সিনিয়র অফিসারদের ডেকে আনতে।
সূত্র (মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য।
সবাইকে জমায়েত করে জেনারেল জিয়া আর কোন রক্তপাত না ঘটানোর নির্দেশ দেন এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করেন।
সূত্র - কর্নেল শাফায়াত জামিল । একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সাহিত্য প্রকাশ।
অফিসারদের বাসায় বাসায়, অফিসে অফিসে হামলা করে। হত্যা করা হল অনেককেই।
জাসদের গণবাহিনীর নেতা ছিলেন কর্নেল (অবসর ) আবু তাহেরদের গোপনে গোপনে সংগঠিত গোপন সৈনিক সংস্থা
ক্যালেন্ডারে ৭ নভেম্বর শুরু হওয়া মাত্রই অফিসারদের বাসায় বাসায়, অফিসে অফিসে হামলা করে। হত্যা করা হল অনেককেই। নারী (ডাক্তার) অফিসারদেরও হত্যা বা অপদস্থ করা হল। অফিসারদের অমান্য করার জন্য প্রকাশ্যে মাইকে ঘোষণা দেয়া হল। অফিসারদের বেশিরভাগই যে যেদিকে পারলেন সেদিকে ছুটে নিরাপত্তা খুঁজলেন। ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিট, রেজিমেন্ট বা ব্যাটালিয়ন- যেখানে যেখানে গোপন সৈনিক সংস্থা সক্রিয় ছিল, তারা রাতের অন্ধকারে সেনানিবাসের রাজপথে নেমে এল। হাজার হাজার অস্ত্রের গুলির আওয়াজ কত প্রকট ছিল, সেটা কোনো ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। আমি নিজে বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিলাম রাত সাড়ে ১২টায় এবং নেতৃত্ব দিলাম সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।
সূত্র - মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক :‘মিশ্র কথন’ বই।
৭৫-এ কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম সেনানিবাসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারদের ফাঁসি চাই- শ্লোগানে ব্যাপক প্রতিহিংসা ছড়িয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেন ‘গৃহবন্দী’ অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি মুক্ত হয়ে সেনানিবাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। যদিও তৎকালীন জাসদ নেতৃত্ব ও কর্নেল (অব) তাহের চেয়েছিলেন জেনারেল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাদের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে। কিন্তু সহকর্মীদের পরামর্শে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া তা করেননি। বরং তিনি সেনানিবাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। এ সময় কর্নেল তাহেরসহ অনেক জাসদ নেতা গ্রেফতার হন। তাদের মুক্ত করতে কর্নেল তাহেরের দুইভাই একটি ‘জঙ্গি গ্রুপ’ তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে কিডনাপ করতে গিয়েছিলেন। এতে কর্নেল তাহেরের এক ভাইসহ কয়েকজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
স্বাধীনতা উত্তর সেনাবাহিনীতে কর্নেল (অব) তাহেরদের সৈনিক সংস্থা গোপন সংস্থার সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরের যোগাযোগ ছিল।তাহেরের সৈনিক সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারদের ফাঁসি চাই- শ্লোগানে হত্যাকান্ড চালায়।
বিষয়: বিবিধ
১৮০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন