শহীদ লে. মুশফিকের আত্মত্যাগের কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ২৮ মে, ২০১৬, ০৬:৫৬:০৭ সন্ধ্যা
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, দেশমাতৃকার অখন্ডতা রক্ষায় এভাবেই নিজের জীবন বিসর্জন দেন লে. মুশফিক ।
ইনসার্জেন্সী অপারেশনের ইতিহাসে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উল্লেখযোগ্য নাম। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন রয়েছে এবং বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে আসছে। এ অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকেও সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
সাতক্ষীরার ছেলে মুশফিক সুদুর পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা এক সবুজ পাহাড়ে তার রানারের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অসহায় রানার থেমে থেমে আক্ষেপে বলে উঠছে, “গুলিটা আমার গায়ে ক্যান লাগল না স্যার ?
২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে কুখ্যাত পাহাড়ি শান্তিবাহিনী সহ দেশ বিরোধী জঙ্গি উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের খবর আসে।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, রাত তখন আড়াইটা। লে. মুশফিক ঠিক চার ঘন্টা আগে লক্ষীছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে ১৭ জন রেইডার্স নিয়ে চেলাছড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলেন । ক্যাম্প থেকে আসতে পাহাড়ী পথ দুর্গম, বিপদসংকুল। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই তারা পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলে। সেদিনের মেঘলা আবহাওয়াও যেন তাদেরই অনুকূলে। কিন্তু কুখ্যাত পাহাড়ি শান্তিবাহিনী সহ দেশ বিরোধী জঙ্গি উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের হাতছাড়া না হয়, সেজন্য সিন্দুকছড়ি ক্যাম্প থেকেও সেকেন্ড লেঃ সাইদ আর একটি দল নিয়ে উল্টাছড়ি গ্রামের পাশে পজিশন নেন। সেনা সোর্সের সহায়তায় পাহাড়ের পাদদেশে আর চূড়ায় দুটি জুম ঘর শনাক্ত করলেন লে. মুশফিক।
সোর্সের ভাষ্যমতে, এ দুটি ঘরেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান করার কথা। দুটো উপদলকে পাহাড়ের পাদদেশে পজিশন নিতে বলে নিজে ৫ জনসহ চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। জুম ঘর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে লে. মুশফিক শুয়ে আছেন তার দলসহ। হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্র হয়ে গেল সেই পাহাড়চূড়া। শুরু হয়ে গেল ভয়ানক যুদ্ধ। শত্রুর প্রথম বুলেটটাই বুকে আঘাত লাগে লে. মুশফিক। যুদ্ধ শেষ করে অপারেশনে অংশ নেয়া সবাই লে. মুশফিকের চারপাশে ডিফেন্স নিলো। উদ্ধার হলো কুখ্যাত পাহাড়ি জঙ্গি শান্তিবাহিনীর ইউনিফর্ম পড়া ৩ লাশ , ২ রাইফেল, ১ এসএমজি। আক্রমনের গোলাগুলির শব্দ পেয়ে লে. সাইদ ততক্ষণে লে. মুশফিকের কাছে পৌছে গেলেন। মুশফিকের রক্তাক্ত বুকের ক্ষত দেখে সবাই মনে করলেন সময় খুব অল্প ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির তরুণ অফিসার লে. মুশফিক। ১৯৮৯ সালে ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনের দায়িত্বে ।
এদিকে আঁধার কেটে গিয়ে দিবালোক যখন প্রখরতর হয়ে উঠছে, মুমুর্ষ মুশফিকের চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। ঠিক নয় দিন আগে বাঘাইহাট থেকে ১০ নম্বর ক্যাম্পে যাবার পথে এই জঙ্গি শান্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে বিলদার হারুন, ল্যান্স নায়েক সুনিল আর ডিএমটি নাজমুল হুদা এই তিনজন প্রাণ হারিয়েছিল। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে, তবু অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়া রানারকে সান্তনা দিতে গিয়ে মুশফিক বলেন - “তোমার তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তুমি মারা গেলে তাদের কি হবে ? আমি মরলে এদেশের কারো কোন ক্ষতি হবে না।”
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিট । লে. সাইদ ছুটলেন হ্যালিপ্যাড বানাতে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই হেলিকপ্টার ছুটে এলো। দূর দিগন্তে উড়ে আসা হেলিকপ্টারটা ক্রমশ বড় দেখাচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মুশফিক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। হয়ে গেলেন শহীদ।
তথ্যসূত্র : সদরদপ্তর, ২৪ পদাতিক ডিভিশন, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, চট্টগ্রাম।
কিছু ইতিহাস --
ভারতের ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র, রক্তাক্ত জঙ্গি গেরিলা হামলা করেছে। বাংলাদেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীকে আশ্রয়, প্রশ্রয়, প্রশিক্ষণ, রেশন, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-সহ অন্যান্য সরকারী সংস্থা (নিউইয়র্ক টাইম্স, ১১ জুন ১৯৮৯)। ‘র’-কর্তৃক শান্তিবাহিনীকে সক্রিয় সহায়তা প্রদানের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক ও গবেষক সুবীর ভৌমিক তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থে (ট্রাবল্ড পেরিফেরিঃ ক্রাইসিস অব ইণ্ডিয়া’স নর্থওয়েস্ট, সুবীর ভৌমিক, সেইজ পাবলিকেশন্স, নতুন দিল্লী, ২০০৯, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৯)।
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারতীয় নির্দেশ দেওয়া হলেও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র ১৯৭৫ সাল থেকে ভারতের অভ্যন্তরে পাহাড়ি জঙ্গি খুনি শান্তিবাহিনীর সংগঠন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ এর পূর্বে তেমন মাথা ছাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের পাহাড়ে গণ হত্যা চালাচ্ছে পাহাড়ি জঙ্গি উপজাতিরা। পত্র পত্রিকায় ১/২ ইঞ্চি কলামে লুকিয়ে ছাপা হয়।
বর্তমান আওয়ামী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুকে একবার চুক্তির মাধমে বিষাক্ত বোমায় রুপান্তরিত করেছিল , এখন সেই বোমায় বাম , আওয়ামীলীগের স্পর্শে গরম হচ্ছে। এটি এমন সময় বিস্ফোরণ ঘটবে, যখন বর্তমান রাজনৈতিক সরকার আর সামলাতে পারবেনা।
মে: জে: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক এর লেখা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ বইয়ে লিখেছেন - জুম্মল্যান্ড নামক বিষয়টি নুতন নয়। ১৯৮৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর আমি যখন বাংলাদেশ-সরকারের প্রতিনিধি দলের উপ-প্রধান হিসেবে খাগড়াছড়ি থেকে অনেক মাইল উত্তরে দূরে গভীর জঙ্গলে শান্তি বাহিনীর দলের সাথে বৈঠক করি, সেই সময় শান্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে যে পাঁচ দফা দাবিনামা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করে, তাতে প্রথমেই বলা হয়েছিল বাংলাদেশ একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হবে, সেই ফেডারেল রাষ্ট্রের দুইটি প্রদেশ থাকবে। একটি প্রদেশের নাম হবে জুম্মুল্যান্ড। রাজধানী রাঙ্গামাটি। আরেকটি প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ, রাজধানী ঢাকা। দুইটি প্রদেশ নিয়ে একটি দেশ হবে, যার নাম হবে বাংলাদেশ- রাজধানী হবে ঢাকা।
পাহাড়ি জঙ্গি উগ্র উপজাতিরা বাংলাদেশের আর্মি হটাও স্লোগানের আড়ালে যে জিনিসের নীল নকশা করছে। তারা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা গড়তে চায় স্বাধীন দেশ জুম্মল্যান্ড। চাডিগাং (চট্টগ্রাম), দিয়াঙ্গা(কক্সবাজার), চেংমি(খাগড়াছড়ি), গংকাবর (রাঙ্গামাটি), আরভূমি(বান্দরবান) পাঁচটি জেলাকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন স্বাধীন জুম্মল্যান্ড। যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি হুমকি।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৫ই ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সংগঠন "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" প্রতিষ্ঠা করে। এবং বাংলাদেশের বিরোদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী জঙ্গি তত্পরতার জন্য ১৯৭৩ সালেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমা "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" সংগঠনের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গঠন করেন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কুখ্যাত এবং রাষ্ট্র বিরোধী শান্তিবাহিনী পাহাড়ি এলাকায় হত্যা, ডাকাতি , ধর্ষণ , গুমসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত হয়। এই অবস্থার মোকাবেলার জন্য তৎকালীন শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ সরকার ঐ এলাকায় প্রথম সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।
প্রাথমিকভাবে সমঝোতা হলেও ১৯৮২ সালের ১০ নভেম্বর নিজ দলের প্রতিপক্ষ সাব-গ্রুপের আক্রমণে নিহত হন মানবেন্দ্র লারমাসহ আটজন। ধারণা করা এর পিছনে সন্তু লারমার প্রত্যক্ষ মদদ ছিল।
আবির্ভূত হয় কুখ্যাত গণ হত্যা কারী আরেক চরিত্র। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আপন ছোট ভাই জ্যোতিন্দ্রিয় বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। ১৯৭৫ সালে ২৬ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হয় । ১৯৮০ সালে ছাড়া পায় । ১৯৮১-তে একবার গ্রেপ্তার হয়ে মুক্ত হওয়ার পর আবার আত্মগোপন করে। এদিকে এসময় সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়।
সংবাদপত্র তথা মিডিয়া এবং দেশের বুদ্ধিজীবি শ্রেণী সবাই পাহাড়ীদের অধিকারের কথা তুলে ধরে। কিন্তু ৬,৭২,০০০ এরও বেশি পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের দু:খ ও কষ্টের কথা কেউ তুলে ধরে না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং শান্তি বাহিনীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল, এর অংশ হিসেবেই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১৯৯৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মে যথাক্রমে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন এবং ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ মে অন্তবর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠিত হয়। সে বছরই সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে। এছাড়া কুখ্যাত জঙ্গি পাহাড়ি জেএসএসের ৬৪জন ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের ১৮৪ জনকে তাদের সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। কুখ্যাত জঙ্গি পাহাড়ি জেএসএসের ৬৮৬ জনকে পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর এরাই পাহাড়ের উপর আরো ভয়ঙ্কর তান্ডব চালায়। এখনো চলছে। এখনো উত্তপ্ত পাহাড়। সন্ধ্যার পর গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এখন পাহাড়ের খাঁজে চলছে অরাজকতা। খুন, অপহরণ , বাহিরের দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদিদের ক্যাম্প এবং তাদের সাহায্যে আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা ।
বিষয়: বিবিধ
২৬৫৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুঃখজনক, আমাদের তরুণ প্রজন্ম এসব ইতিহাস পড়তেও আগ্রহী নয়!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ,
মন্তব্য করতে লগইন করুন