কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ডেকে আনল মহাদুর্যোগ। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৪:২৩:৩১ বিকাল
প্রশাসনের স্বার্থপরতা, অদক্ষতা ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এড়ানোর মানসিকতার চিত্র।
বালি পরিবহনের কার্গো দিয়ে পরিবহন হচ্ছিল তেল
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ডেকে আনল মহাদুর্যোগ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।
বিজ্ঞানী , বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ...................
সুন্দরবনের আশপাশের বাসিন্দারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বা নোনা পানির বন হিসেবে ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)। পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে।
সুন্দরবনে শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েলের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় ছড়িয়ে পড়া তেলে মাছ-কাঁকড়াসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে।
সরকারের তরফ থেকে এলাকাবাসীকে তেল তুলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রি করতে বলা হচ্ছে।
সরকারের এই ঘোষণার পর নারী ও শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ তেল তুলতে পানিতে নেমে পড়েছে। আর এতে করেই চরম স্থাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে সুন্দরবনের আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের।
র ফলে গ্রামবাসীদের যারা তেল তুলতে যাচ্ছেন, তাদের চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। চুলে ও মুখে এই ফার্নেস অয়েল মিশ্রিত পানি লাগার ফলে চুলও পড়ে যেতে পারে।’
‘আসলে বিশ্বের বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের সাথে জাতিসঙ্ঘেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। যখন একটা বিপর্যয় হয়েই গেছে, তখন আমরা এসব হাতুড়ে পদ্ধতিতে না গিয়ে জাতিসঙ্ঘের কাছে সাহায্য চাইতে পারতাম। কিন্তু সেদিকে আমরা গেলাম না। আর তেল তো পানিতে ভেসে থাকে। তাই পানির ওপরে হালকা বাধা দিয়ে তেলগুলোকে এক দিকে নিয়ে যাওয়া যেত। তারপর সেখান থেকে অপসারণ করলে কাজটা সহজ হতো। এখন গ্রামবাসীতে পানিতে নামিয়ে তেল তোলা হচ্ছে। এতে অর্ধেক তেলও তোলা যাবে না। কারণ, ওই ভেসে থাকা তেলে কিছু দিয়ে স্পর্শ করতে গেলেই তা ভেঙে যাবে। ফলে যা হচ্ছে সবই অবাস্তব।’
বাতাসে তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কারণে পাখিসহ জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়া ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। তেলের গন্ধের তীব্রতার কারণে পাখির চোখ-মুখ বা ডানার পালক পুড়ে যেতে পারে। হরিণসহ কিছু জীবজন্তু নদী বা খালের কিনারে এসে পানি পান করে। তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে তারা আর এখন পানি খেতেই পারবে না। ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবন চক্রই পাল্টে গেল।’
উল্লেখ্য, খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গত মঙ্গলবার ভোরে দুর্ঘটনায় পড়ে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি। এমটি টোটাল নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে। দুর্ঘটনার দুই দিন পর ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটি বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়। তবে এরই মধ্যে সাউদার্ন স্টারে থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের প্রায় পুরোটাই সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া ট্যাংকার ছিল বালি পরিবহনের কার্গো তেল পরিবহনের নয়। আওয়ামীলীগের নেতা তোফায়েল আহমেদের ক্ষমতার জোরে বালি বাহী কার্গোটি তেল পরিবহন করার জন্য মিনি ট্যাঙ্কারে রূপান্তর করা হয়।
বালি পরিবহনের কার্গো দিয়ে পরিবহন হচ্ছিল তেল
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই সাউদার্ন স্টার-৭ ট্যাঙ্কার তেল পরিবহনের উপযোগী ছিল না। এ নৌযানটি মূলত বালি পরিবহন কার্গো ছিল। অধিক মুনাফা লাভের আশায় কার্গোটি রাতারাতি তেলবাহী পরিবহন হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। কার্গোর মালিক ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোং। নাম আমির হোসেন ফরিদ। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক । তার ট্যাঙ্কারের তেল পরিবহনের যথাযথ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর শ্যালক হওয়ায় দাপট দেখিয়ে কাজ হাতিয়ে নেয়া হয় । এ ঘটনার চারদিন পরও দুর্ঘটনাস্থলে আসেনি ট্যাঙ্কারের মালিক। তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও মুখ খুলছে না। এর মধ্যে একটি মহল ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কো. এর মালিক আমির হোসেন ফরিদ জানান, কার্গোটি প্রথমে বালি পরিবহন করা হলেও পরে তেল পরিবহন করার জন্য মিনি ট্যাঙ্কারে রূপান্তর করা হয়। এবং আটটি পাম্প বসানো হয়েছে। এটি কত সালে তৈরি তা তিনি বলতে পারেননি। অতিরিক্ত তেল ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি দাবি করেন, কার্গোটির বীমা করা থাকলেও ফার্নেস অয়েল পরিবহনের কোন বীমা ছিল না। সুন্দরবন বিভাগের নির্দেশ থাকলেও কার্গোটি বন বিভাগের জেটিতে নোঙর না করে কেন নদীর মাঝখানে নোঙর করা হলো- এমন প্রশ্ন করলে আমির হোসেন ফরিদ জানান, মাস্টারকে না পাওয়া গেলে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না। নিজেকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি আমার ছোট ভগ্নিপতি। আমার পিতার নাম খোরশেদুর রহমান তালুকদার। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার ধনিয়ায়। তিনি বরিশাল শহরের ব্রান্ড কম্পাউন্ড রোডের সাজমী ভবন নামের একটি বাড়িতে বসবাস করেন।
পৃথিবীর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিস্মিত কি করে এমন একটা জায়গা দিয়ে তেলের জাহাজ চলে। আগে এটা অবৈধভাবে চলত। ২০১১ সালে এই রুটের বৈধতা দেয়া হয়েছে।
সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগহীনতার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, গত মঙ্গলবারের ওই দুর্ঘটনা প্রমাণ করেছে সুন্দরবন কতটা অরক্ষিত। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের নামে সরকার সুন্দরবনে দীর্ঘদিন থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
http://mzamin.com/details.php?mzamin=+NTQ0NDA%3D&s=MTU%3D#.VIwP6HCeJn
দায় সরকারকেই নিতে হবে
সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগহীনতার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, গত মঙ্গলবারের ওই দুর্ঘটনা প্রমাণ করেছে সুন্দরবন কতটা অরক্ষিত। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের নামে সরকার সুন্দরবনে দীর্ঘদিন থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। গতকাল মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ভারত ইতিমধ্যে বনবিভাগের কর্মী, সীমান্ত সেনা এবং উপকূলীয় রক্ষীদের সতর্ক অবস্থায় রেখেছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে জানা গেছে।
ভারতের সুন্দরবন প্রাণিমণ্ডল সংরক্ষণ বিভাগের উপপ্রধান প্রদীপ বিশ্বাস বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় তেল ছড়ানোর বিষয়ে পূর্ব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। তিনি বলেন,‘আমরা সব ধরনের পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ভারতীয় উপকূলরক্ষী ও সীমান্ত রক্ষীরা (বিএসএফ) পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন নদীগুলোতে নৌকাযোগে টহল দেওয়া হচ্ছে।’
ভয়াবহ সর্বনাশের পর ও এরা কি বলে ?
ছড়িয়ে যাওয়া কালো তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান।
দেশের ও বিশ্ব গণমাধ্যমে যখন সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ক্ষতির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে, প্রতিবেশী ভারত ও জাতিসংঘ যখন বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, ঠিক সেই মুহূর্তেই শনিবার দুপুর একটায় সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে মন্ত্রী এ ধরনের কথা বললেন।
বিষয়: বিবিধ
১৯০৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সারা দেশে যখন ভুপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মত কিছু ঘটবে তখনও আমরা ঘুমাব!
মন্তব্য করতে লগইন করুন