গুম প্রতিরোধ দিবসে ওরা শুধু কান্না করেই যাবে ?
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ৩১ আগস্ট, ২০১৪, ০১:৫৭:৫৫ রাত
স্বজনদের অপেক্ষা আর কান্নার কি শেষ নেই?
বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা আজ পড়ে কিছু মানুষের বক্তব্য বিবেক কে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় তারা কি এই সব পড়েন ?
সভামঞ্চে যখন তারা স্বজনদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা একে একে বর্ণনা করছিলেন, মঞ্চের সামনে বসা অন্যদের তখন চোখ মুছতে দেখা যায়। অনেকে কেঁদে লুটিয়ে পড়েন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে গুম আর ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া এমন ৯৭টি পরিবার গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটরিয়ামে একত্র হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস-২০১৪ উপলক্ষে ‘স্বজনদের ব্যথা- গুম, খুন ও নির্যাতন আর না’ শিরোনামে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি। সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম-খুনের শিকার হওয়া ৯৭টি পরিবারের মধ্যে ২২টি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের করুণ কাহিনী তুলে ধরেন। প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগ করা হয়। যদিও গুম-খুনের অভিযোগগুলো বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অস্বীকার করে আসছিলেন।
গত বছরের ২৭শে নভেম্বর রাতে কুমিল্লা থেকে গুম হওয়া সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম হীরুর মেয়ে মাশরুফা ইসলাম বলেন, ‘আমার আব্বু ফ্রিডম ফাইটার ছিল। উনি কি দেশ স্বাধীন করেছে এই জন্য যে, এই দেশে তাকে গুম করা হবে। নয় মাস ধরে আমরা বাবাহারা হয়ে আছি।
মাশরুফার পিতা সাইফুল ইসলাম হীরুর সঙ্গে গুম হয়েছেন হুমায়ূন কবীর পারভেজ। তার স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, আমি আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছি। ঈদের সময় আমার মেয়ে বলেছে, আমার তো বাবা নেই, আমি একটার বেশি জামা নেবো না। এ কথা শুনে আমি হু হু করে কেঁদেছি। আমার বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ি আমার কাছে তাদের ছেলের খবর জানতে চান। আমি কোন উত্তর দিতে পারি না।
প্রায় সাড়ে চার বছর আগে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের মেয়ে মাসুদা আক্তার বলেন, একটা মানুষ মরে যাওয়া স্বাভাবিক। খুন হলেও তার লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু বাবাকে সাড়ে চার বছর ধরে গুম করে রাখা হয়েছে। আমার বাবাকে আমি ফেরত চাই।’ তিনি বলেন, বাবা ছাড়া আমরা কেমন আছি, কেউ খোঁজ নেয় না
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া ফেরার সময় গুম হওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দেসের পিতা মাওলানা আবদুল হামিদ বলেন, ৩০ মাস ধরে ছেলের জন্য অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু ছেলে ফিরে আসে না। আমার স্ত্রী মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখে- মুকাদ্দেস বাড়িতে এসেছে। সে কান্নাকাটি করে। ছেলের বন্ধুরা আসে। আড়াই বছরের প্রতিটা দিন আমাদের চোখের জল ফেলে কাটাতে হয়েছে।’
গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম বলেন, আমার ভাইয়ের একটাই দোষ ছিল সে বিএনপি করতো। সে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিল। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র্যাবের লোক র্যাব-১ লেখা গাড়িতে তাকেসহ ৬ জনকে সবার সামনে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু পরদিনই র্যাব তা অস্বীকার করে। সানজিদা বলেন, ‘র্যাব যদি তাদের না-ই তুলে নিয়ে যায় তাহলে তারা খুঁজে বের করে দেয় না কেন?
সুমনের সঙ্গে গুম হওয়া কাউসারের স্ত্রী মিনু বলেন, ‘আমার স্বামী ড্রাইভারি করতো। সুমন ভাইয়ের কর্মী ছিল। তাকেও ধরে নিয়ে গেছে র্যাব। একটা সন্তান নিয়ে আমি কষ্টে বেঁচে আছি। আমার দেখার কেউ নেই। বাবা-মায়ের সঙ্গে কখনও গ্রামের বাড়ি বরিশালে থাকি। কখনও ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় থাকি। আমার মেয়ে মীমের এখন কি হবে?’ কোলের মেয়েকে দেখিয়ে মিনু বলেন, ‘ছোট্ট মেয়েটা শুধু বাবার কাছে যেতে চায়। বাবার কথা মনে করে নিজে নিজেই নামাজের পাটি বিছিয়ে হাত তুলে আল্লাহর কাছে বাবাকে ফেরত চায়।’ মিনুর কোলে থাকা শিশু মীমকে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘আমার বাবাকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। আমার আব্বু আসবে।
একই সময়ে নাখালপাড়া থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া আদনানের বাবা রুহুল আমীন মাস্টার বলেন, ‘রাতে যখন র্যাব পরিচয়ে লোকজন আমার বাসায় ঢুকে আমি তখন নিজের হাতে ছেলেকে র্যাবের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কারণ র্যাবের প্রতি আমার আস্থা ছিল। কিন্তু পরদিন র্যাব, থানা, ডিবি যেখানেই গিয়েছি সবাই তাকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেছে। এমনকি থানা পুলিশ আমাদের জিডি পর্যন্ত নিতে চায়নি।
কুমিল্লার বাসা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী রকিবুল হাসান শাওনের পিতা মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবদুল মতিন বলেন, ‘প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে র্যাব আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে গুম করেছে। ছেলে অন্যায় করলে তার ১০০ বছর জেল দেন আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এমনভাবে গুম করে ফেললেন যে লাশটাও দেখার সৌভাগ্য আমাদের হলো না।’
২০১১ সালে নয়া পল্টন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শামীমের স্ত্রী ঝর্ণা খানম বলেন, রাজনীতি করার জন্যই তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তার থানায় জিডি করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছি। আমার সন্তানের বয়স এখন দশ বছর। ছেলে জানতে চায় তার বাবাকে মেরে ফেলেছে কিনা? আমি কিছু জবাব দিতে পারি না।
সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে পল্লবীর এক বাসা থেকে ধরে নিয়ে প্রশাসনের লোক। তার ভাই ইসলাম রেজা ফেকু বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা কোন আইন হলো? বিরোধী রাজনীতি করলেই তাকে ধরে গুম করতে হবে?’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পারছি না আমাদের ভাই বেঁচে আছে না তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে পিন্টু বিয়ে করেছিল। তার স্ত্রী নুহাশ এখনও প্রতীক্ষায় আছে তার স্বামী ফিরে আসবে।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে নিজ বাসভবনে র্যাবের হাতে ফয়েজ আহমেদ নিহত হন।অনুষ্ঠানে লক্ষ্মীপুরে র্যাবের হাতে নিহত চিকিৎসক ফয়েজ আহমেদের মেয়ে রুজমা কাওসার অশ্রুসিক্ত চোখে দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন করেন, ‘আমার বাবা একজন চিকিত্সক ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রেও চিকিত্সকেরা বিশেষ সুবিধা পান। কিন্তু আমার বাবাকে হাত-পা বেঁধে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা তো কোনো যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না। তার পরও কেন এ ঘটনা ঘটল?'
ছোট্ট শিশু সাদমান শিহাব আয়মান ও আরোয়া ইসলাম। দু’জনই মায়ের হাত ধরে সভায় এসেছে। গলায় ঝোলানো বাবার ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড। চোখে পানি। আয়মানের বাবা খালিদ হাসান সোহেল (২৭) ও আরোয়ার বাবা সাজেদুল ইসলাম সুমন (৪০)।
গত বছরের ২৮শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে তার পিতা খালেদ হাসান সোহেল নিখোঁজ হয়েছেন। ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে তাকেও একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারও ফেরা হয়নি আর। পিতার কথা জানতে চাইতেই ছোট্ট আরিয়ান বলে, ‘আমার বাবাকে পুলিশ আর র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। তোমরা আমার বাবাকে এনে দাও।’ মা শাম্মি সুলতানা বলছিলেন, আমার ছেলে সব সময় তার বাবাকে কাছে পেতে চায়। ‘বাবা বাবা’ বলে বাসায় চিত্কার করে ডাকে। প্রশ্ন করে- বাবা আসবে কবে? আমি তার কোন উত্তর দিতে পারি না।
চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা তারিক মো: সাইফুল ইসলামকে হত্যার আগে ডিবি অফিস থেকে তার পরিবারকে জানানো হয় রাত ৩টায় তাকে শেষ করা হবে।
তওফিক বলেন, আমার ভাইকে চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংকের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শহর থেকে কিছুটা দূরে শশ্মানঘাটে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে ডিবিতে গিয়ে যোগাযোগ করে বলি আপনারা বিচার করেন। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিচারের রায় দিয়ে দেন। তারপরও ভাইকে বাঁচিয়ে রাখেন।
তখন ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়- আপনার ভাইয়ের কোনো সমস্যা হবে না, নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু হত্যার আগের দিন আমাকে জানানো হয়- রাত ৩টায় আপনার ভাইকে শেষ করা হবে
নির্বাচন পর্যন্ত চুপ থাকার নির্দেশ ছিল
ঘটনাক্রমে সেদিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একসঙ্গে ছিলেন সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৪), তাঁর খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীর (৩০)। আরও ছিলেন আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম (২৪), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল (২৪), মুগদার আসাদুজ্জামান ওরফে রানা (২৭) ও উত্তর বাড্ডার আল আমিন (২৬)। কয়েক ঘণ্টা পর রাত দুইটার দিকে শাহীনবাগের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এ এম আদনান চৌধুরীকে (২৮)। প্রায় একই সময়ে তুলে নেওয়া হয় কাওছার আহমেদকে ।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তানভীরসহ আটজনকে তিন ভাগে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজ ওই আটজনের একজন জাহিদুল করিম ওরফে তানভীর। তানভীরের মা গতকাল শনিবার মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সম্মেলনে এসেছিলেন ছেলের ছবি বুকে ঝুলিয়ে। গাঢ় সবুজ মাঠের ওপর বসে তানভীর কার দিকে যেন তাকিয়ে হাসছে। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর এই প্রথম প্রকাশ্যে আসা তাঁর।
জাহিদুল করিম ওরফে তানভীরের মা নিলুফার বেগম। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তানভীরসহ আটজনকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী l নিখোঁজদের স্বজনেরা জানালেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (৫ জানুয়ারির) নির্বাচন পর্যন্ত চুপ করে থাকতে বলেছিল তাঁদের। কিন্তু আর কত দিন চুপ করে বসে থাকা যায়?
নিখোঁজ আটজনের পক্ষ থেকে সাজেদুলের বোন সানজিদা বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছিলাম র্যাব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনটি গাড়িতে করে এসেছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা র্যাব অফিসে যাই। আমার বৃদ্ধা মা প্রতি সপ্তাহে র্যাবের ডিজি, এডিজি ও সিইওর দপ্তরে ধরনা দেন। আমার ভাতিজিরা বাবার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। এটা অসহনীয়। আমার ভাইকে হয় ফেরত দিন, নয় উদ্ধার করে দিন। ফেরত দিতেই হবে। উত্তর দিতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে ওরা কোথায়? আমাদের ট্যাক্সের পয়সা প্রতিরক্ষা বাহিনী চলে।
সারা দেশ থেকে গতকাল ঢাকায় এসেছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার। তাদের কষ্টের শেষ নেই।
গুম হওয়া স্বজনদের আর্তনাদ শুনছে কি কেউ?
অতীতের কিছু সংবাদ পত্রের অংশ বিশেষ
বিষয়: বিবিধ
১৯৩০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন