নামে আমরা স্বাধীন একটি ভূ-খণ্ড পেয়েছি । পাইনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি।
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ২৮ অক্টোবর, ২০১৫, ১২:২৬:১৯ দুপুর
স্বাধীন একটি ভূ-খণ্ড পেয়েছি । পাইনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি।
মুজিব সরকারের আমলে বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদারকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা। এবং ১৫ আগস্টের কিছু কথা।
স্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ারের ইতিহাস এবং তার সাথে সেই সময়ের কিছু ঐতিহাসিক তথ্য। সকল তথ্য গুলো যাচাই বাছাই করে নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের সফল সৈনিক ( যারা পাকিস্থানি সেনা বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন ) তাদের বক্তব্য থেকে নেয়া। বই এবং ব্যাক্তির নাম বইয়ের শেষ অংশে লিপিবদ্ধ আছে।
১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর অদূরে সাভার এলাকায়। এর পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে নির্যাতন করা হয় সিরাজ সিকদারকে।
সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর পুলিশের প্রেসনোটের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩ ও ৪ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক যথাক্রমে ‘গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলীতে সিরাজ সিকদার নিহত’ এবং ‘সিরাজ সিকদারের লাশ দাফন’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয় যে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার করে। একইদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁহাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন এবং তাহার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাহাদের বেআইনী অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে লইয়া যাইতে রাজী হন।
সেইভাবে ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশ ভ্যানে করিয়া তাহাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল কর্তৃক লইয়া যাইবার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলীবর্ষণ করিলে তত্ক্ষণাত্ ঘটনাস্থলেই তাহার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে।
সিরাজ সিকদারের লাশ দাফন (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি ১৯৭৫) নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ গতকাল (শুক্রবার) তাঁহার পিতা জনাব আবদুর রাজ্জাক সিকদার কর্তৃক শনাক্তকরণের পরে সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর গোরস্তানে দাফন করা হইয়াছে। গতকাল সকাল সোয়া ১১টার দিকে তাঁহার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়।
পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় : ‘সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে গত ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রাম হইতে গ্রেফতার করিয়া ঐদিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁহার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত ২রা জানুয়ারী রাত্রে একটি পুলিশের ভ্যানে তাঁহাকে তাঁহার দলের লোকদের একটি গোপন আস্তানার দিকে লইয়া যাওয়ার সময় তিনি পলায়নের চেষ্টা চালাইলে পুলিশ গুলি চালায় এবং এতে জনাব সিকদার ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।’ এই ঘটনা রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাভারের তালবাগ এলাকায় ঘটে বলিয়া জানা গিয়াছে।
রাত ৩টায় দিকে জনাব সিকদারের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়। গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত হয়। তার শরীরে ৫টি বুলেটের চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে। ৪টা বুলেট দেহ ভেদ করিয়াছে। একটি বুলেট ফুসফুসের ভিতরে পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার পরনে ক্রীম রংয়ের টেট্রনের প্যান্ট ও গায়ে সাদা টেট্রনের শার্ট ছিল এবং বাম হাতে হাতকড়া দেখা যায়।
সিরাজ সিকদারের এই মৃত্যু প্রসঙ্গে তত্কালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে বলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’।
বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করার পর শেখ মুজিব স্বয়ং সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতার দম্ভে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?”
বস্তুতঃ শেখ মুজিব তার নিজের ও পরিবারের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী একটা ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন। বাকশালীরাও শ্লোগান তুলেছিল,
“এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।”
“রক্ষীবাহিনী ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী কাজ শুরু করে, ৮ই মার্চ আইন করে বৈধতা দেয়া হয়। এই বাহিনী ৪০ হাজার লোককে খুন করে কিন্তু একটি খুনের ও বিচার হতে পারেনি। ৪০ হাজার লোকের হত্যার জন্য রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি প্রদানের কাজটি মরহুম শেখ মুজিব করেন। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের সরকারই ইনডেমনিটি প্রবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করে।
বাকশালের রাষ্ট্রীয়করণের নামে আওয়ামী লীগ ব্যাংক, বীমা, মিল, কল-কারখানায় হরিলুট করেছিল। দেশে সম্পদ দেশের বাহিরে পাচার করার জন্য সীমান্তকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আওয়ামী শাসনামলে অবাধ লুটপাটের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে মাত্র ৬/৭ কোটি মানুষের জন্য বিদেশী সাহায্যের বেশিরভাগ মালই ভারতের কোলকাতা ও বিশাখা পাট্টম বন্দরে খালাস পেতো। আওয়ামী লীগের শাসন ও শোষণের ফলে ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর সফল বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ১৫ই আগষ্টের আগষ্ট বিপ্লবের নৈতিক বৈধতার প্রমান দেশবাসীর স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন। মুজিব সরকারের পতন ঘটেছে জানতে পেরে সমগ্র জাতি সেদিন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিপ্লবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে ঢাকার রাস্তায় লোকের ঢল নেমেছিল। জনগণ সারাদেশ জুড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলন স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে। মসজিদে , মন্দিরে , গির্জায় লোকজন সেদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের জন্য বিশেষ দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছিলেন। মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল মহল্লায় মহল্লায়।
সেই সময়ের দেশী বিদেশী খবরের মধ্যমেই তার প্রমান মিলে। শেখ মুজিব সরকারের স্পিকার মালেক উকিল লন্ডনে থাকাবস্থায় বলেছিলেন - বাংলাদেশ ফেরাউন মুক্ত হয়েছে।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিজয়কে আপামর দেশবাসী স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানায়।
ঐ দিনই জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন জনাব মোহাম্মদুল্লাহ। মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয় সেদিনই। মূলত এরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ ওবাকশালের সদস্য এবং নির্বাচিত সাংসদ।
মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ:
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী
ফনিভূষণ মজুমদার
মোঃ সোহরাব হোসেন
আব্দুল মান্নান
মনরঞ্জন ধর
আব্দুল মোমেন
আসাদুজ্জামান খান
ডঃ এ আর মল্লিক
ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী
প্রতিমন্ত্রীঃ
শাহ মোয়াজ্জম হোসেন
দেওয়ান ফরিদ গাজী
তাহের উদ্দিন ঠাকুর
অধ্যাপক নূরুল ইসলাম
নূরুল ইসলাম মঞ্জুর
কে এম ওবায়দুর রহমান
মোসলেম উদ্দিন খান
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল
সৈয়দ আলতাফ হোসেন
মোমিন উদ্দিন আহমদ
অভ্যুত্থানের ১২দিনের মাথায় জাপান, ইরান, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো ৩৯টি দেশের সাথে ভারতও মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
শেখ মুজিবের বাকশাল সরকারের ১৮জন মন্ত্রীর ১০জন এবং ৯জন প্রতিমন্ত্রীর ৮জনই খন্দকার মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন ১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবকে অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে।
১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে সম্পাদকীয়ের অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি: -
“দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে ১৫ই আগষ্ট শুক্রবার প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাবগম্ভীর অথচ অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানে খন্দোকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ যথা: বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনী প্রধানগণও নতুন সরকারের প্রতি তাদের অকুন্ঠ আনুগত্য জ্ঞাপন করিয়াছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিবর্তনের এক বিষাদময় পটভূমি রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা বোনের পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়। কিন্তু বিগত সাড়ে তিন বছরেরও উর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তব ক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার আশা আকাংখা রূপায়নে খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিতে আগাইয়া আসিতে হইয়াছে। তারও কারণ ছিল। পূর্ববর্তী শাসকচক্র সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়া সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসের গতিকে কোনদিন ক্ষমতা লিপ্সার বাধ দিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায় না। আজকের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমাদের দায়িত্ব অনেক। বাংলাদেশের এক মহা ক্রান্তিলগ্নে জননায়ক খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে তাহাকে সুসংহত করিতে হইলে জনগণের প্রতি অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সকলকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া যাইতে হইবে।”
সুত্র - ""অপ্রকাশিত সত্য"" নামে একটা বইয়ের কিছু অংশ।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লাগলো আপনাকে
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন