মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!

লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:১৫:৩৬ রাত



গত মাসে কয়েদিতে পদোন্নতি আমাকে দিয়েই শুরু হয়। আজ কয়েদির সংখ্যা আরও একজন বেড়ে দাঁড়ালো চারে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন কিছুক্ষণ আগে নিম্ন আদালত থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বোঝা নিয়ে কারাগারে ফিরলেন। দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন করার অভিযোগে মামলা চলছিল। জয়নাল ভাইয়ের ধারণা ছিল, দুর্বল চার্জশিট এবং উদ্ধারকৃত চাপাতি ও চাইনিজ কুড়ালের সঙ্গে তার কোনো সংস্রব না থাকায় তিনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। আজ সকালে রায় আনতে যাওয়ার সময়ও তাকে বেশ আশাবাদী মনে হচ্ছিল। বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার আশঙ্কা ছিল, তিনি সাজা পাবেনই। তবে জয়নাল ভাইকে কখনও হতাশ করতে মন চায়নি। কাল সন্ধ্যায় তিনি সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে চলমান দ্বিতীয় মামলাটি হাইকোর্টে ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংবাদটি দেয়ার সময় তার উজ্জ্বল চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সহসাই মুক্তির আশা করছেন। আজ বিকেলে সাজা নিয়ে ফিরে এসে আমাদের দুঃসংবাদ শোনানোর সময় চেষ্টাকৃত উচ্ছ্বাস তার অন্তরের বেদনাকে অন্তত আমার কাছে ঢেকে রাখতে পারেননি। মাত্র ক’দিন আগেই অভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি নিজেই হয়েছি। জয়নাল ভাইয়ের সাজার রায় শোনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তার স্ত্রী আজ আদালতে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেই কারণে আমাদের সামনে স্ত্রীর প্রতি ছদ্ম ক্ষোভ প্রকাশ তার ভালোবাসা ও উদ্বেগকেই বরং ফুটিয়ে তুলছিল। তিনি আদালতে রোরুদ্যমান স্ত্রীকে বলে এসেছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামের পথে সংগ্রাম করলে জেল-জুলুম সহ্য করতেই হবে। কান্নাকাটি করলে আদালতে না থেকে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।” এদিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা চলাকালীন মা এবং স্ত্রীকে সুপ্রিমকোর্টে আসতে নিষেধ করেছিলাম এবং তারা সেই অনুরোধ রক্ষাও করেছিলেন। যাই হোক, কালকের মধ্যেই হয়তো আমার মতো জয়নাল ভাইয়ের বুকেও কয়েদির নম্বর সেঁটে ছবি তুলতে জেল প্রশাসন অস্থির হয়ে উঠবে। অপমান হজম করে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারকে সেই ছবি তুলতেও হবে। নিত্যদিনের অপমানের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার নামই জেল-জীবন। ভাগ্য সহায় হলে হাইকোর্টে আপিল চলাকালীন সময়ের জন্য জয়নাল ভাইয়ের জামিন জুটে যেতে পারে। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস উত্সাহ দেখালে চেম্বারের পুলসেরাতে সেই জামিন আটকে দেয়াও কঠিন হবে না। সব মিলিয়ে তার মুক্তি যে অনেক দিন পিছিয়ে গেল, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। আসন্ন রাতের শেষ প্রহরে পাশের সেল থেকে ভেসে আসা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনের কান্নাভেজা কণ্ঠের ফরিয়াদ অন্য রাতের চেয়ে সম্ভবত জোরে এবং দীর্ঘক্ষণ শুনতে পাব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, তার পথই যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে মহান আল্লাহতায়ালা এক সময় তার ডাকে অবশ্যই সাড়া দেবেন। তবে সেই সময় কবে আসবে, সেটাও তো আল্লাহই নির্ধারণ করবেন।

গতকাল যা ধারণা করেছিলাম, তা-ই ঘটলো। আমার গোসল তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় দেখলাম জয়নাল ভাইয়ের সেলের সামনে জেলগেট থেকে কারারক্ষী এসে উপস্থিত। নতুন কয়েদি জয়নাল আবেদিনকে তখনই মহামহিম জেলার সাহেবকে দর্শন দিতে যেতে হবে। জেলের পরিভাষায় এই দর্শনের নাম ফাইল। সারারাত ইবাদত করে বেচারা ডাক আসার খানিকক্ষণ আগে মাত্র ঘুমিয়েছেন। উপায় নেই, জেলারের সমন বলে কথা! জয়নাল ভাই ফাইলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফিরে এসে জানালেন, ছবি তোলার পালা সাঙ্গ হয়েছে। কয়েদির একটা নতুন কার্ডও তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, নিম্ন আদালত মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেক্টর কমান্ডারকে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে। আদালতের নির্দেশানুযায়ী সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য সর্বনিম্ন শ্রেণীর শ্রমের যে ক্যাটাগরি জেল প্রশাসন নির্ধারণ করেছে, তার নাম ‘সেবক’। জেলে সেবকের কাজ হলো অন্যান্য কয়েদি, বিশেষ করে ডিভিশন কয়েদিদের ফাই-ফরমাস খাটা। বয়সের কারণে জয়নাল ভাইকে হয়তো সেবকের কাজ করতে হবে না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই জেল প্রশাসন একজন শিক্ষিত, সম্মানিত মানুষের উপযুক্ত কাজ যেমন, জেল গ্রন্থাগার দেখাশোনা করার দায়িত্ব প্রদান করতে পারতো। মনে হলো, সপাটে চড়টা আমার গালেই পড়লো। যত দ্রুত সম্ভব জয়নাল ভাইয়ের চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে আপন সেলের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিলাম। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ধিক, এই চেতনাধারীদের। এ দেশে ভণ্ডামির কি কোনো শেষ নেই? রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী?

একজন নির্যাতিত লেখকের কথা ( এখনো এই ২ জন কারাগারে বন্দী )

বিষয়: বিবিধ

১৬২৮ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

212478
২৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৪:৪১
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : ঠিক একিরকম লিখা পোষ্ট করতে গিয়ে এসবিতে ব্যান খাওয়ার দশা হয়েছিল । ধন্যবাদ আপনাকে । মাহমুদুর রহমানের ডায়েরী লেখা শেষ না হতেই আবার কারাবাস । আসলে জুলুমশাহী থেকে বাচতে আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করা ছাড়া গত্যান্তর নেই মনে হচ্ছে ।
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৬:২৮
160743
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : আমাদের উচিত এই সব কষ্টের কথা জাতির সামনে তুলে ধরা
212483
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৬:৫৯
দ্য স্লেভ লিখেছেন : চাপাতি তো সব বাড়িতেই থাকে,আর চাইনিজ কুড়াল তো কুরবানীর ঈদে মাংস কাটার জন্যেও ব্যবহার করা হয়...আমাদের গ্রামে অনেক বাড়িতে আছে।
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৮:২৭
160782
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : এর কারণে কি একজনের এত বড় সাজা। একজন মুক্তি যোদ্ধা , সেক্টর কমান্ডারের এই পরিনতি ? ভাবতে কষ্ট লাগে।
212505
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৯:১৩
কাঁচের বালি লিখেছেন : সত্য বাদী মানুষ গুলোকে কেন এতো কষ্ট পেতে হয় ? :(
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৬
160950
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : বাংলাদেশর কারাগারে এখন বহু সত্য নির্যাতিত হচ্ছে
212541
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:১২
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : বড়ই আফসোস!!!
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৬
160951
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : চেতনার বাস্থবায়ন হচ্ছে
212609
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৩৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : মাহমুদর রহমানের বইতে এই ঘটনাটি যারা পড়েছেন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারবেন এই সরকার এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কতবড় মিথ্যা।
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৭
160952
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : অল্প অল্প এই সব কথা গুলো সবাইকে জানানো আমাদের দায়িত্ব।
212611
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৪০
গ্যাঞ্জাম খানের খোলা চিঠি লিখেছেন : একজন মুক্তিযোদ্ধার যদি এ পরিনতি হয় তবে ভবিষ্যতে প্রিয় মাতৃভূমির কি ভয়াবহ পরিনতি মুখোমুখি হয় তা চিন্তা করে মাথায় গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি হয়ে যায়।
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৯
160956
মাহফুজ মুহন লিখেছেন : সত্যকে হত্যা করে তাবেদার করার পথে যারা , তাদের কারণেই আজ লাঞ্চিত হচ্ছে মানবতা , সত্য , স্বাধীনতা , পতাকা , মুক্তি যোদ্ধা। ২/১ জনের পূজা করতে পারলেই খাটি রাজাকার হয়ে যায় মুক্তি যোদ্ধা ,

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File