গিনেজ বুক , সাউথ সাউথ এওয়ার্ড এবং সমুদ্র বিজয়
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ মুহন ০৭ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪৫:২৮ রাত
মনে পড়ে সাউথ সাউথ এওয়ার্ড নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচারের পর ধরা খায় আওয়ামিলিগ। গিনেজ বুকের নামে ও আওয়ামীলীগের একই অবস্থা।
বিশাল অংকের টাকা ব্যায় করে সর্বাধিক মানুষ মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার রেকোর্ডটা হয় নাই বলেই গিনেস রেকোর্ড বুকে স্থান পায়নাই।
নিজেরাই গিনেস রেকর্ডের ওয়েব পেজে দেখুনঃ
http://www.guinnessworldrecords.com/records-4000/most-people-singing-a-nationalregional-anthem-simultaneously
সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড পাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অ্যাওয়ার্ড প্রদানকারী সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাউথ-সাউথ নিউজ থেকে ‘রিকগনিশন ক্রেস্ট’ নিয়েছেন। অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ২০১৩ সালের অ্যাওয়ার্ডের সঙ্গে শেখ হাসিনার প্রাপ্ত ক্রেস্টের কোনো সম্পর্কই নেই।
২০১৩ সালের সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ নাই।
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/2601/muhon/28171
শেখ হাসিনাকে সমুদ্র বিজয়ের সংবর্ধনার নামে ১০ কোটি টাকার এথলেটিক ট্রেক সম্পূর্ণ নষ্ট করা হয়েছিল। সমুদ্র বিজয় করেনি বাংলাদেশ। রায়ে হেরেছিল। তার পর ও ভুয়া মিথ্যা কাহিনী রচনা করে জাতির শত কোটি টাকা খরচ করে সমুদ্র বিজয়ের সংবর্ধনার নামে লুটপাট করা হয় ।
এবার আসি আসলে কি ছিল সমুদ্র বিজয়ের রায়ে -
জার্মানির হামবুর্গ শহরে স্থাপিত সমুদ্রসীমাবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (আইটিএলওএস) ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় প্রদান করেন। ১৫১ পৃষ্ঠাব্যাপী ৫০৬টি অনুচ্ছেদের এই রায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশের জয় হয়েছে বলে সংবাদ আসতে থাকে।
(১) সমুদ্রতটবর্তী দুটি পাশাপাশি দেশের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র (Territorial Sea) বিষয়ে বাংলাদেশ বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে সাগরসীমা নিয়ে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি আছে (অনুচ্ছেদ ৫৭, ৫৮)। মিয়ানমার এতে আপত্তি করে বলে (অনুচ্ছেদ ৬৫), ওই সমঝোতাগুলো ছিল জাহাজ চলাচলবিষয়ক, সীমানা নির্ধারণের চুক্তি নয়, বা ওই কাজ যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা হয়নি (অনুচ্ছেদ ৮৩)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানায় (অনুচ্ছেদ ৯২, ৯৩, ৯৮)। বাংলাদেশ ওই চুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নানা প্রমাণ দেখালেও (অনুচ্ছেদ ১০১, ১০২, ১০৩) মিয়ানমার তা অগ্রাহ্য করে (অনুচ্ছেদ ১০৭, ১০৮, ১০৯)। ট্রাইব্যুনালও বাংলাদেশের দাবি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি (অনুচ্ছেদ ১১৫, ১১৮, ১২৫)। মিয়ানমার বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তার স্থলসীমানার (নাফ নদ) ভেতরে পড়ে, তাই একে পৃথকভাবে দেখা হোক (অনুচ্ছেদ ১৩১, ১৩২)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তিকে মেনে নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে বাংলাদেশকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের অধিকারই প্রদান করেন (অনুচ্ছেদ ৩৩৭)। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রতটের দক্ষিণ সীমানা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ থেকে মূল ভূখণ্ডে টেকনাফের কাছে সরে আসে। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
(২) রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও সন্নিহিত এলাকাসহ এই এলাকা মহীসোপানের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলির মাধ্যমে এর সাগরতল গঠিত হয়েছে, যা দক্ষিণমুখী রাখাইন সমুদ্রের দিকে প্রাগ্রসরমান। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের মূল বিষয় ছিল এই যে, মিয়ানমার সমুদ্রতট থেকে সমদূরত্ব নীতির মাধ্যমে (ইইজেড) এলাকা নির্ধারণের কথা বলে। যাতে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। কারণ, তাতে বাংলাদেশ থেকে আসা পলির স্তরের ওপর মিয়ানমারের অধিকার বর্তায়। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের কাছে উভয় দেশের ইইজেড নির্ধারণের জন্য সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগের বিরোধিতা করে (অনুচ্ছেদ ২১৬)। কিন্তু মিয়ানমার সমদূরত্ব নীতি অবলম্বনের কথা বলে (অনুচ্ছেদ ২১৮, ২২৩)। ট্রাইব্যুনাল নাফ নদের মুখকে সমদূরত্ব রেখা শুরুর বিন্দু সাব্যস্ত করে (অনুচ্ছেদ ২৭২)। বাংলাদেশ UNCLOS II-এর ৭৬.১ ধারার পলিপাতন নীতি দাবি করলেও (অনুচ্ছেদ ২৭৬, ২৭৭) ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্বের নীতিই গ্রহণ করেন (অনুচ্ছেদ ২৯৩)। বাংলাদেশ বঙ্গীয় সমুদ্রে পলিপাতনের বিবরণ দিলে (অনুচ্ছেদ ৩২০) মিয়ানমার তার ওপর আপত্তি জানায় (অনুচ্ছেদ ৩২১)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের দেওয়া আপত্তি গ্রহণ করে বাংলাদেশের যুক্তি অগ্রাহ্য করে (অনুচ্ছেদ ৩২২)। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
(৩) ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করে যে সমদূরত্ব রেখাটি ২১৫০ আজিমুথ বরাবর প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশ কাট অব এফেক্টের সম্মুখীন হবে না (অনুচ্ছেদ ৩৩৪)। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের অবতল সমুদ্রতটের বিষয়টি বিবেচনায় এনে সমদূরত্ব রেখাটি ২১৫০ আজিমুথ বরাবর সরিয়ে উভয় দেশের তটবর্তী ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড এলাকা ভাগ করে দেয় (অনুচ্ছেদ ৩৪০)। এটি ছিল বাংলাদেশের বিজয়।
ট্রাইব্যুনাল সিএস নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হলে মিয়ানমার বলে, ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বেই উভয় দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে (অনুচ্ছেদ ৩৪৩)। বাংলাদেশ এর প্রতি আপত্তি জানায় (অনুচ্ছেদ ৩৫৪)। UNCLOS III-এর ৭৬ ধারার ৫ উপধারা অনুযায়ী, কোনো দেশের মহীসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। ৬ উপধারা অনুযায়ী, মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে, তবে পাশের দুই দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশ UNCLOS III-এর ৭৬.৫ ধারা অনুযায়ী Natural Prolongation-এর যুক্তি দিলে ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করে না (অনুচ্ছেদ ৪৩৫, ৪৩৮, ৪৪৮, ৪৫৫)। ট্রাইব্যুনাল বলে, বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সিএসের যে দাবি করে তা মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড এলাকা। যেহেতু দুই দেশের ইইজেড এলাকা একে অপরের ওপর পড়ছে না, সেহেতু ইইজেড ভাগাভাগির প্রশ্নই ওঠে না (অনুচ্ছেদ ৪৭১)। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্ব রেখাটিই ২১৫০ আজিমুথ বরাবর প্রলম্বিত করে উভয় দেশের সিএস চূড়ান্তভাবে ভাগ করে দেয় (অনুচ্ছেদ ৫০৫)। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
(৪)সমুদ্রসীমা নির্ধারণে Natural Prolongation নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে ১৫০ নটিক্যাল মাইল সিএসের বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়েছে। এই এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের DS-08-18, DS-08-22, DS-08-23, DS-08-26, DS-08-27, DS-08-28 ব্লক পুরোপুরি এবং DS-08-13, DS-08-17, DS-08-21, DS-08-25 ব্লক আংশিক হাতছাড়া হয়েছে। তা ছাড়া সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন অগভীর ১৮ নম্বর ব্লকটির কিছু এলাকাও হাতছাড়া হচ্ছে। এটি হলো বাংলাদেশের পরাজয়।
সমুদ্র বিজয় রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা -প্রফেসর ড: আব্দুর রব
বিশিষ্ট ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব বলেছেন, মায়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধের রায়, এ নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, সরকারী প্রচারনা নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন।
তার মতে, মায়ানমারের সাথে সমুদ্র বিজয়ের প্রচারনা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে বাংলাদেশ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের রায়ের প্রেক্ষিতে একটি পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।
প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক। তিনি এখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি। সাক্ষাতকারের পূর্ণ বিবরণী নিচে দেয়া হলো:
প্রশ্ন: সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা কী ভাবে শুরু হয়?
প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব : বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে এই ‘বিজয়’ নিয়ে কৃতিত্ব দখলের এক প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকার নির্লজ্জের মত ঘটনা কি ঘটেছে, বা এর ফলশ্রুতি কি হতে যাচ্ছে তা চিন্তা না করেই মিডিয়ায় এবং সংসদে অতি উৎসাহে নিজেদের পিট চুলকাতে শুরু করে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সনের পরে জিয়াউর রহমান শুরু করলে ভারত কানাডিয়ান সার্ভে জাহাজকে নৌবাহিনী দ্বারা তাড়া করে। পরে প্রেসিডেন্ট জিয়া দক্ষিণ তালপট্টির দিকে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে পাঠানোর উদ্যোগ নেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলের অধিকারের ব্যাপারে প্রথম যৌক্তিক ও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহীদ জিয়াউর রহমান। তাঁর শাসনকালে রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ. খানের নেতৃত্বে দ: তালপট্টি ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও সমুদ্র সম্পদ আহরণের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ঐ সময় NOAMI নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বঙ্গোপসাগরের উপর কয়েকটি গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিঁয়া (ঢা: বি, প্রফেসর ড: এম আই চৌধুরী (জা: বি, প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান (রা: বি এবং প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত (বুয়েট) এসব গবেষণা কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শহীদ কমোডর রাব্বানী এবং কমোডর খুরশেদ আলমও (বাংলাদেশ নৌবাহিনী) বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত গবেষণা ও আইনী তৎপরতায় বিশেষ অবদান রাখেন। কিন্তু মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী এ সর্বশেষ আলোচনা ও উদ্যোগ নেয়া হয় বিগত ২০০৮ সনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল কালাম মাহমুদ (কায়েস) কে এ বিষয়ের সেলের প্রধান করে কমোডর (অব মোহাম্মদ খুরশেদ আলমকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তখন থেকেই এ ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে মার্কিনী স্বার্থ থাকায় ঐ সময় থেকে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলীয় অঞ্চলের দাবী দাওয়া নিয়ে মামলা আন্তুর্জাতিক ফোরামে বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। ২০০৯ সনে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ঐ মামলা অব্যাহত থাকে এবং জনাব মাহমুদের পরিবর্তে কমোডর (অব খুরশেদ আলমকে চুক্তিভিত্তিক অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবীদাওয়া সংক্রান্ত আনক্লস সেল (UNCLOS CELL)-র নেতৃত্ব দেয়ার ভার অর্পণ করা হয়।
প্রশ্ন: মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার রায়ের ব্যাপারে সরকার বলছে, এটা বাংলাদেশের মহাবিজয় আর বিরোধী দল বলছে, পরাজয়। আসলে এতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কতটুকু?
প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব : মায়ানমারের সাথে সমুদ্র বিজয়ের প্রচারনা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশ তার অধিকার থেকে বঞ্জিত হয়েছে। ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির মাঝেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। বর্তমান রায়ের ফলে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ এবং ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার মিয়ানমার পাবে। আনুপাতিকভাবে এটা প্রায় ১ : ১.৫৪ হারে মিয়ানমারের অনুকূলে। এলাকা বণ্টনের পরিমাণ ও অনুপাতে পরাজয়টা বাংলাদেশের হয়েছে। এখন শুধুমাত্র মিয়ানমারের সাথে রায়ের ফলে একটি মাত্র রেখা টানা হয়েছে। পশ্চিমের রেখাতো ২০১৪ সালে টানা হবে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরই বুঝা যাবে কি পরিমাণ সমুদ্রসীমা এবং মহিসোপানে কতটুকু পাবে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রীয় সমুদ্র (Territorial Sea) বিষয়ে বাংলাদেশ দাবি করেছিল, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে সাগরসীমা নিয়ে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি আছে। মিয়ানমার এতে আপত্তি করে বলে, ওই সমঝোতাগুলো ছিল জাহাজ চলাচলবিষয়ক, সীমানা নির্ধারণের চুক্তি নয়। এই চুক্তি আর্ন্তজাতিক কনভেনসন অনুযায়ী হয়নি বলে ট্রাইব্যুনাল তা মানেনি।
বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মিয়ানমার তার দেশের নাফ নদের পলিপাতন অংশ হিসেবে তার স্থলসীমানার (নাফ নদ) ভেতরে পড়ে বিবেচনা করে একে সীমানা নির্ধারণের জন্য বিবেচনা না করে পৃথকভাবে দেখার জন্য দাবি করে। অথচ সেন্ট মার্টিন একটি প্রবাল দ্বীপ, যার সঙ্গে নদী বা পলিপাতনের কোনও সম্পর্কই নেই। বাংলাদেশ এই বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরতে না পারায় মিয়ানমারের দাবি মেনে নিয়ে ট্রাইবুনাল কর্তৃপক্ষ সমদূরত্ব নীতির শুরুর বিন্দু নাফ নদীর মুখে নির্ধারণ করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রতটের দক্ষিণ সীমানা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ থেকে মূল ভূখণ্ডে টেকনাফের কাছে সরে আসে। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল (উল্লেখ্য ১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের অধিকারই প্রদান করেন। এখানেই বাংলাদেশ হেরে যায়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর তার এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন (ইইজেড) হারিয়েছে। বাংলাদেশ উপকূলের সব অংশ থেকে ২০০ কিলোমিটার দুরত্বে বিশেষ অর্থনৈতিক সীমার অধিকার পায়নি। যেহেতু সেন্টমার্টিন আমাদের ভু-খন্ড তাহলে একে বেইস লাইন ধরা হল না কেন? এখানে ইক্যুইটি মানা হয়নি।
প্রশ্ন: রায়ের ফলে বাংলাদেশ কী পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব : বাংলাদেশের উপকূল অফসোর এবং ভারত ও মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকা ডিপ-সি। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে Natural Prolongation(প্রাকৃতিক পলিপাতন) নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে ১৫০ নটিক্যাল মাইল মহিসোপান বা কন্টিনেন্টাল শেলফ (সিএসে)-র বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়েছে। এই এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের ৬টি পুরোপুরি এবং ৪টি ব্লকের আংশিক হারিয়েছে। তা ছাড়া সেন্টমার্টিনসংলগ্ন অগভীর ১৮ নম্বর ব্লকটির কিছুসহ সমুদ্রে মোট ২২ হাজার ৪৯ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়েছে। বাংলাদেশের এই এলাকা হাতছাড়া হওয়ায় খনিজ সম্পদ থেকে বঞ্চিত হল। সমুদ্রে যাওয়ার পথ কমে গেল।
আবার পলিপাতন বিভাজন রেখার যুক্তিতে বাংলাদেশের মহীসোপানের দাবিটিও গ্রহণ করেনি আদালত। সমুদ্রসীমা আইনের ৫ ও ৬ নং উপধারা অনুযায়ী মহীসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। আবার মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে; তবে পার্শ্ববর্তী দু-দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না। এ যুক্তি তুলে ধরে বাংলাদেশ মহীসোপানের দাবি করলে মিয়ানমারের বিরোধিতায় আদালত তা গ্রহণ করেনি। ইটলসের এ রায়ের ফলে মিয়ানমারের দাবিকৃত উপকূলীয় সমুদ্রে বিপুল ভূমির আশাতিরিক্ত (আমাদের দাবির চেয়েও বেশি) সমুদ্র অঞ্চল লাভ করেছে।
বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা কর্তৃক ঘোষিত পেট্রোলিয়াম ব্লকগুলো জিও রেফারেন্স করলে দেখা যায় যে, আনক্লসের ধারা মেনে ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহীসোপান বিবেচনায় এনে পরবর্তী ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ব্লক নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে তার দাবি পেট্রোবাংলার মতো ভূ-প্রাকৃতিকভাবে না করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে করেছে এবং এই দাবিরেখা অনুযায়ী ২০০৮ সালে পেট্রোবাংলার ঘোষিত ৩টি পূর্ণ ব্লক এবং ৫টি ব্লকের অংশ বিশেষ মিলে মোট ১৪ হাজার ৭৪৪ দশমিক ১৪২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিজেদের দাবি হতে বাদ দিয়েছে।
বাংলাদেশ দল কেন এই কাজ করল তা বোধগম্য নয়। এখানে কোন সূদুর ষড়যন্ত্র রয়েছে। যেখানে ভারত সমুদ্রে মিয়ানমারের জন্য কিছু এলকা রেখে বাকি সম্পূর্ণ এলাকা তাদের দাবি করে আদালতে দাবি জানিয়েছে। সেখানে পেট্রোবাংলার জরিপ এবং নির্ধারণ করা এলাকা নিজ থেকে বাদ দিলো তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও অস্পষ্ট।
প্রশ্ন: মায়ানমারের সাথে রায়ের প্রভাব কী ভারতের সাথে বিরোধ সংক্রান্ত মামলার উপর পড়বে?
প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব : এখানে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটা সামনে আনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই ভারতের বিরোধের রায় কতটা আমাদের পক্ষে আসবে তা বুঝা মুস্কিল। ভারতের মামলার আরজিতে ’ল‘ অব ইক্যুটির স্থলে তাদের উপস্থাপিত ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল’ যা “সমদূরবর্তী নীতি” – সে গ্রহন করেছে। এখানে মন্তব্য, ভারত, মালদ্বীপ,শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিার (আন্দামান সাগরে) সাথে সমুদ্র -সীমা নির্ধারণে ঐ ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল’ ভিত্তি করে বিবাদ নিরসন করেছে। তাছাড়া ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি। নৌ-শক্তিতে অগ্রগণ্য। তাই ভারত মিয়ানমারের মত তার স্বার্থের বিপক্ষে যাওয়া রায় কিছুতেই মানবে বলে মনে হয় না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণীতে (বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের উপকূলে) বাংলাদেশকে একটি ক্রমবর্ধমান ব-দ্বীপীয় রাষ্ট্র হিসেবে উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণী হাড়িভাঙ্গা নদীর ‘মূল-মধ্যরেখা নীতি’ (Mid-channel Thalweg Doctrine) অনুসরনে ভারতের সঙ্গে নিস্পত্তিতে অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু এখন যদি ঐ একই ‘ইক্যুটি প্রিন্সিপল’ বা ন্যায়পরতার নীতির মাধ্যমে আবার ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয় তবে আবারও বাংলাদেশ ভারতের কাছে তার দাবীকৃত (যৌক্তিক) সমুদ্রঞ্চল (EEZ এবং C.S )- এর ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আর ভারত তার ইপ্সিত দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য তার শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার নূতন দ্বীপ দক্ষিণ তালপট্টিকে মানচিত্র থেকে নিঃশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
আর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ আরো বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইটলসের (ITLOS) রায়ে একজন বিচারপতি দ্বিমত প্রকাশ করে ৬৪ পৃষ্টার মতামত দিয়েছেন। ভারতের সাথে আইনী লড়াই এর জন্য আমাদেরকে সেগুলো সামনে রাখতে হবে। তা না হলে আমরা আবারো বঞ্চিত হবো।
বিষয়: বিবিধ
৩১১৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আওয়ামী লীগটা একটা মাকাল ফল!
মন্তব্য করতে লগইন করুন