ইংলিশ ফুটবলে মুসলিম খেলোয়াদের কান্ড!!!!
লিখেছেন লিখেছেন সান জোসেপ ০৭ জুলাই, ২০১৩, ১০:১৫:৪২ সকাল
ফুটবলে লাথি দিয়ে যারা বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে, তাদের চোখে ভেসে ওঠে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ-ইপিএল। আধুনিক ফুটবলে যতগুলো ঘরোয়া লিগ রয়েছে, তার মধ্যে এখনঅব্দি সবার শীর্ষে এই লিগ।
শুধু দর্শকপ্রিয়তা দিয়ে নয়, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সার্থকতা টেলিভিশন স্বত্ব ও আর্থিক মূল্যমানের দিক দিয়েও তারা শীর্ষে।
দুনিয়ার সেরা এই ইপিএলে একটা সময় মুসলিম খেলোয়াড় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমান সময়ের ইপিএলের চেহারা শুধু নয় পুরো ফুটবল বিশ্বের সংস্কৃতি পাল্টে দিচ্ছেন মুসলিম ফুটবলাররা।
ধর্মীয় বিশ্বাস-আচার সমুন্নত রেখে তারা ক্লাবের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। মাঠে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে বিজয় কিংবা গোলের উদযাপন এখন আইকন হয়ে গেছে। মুসলিম খেলোয়াড়দের ওই উদযাপন ভঙ্গির তালিম নিতে শুরু করেছে ইংলিশ দর্শকরা।
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মাঠে খেলার সময় গোল করার পর উদযাপনের জন্য শিশুরাও পড়ে যাচ্ছে সিজদায়। যদিও তারা জানে না এর মানে কি? এটা মুসলিম রীতি হলেও দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইংলিশ সংস্কৃতিতে।
‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ’ নামে ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ শুরুর সময় মুসলিম খেলোয়াড় ছিলো মাত্র একজন। টটেনহ্যাম হটস্পার্সের হয়ে খেলতেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার নাঈম। তবে এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের বিভিন্ন ক্লাবে ৪০ জন মুসলিম খেলোয়াড় রয়েছেন। আর এই মুসলিম খেলোয়াড়রাই পাল্টে দিচ্ছেন ইপিএলের সংস্কৃতি।
মুসলিম খেলোয়াড়রা বেশ কিছুদিন আগে থেকে খেলে আসলেও তাদের গোল উদযাপন ছিল একেক রকম। তবে প্রিমিয়ার লিগের সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। সেন্ট জেমস পার্কে চলছিল নিউক্যাসল ইউনাইটেড বনাম অ্যাস্টন ভিলার ম্যাচ। ওই ম্যাচের একটি গোল উদযাপনের ভঙ্গিই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক।
খেলার ৩০ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেডের হয়ে গোল করেন সেনেগালের মুসলিম খেলোয়াড় ডেম্বা বা। তিনি গোল উদযাপনের জন্য দৌড়ে চলে যান কর্নার পতাকার কাছে। যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার স্বদেশী আরেক খেলোয়াড় পাপিস সিসে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুই সতীর্থ গোল উদযাপনে সিজদায় পড়ে যান। সেই থেকে ওই সিজদাই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক। লিগে খেলা প্রত্যেক মুসলিম খেলোয়াড়ই এখন ওই প্রতীক ব্যবহার করছেন।
শুধু প্রিমিয়ার লিগেই নয়, মুসলিম সংস্কৃতির ওই প্রতীককে মুসলিম খেলোয়াড়রা এখন আন্তর্জাতিকীকরণ করে ফেলেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে প্রায় দেড় শতাধিক মুসলিম খেলোয়াড় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলছেন, তারাও তাদের ক্লাবের উৎসবে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছেন।
ফুটবল বিশ্ব নতুন প্রতিভা খুঁজতে যে জাল ফেলেছে, তার মধ্যে ইংলিশি প্রিমিয়ার লিগে জালটাই বোধ হয় বেশি শক্ত। আফ্রিকার মতো অনগ্রসর মহাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণরাও প্রিমিয়ার লিগে এসে হয়ে উঠছেন মহারতারকা। তবে অনগ্রসর আফ্রিকানদের তারকা হওয়ার আরেকটি জায়গা প্যারিসও।
ইংলিশ ক্লাবে খেলে তারা অনেক অর্থ এবং খ্যাতি পান। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কারণ যে সংস্কৃতি তাদের পথ দেখায়, স্বস্তি এবং শক্তি দেয় তা হলো তাদের ইসলামের প্রতি বিশ্বাস।
ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ক্লাব পরিবর্তনের সময় অনেক খেলোয়াড়ই তাদের ধর্মের জায়গাটা পরিষ্কার করে নেন। যেমন ডেম্বা বা, তিনি এ বছরই নিউক্যাসল ছেড়ে চেলসিতে যোগ দিয়েছেন। ক্লাব পরিবর্তনের সময় চেলসিকে সাফ বলে দেন, ‘আমি আমার ধর্মের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। ক্লাব তার সে কথা মেনে নিয়ে তাকে ধর্মের স্বাধীনতা দিয়েছে।’
মুসলিম খেলোয়াড়দের দাবির মতোই প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো তাদের মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য হালাল খাবারের ব্যবস্থা করে। দলের অন্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা, ভিন্ন গোসলখানা ও প্রার্থনার জন্য তাদের সুযোগ করে দেয়।
প্রিমিয়ার লিগে যিনি ম্যাচ সেরা হন, রীতি অনুযায়ী তাকে এক বোতল স্যাম্পেইন দেয়া হয়। ইসলামে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ, তাই মুসলিম খেলোয়াড়রা সেটি নেন না। যেমন ম্যাচ সেরা হয়েও বিনয়ের সঙ্গে স্যাম্পেইনের বোতল নিতে অস্বীকার করেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির আইভরিকোস্টের মিড-ফিল্ডার ইয়া ইয়া তোরে। সে সময় লিগ কর্তৃপক্ষ নোটিস জারি করলেও পড়ে তার পরিবর্তন করে।
এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো খেলোয়াড় স্যাম্পেইন নিতে না চাইলে তাদের জন্য ছোট ট্রফির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২০১২ সালে লিভারপুল যখন লিগ কাপ শিরোপা জিতেছিল, তখন তাদের খেলোয়াড়রা একটি স্যাম্পেইন কোম্পানির পোশাক পরেছিল এবং প্রত্যেক খেলোয়াড় মাঠেই তাদের পোশাক পরিবর্তন করেন। কিন্তু মুসলিম খেলোয়াড়রা ডেসিং রুমে গিয়ে তাদের পোশাক পরিবর্তন করেছিলেন।
তবে এসব মুসলিম খেলোয়াড়দের নিয়ে দল এবং কোচিং স্টাফরা কিছুটা সমস্যায় সম্মুখীন হন রমজানে। একজন খেলোয়াড় কি প্রায় ১৮ ঘণ্টা কিছুই না খেয়ে ৯০ মিনিট পূর্ণ পারফর্ম করতে পারে?
এখানেও একটা উপায় বের করে নিয়েছেন মুসলিম খেলোয়াড়রা। তাদের কেউ কেউ ট্রেনিংটা আগেই সেরে নেন। আবার কেউ কেউ ম্যাচের দিন ট্রেনিং করেন না। আবার কেউ রাতের বেলায় সেরে নেন অথবা শুধু ম্যাচের দিন রোজা রাখেন না। ক্লাবগুলোও তাদের এসব ব্যাপারে অনেক স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। তবে এর মধ্যেও মাঝে মধ্যে কিছুটা অসুবিধায় পড়েন কোচ।
খেলা নয় ধর্মকেই আগে রাখছেন এইসব খেলোয়াড়রা। আর্সেনাল মিডফিল্ডার আবু দিয়াবি বলেন, ‘আমার কাছে আর্সেনালের অগ্রাধিকার আছে। তবে সেটা এক নম্বর নয়। কারণ তারা এটা জানে, এই সময়টা (রমজান) আমার কাছে খুবই স্পেশাল। সুতরাং তারা এর মধ্যে দিয়েই আমাকে সেরাভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে।’
২৮ বছর বয়সী বা বলেন, ‘রমজান নিয়ে কোচের সঙ্গে আমার কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আমার জায়গায় আমি অনড়।’ তিনি বলেন, ‘কোচ সব সময় আমার ওপর খুশি হন না। কিন্তু আমি তাকে বলি, আমি এটা করব। আর এটি করলে আমার পারফর্মেন্স ভালো হবে। যদি পারফর্মেন্স ভালো না হয়, আপনি আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখবেন। তাতে আমার অসুবিধা নেই। তবে এটা আমাকে করতেই হবে।’
তবে এবারের রমজান ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষের জন্য সুখবর বয়ে এনেছে। লিগ শুরুর ১০ দিন আগে রোজা শেষ হয়ে যাবে।
মুসলিম খেলোয়াড়দের নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েছে বিভিন্ন স্পন্সর কোম্পানি। কারণ তাদের জার্সি চড়াতে চান না অনেক মুসলিম খেলোয়াড়। কারণ এই কোম্পানি মুসলিম বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামিক রীতির সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠানের জার্সি সাংঘর্ষিক, সেই জার্সি পড়তে রাজি হন না মুসলিম খেলোয়াড়রা।
গত মাসে নিউক্যাসলের স্পন্সর কোম্পানি ওনগার সঙ্গে কথা বলেছেন সিসে। কারণ তিনি খুবই চিন্তিত যে, ওই কোম্পানিকে প্রমোট করতে গিয়ে তার ইসলামিক বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। উইগান ও ওয়েস্টব্রুমের দুই মুসলিম খেলোয়াড়ও তাদের ক্লাবকে বলে দিয়েছেন, ক্লাবের পছন্দকৃত স্পন্সরের কারণে যাতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আক্রান্ত না হয়।
উইগানের কুয়েতি গোলরক্ষক আলী আল-হাসবি বলেন, ‘আমরা এখানে ফুটবল খেলতে এসেছি, এটা আমাদের চাকরি। তাই চাকরির জন্য যেন আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।’
আর এতোসব ভেবে প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষও কিছু একটা করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। হয়তো অচিরেই এ বিষয়ে একটি পথ বেরিয়ে আসবে। যেখানে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান মুসলিম খেলোয়াড়দের নিয়ে বিকল্প চিন্তা করবে।
তবে সবচেয়ে আশার দিক, ধর্মীয় অনুসরণ মেনে ক্লাবের অন্যদের সঙ্গে বিজয় কিংবা গোলের উদযাপন। মাঠে আল্লার উদ্দেশে সিজদায় পড়ে যাওয়া ভঙ্গির তালিম নিতে শুরু করেছে ইংলিশ দর্শকরা। বিশেষ করে খেলা দেখতে যাওয়া শিশুরা। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মাঠে খেলার সময় এখন গোল করার পর তারাও সিজদা দিচ্ছে। অথচ তারা জানে না এটির অর্থ কি? হয়তো মুসলিম প্রিয় খেলোয়াড়ের এই ভঙ্গি রীতি অনুসরণ করতে করতে এখন সবার বেলাতেই এই সিজদা রীতি দিচ্ছে শিশুরা। এটা মুসলিম রীতি হলেও দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং ইংলিশ ফুটবল সংস্কৃতির পালে নতুন হাওয়া লাগিয়েছে।
সুত্রঃ আর টি এন এন
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন