যেখানে শুধু মানুষ গড়া হয় না - জ্যান্ত মানুষ কাঁটাও হয়
লিখেছেন লিখেছেন রফছান খান ০২ মে, ২০১৫, ০৭:৩৬:২৩ সন্ধ্যা
চাকসু থেকে জিরো পয়েন্ট এসে রিক্সা থেকে নামতেই আবিষ্কার করলাম একদল ছেলে অকথ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে ষ্টেশন থেকে শাহজালাল হলের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবলাম, হয়ত হলে মারামারি বেধেছে এজন্য সবাই ওদিকে ছুটছে। নিশ্চিত মনে ষ্টেশন রোডে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে পুলিশ এদিকে এসে অবস্থান নিয়েছে।
দুই মিনিট পর শাহজালাল হলের দিক থেকে হটাৎ চিৎকার আসতে লাগলো। দেখলাম কয়েকদল ছেলে হাতে রাম দা, রড, লাঠি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চিৎকার করে কাউকে খুঁজতে লাগলো। বুঝতে পারলাম হাতে থাকা জিনিসগুলো আনতে দৌড়িয়ে হলে গিয়েছিলো। পুলিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাঁশী দিতে লাগলো। আর সাধারণ ছেলেমেয়েরা এদিকে ওদিকে পাগলের মত দৌড়িয়ে জায়গা করে নিল। স্পটে এখন শুধুমাত্র পুলিশ আর তারা। আর আমাদের মত উৎসুক জনতারা একপাশে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
হন্য হয়ে তারা খুঁজে চলেছে। সিপি রেস্টুরেন্টের দিকে একটা বন্ধ দোকানে হটাৎ হামলা চালালো কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলো না। তালা ভাঙার চেষ্টা করা হল এমনসময় কেউ মনে হয় বের হল। রামদা গুলো উপরে উঠে এলো। উত্তেজনাকর চিৎকার দিতে লাগলো। পুলিশ এগিয়ে আসলো। কিছু একটা হচ্ছে ওদিকে। ভয়ে পাথর হয়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে। একজন পুলিশ কনস্টেবল বন্দুক তাক করলো 'খবরদার খবরদার' বলে চিৎকার করতে করতে। তখন টার্গেট সরে গিয়ে সেই পুলিশ কনস্টেবলকে ধমকাতে লাগলো। বেচারা মুষড়ে পড়লো।
আড়াইটার শাটল ট্রেন তখনো দাঁড়িয়ে। সময় দেখলাম ২টা বেজে ২৮ মিনিট। ট্রেন ছাড়তে আরো ২মিনিট বাকি। ভর্তি ট্রেনের দরজা,ছাদ সবখানে শিক্ষার্থীরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে স্পটের দিকে। মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম আল্লাহ্ যেন দ্রুত ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। কোনভাবে ট্রেন আটকালে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এখানে আটকা পড়বে। এর মধ্যে একটা দল চিল্লায়ে উঠলো 'ট্রেন ট্রেন' বলে। অস্ত্রগুলো উঁচু করে তারা এগিয়ে চললো ট্রেনের ইঞ্জিনের দিকে। বগির দরজা গেড়ে বসে থাকা ছেলে মেয়েগুলোর চেহারা মুহুর্তে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। দেখে মনে হতে লাগলো ওরা যদি এখনি ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে উড়াল দিতে পারতো তবে হয়ত প্রাণে বেঁচে যেত। ততক্ষণে ট্রেনের ইঞ্জিন গর্জে উঠেছে। ইঞ্জিন পর্যন্ত দৌড়িয়ে পৌঁছানোর আগেই ট্রেন নাগালের বাইরে চলে গেলো।
যাক বাঁচা গেল ! ভাবলাম মনে মনে।
মূলগেট থেকে পরপর তিনটা টিচার বাস বেরিয়ে এলো। রাস্তার উপর কিছুটা ভীড় থাকায় বাসগুলো দ্রুত চলতে পারছিল না। খেয়াল করলাম কয়েকজন শিক্ষক চেঁচিয়ে ড্রাইভারদের উদ্দেশ্যে বলছেন 'দ্রুত যাও - দ্রুত চালাও'। মনে হত লাগলো শিক্ষকগণ তাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে পারলেই যেন এখনকার মত বাঁচতে পারবেন। এমন সময় আবিষ্কার করলাম আমি আর আমার বন্ধু রাস্তার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার চারিপাশেই রামদা হাতে ছেলেরা টহল দিচ্ছে। আমার ১ গজ দূরে একটি ছেলে বসে রামদার হাতলের উপর ভর করে দুহাত রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে। দু গজ সামনে একজনের মাথায় অন্যজন পানি ঢালছে। বুঝলাম রাগের সময় মাথায় পানি ঢাললে রাগ কমে যায়, মাথা ঠাণ্ডা হয়। তাই আল্লাহর কাছে আবার দোয়া করলাম 'আল্লাহ তুমি বৃষ্টি দাও যেন সবার মাথায় পানি লেগে মাথা ঠান্ডা হয় আর পরিস্থিতি শান্ত হয়'।
একটু দূরে এগিয়ে এলাম। আমাদের ভিতরে ভয় আর উৎসুক দুটায় কাজ করছিল। মূল ফটক আর সিপি রেস্টুরেন্টের মাঝের জায়গাটুকুতে এখন তারা আর পুলিশ ছাড়া কেউ নেই। ফ্যাকাল্টির দিক থেকে একটা সি.এন.জি এসে থামলো। প্রথমে একটা মেয়ে নামলো। দেখে মনে হল ফোর্থ ইয়ার বা মাস্টার্সে পড়ে থাকবেন। পর পর কজন ছেলে নামলো। হটাৎ দূর থেকে কজন তাদের অস্ত্র উঁচু করে 'ধর-ধর,মার-মার' বলতে বলতে সি.এন.জির দিকে দৌড়ালো। যে যেদিকে পারলো ছুটে গেলো। মেয়েটা মউর দোকানের দিকে দৌড়াচ্ছিল। তার পাশেই দুটি ছেলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। এদেরকে তাড়া করলো দৌড়ে যাওয়া দলটি। কিছুক্ষণের জন্য চোখে ভ্রম লাগলো আমার। মেয়েটিকে তাড়া করছে না তো !! যতটুকু বুঝলাম উনি আতংকের মধ্যে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছেন। এমন বিপদে ক্যাম্পাসে কি যে অসহায়ভাবে প্রাণের মায়া নিয়ে দৌড়ায় আমাদের এই বোনেরা যে না দেখলে বুঝে উঠা যাবে না। সারাজীবনে এই আতংক মনে আসলেই ভয় তাদের কাঁপিয়ে দিবে নিশ্চিত। ওদিকে বেশ হয়হুল্লোড় চলছিল। ঠিকমত দেখতে পারছিলাম না। মিনিট খানিক পর শান্ত হল। পুলিশ গিয়ে দুটা ছেলে বের করে আনলো। রক্তে ভিজে গেছে সারা শরীর। হাতে মাথায় কাটা দাগ। চামড়া পৃথক হয়ে গিয়েছে। একজন খুব কাতরাচ্ছিল। সি.এন.জি করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হল তাদের।
আমার পাশে কে যেন বলল 'এই বুচা জংধরা দা দিয়ে কুপালে জান বাঁচে ? ' শুনে আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম 'শুধুমাত্র চামড় কেটেছে। আর ধারালো অস্ত্র হলে হাড় মাংস কেটে পৃথক হয়ে যেত'। আবার ফটক থেকে আওয়াজ এলো। দেখলাম একটা ছেলে ব্যাগ হাতে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। আর তার পিছে দশ/পনেরজন ছেলে দেশীয় অস্ত্র হাতে মারতে উদ্যত। প্রাণ বাঁচাতে ছেলেটি বেশ এগোয়ে গেল কিন্তু বয়স কম টাইপের একটা ছেলে রামদা হাতে এতটাই কাছে এগিয়ে গেল যে কোপ দিলেই আঘাত লাগবে। রামদা উপরে উঠানো ছিল, যেন মেরেই দিবে। ততক্ষণে সামনে থেকে মুরব্বি করে একজন পুলিশ কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে থামাতে পারলো। পুলিশকেও বড় অসহায় মনে হচ্ছিল এখানে। অনেকে বলছিল চবির ফাঁড়ি পরিদর্শককে আঘাত করা হয়েছে। আসলে অস্ত্রধারী সবাইকে দেখে এমন মনে হচ্ছিল যেন সামনে যাকে পাবে তাকেই মেরে বসবে।
শহরে জরুরী মিটিং ছিল। ডেমু ট্রেন দেরী করাতে বন্ধুকে নিয়ে বাসের উদ্দেশ্যে ১ নম্বর গেটের দিকে রওনা হলাম। শহরে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে। ১০ জন আহত হয়েছে। কালেরকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ভাই এর মোবাইল ভেঙে ফেলা হয়েছে, তাকে আঘাত করা হয়েছে। রাত ৮ টার ট্রেনে শহর থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলাম। ফতেহাবাদের কাছাকাছি এসে ট্রেন থামার জন্য কিছুটা ধীর গতিতে এলো। হটাৎ সামনের বগিগুলোর দিক থেকে ঠুন-ঠান আওয়াজ আসছিল, অনেকে চিৎকার করছিল 'সবাই নিচে বসে যান, মাথা নিচেই মিশিয়ে রাখুন'। আমার এমন অভিজ্ঞাতা এই প্রথম। এমনিতেই দুপুর থেকে আতংকে আছি। তার উপর এখন এই অবস্থা। ভয়ে মুষড়ে পড়েছিলাম। তবুও সাহসের পরিচয় না দিলেই নয় ! সীটের নীচে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্টাটাস লিখলাম 'খুব আতংকে আছি পাথর মারা হচ্ছে, আল্লাহ্ ভরসা'। ঠুনঠান আওয়াজ ৪/৫ মিনিট ধরে চললো। একটা মেয়ে কান্না করছিল। আমার বগিটা ফ্যামিলি হওয়াতে পাথরগুলো মাঝে এসে পড়ছিল। একজন শিক্ষক তার স্ত্রী আর তিন বছরের কন্যা নিয়ে এক কোনায় বসে ছিলেন। কন্যার মা আতংকে শুকনো গলায় বারবার বলছিলেন 'ভাই আমার মেয়ে, ও ভাই আমার মেয়ে' এক পর্যায়ে কেঁদে দিলেন। সে এক করুণ দৃশ্যরে ভাই ! মেয়েকে কোলে করে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। তখনো সেই শিক্ষক কোন শব্দ করেননি, একটা কথাও বলেননি । একদম নির্বাক ! নিশ্চুপ !
উপরের কথাগুলো বাংলা সিনেমার কোন চিত্র নয়।কিংবা তামিল মুভির কোন একশন দৃশ্যও নয়। গতকাল আমার প্রিয় মমতাময়ী ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কিছু সময়ের ছবি। আমাদের কাছে এ অসাধারণ কিছু নয়। কেননা বছরে এমন মহড়া আর সংঘর্ষ অনেকবারই হয়, বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্য ঘটনা এসব।
ফ্রেন্ডলিস্টে একজন ইন্দোনেশিয়ান বন্ধু আছে। জাভা ইউনিভার্সিটিতে ক্যামেস্ট্রিতে পড়ছে। সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে ফেসবুকে বসে। এত কম সময় কেন ফেসবুকে দেয় জিজ্ঞাসা করতে সে যা বলেছিল তাতে বুঝলাম, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাশগুলিতে এত পরিমাণ হোম টাস্ক, এসাইনমেন্ট, রিসার্চ আর প্রবন্ধ, প্লট তৈরি করতে দেওয়া হয় যে দিনের মধ্যে নিজের প্রয়োজনীয় কাজের বাইরে অন্য কোন সময় তারা বের করতে পারে না। ফাঁকি দিলেই ক্রেডিট লস। এমনকি অসুস্থ হলে চিকিৎসার সময়টুকু পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টের কন্ট্রোলে চলে। যেটুকু আড্ডা হয় তাও সেই পড়াশোনার টপিক আলোচনার ফাঁকে। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর সকল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীক্ষার্থীদের রাজনীতি করার মত অবকাশ দেওয়া হয় না। হয়ত আরো অনেক কারন থাকতে পারে কিন্তু এটাও একটা কারন যে আমাদের প্রচুর অবকাশ রয়েছে। অলস সময় কাটাতে আর যা ইচ্ছা তাই পূরণ করতে 'রাজনীতি'র মত মহৎ আর পাওয়ারফুল মাধ্যম তো আছেই !!
আমার কোন কাজিন বা বন্ধু পারলে এই লেখাটি আমার মা-বাবা কে পড়ে শুনাইয়ো। তাহলে তারা যখন গর্ব ভরে অন্যের কাছে নিজের ছেলের কথা বলে তখন বলতে পারবে 'জানেন মশাই, আমার ছেলে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যেখানে শুধু মানুষ গড়া হয় না - জ্যান্ত মানুষ কাঁটাও হয়'।
বিষয়: বিবিধ
১১৭৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন