সেলিনার গল্প
লিখেছেন লিখেছেন রফছান খান ১৯ জুলাই, ২০১৪, ০৩:১৬:৫১ রাত
গেটের সামনে গাড়ির হর্ণ শুনেই সেলিনার অন্তর কেঁপে উঠল ।
আজ বেশ কয়েকদিন যাবত মাহবুব সাহেব দুপুর ১২ টায় বাসায় চলে আসেন, এরপর লাঞ্চ করে আর অফিসে যান না । কদিন আগেও অবশ্য এ নিয়ম ছিল না । মাহবুব সাহেব আর তার স্ত্রী দুজনেই সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বের হন, সাথে থাকে একমাত্র ছেলে নাহিদ । নাহিদকে কিন্ডার গার্ডেনে রেখে স্বামী-স্ত্রী অফিসের দিকে রওনা হন । স্বামী স্ত্রী দুজনেই ব্যাংকার হলেও অফিস আলাদা আলাদা । মাহবুব সাহেব আছেন একটা সরকারী ব্যাংকে আর মিসেস মাহবুব আছেন বেসরকারী ব্যাংকে । প্রতিদিন দুপুর দুটায় ড্রাইভার নাহিদকে স্কুল থেকে বাসায় এনে মাহবুব সাহেব কে আনতে যায় । মাহবুব সাহেব বাসায় আসেন বিকাল চারটার দিকে আর মিসেস মাহবুব সন্ধ্যায় ।
গেল ঈদে দুঃসম্পর্কের এক ফুফু সেলিনার বড় ভাইকে বুঝায়েছিল “একটা মাত্র বোন তোদের সারাদিন বাড়ি বসে থাকে আর তোগের বৌদের গা জ্বালা কথা শুনে বেড়ায়, তার চেয়ে আমার কাছে দিয়ে দে ভালো একটা বাসায় কাজ ঠিক করে দিবো । ভালো কাপড় পাবে, খাইতে পারবে, কিছু টাকাও পাবে।”
আসার সময় সেলিনা কোন কথা বলিনি । বাবা মা মারা যাওয়ার পর দুই ভাইয়ের সাথেই রয়েছে সে, তাদের বৌ রয়েছে, ছোট দুটা ছেলে রয়েছে, সামান্য ভ্যান চালিয়ে কত টাকা আর আয় হয় । ১৩ বছর বয়স হলেও নিজেকে যেন বুঝ দিতে পারে সেলিনা।
সেলিনা ঢাকায় এসেছে দুই মাস হল মাত্র । ভালো আছে কি খারাপ আছে এটা সে বুঝে উঠতে পারে না তেমন । গ্রামেও তো কত কষ্টেই ছিল । মা মরে যাওয়ার পর থেকে সারাদিন বড় দুই ভাবীর নানারকম খুটা শুনতে হত । এখানে আসার পর প্রতি সন্ধ্যায় যখন এটা ওটা নিয়ে নানা রকম বকাঝকা শুনতে হয় তখনো ওঁর তেমন বেশী কষ্ট হয় না । সাহেব আর ম্যাডামের বকাঝকা তার ভাবী দুজনার থেকে বেশী না , ভাবিদের মত গালি দেয় না, খুটা দেয় না ।
কিন্তু আজ দুদিন সেলিনার মনে কেমন যেন ভয় কাজ করছে । সাহেবের গলার আওয়াজ, পায়ের আওয়াজ কিংবা গাড়ির আওয়াজ ওর বুকে কেমন ঢোল পেটায়, হাত-পা ঠান্ডা করে দেয় । সেদিন খুব ঝড় বৃষ্টির রাতে মাহবুব সাহেব রাত করে বাসায় ফিরেন । নাহিদ তার মায়ের সাথে ঘুমায়ে ছিল । সেলিনা মাহবুব সাহেবকে খাবার দেয় । মাহবুব সাহেব খাবার খেয়ে বেড রুমে যাওয়ার পর সেলিনা ডাইনিং রুমের বাম কোনায় নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে । বেশকিছুক্ষণ বাদে সেলিনা টের পায় তার ঘরে লাইট জ্বলে উঠেছে আর কি যেন একটা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে ।
সেলিনা সেদিন ধড়ফড় করে উঠে বসে যাওয়ার পর মাহবুব সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার ফিরে চলে যান। কিন্তু এরপর দিন থেকে তিনি দুপুর ১২ টায় বাসায় চলে আসেন, সেলিনাকে নানা অজুহাতে কাছে ডাকেন, কখনো ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান । এসে শুধু জিজ্ঞাসা করেন সেলিনা কি করিস ? সেলিনা কেমন মুষড়ে দু-এক কথায় জবাব দেয় । আজও মাহবুব সাহেব ১২ টার পরপরই ফিরেছেন । বাসার দরজা খোলার পর কোনদিক না তাকিয়েই তিনি রুমে গিয়েছেন । সেলিনা যেন আশ্বাস পাচ্ছিল সাহেব আজ তাকে ডাকবে না । কেন যেন সবসময় ভয় হয় ওর, কিসের ভয় ঠিক নির্দিষ্ট করতে না পারলেও উঠতি বয়সে পা রেখে সেলিনা যেন কিছু একটা বুঝতে পারে । সাহেব থেকে দুরে দুরে থাকতে চায় ।
মাহবুব সাহেব আজও সেলিনাকে ডাক দিলেন কিন্তু আজ আর রান্নাঘরের দিকে আসলেন না । তার ঘরে বসেই ডাকতে থাকলেন । সেলিনা গায়ের কাপড়টা ঠিক করে দুরুদুরু মনে মাহবুব সাহেবের ঘরে গেলো । মাহবুব সাহেব সেলিনার দিকে এগিয়ে এসে সেলিনার ডান হাতটা শক্ত করে ধরলেন।
তারপর, খালুজান আমায় ছেড়ে দিন খালুজান ! আপনার পায়ে ধরি খালুজান, দোহায় লাগে আপনার আমাকে ছেড়ে দিন! অস্পষ্ট এই চিৎকারে মাহবুব সাহেবের নির্জন বাসা যেন হাহাকার করে উঠল ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন