‘ প্রিয় মা ’
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাবিত ০৭ মার্চ, ২০১৩, ১০:৩৮:৪২ রাত
পৃথিবীর এক কোনে জম্ম নেয়া মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি জগত সম্পর্কে কতটুকুই জানতে পারে। তাই তো অল্লাহতা’য়ালা পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ ( স: ) এর মাধ্যমে মানব জাতিকে সৃষ্টির সুচনা ,মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, মানুষের দায়দায়িত্ব- করনীয়- জবাবদিহিতা ইত্যাদি মানব জীবনের সকল বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রিয় নবীজি অনেক অনেক বেশী জেনেছেন যা অন্য কোন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আল্লাহতা’য়ালা এবং রাসুল ( স: ) কে অনুসরন করে চলা প্রত্যেক মানুষের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আল্লাহর পথে নিজকে গড়তে হলে মা’ প্রত্যেক মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপুর্ন অধ্যায়। এই অধ্যায়ের প্রশ্নপত্রের সঠিক উত্তর দিতে না পারলে দুয়িায় ও আখেরাতের জীবনে অনেক সমষ্যায় পড়তে হবে।আল্লাহতা’য়ালা বলেছেন, মা-বাপের সাথে উহ’ শব্দ টুকুও বলা যাবে না। রাসুল ( স: ) বলেছেন, মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশেত। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে মা’ এর শরয়ী মর্যাদা রয়েছে। আশা করি পাঠক এগুলো দেখে নেবেন। আল্লাহর রাসুল ( স: ) মায়ের সংগে মদীনায় বেড়াতে গিয়ে আব্বার কবর জিয়ারত শেষে মক্কায় ফিরে আসার পথে মা আমেনা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু নবী দাসীকে নিয়ে দাদা আবদুল মোতালেবের গৃহে ফিরে এলেন। সে দিন আমার নবীজির মনে কত ব্যথা ছিল।
আমি একদিন অসহায় ছিলাম। মা’ আমার খাওয়া, ঘুম, অসুখ-বিসুখ, নিরাপত্তা সবই
দেখেছেন। আমি কথা বলতে পারতাম না, হাঁটতে পারতাম না। মা’ আল্লাহর সৃষ্টির এক অপুর্ব নিয়ামত। সন্তানের জন্য এমন দরদী পৃথিবীর বুকে আর কেহই নাই। অনেকে বউয়ের কথায় কান দিয়ে মনে করেন আমার মা’ আমার চেয়ে উমুক ভাই বা বোনকে বেশী ভালবাসেন। এই ভাবনা মোটেই ঠিক নহে। মা’ সকল সন্তানদের জন্যই বুকে দরদ রাখেন। যাদের মা-বাবা দুনিয়া ছেড়ে গেছেন তারা বুঝতে পারবেন আল্লাহর সৃষ্টির এই মোজেজা। আমার বাবা যে দিন চলে গেলেন আমি সে দিন বুঝতে পেরেছে এই রহস্য। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি “ আল্লাহ মায়ের খেদমত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দাও।” আমার মা গ্রামে থাকেন। ঢাকা বেড়াতে আসেন কিন্তু দীর্ঘ সময় থাকতে চান না। গ্রামে আলো বাতাস পরিবেশ মায়ের খুব ভাল লাগে। গত মে-২০১২ মাসে হঠাৎ আমার সহধর্মিনী সাঈদা দুনিয়া ছেড়ে গেলেন। খবর পাওয়ার সাথে সাথে মা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ঢাকা পৌছেই শোকে কাতর হয়ে গেলেন। সাঈদা মায়ের মনটা জয় করে নিয়েছেন বলে এ এক অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য আমি মরহুমার জন্য সব সময় দোয়া করি। মা’ ৪/৫ মাস আমার ছেলেমেয়েদের ছায়া দিলেন। এই সময় আমার ছোটকালের সকল ইতিহাস একর পর এক আমার সামনে এসে হাজির হলো। আমার মা’ আমার সাথে কথা বলতে খুবই পছন্দ করতেন। বাড়ীতে গেলে এখনো কথা বলতে বলতে সারা রাত কেটে যায়। তিন বছর বয়সে আমার দু’পা আগুনে পুড়ে যায়। আমার মা হাতের তালুর উপর রেখে আমাকে লালন পালন করেছেন। ছোটকাল থেকে নামায কুরআন পড়ার প্রতি আমার মনোযোগ ছিল বেশী।
আমার নানার সান্নিধ্যে থেকে আমি লেখাপড়া শিখেছি। আমার নানা ভাল শিক্ষিত এবং আল্লাহওয়ালা মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেক এলেম শিখিয়েছেন। আমার মা’ কুরআন হাদীস, পারিবারিক, সামাজিক বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখেন। আমার বাবা ছাত্র জীবন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সংগে জড়িত ছিলেন। বেশীর ভাগ সময়ই সমাজের দরবার এবং মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। আমাদের লেখাপড়া মায়ের চেষ্টাই হয়েছে। আমার পড়ালেখার প্রতি যত্ন ছিল ভিন্ন রকম। আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি আমার মা সন্ধ্যা বেলায় আমার পড়ার রুমের বাহিরে পাহারা দিতেন কারন বাড়ীর দুষ্ট ছেলেরা অনেক সময় শোরগোল করত। পরীক্ষা আসলে আমি খাওয়া দাওয়া করতেই চাইতাম না। আমার মা অনেক আদর করে মুখে খাবার তুলে দিতেন। আমি ছোটকালে একটা কালো গরু পালতাম। আমার আকিকার সময় নানা-নানু-মামা টাকা দিয়েছেন। সে টাকা দিয়ে আমার মা একটা গরুর বাছুর কিনেছিলেন। সে একটা গরু থেকে অনেক গরু হয়েছে। আমি ফেনী সরকারী কলেজে পাঠ্যকালীন সময় সর্বশেষ গরুটি বাবা বিক্রী করে দিয়েছেন। আমি এ গরুটির জন্য অনেক কেঁদেছি। ছোটবেলায় মায়ের সংগে সাংসারিক কাজ করতাম, মাছ ধরতাম, দুধ দোহাইতাম, ঘাঁস কাটতাম। বাবা নোয়াখালী শহর থেকে বড় বড় ইলিশ মাছ নিয়ে আসতেন অনেক রাতে। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে আমার মা ইলিশ মাছ রেঁধে, বেজে কত যত্ন করে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়াতেন। একদিন রাতের তিনটায় আমি ঘুম থেকে উঠে লেপ নিয়ে নামায পড়া শুরু করে দিলাম। আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার মা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে বাবা। আমি বললাম আমি তো এমন কিছু মনে করতে পারছি না।
আমি ছোটবেলায় চাষের কাজ করতাম। শাক-সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, চাষ করতাম। আমার মা গোপনে চাল দিতেন। বাজারে বিক্রী করে বীজ, গাছের চারা আনতাম, মাঝেমধ্যে মোড়া, বিস্কুট কিনে বাড়ী আনতাম। আমি কগজি লেবু গাছের চাষ করতাম। আমার গাছের কাগজি সেবারহাট বিক্রী করতাম সে সময় আট আনা হালি দামে। অবশ্য মিয়াবাড়ীর ছেলে এ জন্য কামলা নিয়ে বাজারে যেতাম। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম ওরা বিক্রী করত। কাগজির এক ঘটনা মনে পড়ল। কাক্কু দরবেশ ভাত খেতে বসলে বাবা বললেন একটা পাকা কাগজি এনে কেটে দেয়। কাগজি পাড়তে গিয়ে দেখি আমার গাছের কাগজি পাকে নাই পাশে ঢাকার জেঠাইর গাছে পাকা কাগজি ছিঁড়ে এন কাক্কুকে কেটে দিলাম এ জন্য কাক্কুর অনেক রাগ সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। কাক্কু দরবেশ একজন বুজুর্গ আল্লাহওয়ালা ছিলেন। কখনো হারাম জিনিস এবং মা-বাপের নাফরমান সন্তান সহ্য করতে পারতেন না। কাক্কু দীর্ঘ প্রায় ১২/১৪ বছর তিনি আমাদের বিল্ডিংয়ের বারেন্দায় ছিলেন এবং খাবার খেতেন। আমার মা-বাপ দু’জনই কাক্কুর ভক্ত ছিলেন। এখনো কাক্কুকে নিয়ে গল্প করলে আমার মা অনেক আনন্দ পান। কাক্কুর মৃত্যুর পর আমি অনেক দিন গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। কাক্কুর ছেলে সৌদী আরবে প্রবাসী আবু তাহের এর সংগে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। কাক্কুর একমাত্র উত্তরাধিকারী আবু তাহেরকে দাওয়াত এবং ভাল পরামর্শ দেয়ায় আমার মা অনেক খুশী হয়েছেন। সত্যিকার অর্থে আমি মাকে খুশী করার নিয়তেই এ কাজটি করেছি।
আমারা গরীব সংসারে বড় হয়েছি। বংশীয় গৌরব, সম্পত্তি থাকলেও বাবার সামাজিক দর্শনের কারনে এ অবস্থা হয়েছিল। আমার মা আমাদের এটি বুঝতে দিতেন না। আমাদের সামনে খেতেন না। আমি ভাবতাম উনার মনে হয় খেতে হয় না। বাবাও অভাব আছে বুঝাতেন না। টাকা চাইলে ২/১ টাকা দিতেন। আমার শিশু মনে ভাবনা ছিল বাবার কাছে টাকার অভাব নাই। সত্যিই তাই দেখলাম বাবার মৃত্যুর পর। প্রত্যেক বইয়ের পাতায় পাতায়, পত্রিকার পাতায়, বিছানার নিচে এক টাকা থেকে শুরু করে পাঁচশত টাকার নোট। কি আশ্চার্য টাকা আর টাকা। আমি মায়ের সংগে এ সব নিয়ে গল্প করি। আমার মা এ বয়সেও সেই স্মৃতিতে নতুন জীবনের সন্ধান পান। আমার বাবা ছোট ঔষধের শিসিতে এক বতল সরিষার তৈল আনতেন। আমার মা অন্তত: দশ দিন তরকারি রাঁধতেন। কত সাধ হতো। এখন সপ্তাহে দুই লিটার তৈলের তরকরিতেও এ সাধ পাই না। আমার মা না খেয়ে থাকতেন কিন্তু কাহাকেও বুঝতে দিতেন না। একদিন ভাত খেতে বসে লবনের জন্য কেঁদেছি কিন্তু আমার মা পাশের ঘর থেকে লবন আনতে দিলেন না। মা’ এমন একটি নাম সারা জীবন লিখলেও এ রচনা শেষ করা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। আল্লাহ অমার মা’কে নেক হায়াত দিন, সুস্থ্য রাখুন, কবর এবং আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের তওফিক দিন। আমাকে মা’য়ের খেদমত করার সুযোগ দিন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৪০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন