হল-মার্কের সঙ্গে সমঝোতা!
লিখেছেন লিখেছেন আমার পথ চলা ২৮ মার্চ, ২০১৩, ১০:৩৮:৫৬ সকাল
সরকারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সমঝোতাই হতে যাচ্ছে হল-মার্কের। দেশের ব্যাংক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি করে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার পরও হল-মার্ককে আরও ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। আর তা করা হচ্ছে হল-মার্কের কারখানাগুলো চালু করার কথা বলে। এ জন্য জেল থেকে বের করে আনাও হবে কেলেঙ্কারির হোতাদের।
সচিবালয়ে গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ধরনের কথাই বলেছেন। অর্থমন্ত্রী এ সময় সরাসরিই বলেছেন, ‘তাঁদের জামিনে জেল থেকে বের করে আনার চিন্তা রয়েছে।’
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে নানা ফন্দিফিকির ও জালিয়াতির মাধ্যমে দুই হাজার ৬৮১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে হল-মার্ক গ্রুপ। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। পরে সোনালী ব্যাংকের জড়িত কর্মকর্তা এবং হল-মার্কের এমডি, চেয়ারম্যান ও মহাব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তবে সরকারের এই উদ্যোগে বিস্ময় প্রকাশ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হল-মার্কের ব্যাপারে সরকারের এই চিন্তা সমাজে ভুল বার্তা দেবে। এতে ভবিষ্যতে একই ধরনের অন্যায় করতে উৎসাহিত হতে পারে অন্যরা।’
সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে দুর্নীতি-সহায়ক শক্তি না দুর্নীতি প্রতিরোধ শক্তির প্রভাব বেশি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য: হল-মার্কের ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার কারণ হিসেবে ৩১ বছর আগের কিছু ঋণখেলাপির ব্যাপারে তৎকালীন সরকারের উদাহরণ সামনে আনেন অর্থমন্ত্রী। গতকাল তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালে ১০ জন বড় ঋণখেলাপি ছিলেন। একেকজন পয়সা নিয়েছিলেন সাত থেকে আটটি ব্যাংক থেকে। কিন্তু তখন তা ফেরত দেওয়ার অবস্থা ছিল না তাঁদের। ঋণখেলাপিদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও দায় হিসাব করে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। হল-মার্কের ক্ষেত্রে এ রকম কিছু একটা হবে।’
হল-মার্কের বিভিন্ন ব্যবসা আছে, যেগুলো চালু হওয়া প্রয়োজন—এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হল-মার্ক যে টাকা নিয়ে গেছে, তা জনগণের টাকা। এই টাকা উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধারের জন্য দরকার কারখানা চালু। আর সে জন্যই ওদের দরকার আরও ঋণ।’ হল-মার্কে প্রশাসক নিয়োগের কথা উঠেছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে। আমি অবশ্য প্রশাসক নিয়োগের কথা বলিনি।’
হল-মার্কের এমডি ও চেয়ারম্যান কারাগারে, কারখানা চালুর জন্য আবারও ঋণ দেওয়া হলে তা কে, কীভাবে ব্যবহার করব্লেন্ল—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁরা জামিনে বের হয়ে আসতে পারেন।’ সরকার জামিন দিতে পারে কি না, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হল-মার্কের শ্রমিক ও কর্মকর্তারা আমার কাছে দরখাস্ত করেছে। আর সরকার কেন জামিন দেবে? জামিন দেবে আদালত। আদালত সব সময়ই যৌক্তিক আচরণ করেন।’
হল-মার্কের ব্যাপারে সরকারের এই নমনীয় মনোভাব সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দেবে—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হল-মার্ক যে টাকা নিয়ে গেছে, তা জনগণের টাকা। এই টাকা উদ্ধারে সরকার উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিচ্ছে—জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছাবে।’
প্রতিক্রিয়া: হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না মন্তব্য করে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এই কেলেঙ্কারি শুধু ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতিরই ক্ষতি করেছে।’ বরং আইন সংশোধন করে কারখানাগুলো সরকারের আয়ত্তে আনা যায় কি না, দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে বিস্ময় প্রকাশ করে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘এ কেমন চিন্তা যে যারা দোষী, তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সব?’
যোগাযোগ করা হলে সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখান দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী কোন প্রেক্ষাপটে এসব কথা বলেছেন, তা আমি বলতে পারছি না। তবে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। জামিনের জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হলে দুদক তার আইনজীবীদের নিয়ে লড়বে।’ যদিও তিনি এক দিন আগেও সর্বত্র দুর্নীতির বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হল-মার্কের আবেদনে সরকারের এই সম্মতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে টাকা চলে গেছে, তা উদ্ধার হওয়া যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া।’
শুরু থেকেই হল-মার্কের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী খুব একটা গুরুত্ব দেননি বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘উনি বলেছিলেন, চার হাজার কোটি টাকা বড় কিছু না। এতে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।’
আগেই সমঝোতার উদ্যোগ: কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের পরপরই হল-মার্কের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ে একটা সমঝোতা চেয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এই প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থের দায়দায়িত্ব হল-মার্ককে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিয়ে ১৫-২০ বছরের জন্য তা পুনঃ তফসিলের প্রচেষ্টা ছিল। এ নিয়ে এক দফা বৈঠকও হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কৌশল করে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির তথ্য-উপাত্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পাঠিয়ে দেয়। ফলে তখন সেই উদ্যোগ আর সফল হয়নি।
আবার হল-মার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের পরও উদ্যোগ ছিল এই ঋণকে ২০ বছরের পুনঃ তফসিল করে দেওয়ার। প্রথম দিকে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এমনকি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজি করানোর চেষ্টাও নেন।
আবার, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম জামিনে বের হয়ে এসে ২০ বছরে পুনঃ তফসিলের প্রস্তাব পাঠান অর্থমন্ত্রী, গভর্নর, দুদকের চেয়ারম্যান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, সোনালী ব্যাংকের এমডি ও রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক এবং দুদকের উপপরিচালকের কাছে।
এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা থেকে বেশ কিছু সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে সাভারে নিয়ে গিয়ে কারখানা পরিদর্শন করানো হয়। বলা হয়, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও কর্মসংস্থান রক্ষা করতে হল-মার্ক চালু করতে হবে।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হল-মার্কের শ্রমিক পরিবার রক্ষা এবং শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ১১ মার্চ আমমোক্তারের মাধ্যমে আবেদন করে হল-মার্ক কর্তৃপক্ষ, যার অনুলিপি দেওয়া হয় অর্থমন্ত্রী, গভর্নর, দুদকের চেয়ারম্যান, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও দুদকের একজন উপপরিচালকের কাছে।
হল-মার্কের সম্পদের হিসাব: সোনালী ব্যাংকে হল-মার্কের জামানত হিসেবে দেওয়া জমির আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পৃথক একাধিক জমি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যাংক এই মূল্যমান নিরূপণ করে। এতে দেখা যায়, হল-মার্কে দুই হাজার ৬৮১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার জালিয়াতির ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত জমি, ভবন ও যন্ত্রপাতি পরিমাণের আর্থিক মূল্য হচ্ছে ৩৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
আর সম্প্রতি হল-মার্ক ব্যাংকের কাছে কিছু জমি, ভবন ও যন্ত্রপাতি জামানত হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ব্যাংকের জরিপকারী প্রতিষ্ঠান হিসাব করে বলেছে, এর আর্থিক মূল্যমান হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
১৪ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে গঠিত উপকমিটি তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেছিলেন যে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির অর্থ কোনোভাবেই আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নামমাত্র জামানত রয়েছে এই বিপুল জালিয়াতির বিপরীতে। ফলে সরকারের উচিত হবে সোনালী ব্যাংকের পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূলধন জোগান দেওয়া। অথচ সেই সুপারিশ না মেনে পাল্টা ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
৭৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন