আমার শৈশবের ব্যাঙ তেলাপোকা আর পাখীরা
লিখেছেন লিখেছেন পটাশিয়াম নাইট্রেট ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:১৭:৫৪ সকাল
কপ্পা দিয়ে পাখী ধরা আমার শুধু নেশাই ছিলনা আমি ছিলাম একেবারে ওস্তাদ।! বাংলাদেশে এমন কোন হালাল পাখী আছে কিনা সন্দেহ আছে যার স্বাদ আমি চেখে দেখিনি। তিনটা নারকেলের শলা বেঁধে তাতে আঠা লাগিয়ে তেলাপোকা বা ব্যাঙ বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম মাঠে-মাঠে। একটা কনডেন্সড্ মিল্কের খালি কৌটায় থাকতো তেলাপোকা বা ব্যাঙ আর আরেকটাতে থাকতো বিশেষ ভাবে বানানো আঠা। আঠা বানানো কিন্তু মোটে ও সহজ নয় । বিভিন্ন গাছের কষ নিয়ে সরিষার তেল দিয়ে রান্না করে বানাতে হয় ঐ আঠা। এটা ভয়নাক রকমের আঠালো এবং শুকিয়ে যায়না।
আঠা বানানো শেষ হলে সংগ্রহ করতে হতো ব্যাঙ, তেলাপোকা তুর্গুলা বা উর্চুঙ্গা। তেলাপোকা ধরতাম খালি হাতেই আলমারীর অন্ধকার কোনা থেকে । ধরে পকেটে ঢুকিয়ে পকেট এক হাতে চেপে রাখতাম, আরেক হাতে আরো যতটা ধরা যায়! এরপর সবগুলারে বোতলে ভরতাম। হাতটা ভীষণরকম দূর্গন্ধ হয়ে যেত। আমার বাপ আমার হাত শুকে বলতে পারতো আজ আমি যে তেলাপোকা ধরেছি। এরপর ধমাধম!
তেলাপোকা সম্পর্কে আরেকটা কথা না বল্লেই কিন্তু নয়। আমার নানা বাড়িতে কয়েকটা ঘর ছিল। তেলাপোকার উপদ্রব ও ছিল বেশী। নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে নানী তেলাপোকা নিধনের দায়ীত্ব দিতেন। আমি খালি হাতে ধরে আছাড় মেরে মেরে গুনতাম কয়টা বধ করেছি। অনেক সময় মাটি খুঁড়ে কবরের মত করে তেলাপোকা রেখে দিতাম। ৮/১০ দিন পর তুলে দেখতাম সবগুলাই জীবিত। মাথা কেটে কবর দিলেও ২/৪ দিনে মরতো না। ক্লাস নাইনে জীববিদ্যা পড়ার সময় তেলাপোকা সম্পর্কে যা পড়ছিলাম তা আমি ক্লাস টুতেই প্র্যাকটিক্যাল করে এসেছি। আমাদের পড়াশুনা আসলেই সেকেলে! কি বলেন? এই কবর এক্সপেরিমেন্ট থেকে বাদ পড়েনি কাঁকড়া, ব্যাঙ, ফড়িং কেউই।
যা হোক পাখীর জন্য তেলাপোকা না পেলে উর্চুঙ্গা ধরতে যেতে হত পুকুর পাড়ে আমি গর্ত দেখে চিনতে পারতাম উর্চুঙ্গা আছে কিনা। উর্চুঙ্গা থাকলে গর্তের মূখ গুটি-গুটি মাটির কণাতে ভরাট হয়ে থাকতো। এরপর বদনা দিয়ে বেদম পানি ঢালা শুরু যতক্ষণ না বের হয়! অনেক ক্ষেত্রে উর্চুঙ্গা অন্য কোন দিকে আরেকটা গর্ত করে রাখতো।
তাতে পানি ঢাললে পানি ঐ গর্ত দিয়ে বের হয়ে যেত। এক্ষেত্রে ঐ গর্ত আবিস্কার করে বন্ধ করে দিতাম। এক পর্যায়ে বাছাধনকে বেরিয়ে আসতেই হত। এরপর সরাসরি বোতলে বা কনডেন্সড মিল্কের কৌটায়।
তবে পাখী ধরার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হচ্ছে তুর্গুলা! এরা ভীষণ চটপটে আর হালকা। সহজেই পাখীর চোখে পড়ে আর টেনে ক্প্পটা ফেলে দিতে পারেনা, যেমনটা ব্যাঙ বা উর্চুঙ্গা পারে।এই তুর্গুলা পাওয়া যেত গোয়াল ঘরের কাছে গোবরের গাদায়। শুকনো গোবরের স্তুপ কোদাল দিয়ে সরালেই পাওয়া যেত ঊনাদের। সমস্যা হলো আমাদের গরু ছিলনা। তাই চুরি করে অন্যের গোয়াল ঘরে হানা দিতে হত।
পাখী ধরতাম মুলত শীতকালে। আর আমার লাগতো ছোট সাইজের ব্যাঙ। পরিত্যাক্ত উর্চুঙ্গার গর্তেই পাওয়া যেত ওদের। সম্ভবত শিতনিদ্রা যেত গর্তের ভেতর। নিদ্রা ভাঙতো বদনার পানিতে।
যাই হোক সব রেডি হলে নারকেলের শলা দিয়ে বানানো কপ্পায় আঠা লাগিয়ে তেলাপোকা, ব্যাঙ , উর্চুঙ্গা বা তুর্কুলা বেঁধে নেমে পরতাম অভিযানে।কোথাও কোন পাখী দেখলে পাখীর চোখে পড়ে মত করে আলতো করে কপ্পাটা মাটিতে গেঁথে দিতাম। খাবারের লোভে যেই ঠোকর দিত অমনি কপ্পাটা পাখীর গেয়ে জড়িয়ে যেত। দোয়েল, খখিয়া (বড় মাছরান্গা) ছিল আমার প্রধান এবং সহজ শীকার। দোয়েল টার্গেল করে ক্প্পা বসানোর সময় শীস্ দিতাম, এতে দোয়েল দেরী না করে মাটিতে নেমে এসে ঠোকর দিত ।
খখিয়ার একটা বদ-অভ্যাস ছিল সে শুধু মাত্র এলাকার নিদ্দিষ্ট কিছু গাছে বসে। তাই এক গাছ থেকে উড়ে চোখের আড়ালে চলে গেলে ও আমি বলতে পারতাম কোন গাছে গিয়ে বসেছে। অনেক সময় দূর থেকে ডাক শুনেও আমি বুঝতে পারতাম কোন গাছে তিনি বসে ডাক দিচ্ছেন।
এভাবে শালীক, বক, ডাহুক, ঘুঘু কোনটাই বাদ যেতনা। যেদিন খারাপ যেত সেদিন ধরতাম শ্যামা। এটা খাওয়া যায়না। ধরে পায়ে রশি বেঁধে ওড়াতাম।আমার প্রধান শত্রু ছিল কাউয়া! কোন পাখী ধরতে দেখলে এলাকা মাথায় তুলে ছাড়তো সেদিন আর কোন পাখী ধরার সাধ্য ছিলনা। পরে আমি যখন এয়ারগান দিয়ে শিকার শুরু করলাম তখন মেজাজ খারাপ হলে প্রতিহিংসায় কাউয়া মারতাম। গুলতিতে ও হাত ছিল বেশ পাকা আমার।সেদিকে আর গেলাম না লম্বা হয়ে যাচ্ছে!
প্রশ্ন করতে পারেন ধরার পর আমি পাখিগুলা কি করতাম। খেতাম! হ্যাঁ রোষ্ট করেই খেতাম!!। ঘরে চান্স না পেলে জবাই করে চামড়া ছিলে লবন মরিচ লাগিয়ে শলায় গেঁথে আগুনে পুড়ে কাবাব বানিয়ে খেতাম।
কি করে আমি পাখী মারা ছেড়ে দিলাম সে গল্প বলেই শেষ করছি।
একদিন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়ে দেখলাম দুইটা দোয়েল। ওদের বাসা ও আমি চিনতাম। সম্ভবত বাসায় ফিরছিল। আমি কপ্পাটা বসালাম। দেরী না করে একটা আটকে গেল । আমি দৌড়ে ধরতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দ্বিতীয় দোয়েলটা সম্ভবত সন্গীকে ক্প্পা থেকে ছাড়িয়ে নেমবার জন্য একরকম প্রায় ঝাঁপ দিল কপ্পা বরাবর। তাতে প্রথমটা ছুটে গেল আর দ্বিতীয়টা আটকে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দোয়েলটা ছেড়ে দিলাম। উড়তে পারছিলনা। লাফ দিতে দিতে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। সেই থেকে আমার পাখী মারা বন্ধ।
সময় করে কুকুর বিড়াল আর ইঁদুরের কথা গুলু বলবো।
বিষয়: বিবিধ
৩০৯১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার লেখা সাবলিল, প্রাঞ্জলতায় পাঠককে ধরে রাখে। আর ভাষার গাঁথুনি অনেক মজবুত। এগিয়ে যান।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
পাখির গোস্ত আসলেই খুব মজাদার!
বলবো।
আর আমিও পড়বো।
অন্নেক ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
অনেক শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন