চেতনার বাকশাল ও দিন বদলের বাকশাল (!)
লিখেছেন লিখেছেন থার্ড পারসন ২২ মে, ২০১৩, ১১:৪৩:৩০ রাত
দেশে কোন জরুরী অবস্থা নেই। বিরোধী দলের আন্দোলনেরও কোন ফুসরত নেই। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে। চলছিল সংলাপের প্রস্তাবনা। জাতিসংঘ সহ বিশ্ব বিবেককে তোয়াক্কা না করে সরকার সভা সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হলো। ফেইজবুক,টুইটার ও ব্লগ বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করছে সরকার। অনেকেই ভাবছেন এই বুঝি দিন বদল, এই বুঝি ডিজিটাল।
অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, সভা-সমাবেশের অধিকার হরণ থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার ‘ঐতিহ্য’ তাদের রয়েছে।১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যে সংবিধান প্রকাশিত হয়, তার ব্যবচ্ছেদ শুরু হতে সময় লেগেছে মাত্র ৭ মাস। তবে সংবিধানের মৌল চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক এবং পরিপন্থী সংশোধনীটি আনা হয় ৯ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। আর এটি সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী - যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানসহ নানা নিবর্তনমূলক বিষয়গুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আর এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪২ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা স্থগিত করার বিধান রাখা হয়। এর ফলে যে মৌলিক অধিকার সংবিধান নিশ্চিত করেছিল অর্থাৎ চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক, ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের মূল বিষয়গুলো স্থগিতকরণ বা কার্যকারিতা হরণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এভাবেই শুরু হয় হোচট খাবার প্রথম পর্বটি। এর পরে ওই আমলেই মানুষ অসংখ্যবার হোচট খেয়েছে। নির্বিচারে গ্রেফতার, অত্যাচার-নির্যাতন, বিরোধী পক্ষকে হত্যা, গুম করা শুরু হয়ে যায়। হোচট খেতে খেতে আহত অবস্থায় পৌছানোর কাছাকাছি এসে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো এদেশে জারি হয়। যদিও ওই বিধানের বলে যা যা করা যায়, তা বাস্তবে আগে থেকেই চলছিল। জরুরি অবস্থা ঘোষণার অন্য আরেকটি কারণ যে ছিল তা খুব স্বল্প সময়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাত্র ২৭ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। এই চতুর্থ সংশোধনীটি বিদ্যুতের বেগে দ্রুত পাস হয়ে যায় এবং গঠিত হয় বাকশাল পদ্ধতির বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সংশোধনীর ১১৭ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমন এক দল গঠন করা হয়, যেখানে একটি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, সবাইকে তাতে যোগ দিতে হবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি সংবাদপত্র ছাড়া কোনো সংবাদপত্র থাকবে না- জাতীয় বিভিন্ন বিষয় এই সংশোধনীতে সন্নিবেশিত হয়েছিল। এ ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার এমন এক নজিরবিহীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা - যা জনগণের প্রত্যাশিত ছিল না, যার জন্য তারা প্রস্তুতও ছিলেন না - না মানসিক বা অন্যভাবে। মুক্তিযুদ্ধের দগ দগে ঘা তখনো না শুকালেও ক্ষমতার রাজনীতিতে কূটকৌশলের ক্ষেত্রে এটি ছিল এক অভিনব উদ্ভাবন।
সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত এবং চিরস্থায়ী করার বাসনা। সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা, সভা-সমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ, গ্রেফতার, নির্যাতন সবই করা হচ্ছে ওই একই উদ্দেশ্যে। কার্যতঃ অনেকদিন ধরেই দেশে জরুরি অবস্থা চলছে - এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও সভা-সমাবেশের অধিকার বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের যে সব অনুচ্ছেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে স্থগিত হয়ে যায়, সে পরিস্থিতি কি দেশে বিরাজ করছে না? দেশে এক দল, এক মত, এক চিন্তার অনানুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না? সবাই পারছেন। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, উপলব্ধি করতে পারছেন, টের পাচ্ছেন ভয়াবহতা এবং তীব্রতা। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রে এক দল, এক মত, এক চিন্তা অর্থাৎ এক এবং এককের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস বড়ই নির্মম এবং নিষ্ঠুর - এটা শাসকরা কখনই মনে রাখে না।
বিষয়: বিবিধ
১০০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন