লাশঃ রক্তাক্ত ২৮ ( শেষ পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ানা জেরিন ৩০ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:৩০:০৭ রাত



ইয়াহিয়া চলে যাওয়ার পর নার্গিস নিজের একাকী জীবনে ফিরে আসে। কিছুদিন পর তার একাকীত্ব দূর করতে ঘর আলো করে আসে ছোট্ট একটা ফুটফুটে শিশু।

ইয়াহিয়া বিদেশে থেকেই কন্যার আগমনের খবর পায়। খুশীতে তার মানসপটে সারাদিন ভাসে কন্যার কল্পিত ছবি। নার্গিসের চিঠি সহ ছবিও পায় সে একদিন।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার অফিসে ছুটির দরখাস্ত করেছে পারিবারিক বিভিন্ন ইস্যু তুলে। কিন্তু তার কাজ কাউকে বুঝিয়ে না দিয়ে ছুটিতে যাওয়া যাবেনা, আলী ভাই দেশ থেকে আসলে তাকে কাজ গুছিয়ে দিয়ে তবেই দেশে যেতে পারবে।

বোধ হয় , এই বছর ও যাওয়া হবেনা। কয়েকটা ঈদ এখানে নার্গিসকে ছাড়া কাটল! এখানে ঈদ যেন ঈদ না, প্রিয়জনের শূন্যতার এক হাহাকার গাঁথা গানের মতো এখানের ঈদ বড় করুণ শুনায়।

কিন্তু, প্রিয়জনের কাছে ফিরেও যেতে পারছেনা, কলিজার টুকরা মেয়েটার একবছর হয়ে গেলো, কোলে ও নিতে পারেনি। বাবা ডাক শুনার আশায় ইয়াহিয়ার রাত কাটে তো দিন কাটে না, দিন কাটে তো রাত কাটে না।

এসব মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে সে আল্লাহ্‌র দরবারে ধর্না দেওয়াই শ্রেয় মনে করে। সামনে হজের মৌসুম! এবার সে হজ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।

হজের সময় ইয়াহিয়া ইসলামের নানা বিষয়ে জানতে পারে, সেবারই ঠিক করে ফেলে সে সুন্নত মেনে চলবে, এবং দাড়ি রাখবে। এতে নার্গিস ও খুশী হবে।

এরমদ্ধেই ইয়াহিয়ার অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর হয়। নার্গিস কে সেদিন ই ফোন করে জানায় যে সে আসছে। খুশীতে নার্গিস কেঁদে ফেলে।

ইয়াহিয়া দেশে ফিরে আসে। কন্যার সাথে খেলা করাই তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ।মাঝে মাঝে নার্গিসের সাথে খুনসুটি হয়।

- আমার মেয়ে একদম দেখতে আমার মতোই হয়েছে

- হুম! তোমার মতো স্বভাব না হলেই হয়, যেই অলস মেয়ের বাবা!

- তুমি একদম ভেবো না নার্গিস! আমার মেয়ে আমার বউয়ের মতো কর্মঠ হবে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে

বলে ইয়াহিয়া মুচকি মুচকি হাসে।

কেউ কাউকে রাগাতে চাইলে তার জন্য সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হোল না রাগা। ইয়াহিয়া যখন রাগের কথায় ও রাগ করেনা, তখন নার্গিস ই রাগ করে বসে থাকে।

কতো ঠাণ্ডা একটা মানুষ, মনের মধ্যে এতোটুকু খারাপ ভাবনা নেই কারো জন্য!

হজ করার পর থেকে সে পুরাই পাল্টে গেছে! আগে তো তাও একটু মেজাজ গরম ছিল, এখন সে একদম অন্য মানুষ।

নার্গিস একবার পিছন ফিরে দেখে তার কোন সুখেরই কমতি নেই, মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়!

এতো সুখ যদি ভাগ্যে না সয়! এতো সুখ যদি স্থায়ী না হয়! মেয়ে আর স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য এক সুখের ঠিকানা খোঁজে নার্গিস।

ইয়াহিয়া ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে দেশে আসার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। তত্ত্বাবধায়ক প্রধান কে মানে না বিরোধী দল, তারা নিজেদের ইচ্ছামতো একজন কে চায়। এসব নিয়ে দেশ খুব উত্তপ্ত।

এই দেশে বিবাদ হয় রাজায় রাজায়, আর ভুক্তভুগি হয় সাধারণ প্রজারা। তাই জনগনের জীবনের বিরাট একটা অংশের জীবনের উত্থান পতনে রাজনীতি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত।

ইয়াহিয়ার অতো রাজনৈতিক ভাবনা নেই, তবে ইসলাম প্রিয় হিসেবে ডানপন্থীদের সে মনে মনে সমর্থন করে। সে প্রবাসী মানুষ, সক্রিয় রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক নেই।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর,

সরকারের ক্ষমতা ফুরবার দিন। সকালে উৎকণ্ঠা নিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিল। এরমদ্ধে নার্গিস এসে চায়ের কাপ দিতে দিতে বলল- আজ তোমার বাহিরে যেয়ে কাজ নেই, সারাদিন ঘরেই থাকো, লুবাবা কে নিয়ে খেলো, বিকেলে আমি তোমার প্রিয় একটা নাস্তা বানাবো।

প্রিয় নাস্তার কথা শুনে ইয়াহিয়ার চোখ চকচক করে উঠে। তার প্রিয় নাস্তার মধ্যে আজ কি বানাতে পারে নার্গিস? ফালুদা? পুডিং? নাকি হাতে বানানো নুদলস?

পেপার পড়তে পড়তে চায়ের কাপে চুমুক দেয় ইয়াহিয়া।

এরমদ্ধেই মোবাইল বেজে উঠে।

- এটা কি ইয়াহিয়া সাহেবের নাম্বার?

- - জী, আপনি কে বলছেন?

- একজন লোক রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট করেছে, তার মোবাইলে এটা সেভ করা দেখলাম, সম্ভবত আপনার কোন আত্মীয়! উনাকে ডি এম সি তে নেওয়া হয়েছে, আপনি কি একটু আসতে পারবেন?

- হ্যা হ্যা আমি আসছি। আপনি একটু থাকুন ভাই ওনার সাথে। আমি এখুনি আসছি।

ইয়াহিয়া তাড়াতাড়ি চেয়ারের উপর ফেলে রাখা পাঞ্জাবীটা পড়ে নেয়। বের হওয়ার সময় নার্গিসকে বলে আমি একটু আসছি। তুমি থাকো।

- কই যাও তুমি ?

পরে ফোন করবো তোমাকে। এখন বলার সময় নেই। তুমি দরজা লাগিয়ে রেখ। আমি আসছি একটু পরেই।

রাস্তায় বের হয়ে ইয়াহিয়া চমকে যায়। তেমন কোন যানবাহন নেই। বাস মতিঝিল পর্যন্ত এসে সব যাত্রী নামিয়ে দেয়। সামনে আর যাবেনা। ইয়াহিয়া অগত্যা হাটা শুরু করে।

হাটতে হাটতে পল্টন আসে। পথিমধ্যে যতো মানুষ দেখেছে সবাই খুব ব্যস্ততার সাথে পালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সামনে কিছু হয়েছে?

পল্টন এসেই সে একদম লগি বৈঠা ধারীর ঘেরাও ের মধ্যে পড়ে যায়। ঐ যে হুজুর, ধর ধর বলে একদল লোক তাকে ধাওয়া করা শুরু করে। ১০/১২ জনের সাথে সে পেরে উঠে না।

ইয়াহিয়া তাকে ধাওয়া করার কারন কিংবা তার অপরাধ বুঝতে পারেনা। তবুও আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য বলে

- ভাই আমি কোন দল করিনা ভাই! আমাকে ছেড়ে দেন ভাই, আমার আত্মীয় হাসপাতালে!

তবুও পাষণ্ডদের কানে সেই আর্ত চিৎকার ঢুকে না।

সবাই মিলে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করে ইয়াহিয়া কে।

দাঁড়ানো থেকে শুইয়ে ফেলে মারতে মারতে। তবুও ইয়াহিয়ার ক্ষীণ কণ্ঠের চিৎকার অব্যাহত থাকে। তার চোখ দিয়ে পানি ঝরে। এক লগি বৈঠাধারীর তা সহ্য হয়না। সে এসে একটা লগি ঠেসে ধরে ইয়াহিয়ার চোখে। এই দৃশ্য দেখে সাংবাদিক ও কেঁদে ফেলে।

এরমদ্ধে নার্গিস কাজ সেরে টি ভি সেটের সামনে বসে। টি ভি খুলেই এক বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হয়।

পল্টনের একি চেহারা! সব ধ্বংস হয়ে গেছে।

লগি বৈঠা দিয়ে একজন পাঞ্জাবী পড়া মানুষ কে সবাই মিলে মারছে। একটু খেয়াল করে দেখতেই লোকটা কে তার ইয়াহিয়ার মতো লাগে। পাঞ্জাবীটা তার নিজের হাতের কাজ করা। ওটা তার চিনতে ভুল হয়না। ডুকরে কেঁদে উঠে জ্ঞান হারায় সে।

ইয়াহিয়ার নিথর দেহের উপর জাহেলি কায়দায় নৃত্য করে খুনিরা। মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা তা বুঝতে আরও কয়েক ঘা লাগায়, চোখ লগি দিয়ে খুঁচিয়ে দেখে, জিহ্বা টেনে পরোখ করে,লাশের বুকে বার কয়েক লাফিয়ে দেখে।

পল্টনে একদিকে যখন চলছে এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা তখন ছোট্ট শিশু লাবিবা বাসায় পরম শান্তিতে ঘুমুচ্ছে, সে জানে ও না সে আজ পিতৃ হারা হয়েছে, আর তার মা হয়েছে বিধবা। বাবা ডাকা হবেনা আর কোনদিন তার। আর বাবা ডাক শোনার ইয়াহিয়ার সাধ অপূর্ণই রয়ে গেলো। নিথর ইয়াহিয়া পল্টনে পড়ে রয় ইসলাম বিদ্বেষ , সুন্নতি পোশাকের অপমানের এক জলজ্যান্ত প্রমাণ হয়ে।

( ২৮ এ অক্টোবরের বর্বরতার শিকার শহীদ জসিমের উপর লিখা একটি অনুগল্প)

বিষয়: বিবিধ

২১১৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

279809
৩০ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:২৩
রিদওয়ান বিন ফয়েজ লিখেছেন : অজান্তেই চোখের কোনায় পানি। ধন্যবাদ
৩০ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:৪২
223507
রিদওয়ান বিন ফয়েজ লিখেছেন : সে আখেরাতের গৃহ তো আমি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেবো যারা পৃথিবীতে নিজেদের বড়াই চায় না এবং চায় না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে। আর শুভ পরিণাম রয়েছে মুত্তাকীদের জন্যই। {আল কাসাসঃ ৮৩ }
279836
৩০ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৩৭
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : সেদিনকার কথাগুলো আমি মনে করতে পারি না। মানুষ হয়ে কিভাবে মানুষ এমন করতে পারে সেদিন সেটা না দেখলে বুঝা যেতো না। Sad Sad
279855
৩১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:০৩
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনার জন্য দোয়া, মহান আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আল্লাহ যেন শহীদ জসিম ভাইকে কবুল করেন, তাকে জান্নাত দান করুন। তার পরিবার কে হেফাজত করুন । আমীন । অনেক ধন্যবাদ
279872
৩১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৪:২৯
কাহাফ লিখেছেন :
কত টা হায়েনা হলে একটা মানুষ কে পিটিয়ে মেরে ফেলে ঐ লাশের উপর নৃত্য করতে পারে!
শত ধিক ঐ হায়েনাদের!
পরাক্রমশালী আল্লাহ গজব নাযিল করুন ঐ হায়েনাদের উপার!
সকল শহীদদের কে আল্লাহ জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন,আমিন।
279880
৩১ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৫:৫৯
বাজলবী লিখেছেন : ধিক্কার অাওয়ামী বর্বরদেররকে। শহিদ জসিম ভাইকে অাল্লাহ তাঅালা জান্নাতে সর্বোচ্চ অাসনে সমাসিন করুন অামিন।
306389
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৫
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : আমাদের শহীদেরা সবচেয়ে বড় সম্পদ গড়ে গেছে সাহসের দ্বিধাহীন সোজা রাজপথ.।.।.।.।।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File