লাশঃ রক্তাক্ত ২৮ ( পর্ব - ২)
লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ানা জেরিন ২৮ অক্টোবর, ২০১৪, ০৫:৫৮:২৪ বিকাল
দেখতে দেখতে কীভাবে দিনগুলি ফুরিয়ে এলো ইয়াহিয়া টের ও পায়নি। খুব অল্প বয়সে কাজের সন্ধানে প্রবাসী হয়েছে সে। ১৩ বছর ধরে শুধুই টাকার জন্য বিদেশে থাকা, বাবা-মা ভাই- বোন কে ফেলে থাকা খুবই জাতনাদায়ক। পরিবারের মূল্য তার চেয়ে আর কে বেশী বুঝে! নার্গিস কে ছেড়ে থাকতে তার খুব খুব বেশী কষ্ট হবে। ভাবতেই চোখে জ্বল আসে। মাত্র ৪ মাসে কতো আত্মার আত্মীয় মনে হয় মেয়েটাকে!কিছুদিন পর ঘর আলো করে আসবে সোনামনি! না জানি এবার গেলে আবার কবে আসতে পারে। সে আসতে আসতে তার অনাগত সন্তান হয়তো মায়ের কোলে খেলা করবে। কিন্তু সে তাকে ধরতে পারবে না, খেলতে পারবে না। অফিসের বসরা ও খুব বেরহম। ছুটি পাওয়া যেন সোনার হরিণ। এসব ভাবছিল ইয়াহিয়া!
তখন নার্গিস এসে শুধাল- চা খাবে?
- কি চা?
- রং চা। চিনি ছাড়া। খাবে?
- কেন চিনি নেই?
- আছে
- তাহলে চিনি ছাড়া কেন?
- বাসায় শুয়ে বসে থাকতে থাকতে তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ। এখন একটু কন্ট্রোল করো। ২ দিন পর বাহিরে যেয়ে হাত পা চলতে চাইবেনা দেখো!
-বাব্বাহ! ভালো ডাক্তারনি ই তো হয়েছেন আপনি! ঠিক আছে, চিনি ছাড়াই দেন ম্যাম!
নার্গিস কে কেউ একজন বলেছে এই অবস্থায় বেশী চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয়। এখন সে তো খায় ই না, ইয়াহিয়া কেও খেতে দেয়না। যাক, যাওয়ার আগে বউকে এক ফোঁটা ও কষ্ট দেওয়া যাবেনা। এমনি ও খুব ভেঙ্গে পড়েছে।
২ দিন পর ইয়াহিয়ার ফ্লাইট। নার্গিসের থেমে থেমে শুধুই কান্না আসে। কেমন যে লাগে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারেনা। আরও বেশী কষ্ট এমন সময়গুলো তাকে একা একা কাটাতে হবে বলে। ইয়াহিয়ার ফ্লাইটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসলো।
যেতে নাহি দিবো হায়, তবু যেতে হয় তবু চলে যায়!
নার্গিসের অবস্থা ছোট্ট খুকির মতো হয়েছে। অবিরাম চোখ দিয়ে ঝরছেই নোনা জ্বল। স্বামী বিরহে কবি কেন কবিতা লিখেছিলেন তা নিয়ে অনেক সময় মনে কৌতুক উদ্ভব হয়েছিল তার! সেই কৌতুক অনুভূতি ই একদিন বাস্তব হয়ে জীবনে আসবে কে জানতো। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে সে স্বামীকে জিজ্ঞেস করে
- আবার কবে আসবে?
- খুব শীঘ্রই আসবো। তুমি এতো ভেবো না।
- ফোন দিও মাঝে মাঝে
- মাঝে মাঝে কি? প্রায় ই দিবো তুমি দেখো!
- সত্যি?
নার্গিসের চোখ আলোর মতো জ্বলে উঠে
- এতো ফোন দিবো যে তুমি বিরক্ত হয়ে যাবে!
- যাহ! আস্ত ফাজিল তুমি! এতো ফোন দিতে হবেনা। মন দিয়ে কাজ করো
- হুম! আর আপনি নিজের দিকে যত্ন নিয়েন। আমি নেই! কে যে তোমাকে মেরে মেরে খাওয়াবে! চিন্তায় আছি
- আমি কি খুকী? মারতে হবেনা! এমনি ই খাবো। তুমি নিজের যত্ন নিও।
ইয়াহিয়া একসময় খুব কবিতা পড়তো। নজরুলের বাতায়ন পাশে নিশীথ জাগার সাথী কবিতা টা মনে পড়ে যায়। ওয়াশ রুমে যাওয়ার নাম করে একটু আড়ালে সরে একটা কাগজে কবিতা টা লিখে ফেলে বউয়ের জন্য-
"বিদায় হে মোর বাতায়ন পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা শেষ হয়ে এলো বুঝি বিদায়ের রাতি!
আজ হতে হোল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি-
আজ হতে হোল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।
অস্ত আকাশ অলিন্দে তার শীর্ণ কপোল রাখি,
ডাকিতেছে চাঁদ মুসাফির জাগো নিশি আর নাই বাকি!
নিশাথিনি যায়, দূর বনছায় তন্দ্রায় ঢুলুঢুল,
ফিরে ফিরে চায় ২ হাতে জড়ায়ে আধারের এলো চুল।
আজ বিদায়ের আগে-
তোমারে জানিতে, আমারে জানাতে কতো কি যে সাধ জাগে!
নয়নের বানী শুনি তব ঐ নয়ন সম্মুখে কেন?
জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন!
তোমাদের তরে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না-
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না!
নিশ্চল নিসচুপ-
আপনার মনে পোড়াবো একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ।"
মাইকে বিমানে উঠার জন্য তাগাদা দিচ্ছে বারবার । নার্গিস বারবার উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকাচ্ছে স্বামীর পথপানে। অবশেষে ফিরল সে।
-এবার বিদায় দাও? আসি।
হাতে কবিতা লিখা কাগজ ধরিয়ে চলে যায় ইয়াহিয়া। নার্গিস তার গমন পথে চেয়ে থাকে অপলক!
বাসায় ফিরে কবিতা টা পড়ে আর সামলাতে পারেনা নিজেকে। সেদিন রাতে নার্গিসের সঙ্গী শুধুই কবিতার গন্ধ বিধুর ধূপেরা।
( চলবে)
( ২৮ অক্টোবর অবলম্বনে ধারাবাহিক অনুগল্প, লাশঃ রক্তাক্ত ২৮, পর্ব - ২)
বিষয়: বিবিধ
২২৬৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন