হায়রে বিয়ে! হায়রে লজ্জা ! ( পর্ব- ২)
লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ানা জেরিন ০৯ জুন, ২০১৪, ১০:২১:৫৪ সকাল
ঝুমানাদের ক্লাসে ২ জন নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। ২ জন ই মাশাল্লাহ দেখতে শুনতে সেরকম। সবাই জানে তাদের খবর। তো সেদিন ইফতার পার্টির আয়োজন নিয়ে কথা হচ্ছিলো সবার সাথে। খাবারের আইটেম আর পরিমাণ দেখে একজন বলছিল - এতো রকম খাবার! এটা তো পুরা বিয়ের আয়োজন মনে হচ্ছে! তার সামনেই সেই জুটির মেয়েটি দাড়িয়ে ছিল। তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল , ঝুমানা বলল- তাহলে এক কাজ করি! ওদের ২ জনের বিয়ে দিয়ে দেই। এভাবে প্রেম করে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে বিয়ে করে যা খুশি করুক, কি বলিস তোরা? হায় ! হায়! ঝুমানার প্রস্তাব দেখি কেউ সমর্থন করেনা। একজন তো মুখ বাঁকিয়ে বলেই বসলো - হ! খাইয়া কাম নাই! এই বয়সে বিয়ে করবে! জীবনটাই নষ্ট।
এটা আমাদের সমাজের খুব সাধারণ একটা চিত্র। এটা এমন এক সমাজ যেখানে বিয়েকে সবচেয়ে কঠিন একটা সামাজিক প্রথায় পরিণত করা হয়েছে আচার আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে । আর এমন সমাজেই প্রেম করা বিয়ে করার চেয়ে ১০১ গুন বেশি সহজ বলে পরিগনিত হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
গত পর্বে ছেলেদের সুন্দরের প্রতি অন্ধ ভালবাসার কাহিনী ও কুফল বলেছিলাম। এ পর্বে মেয়েদের কিছু বলবো ।
মেয়েরা জন্মগতভাবেই নিজেদের নিয়ে সবসময় অনিশ্চয়তা বোধ করে। সেটা সামাজিক , পারিবারিক , শারীরিক , বিভিন্ন কারনেই হতে পারে। তাই , নিজের সঙ্গী হিসেবে নিজের থেকে বেশি যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নেয়। এই যোগ্য ব্যক্তি বাছার প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি যে বৈশিষ্ট্য টা ছেলেদের যোগ্যতা মাপতে ব্যাবহার হয় তা হোল ব্যাংকে কতো আছে? কতো বড় চাকরী করে? নামের শুরুতে কিংবা শেষে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পদবী লাগানো আছে কিনা? কিংবা ছেলের বাপের কতো বড় বাড়ি আছে। আরও একটা শর্ত ও ইদানিং কন্যাকুল খুব গুরুত্ব দেয় , সেটা হোল- ছেলের দাড়ি নেই তো আবার! হুজুর বিয়ে করবে কে? খ্যাত! গাইয়া ইত্যাদি ।
একবার এক ডাক্তার আপুকে দেখতে এলো ছেলে পক্ষ। আপু আবার শর্ত দিয়েছিলো উনি দাড়িওয়ালা কাউকে বিয়ে করবেননা ।
কিন্তু কথায় আছে না- যে যা নিন্দে, তার গায়ে তা বিন্দে!
আপুকে যে ভাইয়া দেখতে এলো তিনি আবার দাড়িওয়ালা। ছেলেমেয়েকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে মুরব্বীরা চলে গেলো। ২ জনের কথোপকথন শুরু হওয়ার আগেই আপু ভাইয়ার দিকে এক নজর দেখেই মুখ ফোঁসকে বলে ফেললেন- গবেট !
হায় হায়! সেই দিন তো মহা গ্যাঞ্জাম! ভাইয়া মনের দুঃখে শেষ! তাকে গবেট বলায়। যদিও পরবর্তীতে এই গবেট এর মালায় ই গলা দিতে হয়েছিলো।
যাইহোক, আজকের ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক ।
ঘটনা - ২
কৈশোর থেকেই নোমান কিছুটা ইঁচড়ে পাকা স্বভাবের । মা অনেক চোখে চোখে রাখলেও এতো দুরন্ত ছেলেকে সামলে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ক্লাসে ছেলের চেয়ে মেয়ে বন্ধুই তার বেশি। চার্মিং ইমেজের জন্য মেয়েদের কাছে সে বেশ পপুলার। আজ ওই পাশের বাসার মেয়ে ডাক দেয় তো কাল ছাত্রী পারফিউম গিফট করে, পরশু এলাকার ছোট বোন প্রপোজ করে। মোট কথা, কৈশোর থেকে যৌবনে আসতে তার জীবন কখনোই শূন্য ছিলনা। কিন্তু কারো প্রতি ই সে ওইরকম টান বোধ করতনা। সব ই ছিল সময় কাটানোর ছল।
অবশেষে এমন একজন তার জীবনে এসেই গেলো। পরিচয় ফেসবুকে, মেয়েটার ছবি দেখেই নোমান কাত হয়ে গেছে। মেয়েটার নাম ইশিতা ।এরপর প্রায় ই তারা ঘুরতে যায়, একসাথে খাওয়া , সিনেমা দেখা আরও কতো কি! এখন আর সে আগের মতো ১০০ টা মেয়ের পিছু ঘুরেনা। নোমানের জগত ইশিতাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই নোমান ইশিতা বিয়ে করে ফেলে কাউকে না জানিয়ে।
কিছুদিন পর নোমানের মা মারা যায়। বাবা বিয়ে করে নতুন সংসার পাতে। নোমানের ও পড়া শেষ হয়ে চাকরী করার পালা। ছন্নছাড়া সংসারে নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার কোন উপায় নেই। ইশিতাকে খাওয়ানোর সামর্থ্য ও তার নেই। কোনমতে একটা চাকরী জুটে যায় নোমানের। প্রাইভেট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে যেমন বেতন পাওয়া যায়, বেতন তেমন ই। এই বেতন দিয়ে বাসা ভাড়া খাওয়া দাওয়া আর মাঝে মাঝে ছোট ভাই বোনদেরকে কিছু হাত খরচ ই দেওয়া যায় , বউ পালা যায়না।
ওদিকে ইশিতার বাবা সুপ্রিম কোর্টের বড় উকিল। কীভাবে কীভাবে জানি তিনি সব জেনেছেন। তিনি এমন চালচুলাহীন ছেলের সাথে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দিবেন না। ইশিতার মা ইশিতাকে অনেক বুঝায়। এমন ছেলেকে বিয়ে করে সে ভালো থাকতে পারবেনা, এমন আয়েসি জীবন যাপন করতে পারবেনা।
বুঝাতে বুঝাতে ইশিতার চোখে একদিন বাস্তবতা ধরা দেয়। যেদিন দেখে ঘুরতে যাওয়ার সময় নোমানের পকেটে সামান্য সি এন জি ভাড়া ও নেই। নোমান ইশিতাকে বলে মাসের শেষে তার হাতে একটু টানাটানি ই থাকে। এভাবে বেশ কিছুদিন ঘোরার পর ইশিতার আর ভাললাগেনা। এমন জীবনে সে অভ্যস্ত নয়। আর নোমান আগে এমন ছিলনা। আগে সে দু হাত ভরে খরচ করতো ইশিতার জন্য। আর এখন কেমন যেন কিপ্তা হয়ে গেছে। আর তাছাড়া নোমানদের ভাঙ্গা বাড়িটাও তার কাছে নিজে থাকার জন্য বড় বেমানান ঠেকে ।
ইশিতার খালাতো ভাই শুভ থাকে আমেরিকায়।সে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। ইশিতার বাবার খুব পছন্দ শুভকে । শুভর সাথে ইশিতার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। ওদিকে নোমান ও তালাক দেয়না ইশিতাকে। কিন্তু যে চলে যেতে চায় , তাকেই বা কীভাবে ধরে রাখা যায়। তাই নোমান স্ব উদ্যোগে ইশিতাকে তালাক দিয়ে দেয়। ইশিতার বিয়ে হয়ে যায়। আর নোমান পড়ে রয় পিছনে নিঃসঙ্গ বালুকায়।
ঘটনা - ৩
ইয়াসমিন আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এ মাসের ২৬ তারিখ। কিন্তু বিচিত্র কারনে তিনি বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন। ৩৩ বছর বয়সে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া মূর্খতাই বটে । পাড়া প্রতিবেশী সকলেই অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু তার এক কথা- ছেলে নাকি তার যোগ্য নয়। ভাইয়ার একটা ছোট ফটোকপির দোকান আছে, এক কথায় বলা যায় ঢাকা শহরে পরিচয় দেওয়ার মতো বড় কোন পরিচয় নেই। ইয়াসমিন আপু ও যে খুব আহামরি সুন্দরী তাও নয়। কালো শুকনা তাল গাছের মতো লম্বা একজন মানুষ। বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আগে কেউ করেনি। সবাই ভেবেছে- পরালিখা করছে আস্তে ধীরে বিয়ে দিবে। কিন্তু সেই আস্তে ধীরে করতে করতে য তার বিয়ের বয়স আর বিয়ের আগ্রহ দুটাই যে হারিয়ে গেছে সে খবর আর কেউ রাখেনি । এখন সে একেকবার একেক বাহানা করে বিয়ে থেকে বাঁচতে চায়।
নাইম ভাইয়া খুব ভালো একজন মানুষ। যেমন নামাজী তেমন সৎ। তাই হয়তো বাটপারি করে জীবনে বড় হওয়া শিখেন নি। এমনকি জীবনের সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট সিধান্ত নিতে যেয়ে ও বাহ্যিকতা কে প্রাধান্য দেন নি। ছেলের গুনে ঘটক এতো টাই মুগ্ধ হয়েছেন যে তিনি যে কোন মূল্যে ইয়াসমিনের সাথে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন ।
ভাইয়ার কাছে কালো সাদা কোন ব্যাপার না, তিনি বলেছেন - কালো মেয়েও সে বিয়ে করতে রাজি যদি মেয়ে পর্দা করে , ও নামাজী হয়। দেখতে দেখতে আপুকে তার পছন্দ হয়ে গেলো। কিন্তু ভাইয়াকে আপুর একটু ও নাকি ভাললাগেনি। ভাইয়ার একটাই দোষ! বেচারা খুব গরীব। এতো গরীব ছেলে উনি কীভাবে বিয়ে করবেন!
বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক । আমার খালামনি এটার ঘটকালি করেছেন। ভাইয়া বিয়ের শাড়ি কিনার জন্য টাকা দিয়েছেন, সেই টাকা দিয়ে শাড়ি ও কিনা শেষ । কিন্তু, বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আপু বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন, গরীব পাত্র বিয়ে করবেন না বলে। ভাইয়াকে বিয়ের জন্য কিনা শাড়ি ফেরত দেওয়া হোল। বউ তো পেলনা, বউয়ের শাড়ি ধরে কিছুক্ষন কেঁদেও যদি সুখ হয়।
উপরের ২ টি ঘটনাই বর্তমানে সমাজে খুব সচরাচর দেখা যায়। এই সমাজে যেমন ভদ্র নামাজী পাত্রী খোঁজা হয়না, ঠিক তেমনি পাত্রের যোগ্যতায় ও এই ২ টি শব্দ অনুপস্থিত। একটা ২ পেজের জীবন বৃত্তান্তে কি কোথাও লেখা থাকে ছেলের জীবন দর্শন কি? ধর্ম সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা কি? সে কতোটুকু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে? তবুও ওই ২ পেজের জীবন বৃত্তান্ত দেখেই একটা মেয়ে একটা ছেলের ২ জীবনের সঙ্গী হয়ে যেতে প্রস্তুত হয়। খুব স্বাভাবিক একটা সত্য কথা হোল- সৎ মানুষ নিশ্চয়ই রাতারাতি বিল গেটস বনে যাবেনা ! তার বড় হতে কিছু সময়ের দরকার হয়। আর সেই কিছু সময় পর্যন্ত বসে থাকলে সারাজীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পার হয়ে যাবে , এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
তাহলে আমরা কেন এমন টা আশা করি যে, এমন একজন মানুষকেই জীবন সঙ্গী করতে হবে, যার অলরেডি কাড়ি কাড়ি টাকা আছে? বরঞ্চ এমনটা কি ভাবা যায়না যে পাশাপাশি থেকে ভদ্র ভাবে বেঁচে থাকার জন্য একজনকে সাথী করে জীবনে যুদ্ধ করে টিকে থাকার চেষ্টা করাই জীবনের সার্থকতা ?
এসব কারনেই দেখা যায়, অনেক বড়লোকের সাথে বিয়ে হয়েও অনেক নারীর প্রান ধুকে ধুকে কেঁদে যায়। পাশের বাসার বাড়িওয়ালা ডাক্তার তার নববধুকে যৌতুকের জন্য মেরে ফেললো । তার ৫ তালা বাড়িতে কিসের অভাব ছিল? টাকা পয়সার অভাবের চেয়েও একটা বড় অভাব আছে এই সমাজে। সেটা হোল নৈতিকতা । সেই অভাব যে ছেলের মধ্যে থাকবে, তার যতো টাকাই থাকুক, সে ঘরে দুঃখ কোন না কোন বাহানায় ঠিক ই জায়গা করে নেয়। এই জন্যই বলছি - কে কতো টাকা দেনমোহর দিতে পারলো , কতো বেশি জাঁক জমক করে বিয়ে করতে পারলো , ওদিকে খেয়াল না দিয়ে একবার রক্ত মাংসের মানুষটিকে বিবেচনা করুন, তার মাঝে লুকিয়ে থাকা নৈতিকতা বোধ কে মূল্যায়ন করুন, সুখ অবশ্যই ধরা দিবে আপনাদের মণিকোঠায় ।
বিষয়: বিবিধ
৩৮০১ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নীতিকথা আমরা অনেকই বলি। তবে শুধু অন্যের বেলায়। নিজের পরিবারের কারো বিয়েতে (যেমন ভাই, বোন কিংবা পুত্র,কন্যা) আমরা ঠিকই সুন্দর,আভিজাত্য, অর্থকড়ি এসবকে প্রাধান্য দিই। ইট'স অ্যা প্রবলেম।
০ পজিশন তো মিলা , লিকেন স্যাটিসফেকশন নেহি মিলা
কৌতুক থেকে এডিট কৃত।
যে দুটি ঘটনা বর্ননা করেছেন দুটোই কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এ অনিয়মগুলোর জন্যই সমাজে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।এই অনিয়মগুলো ভেঙে সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন