বিলুর মা
লিখেছেন লিখেছেন পিন পয়েন্ট ১৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৪১:৫৯ সকাল
বগুড়া আযিযুল হক কলেজে ইন্টারমেডিয়েট ভর্তি হয়েছি মাত্র।
মেসে থাকতে হবে, গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজ করা সম্ভব নয়। এক বিকেলে কাঁথা-বালিশ নিয়ে মেসে উঠলাম। এই প্রথম বাহিরে থাকা।
রাতের খাবার হলো পাতলা ডাল আর ছোট মাছের চচ্চরি। মাছ জিনিস টা বরাবরই আমার অপছন্দের তালিকায়, ছোট মাছ হলে তো কথাই নেই একেবারেই অপছন্দ। কী করব উপায় খুজে পাচ্ছিনা, শুধু পাতলা ডাল দিয়ে অল্প ক’টা খেয়ে বাটি রেখে দিলাম।
সকালে এক বয়স্ক মহিলা এসে বলল, “রাতে খেতে পারোনি বাবা, রান্না ভাল হয়নি বুঝি?
-মাথা নেড়ে বলললাম হ্যাঁ ভালই হয়েছে তবে..., পেট ভরা ছিল তাই খাইনি।
মনে হলো আমার কথা সে মোটেও বিশ্বাস করেনি। কিছু না বলে রুম থেকে চলে গেল।
বুঝলাম, এই মহিলাই আমাদের কাজের বুয়া।
বগুড়ায় মেসের বুয়াদের সাধারনত বেটি অথবা খালা বলে ডাকা হয়ে থাকে। আমাদের সময় ঐ মেসে তাকে বেটিই ডাকতাম। প্রথম ক’ দিন কিছুই ডাকতাম না, বেটি বলে ডাকতে একটু অশস্তি লাগত। কারণ, এসব অঞ্চলে নিজের মেয়েকে বাবা-মা আদর করে বেটি বলে ডেকে থাকেন। তাই ভাবছি এ বয়স্ক মহিলা কে বেটি ডাকব কেমনে, এখনো তো বিয়ে-সাদিই করিনি! যা হোক, ক’ দিন পর অবশ্য ঠিক হয়ে গেল। আমিও সবার মতই তাকে বেটি বলে ডাকি।
এলাকায় তিনি বিলুর মা বলে সমধিক পরিচিত। ছেলের নাম বেলাল, আর এই বেলালের ডাক নাম বিলু, সেখান থেকেই বিলুর মা।
কোন মেসে বেটি লাগবে, কোন বেটি চুরি করল, কোন বেটির কি সমস্যা সব তদারকি করতেন এই বিলুর মা। তার এই দেওয়ানি গিরি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো।
একদিন এক কান্ড ঘটলো...
দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখি পাতিলে ভাত আছে তরকারি নাই। কাচা তরকারি বাটিতে কাঁটা কিন্তু রান্না হয়নি। কী আর করা, দুপুরে খাওয়া বন্ধ। মেস ম্যানেজার ক্ষেপে গিয়ে চেচামেচি শুরু করল, তার মেজাজ এখন ‘ফোট্টি নাইন’।
ঐ মাসে দুদু মামা ম্যানেজার।
দুদুকে সবাই মামা ডাকতাম। মেসে সব সময় ম্যানেজারদের এক্সট্রা পাওয়ার থাকে। এ মাসে দুদু মামার হাতেও অনেক ক্ষেমতা। সে বেটির চাকরি মুহুর্তে নট করে দিতে পারে।
রাতে একটা মিটিং ডাকা হলো। সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত, আগামি কাল বেটি কে বিদায়। নো এক্সকিউজ । বেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কাট-কাট মার-মার। আর যাই হোক এই দেওয়ানি বেটিকে আর রাখা যাবে না।
বাধ সাধলেন একজন। সবার সিনিয়র বকর ভাই। তিনিই এই মেসের ফাউন্ডার। যখন এই বাসা ভাড়া নেয়া হয়, তখন থেকেই বিলুর মা এখানে কাজ করেন। যত বার এই বেটির চাকরি নট হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই বকর ভায়ের জন্যই পারা যায় না।
মিটিং শেষে বকর ভাই বললেন, আগামি কাল সকালে বেটি আসলে আগে শুনে নেই যে কি কারনে আজ দুপুরে রান্না হয়নি। তার পরে ফাইনাল সিদ্ধান্ত। একজন গরিব মানুষ কে এভাবে তাড়িয়ে দেয়া মোটেই সমীচিন নয়। বকর ভায়ের কথা শুনে সবাই চুপ।
তার পরেও ভিতরে ভিতরে সবাই রেগে আছে। সকলের এক কথা, যা হবে আজই হোক। আগামি কাল ঐ বেটিকে আর দেখতে চাইনা।
কিন্তু, হলোনা। রাতটা অপেক্ষা করতেই হলো। একজন তো বলেই বসলেন, “বকর ভায়ের এখানে কী স্বার্থ। সে সব সময় এই বেটির পক্ষে কথা বলে কেন”?
যথারিতি সকালে বেটি আসলেন। বকর ভাই জিজ্ঞেস করলেন গতকাল সে কোথায় গিয়েছিল? কেন রান্না হয় নি?
শুরু হলো বেটির প্যাচাল!
-জানো বাবা, ঐ যে পাশের মেসে আগে যে বেটি ছিল তার ছেলেটার খুব জ্বর। দু’ মাস যাবত কাজ নাই। টেকা-পয়সা হাতে নাই তার মধ্যে ছেলেটার আবার জ্বর। তাকে নিয়ে হাসপাতাল গেছিলাম। কী করব বাবা, ওরা ওরা খুব গরীব, না করতে পারিনি...
শুনে আমাদের মনটাও নরম হলো। ব্যাস, এ যাত্রায় চাকরি আর গেলো না। আমরাও কিছু না বলে যে যার রুমে গেলাম।
এক সন্ধ্যায় দেখি বেটি খাবার তৈরী করছে আর চোখ মুছছে। বললাম বেটি কাঁদো কেন?
-না বাবা কাঁদি না।
-তাহলে চোখ মুছো কেন? বলতেই কথা আরো গাঢ় হয়ে গেল।
-কী হয়েছে বলো? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
- না বাবা কেউ কিছু বলেনি।
-তাহলে কাঁদো কেন?
- না বাবা খুশিতে কাঁদি। আল্লাহ আমার বিলু রে ফিরায়া আনছে।
-কেন, বিলু কৈ গিয়েছিল?
- শুরু হলো বিলুর গল্প।
গত দু’সপ্তাহ যাবত বিলু বাড়ী ফিরেনা। সে ট্রাক ড্রাইভার। কোথায় গেছে মা জানেনা। বিলু কোন দিনও মাকে বলে যায় না। কিন্তু প্রায়ই মা রাত জেগে দরজায় বসে থাকে। বিলু যখন বাড়ী ফিরে, মা তখন ঘুমাতে যায়।
বিলুর মা কার কাছে যেন শুনেছে যে চিটাগাং এ একটা ট্রাক এক্সিডেন্ট হয়েছে। পেপারে নাকি তার ছবিও দিয়েছে। বিলুর মায়ের ধারনা ঐ ট্রাক-ই বিলুর, তাছাড়া সে বাড়ী ফিরবেনা কেন?
সেই যে খবর শোনার পর থেকে বিলুর মা রাতে আর ঘুমোয় না। রাত জেগে জেগে কাঁদে। জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মিনতি করে- আল্লাহ আমার সোনারে ফিরাইয়া দাও। আমার কলিজাটারে বাচায়ে রাখো মাবুদ...।
গভীর রাত শুনশান নিরবতা, কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। কলিজা ধক করে উঠে মায়ের। এই বুঝি বিলু আসলো।
কিন্তু না...।
এভাবে চলতে থাকে কিছু দিন.........
হ্যাঁ, আজ সত্যিই বিলু এসেছে। বিলুর পায়ের আওয়াজ তার মা দূরে থেকেই বুঝতে পারে আজ। দরজার ফাক দিয়ে তাকিয়ে থাকে মা। কখন তার ছেলেটা বারান্দায় বের হবে। এক নজর সন্তান কে দেখবে তাই...
এই বাড়ির জমি বিলুর মায়ের নামে কেনা। তার বাবা সখ করে এই জমি কিনে ভালোবাসার মানুষের নামে দলিল করে দেয়। বর্তমান বাজারে এই জমির দাম পঞ্চাশ লাখের বেশি হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিলুর বাবা সেই যে বাড়ি থেকে ব্যাবসার কাজে বাহিরে গেলেন আর ফিরলেন না। সেই বাড়িতেই বিলু থাকে পাকা ঘরে। মা এবং তালাক প্রাপ্ত বোন থাকে পাশের একটা ঝুপড়ি ঘরে। এই বোনটাকে নিয়েই মায়ের সাথে ছেলে-বউয়ের বিবাদ। তারা কথা বলেনা। এমন কি জিজ্ঞেস করলেও না।
কিন্তু, সে তো মা। মা হয়ে মেয়েকে ফেলে দিতে পারেনা। তাই এই বয়সেও অন্যের ঘরে ঝিয়ের কাজ করতে হয়। সারা দিন কাজ করে যে খাবার পায় তাই মা-মেয়ে খায়। ছেলে কোন দিন মা-বোনের খোজ করেনা। তাতেও মায়ের কোন আক্ষেপ নাই।
গল্প শুনে আমার চখেও ছলছল। কথা আটকে আটকে যাচ্ছে। বললাম জমিটা বিক্রি করে দাও। ছেলে-বউ যেখানে পারে সেখানে যাক। তোমার এতো কী? যে ছেলে তোমাকে একমুঠো খেতে দিতে পারেনা তার জন্য এত মায়া কেন?
বিলুর মা বললেন ‘ছেলেটারে কই ভাসায়ে দিমু বাবা, রাস্তা দিয়ে যখন হাটি তখন সবাই তো আমারে বিলুর মা বলেই ডাকে তাতেই আমার বুক ভরে যায়’।
-বিলুর মায়েরা এভাবেই প্রশান্তি খুজে পায়... দিনের পর দিন...
বিষয়: Contest_mother
১৮৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন