***উপলব্ধি*** ছোট গল্প (শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন egypt12 ১৯ মে, ২০১৪, ০৮:৫০:৪১ সকাল
***উপলব্ধি*** ছোট গল্প (পর্ব ১)
***উপলব্ধি*** ছোট গল্প (পর্ব ২)
(***উপলব্ধি*** ছোট গল্প পর্ব-৩)
ব্রোকারঃ (অভয় দিয়ে) এখানে কেউ তোমার কিছু করবে না। এমন হলে আমাদের এই বাজারের ক্ষতি হবে তুমি নিরাপদে থাক। আমি তো ইন্দোনেশিয়ান রুপি কখনো ভাঙ্গাইনি তাই দাম জানি না, দাড়াও আমি খবর নিয়ে আসি।
রাজ্জাকঃ দাঁড়ান ভাই আপনার নাম্বার টা দিয়া যান। (ব্রোকার দিয়ে গেল)
প্রায় আধ ঘণ্টা পর ব্রোকার এল এবং বলল তোমার কাছে কত আছে যেন?
রাজ্জাকঃ ৫০০০০ রুপি।
ব্রোকারঃ (মুচকি হেসে) এই টাকার মান তো অনেক কম।
রাজ্জাকঃ কত হইব?
ব্রোকারঃ এই ধর তোমার পুরো বান্ডিলের দামই আসবে ৪৪৫ টাকা আর আমাদের নাভ রেখে তোমাকে ৪২০ টাকা দেয়া যাবে।
রাজ্জাকঃ কি!? ৪২০! আপনে কি আমারে টাউট মার্কা ৪২০ আবুল ভাবছেন? দুনিয়ায় সব শালারা বাটপার... এই বলে ব্রোকারকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে হাঁটতে লাগলো এবং ব্রোকারের উদ্দেশ্যে মনে মনে তার গালির ভাণ্ডারের সব গালি উৎসর্গ করল, আর এক দমে বাসায় চলে আসলো।
রাতে চুপ চাপ খেয়ে জেবুকে কিছু না বলেই শুয়ে পড়ল রাজ্জাক... মনে অনন্ত ক্ষোভ, মানুষ সব বেইমান আর চিটার, শান্তা কিভেব তার বিশ্বাসসহ আরও অনেকের বিশ্বাস নিয়ে খেলছে সেটাও মনে করলো; আর ভাবল আমার জেবু অনেক ভালো শুধু আমারেই চায় আর কিছু না।
সকালে রাজ্জাক সরকারী রেজিস্টার্ড মানি এক্সচেঞ্জে গেল। সেখানে গিয়ে সে শিওর হল ব্রোকার ঠিকই বলেছে!!! এই রুপির দাম খুবই কম। সেদিনই রাজ্জাক আগ্রাবাদ গেল এবং ঐ ব্রোকারকে কল করে খুঁজে নিল। সে তার ভুলের জন্য ব্রোকারের কাছে ক্ষমা চাইল; ব্রোকার ছিল ভাল মনের মানুষ তাই শুধু বলল তোমার কাছে কয়টা ব্যান্ডেল আছে?
রাজ্জাকঃ ১০৯ টা।
ব্রোকারঃ যদিও কাজটা রিস্কি তবুও কম মানের নোট হওয়ায় সমস্যা হবে না, নিয়ে এসো।
রাজ্জাক দুই দিন পর আসবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল...
রাজ্জাকের মন খুবই খারাপ এই ভেবে যে গত প্রায় দুই মাস ধরে সে যে স্বপ্ন ভেলায় ভেসেছে তা কেমন ফাঁকা ছিল! আসলেই জীবন তার সাথে অনেক কঠিন ছলনা করেছে। তবুও সে খুশি যে ব্যক্তিগত ভাবে তার ভালো একটা শিক্ষা হল আর জেবু এসব ব্যাপারে জানেনা, না জানাই ভালো এগুলো অনেক জটিল ব্যাপার; রাজ্জাক ভাবল...
দুইদিন পর এক ভোরে জেবু ঘুমিয়ে থাকতেই রাজ্জাক টাকার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, ব্যাগটিকে সে সাধারণ ময়লা একটা থলেতে নিল; এবার তার অপেক্ষা ঘড়ির কাঁটায় নয়টা বাজার জন্য। তাই সে পরিচিত একটি টং দোকানে সময় কাটানো ও নাস্তা করার উদ্দেশ্যে বসে ছিল। নাস্তা শেষে যখন সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে তখন তার ঐ বিদেশীর কথা মনে পড়ে গেল, যার কথা এতদিন তার মনেই পড়েনি। রাজ্জাক চা খাচ্ছে আর ভাবছে... না আমার জমানো সব টাকা শেষ হয়ে গেলেও আমি এই রুপি এত তাড়াতাড়ি বিক্রি করবো না (রাজ্জাক মনে মনে ভাবল)... তাই সে বিদেশীর খোঁজে এক মাস অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। এবং এই একমাস সে আবার রিক্সা চালাবে। তবে চেষ্টা করবে বিদেশীর খোঁজে ওই বারেক বিল্ডিং মোড়ের আশেপাশেই থাকার।
রাজ্জাক আবার বাসায় ফিরে এল, এবং জেবুকে ফাঁকি ফিয়ে টাকার ব্যাগটি আবার পুরনো ট্রাঙ্কে রেখে দিল। জেবু পাকঘরের পাশে চাপ কলে কাজ করছিল আর রিয়াদ মায়ের সাথে বায়না ধরে কোলে ওঠার জন্য কাঁদছে। জেবু সন্তানকে সান্তনা দিচ্ছিল কখন নরম আবার কখনো গরম ভাষায়। রাজ্জাক ধীরে ধীরে কলের পাড়ে গেল এবং পেছন থেকে রিয়াদকে ধরে কোলে তুলে নিল। রিয়াদ কে তাকে কোলে নিচ্ছে এটি বুঝতে না পেরে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিল, পরে রাজ্জাক ছেলেকে নিজের দিকে ফেরাল এবং ঘাড়ের উপর নিয়ে জেবুকে বলল আমি রিয়াদরে নিয়া তিরিশ-চল্লিশ মিনিট হাইটা আসি, জেবু আর চোখে তাকিয়ে বলে যাও তলুকদার সাব ঘুইরা আসো। রাজ্জাক জেবুকে রোম্যান্টিক ধমক দিল জেবু মুছকি হেসে কাজে নিমগ্ন হল,রিয়াদ-রাজ্জাক বেরিয়ে গেল।
পরদিন সকালে...
ভোরেই উঠল রাজ্জাক জেবু চুলায় রুটি বানাচ্ছে, বউকে উদ্দেশ্য করে রাজ্জাক বলল তাড়াতাড়ি আমারে কিছু দাও আইজকে একটু গ্যারেজে যাব।
জেবুঃ ক্যান তালুকদারের তালুকদারী ফুটানি কি শেষ!?
রাজ্জাকঃ হ শেষ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)।
জেবুঃ কেন কি হইছে!?
রাজ্জাকঃ আরেকদিন কমুনে বহুর ঝামেলার কথা...
জেবুঃ কও না, ইদানীং তুমি কেমুন জানি হইয়া গেছ, বহুত কিছু ভাবতে থাক কিন্তু আমিই কিছু জানিনা।
রাজ্জাকঃ তোমারে না কইয়া কারে কমু বউ, আমিই তো বুঝিনা। আইচ্ছা পড়ে কমুনে এখন তাড়াতাড়ি দেও।
জেবু আর কথা না বাড়িয়ে রাজ্জাককে নাস্তা দিতে মনযোগী হয়...
রাজ্জাক অনেকদিন পর রিক্সার গ্যারেজে এসেছে ভাগ্য ক্রমে খালি একটা রিক্সাও পেয়ে গেল এবং মহাজন থেকে চাবি চেয়ে নিল, মহাজন রাজ্জাকের অনুপস্থিতি ও সমস্যা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখালেও রাজ্জাক মনমরা ভাব নিয়ে ব্যাপারটি এড়িয়ে গেল। মহাজন রাজ্জাককে পছন্দ করে তাই সে পরে জানার আশায় আর কথা বাড়াল না।
রাজ্জাক আবার পেটের দায় ও বিবেকের তাড়নায় রিক্সা নিয়ে রাস্তায়... তার উদ্দেশ্য এক মাসের মধ্যে বিদেশীকে খুঁজে নেয়া এবং তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে রুপি গুলো ফেরত দিয়ে আবার জীবন সংগ্রামের পথে হাটা। কিন্তু দিন-সপ্তাহ-মাস সব চলে গেল বিদেশীর খোঁজ সে পেল না, তাই তার প্রতিটি দিনই যেন অস্থিরভাবে কাটলো। শেষে সে হতাশ হয়ে পড়ল।
সেই অস্থির সময় গুলোর একটি রাতঃ এক মাস পেরিয়ে গেছে অনেক আগে... রাজ্জাক ভাবছিল আর রিক্সা নয় রুপি গুলো বিক্রয় করে আলী ভাইয়ের মত একটি টংয়ের দোকান দেবে সে। কখনো যদি বিদেশীর খোঁজ পাওয়া যায় ধীরে ধীরে তার টাকা শোধ করে দেবার চেষ্টা করবে। পরে স্থির হয়ে সে ভাবল রুপি গুলো বিক্রয় করে কত পাওয়া যাবে; মনে মনে হিসেব করে এবং কাগজ-কলমের সাহায্যে সে নিশ্চিত হল পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মত পাওয়া যাবে। সে মোটামুটি জানে একটি টংয়ের দোকান দিতে কত লাগে, একটি দোকান সদৃশ ভ্যান লাগবে যা ভালো ভাবে বানালে বার থেকে পনের হাজার টাকা লাগবে... আর দৈনিক দশ থেকে বার হাজার টাকা খাটাতে হবে যা প্রতিদিনই বিক্রয় করে উঠিয়ে নেয়া যাবে।
আজকের এই সকাল হতে রাজ্জাক আর রিক্সা চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল তাই মহাজনের গ্যারেজে আর গেল না... সে ব্রোকারের নাম্বারে কল দিল এবং ব্রোকারকে জানালো সে আসবে; ব্রোকার তাকে দুপুর দুইটার পর আসতে বলল। রাজ্জাক দুপুরের খাবার খেয়ে রিয়াদ-জেবুকে ঘুম পাড়িয়ে যেতে যেতে তিনটা বেজে গেল, ব্রোকার রুপি গুলো ভালো করে চেক করে দেখল এবং সে নিশ্চিত হল যে এগুলো জাল নয়। ব্রোকার ভালো করে সব চেক করে রাজ্জাককে পঁয়তাল্লিশ হাজার পাঁচশ টাকা দিল এবং সে খুশি হয়ে ব্রোকারকে দেড়হাজার টাকা দিতে চাইল; ব্রোকার তাকে জানালো এই টাকার দরকার নেই কারন এর মাঝেই তার তিন হাজার টাকা লাভ হয়েছে। তবুও রাজ্জাকের অনুরোধে ব্রোকার টাকাটি নিল। রাজ্জাক ব্রোকারকে জানাল সে তার উপর খুশি কারন সে তার সাথে প্রতারনা করেনি; ব্রোকার বললঃ ‘আমি অত ভালো নই ভাই, কথা হল কিছুটা বেআইনি ভাবে টাকা ভাঙ্গানোর কাজ করলেও আমি ক্লায়েন্টদের না ঠকাতেই চেষ্টা করি’। ব্রোকার তাকে হেসে জানাল, আজকের এই ঘটনা তার ব্যবসা জীবনের বড় একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে কারন এর আগে কখনই সে এত টাকার ডিল করে এত কম কমিশন পায়নি, রাজ্জাক তাকে জানালো এই রুপির এই মান এত কম তা সে কল্পনাও করেনি দুজনেই অনেক্ষন হাসল। পরে দুজনের মাঝে অনেক কিছু নিয়েই কথা হল একসাথে তারা বিকেলের নাস্তা করল এবং রাজ্জাক নিজেই বিল নাস্তার বিল পরিশোধ করল দুজনই পরবর্তীতে যোগাযোগ রাখার প্রত্যয় ব্যাক্ত করে বিদায় নিল।
আগ্রাবাদ থেকে আসার পথে রাজ্জাক আলী ভাইয়ের টং দোকানের সামনে নামলো এবং রাজ্জাক তাকে জানালো সেও একটা টং দোকান দেবে সাথে লাভ সম্পর্কে জানতে চাইলো। আলী তাকে বলল কি ভাই কি বল তুমি না ব্যাটারি রিক্সা কিনবা!?
রাজ্জাকঃ না ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম টং দোকানই করুম।
আলীঃ তাইলে শুন এই দোকান দিতে প্রথমে খুশি রাখতে হয় পুলিশরে মাসে কমপক্ষে পুলিশের বিভিন্ন চ্যানেলে তিন বা চার হাজার টাকা দিতে হয়, তবুও কষ্ট করলে এইখান থেইকা বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা তুলতে পারবা। (আলী তাকে আরও কিছু সাপ্লাই চ্যানেল ও অভিজ্ঞতা রাজ্জাকের সাথে শেয়ার করল)
রাজ্জাকঃ আমিও এমনই হিসাব করছিলাম ভাই...
আলীঃ রাজ্জাক ভাই দোকান দিবা দিও কিন্তু ভাই আমার আশেপাশে দিওনা কষ্ট পামু।
রাজ্জাকঃ যাহ আলী ভাই এইডা হয় নেকি। তুমি তো আমার বন্ধু মানুষ তোমার ক্ষতি কেমনে করি!? তুমি চিন্তা কইরো না।
কিছুদিনের মাঝেই রাজ্জাক বি.জি.সি. ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটির সিটি ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্থানে জায়গা নির্বাচন করে একটি টং দোকান স্থাপন করল এবং সততা ও শ্রম দিয়ে কর্মে লিপ্ত হল।
ছয় মাস পরের অবস্থা...
রাজ্জাকের ব্যবসা জমে উঠেছে এখন সে প্রায় চল্লিশ কেজি বিফ ও চিকেন বিরানি বিক্রি করে সকালের নাস্তা ও দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে সাথে সিঙ্গারা-ছমুচা ও অন্যান্য তো আছেই। তবে রাজ্জাক তার টংয়ে সিগারেট বিক্রয় করেনা সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে, কারন সে এ কাজটাকে ঘৃণার চোখে দেখে। পুলিশ ও স্থানীয় ছিঁচকে নেতাদের ম্যানেজ করে মাসে প্রায় বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা লাভ থাকে তার। এখন রাজ্জাক স্বপ্ন দেখে ভালো মানের একটা রেস্টুরেন্ট দেবার এবং ব্যবসায় আরও উন্নতি করার তবে এবার স্বপ্ন দেখে নয় সে পরিশ্রম করেই এটি করার পরিকল্পনা করে।
জেবুও ও রাজ্জাক এখন অনেক ভালো আছে তাদের ঘরে আবার নতুন অথিতি আসবে এ নিয়ে তারা এবং রাজ্জাকের বাবা-মাও অনেক খুশি, ও হ্যাঁ রাজ্জাকের বাবা-মা বিষয়টি মেনে নিয়েছে। তারা এখন বাসায় আশা যাওয়া শুরু করেছে। রাজ্জাক বাসা নিয়েছে তার ব্যবসা স্থলের কাছেই ভাড়া ছয় হাজার টাকা।
এখনো রাজ্জাক স্বপ্ন দেখে জেবুর পরিবারও তাদের বিয়ে মেনে নেবে এবং তার সন্তানেরা সবার সাথে সম্পর্ক গড়ে নিয়ে থাকতে পারবে... ভাবতে ভাবতে রাজ্জাকের চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছিল এর মাঝেই তার কর্মচারীর ডাক ভাইজান “ছওয়া বিরানির টেয়া লন” (ছয়টা বিরানির টাকা নিন)... রাজ্জাক সম্ভিত ফিরে পায়, ছাত্ররা মজা করে বলতে থাকে কি রাজ্জাক ভাই পুরনো দিনের কথা ভাবেন নাকি চোখে পানি কেন? সে চোখে কিছু পড়েছে বলে এড়িয়ে যেতে চায়, ছাত্ররা বিশ্বাস না করে গান গাইতে শুরু করে “আমার মনে যত দুঃখ সয়... বন্ধুয়ারে পড় তোমার মনে যাহা লয়...” নাহ এদের সাথে কথায় পারা যাবে না- শিক্ষিত দুষ্ট; ঠোঁটের কোনে হাঁসি ফুটিয়ে সেও ব্যস্ততা ও আড্ডায় হারিয়ে যায়।
.
শেষ...
বিষয়: সাহিত্য
১৩৫৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অভাগা যেদিকে চায়,সাগর শুকিয়ে যায়!!!
ভাললাগল পুরা গল্পটিই।
আপনি ভাল লেখেন, চালিয়ে যান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন