আই. সি. ইউ.

লিখেছেন লিখেছেন egypt12 ১৩ জুন, ২০১৩, ০৯:০৯:৩১ রাত



একটি বৃদ্ধাশ্রম হতে গুরতর অসুস্থ এক বৃদ্ধ রোগী এসেছেন, সমস্ত হাসপাতাল উন্মাতাল। রোগী বৃদ্ধাশ্রম থেকে এসেছেন বলে নয়, মূল কারন বৃদ্ধাশ্রমের মালিকের সম্মান ও ক্ষমতা। তাছাড়া প্রাইভেট হাসপাতাল বলেও কথা; সরকারী হাসপাতালের অবস্থা খুবই করুন- তাই ছায়ানীড় বৃদ্ধাশ্রমের মালিক শেখ ফরিদ নিজের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ বেশী অসুস্থ হলে তাদের এখানেই রাখেন, এ ব্যাপারে একটি অলিখিত চুক্তিই যেন আছে মেট্রোপলিটন হাসপাতালের সাথে।

শেখ ফরিদ মানুষটি খুবই উদার, নিজের মা-বাবা এক সময় বিনা চিকিৎসায় কষ্ট ভোগ করে মারা গিয়েছিলেন, তাই এখন চান না কেউ বিনা চিকিৎসায় অসহায় ভাবে মারা যাক। তাই তিনি অর্থ প্রতিপত্তি অর্জন করার পর আত্মার দায়বদ্ধতা থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ওই ছায়ানিড়েরই একজন বাসিন্দা সাবরিনা সিদ্দিকা, বয়স ষাটের কাছাকাছি; আজ সকালে হটাৎ-ই মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে যান,তাই দ্রুতই উনাকে অজ্ঞান অবস্থায় এখানে আনা হয়।

সাবরিনা সিদ্দিকা এখন মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আই.সি.ইউ.-তে। নিদিষ্ট ডাক্তারের অধীনে সার্বক্ষণিক সেবা ও গুরতর অবস্থা এড়াতেই তাকে এখানে রাখা হয়েছে। তিনি এখন কিছুটা শঙ্কা মুক্ত হলেও কমোডের উঁচু স্থান বুকের বাঁ-পাশ থেতলে দেওয়াতে হার্টের আঘাত গুরতর।

টানা প্রায় চারদিন সাবরিনা আই.সি.ইউ. তে; অবস্থার তেমন উন্নতি নেই। তিনি মোটামুটি কথা বলতে পারছেন তবে কষ্ট হচ্ছে। শুয়ে শুয়ে অতীতের হিসাব মেলাচ্ছেন আর নামাজের সময় হলে ইশারায় নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মৃত্যু থেকে খুব কাছে এবং তার মনও সেই মৃত্যু আলিঙ্গনে প্রস্তুত, কিন্তু জীবন যেন তাকে কিছুতেই ছাড়পত্র দিচ্ছে না। তাই এত কষ্টের মাঝেও তার বাঁচা।

একটি হাঁটার শব্দ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে...

হঠাৎ-ই খুলে যায় আই.সি.ইউ.র বন্ধ দরজা; ডাক্তার বা নার্স আসছে হয়ত... কিন্তু না এসেছে একটি পরিচিত মুখ যা সাবরিনার মনকে কিছুটা পুলকিত করল (মস্ত তীব্র কোন অনুভূতি নয়)। এই সেই প্রিয় মুখ যার জন্য তিনি জীবনের ৩৯ টা বসন্ত স্বামীহীন থেকে নিজের জীবন-যৌবনের সকল সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন। হুম এই পরিচিত মুখটিই মামুন সিদ্দিক; সাবরিনার নাড়ি ছেড়া ধন।

মামুন এখন আই.সি.ইউ.র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখে ভাষা নেই। ওদিকে সাবরিনা সিদ্দিকাও নিরব হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আসলেই দুজনের বেশী কথা থাকার কথা না। কারন আজ থেকে ৭ বছর পূর্বে মামুন বিয়ে করার কিছুদিন পর থেকে তার মায়ের কোন খোঁজই নেয়নি; এর মূল কারন হল তার শ্বশুর পক্ষ অনেক ধনী এবং বিয়ের আগের গোপন শর্ত ছিল মামুন তার মাকে ছেড়ে আসতে পারলেই মামুনকে নিশিদের ফ্যামিলি মেনে নেবে।

হ্যাঁ নিশি রাব্বানী-ই মামুনের স্ত্রী তারা দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর প্রেম করার পর বিয়ে করেছে। মামুন বিয়ের পর পর শ্বশুরকে দেয়া সব কথা রেখেছে, নিশি ও তার উচ্চাভিলাসের জন্য; কিন্তু তার দুঃখিনী মাকে দেয়া একটি কথাও তার মনে পড়েনি। তাই হয়তো রাখাও হয়নি...

মামুন এখনো দরজায় দাড়িয়ে অনুশোচনা ও অপরাধ বোধ নিয়ে, তাই তার মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে। সে মায়ের সাথে যা করেছে তার কোন ব্যাখ্যা হয়না এটা শুধুই স্বার্থপরতা ও অমানবিকতাই বলা চলে।

হটাৎ মায়ের ডাক “আয় বাবা কাছে আয়...” মামুন সম্ভিত ফিরে পায় এই ডাক শুনে। এই ডাক যেন তার সেই দিনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যেদিন মামুনের নানা তার মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছিল কিন্তু তার মা মামুনকে ছেড়ে যেতে চায়নি তখন মামুনের বয়স ছিল ছয় বছর। মামুনের মা তখন তার নানার সাথে গেলে তাঁর বিয়ে হয়ে যেত। তাই সন্তানের জন্য সাবরিনা স্বামীর মৃত্যুর পর প্রথম ৯-১০ বছর নিজের বাবার বাড়ি যায়নি। পরে যখন মামুন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ৪ বিষয়ে স্টার মার্ক নিয়ে পাস করল; তখন তার মা তাকে নিয়ে প্রথম নানা বাড়ি যায়। মামুনের নানা ছিলেন প্রসিদ্ধ ডাক্তার। রাতে চেম্বার হতে এসে মেয়েকে দেখে তিনি খুবই খুশি হলেন। পরে তিনি ফন্দি এঁটে মেয়েকে রেখে দিতে চাইলেন। মামুনের মা নিজ বাবার ফন্দি বুঝতে পেরে দেরি না করে রাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন মামুন হতভম্ভ হয়ে বসেছিল দরজার কাছে; সেদিন তার মা তাকে ঠিক যেন এই সুরেই ডেকেছিল বলে মামুনের মনে হল...

মামুন মায়ের কাছে এসে বসেছে পুরো রুম জুড়ে পিন পতন নিরবতা। মামুনের চোখে অঝোরে পানি ঝরছে আর সাবরিনা সিদ্দিকা এ দৃশ্য দেখছেন; কিন্তু তাঁর চোখে পানি নেই আছে চাপা বেদনার প্রকাশ। কারন গত ৩৯ বছরে তিনি এত অশ্রু ঝরিয়েছেন যে আজ তাঁর চোখ অশ্রু শূন্য। সাবরিনা সিদ্দিকা মায়ের মমতায় ছেলের চোখের পানি মুছে দিলেন।

কেন এসেছিস বাবা? মায়ের কৌতূহলী প্রশ্ন...

মামুনঃ তোমাদের বউ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে আছে আমাদের সন্তান হবে।

সাবরিনাঃ ও তাই? খোকা না খুকি হবে দেখেছ কি?

মামুনঃ হুম, খোকাই হবে।

সাবরিনাঃ গত দিনগুলো কিভাবে গেছে খোকা?

মামুনঃ আর বলোনা মা- অনেক কষ্টে গেছে গত দুই মাস; শুরু হতেই জটিলতা হচ্ছিল এর মাঝে গত কিছুদিন অনেক ব্লিডিং হয়েছে। গতকাল তো প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় এখানে এনেছি।

এবার মুখ খুললেন সাবরিনা সিদ্দিকা... বাবা মামুন; তোমাকেও আমি এভাবেই জন্ম দিয়েছি। অনেক কষ্টের পাশাপাশি নিজের পাশে কবর খুঁড়ে রেখেই তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি। পড়ে তোমার কথা চিন্তা করেই আমি আর বিয়েও করিনি। বাবা তুমি তো এখন বোঝ যৌবনের চাহিদার তীব্রতা? তোমার মুখ দেখে তবুও কাটিয়েছি সারাটা জীবন। কিন্তু বাবা, বিপরীতে আমি কি পেলাম বলতো!? তোমার নানার বাড়িতে কাটানো আমার জীবনের ১৮ বছর আর তোমার বাবার সাথে কাটানো আমার জীবনের ৩ বছর ছিল আমার জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা, চলার পথের একমাত্র অবলম্ববন, সাথে ছিল আল্লহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস যার কারনে আমি ভেঙ্গে পড়িনি। তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন; আমার চোখে, তার পরিবারের চোখে, তথা সকলের চোখে। কিন্তু যখন আমার সন্তানই আমাকে অপাংতেয় ভাবা শুরু করল! যার কাছে আমার একবুক আশা ছিল তখন আমার আর কিছুই যেন রইল না। মামুন মায়ের হাত ধরে হাঁটু গেঁড়ে কাঁদতে লাগলো।

সাবরিনা সিদ্দিকা আবার বলা শুরু করলেন...

আমার প্রতিপালকের কাছে আমার একটি আশা ছিল; মৃত্যুর আগে যেন আল্লাহ তোমাকে দেখার সৌভাগ্য দেন আমায়, আজ আমি তোমাকে প্রানের সকল ক্ষুধা মিটিয়ে আবার দেখে নিলাম, তাই পৃথিবীর মায়া ছাড়তে আমার আর কোন আপত্তি নেই। আমার মানিকের কাছে আমার কোন দাম না থাকতে পারে, তার কাছে আমি হয়ত আল্লাহ প্রদত্ত কোন বাঁদী ছিলাম কিন্তু খোকা তুমিই ছিলে আমার আশা ও সুখের সাম্রাজ্য ও গর্বের হাতিয়ার, যেদিন আমার শক্তির এ হাতিয়ার ভেঙ্গে গিয়েছিল সেদিন হতেই আমি আমার কাছে মৃত।

নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে মামুন প্রায় বাকরুদ্ধ শুধু অস্পষ্ট ভাবে বলল; না মা তুমি থাকবে আমার জন্য, আমাকে আবার জীবনবোধ শিক্ষা দেবার জন্য, আমার ভ্রান্তির বন্ধ দরজাগুলো আঘাতে আঘাতে চুর চুর করে দেবার জন্য। কথা দিচ্ছি মা- তোমার খোকা আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবেনা, তোমাকে দেয়া সব কথা রাখবো আর তার জন্য আমাকে যদি এই জীবনও বিসর্জন দিতে হয় আমি রাজি, শুধু একবার বল “আমাকে ক্ষমা করেছ”।

সাবরিনা সিদ্দিকা অবাক হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের হারিয়ে যাওয়া মানিককে দেখতে লাগলেন; (দুজনই অনেক নিরব বাকশূন্য)... হটাৎ মুখে উজ্জ্বল হাসি এনে সাবরিনা সিদ্দিকা বললেন বাবা তোমাকে আমি আমার মনের অন্তঃস্থল হতে ক্ষমা করে দিলাম, আল্লাহ হাফেজ। মামুন বলল মা আমি যাচ্ছি না তো; তুমি সুস্থ হয়ে বাসায় যাবে আর আমার সাথেই থাকবে। মা বললেন নারে বাবা তা হয়না অনেক দেরি হয়ে গেছে দেখ না আমার অনন্তকালের ঐ মহাযাত্রার ডাক এসে গেছে আজরাইল (আঃ) আমাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবার জন্য পশ্চিমের পিলারের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন;

মামুন বললঃ কোথায় মা!? ওটা তোমার ভাবনার ভুল।

সাবরিনাঃ না বাবা আমি ভুল দেখছি না, ঐ দেখ তিনি আমার দিকেই আসছেন উনার হাতে রয়েছে দুটো শুভ্র রুমাল যা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি...

এই বলতে বলতেই সাবরিনা সিদ্দিকা স্পষ্ট আওয়াজে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ধ্বনিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন... মামুনও যেন সেই সম উচ্চারনে মায়ের কোলে শিশু কালের সেই নিশ্চিন্ত ঘুমের মত করে অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে গেল...

বিকালের ঔষধ দেয়ার জন্য আই.সি.ইউ.’র কেবিনে প্রবেশ করলেন সিনিয়র নার্স; তিনি দেখলেন রুগীর ঠিক কোমরের একটু উপরে পাশে বসে থাকা মানুষটি মাথা রেখে চোখ খুলে আছে, তাই তিনি রাগে চিৎকার করে উঠলেন রুগীর বিশ্রামের সময় কে ওখানে!? অনুমুতি নিয়ে আসেননি কেন? কিন্তু কোন প্রতি উত্তর আসল না। পরক্ষনে নার্স কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে বেডের কাছে আসলেন; দুজনেরই পালস চেক করে মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। সাবরিনা সিদ্দিকার চোখ বন্ধই ছিল নার্স শুধু আগন্তুকের চোখটি বন্ধ করে দিলেন।

নার্স কেবিনের বাইরে যাবেন ঠিক ঐ সময় মামুনের সেল ফোন বেজে উঠল; নার্স মামুনের ঠাণ্ডা হাত হতে মোবাইলটি নিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ হতে নারী কণ্ঠের উচ্ছসিত আওয়াজ শোনা গেল... দুলাভাই কোথায় আপনি? আপনার একটি রাজপুত্র হয়েছে, ঠিক আপনার মতই লাগছে! এ কথা শুনে নার্স কিছুই বলতে পারলেন না, শুধু চোখের কোনে জমে উঠল কিছু বাঁধভাঙা অশ্রু তাই নির্বাক থেকেই লাইন কেটে দিলেন-পরে তিনি যেন জন্ম মৃত্যুর দূরত্ব ভাবতে ভাবতেই অশ্রুসজল চোখে পরবর্তী করণীয় দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে কেবিন হতে বেরিয়ে গেলেন।

পুনশ্চঃ

আজ থেকে হয়ত মামুনের স্ত্রী নিশি রাব্বানীর আরেক সাবরিনা সিদ্দিকা হয়ে যাত্রা শুরু... যার শেষও হয়তো এমনই হবে... এই ক্ষণস্থায়ী জীবনটা যেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিচিত্র ক্যারিয়ার; একজনের প্রয়োজন ফুরাতে না ফুরাতেই আরেক অভিনেতা-অভিনেত্রী আবির্ভূত হয় জীবনের রঙ্গমঞ্চে! ইতিহাস বার বার ঘুরে ঘুরে আসে, তবুও খুব কম লোকই তা হতে শিক্ষা নেয়। তাইতো উন্নতি নেই সমাজের এই ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে থাকা মূল্যবোধের। তাই সাবরিনা সিদ্দিকারা আসে নিজ দায়িত্ব ও ক্যারিয়ার শেষে একবুক কষ্ট নিয়ে চলে যায়, আবার নিশি রাব্বানীদের হাতে এসে পড়ে সেই একই দায়িত্ব। তারপরও যে বদলায় না কিছুই; সবাই যেন একই চক্রে ঘুরতে থাকে জীবন নামক সৌরবলয়ে, তাই সবাই থেকে যায় ভুল পথেরই অন্ধ যাত্রী সাথে সাথে আশার মোমবাতিটিও ক্রমাগত ছোট হতে থাকে; আর... নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকে আমার আপনার আগামী।



বিষয়: সাহিত্য

২৯৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File