নিয়তির পথে পথে রাজ্জাক- ছোট গল্প (পর্ব ১)
লিখেছেন লিখেছেন হাসান বিন নজরুল ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:০৫:১০ বিকাল
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর নাম; প্রতিবছর ঢাকায় ভাগ্য অন্বেষণকারীদের যে চাপ, চট্টগ্রামেও তার কম চাপ পড়েনা। এখানেও কম-বেশ দেশের প্রায় অঞ্চলের মানুষের বসতি আছে। অনেকের মতই রাজ্জাক তালুকদারও এক ভাগ্য অন্বেষণকারী। তার বাবা নায়ক রাজ রাজ্জাকের ভক্ত ছিল তাই তার নাম রাজ্জাক রেখেছে কিন্তু তাদের চৌদ্দ পুরুষের মাঝে কে তালুকদার ছিল! এটা কেউ জানেনা এমন কি সে ছাড়া আর কারো নামের সাথে তালুকদার ছিল না বা এখনো নেই। যা হোক এই তালুকদার বিতর্ক কিন্তু মানুষ ঠাট্টা করে তোলে তার অবস্থা আর আচরন দেখে, আসলে সে চট্টগ্রাম শহরের হাজারো রিক্সা চালকদের একজন; থাকে দামপাড়ার বস্তিতে।
শহরের বস্তি গুলোও কেমন জানি! চারিদিকে প্রাচুর্যের অনন্ত ঝলকানির মাঝে বস্তিগুলো যেন গরিব ও ধনী দুজনের সাথেই প্রহসন করে। ব্যাপারটি হল; এই বস্তি গুলো ধনীদের গরিবের প্রতিবেশী করেছে ঠিক কিন্তু কেউ কাউকে প্রতিবেশী পরিচয় দিতে পারে না বা দেয় না। এক দিকে চলে প্রাচুর্যের বাড়াবাড়ি অন্যদিকে থাকে দারিদ্র্যের নিত্য আনাগোনা এই হল আমাদের শহুরে সভ্যতা।
যাই হোক এবার মূল কথায় আসা যাক, এদেশেরই কোন মফস্বল শহরের এক স্বপ্ন বিলাসী যুবকের নাম রাজ্জাক। তার পরিবার মোটামুটি সচ্ছল পরিবার হিসেবে নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু সে পাঁচ ভাই দু বোনের মাঝে সবচেয়ে বড় ছিল; তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে, তার বাবা ছেলেকে পড়াশুনা করিয়ে বড় আসনে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যই খারাপ, রাজ্জাক ছিল স্বপ্ন বিলাসী। সে তার জীবনে হটাৎ ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখত কিন্তু সেই স্বপ্ন পুরনে কিছুই করত না, ‘এস.এস.সি.’তে তিনবার ফেল করার পর তার আর পড়াশুনা করা হয়নি। এর চার বছর পর বাবা ছেলেকে পাঠায় সৌদি আরবে পাঠায় যদি শুধরায় এই আসায়, নাহ সেই আশার গুড়েও বালি পড়ল যখন দুই বছর পর সে খালি হাতে ফিরে এল। তবুও বাবা বলে কথা, ছেলেকে ফেলে দেয়নি। এর ভেতরে ঘটে যায় অন্য এক ঘটনা যা মূলত বেকার ও ভবগুরেদের কমন কাজ; তা হল রাজ্জাক বাঁধা পড়ে যায় তাদের চেয়ে বংশ মর্যাদায় বড় এমন পরিবারের এক মেয়ের প্রেমে। এই প্রেমের কারনে এলাকায় সংঘাত সৃষ্টির উপক্রম হলে রাজ্জাক মেয়েটিকে নিয়ে চট্টগ্রাম পালিয়ে আসে। এখানে বিয়ে করে দামপাড়া বস্তিতে শুরু হয় রাজ্জাক তালুকদার ও জেবুন্নেসা ওরফে জেবুর সংসার। সংসার ও পেটের চাহিদার দায়ে রাজ্জাক শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠে রিক্সা চালক। প্রতিদিন সকাল ৬টায় মহাজন থেকে রিক্সা নিয়ে বের হয় আর সন্ধ্যা ছয়টায় জমা দেয় এজন্য তাকে দিনে ৮০ টাকা করে দিতে হয় মহাজনকে।
রাজ্জাকের জানা হয়ে গেছে তার আর বাড়ি ফেরা হবে না, তার বাবা ও পরিবার বিয়েটি মেনে নিলেও মেনে নেয়নি জেবুর পরিবার। জেবুর ভাইয়েরা দুজকেই পেলে জনমের শাস্তি দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। জেবুদের পরিবার রাজ্জাকদের মতই অর্থ-বিত্ত ও সচ্ছলতার মানদণ্ডে, কিন্তু জেবুদের পূর্বপুরুষ ছিল জমিদার আর রাজ্জাকদের পূর্বপুরুষ ছিল জেবুদের পরিবারের শ্রমিক ও কামলা এবং এখনো এলাকায় জেবুদের পরিবারের অনেক প্রভাব; তাই জেবুদের পরিবার এই বিয়ে মেনে নেবার স্বপ্নও দেখেনা। রাজ্জাক এই বাস্তবতা বোঝে বলেই চট্টগ্রাম শহরে রিক্সা চালানোটাই নিজের নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। জেবুরও এতে আপত্তি নেই সে শুধু রাজ্জাককে চায়।
ভালোই চলছে রাজ্জাক-জেবুর সংসার। এখনো তেমন চাপ নেই, শুধুই টোনা-টুনির সংসার। তারা শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজেদের জন্য সুন্দর সময় কাটানোর জন্য সময় বের করে নেয়, সপ্তাহে এক-দুই দিন ঘুরতে বের হয়। রক্ত সম্পর্কীয় একান্ত আপনজনদের থেকে দূরে থেকেও তারা জীবনকে উপভোগের চেষ্টা করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাদের কোলে এল এক ফুটফুটে সন্তান। তাদের প্রথম সন্তান ছেলেই হল; রাজ্জাক ছেলের নাম রাখল রিয়াদ তালুকদার। সদ্য জন্ম নেয়া সন্তান নিয়ে তাদের ভালোই যাচ্ছে, দুজনই খুশি কারন এই সন্তান তাদের দুজনের ছোট পরিসরের জীবনে আলো ও খুশির উপলক্ষ নিয়ে এসেছে। রাজ্জাক দৈনিক নিজের বাইরের ব্যস্ততা শেষে এবং জেবু ঘরের ব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় ছেলে রিয়াদকে নিয়ে আনন্দ করে কাটায়। রিয়াদের মুখ তাদের দুজনের মনে জমাট বাঁধা অনেক দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।
রাজ্জাকের স্বপ্ন ও সাধ নিজের কেনা রিক্সা চালানো এবং পরে রিক্সার মহাজন হওয়া। তাই শুরু থেকেই সে কিছু কিছু টাকা জমিয়ে রাখে জেবুর কাছে; কিন্তু যখন মটর চালিত রিক্সা এলো তখন সে ওটাই কেনার সংকল্প করল। এভাবেই বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় সে তার সপ্নের মটর চালিত রিক্সা কেনার জন্য ৩৫০০০ হাজার টাকার মত জমিয়ে তোলে। তবুও রাজ্জাক মটর চালিত রিক্সায় অভ্যস্ত হবার জন্য মটর চালিত রিক্সা ভাড়ায় নিয়ে চালানো শুরু করে। আসলেই এটা চালাতে পরিশ্রম কম আর আয়-রোজগার পায়ে চালিত রিক্সা থেকে ভালো।
নগর জুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, রাজ্জাক এখন বারেক বিল্ডিং মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় এক বিদেশীকে রিক্সা ঠিক করে দেবার জন্য এক যুবক আসলো, বিদেশীটা যাবে আসকার দীঘির পাড়। ভাড়া ঠিক হল ৭০ টাকা পরক্ষনেই রাজ্জাক বিদেশীকে নিয়ে আসকার দীঘির পাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রিক্সা চলতে চলতে যখন আইস ফ্যাক্টরি রোডে ঢুকল তখনি আবছা অন্ধকারে আকস্মিক ভাবেই কিছু আততায়ী তাদের রিক্সা থামালো, রাজ্জাক কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে চড়-থাপ্পড় ও লাথি দিয়ে চলে যেতে বাধ্য করল আততায়ীরা।
রাজ্জাক জানের ভয়ে ছুটছে তো ছুটছেই এমন সময় একটি ব্যস্ত টং দোকানে এসে রাজ্জাক থামল কিছু খাবার জন্য। খেয়ে যখন সে রিক্সার কাছে আসল তখন সে দেখতে পেল একটি ছোটখাট বস্তার মত ব্যাগ। সে বুঝল এটা বিদেশীর, ওটাতে কি আছে তা জানার জন্য সে ব্যাগের চেইন খুলল; সেখানে সে যা দেখতে পেল তা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না “এত বিদেশী টাকা!” রাজ্জাক অবাক হল। যাহোক রাজ্জাক বিদেশী লোকটির কথা মনে পড়তেই টাকার ব্যাগটি সিটের নিচে রেখে দুরুদুরু বুকে আবার আইস ফ্যাক্টরি রোড হয়ে বারেক বিল্ডিং মোড় ঘুরে এল; কিন্তু বিদেশীকে না পেয়ে বিদেশীর জন্য তার কষ্ট হল সে ভাবল আহরে ঐ বিদেশী ও তার দেশের মানুষ আমার দেশ নিয়ে কি ভাববে!? পরে রাজ্জাক দেরি না করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেতে যেতে রাজ্জাক ভাবছিল এই কথা কাউকে বলা যাবে না এমনকি জেবুকেও না সে যদি অন্যদের বলে দেয় তবে রাজ্জাক থেকে এ টাকা অন্যরা লুটে নিতে পারে।
আজ রাজ্জাক বাসায় ফিরল অনেক বাজার নিয়ে সাথে আছে টাকার থলেটাও। সে পাকের ঘরে বাজার দিয়ে আসলো আর টাকার থলেটা জেবুর অজান্তেই রেখে দিল তাদের এক পরিত্যাক্ত ট্যাঙ্কে, এই ট্যাঙ্ক তারা মাসেও একবার খোলে না। রাজ্জাক আজ জেবুর সাথে বেশী কথা বলল না এবং রিয়াদকে নিয়ে খেলাও করল না শুধু খেয়েই শুয়ে পড়ল, আর সারা রাত চিন্তা ও খুশির মিশ্রণে কাটলো। সে শুধুই ভাবতে লাগলো ছোট থেকে হটাৎ ধনী হবার যে স্বপ্ন সে দেখত তা বুঝি সত্যি হতে চলেছে!
পরের দিন ভোরে জেবু উঠে রাজ্জাককে ডাকতে লাগলো “উডো উডো না আইজ কামে যাবা না?” রাজ্জাক তো উঠে না বরং আরও আয়েসে ঘুমায়... শেষে রাজ্জাক ঘুম থেকে উঠল সাড়ে দশটায় আর জেবু তাকে ভাত খেতে দিল।
রাজ্জাক বলল “আইজ ভাত খামুনা বউ” বাইরে থেইকা কিছু খাইয়া আসি”। আর বলল “তোমার কাছে আমার যেন কত টাকা জমা আছে জেবু?”
জেবুঃ “পঁয়ত্রিশ হাজার তিনশত সত্তর টাকা”।
রাজ্জাকঃ বাহ! বউ তুমি তো সব গুইনাই রাখছ?
জেবুঃ এইগুলান আমি প্রতিদিনই গুনি আমাগো স্বপ্ন পুরনের লাইগা খুশিতে গুনি হা হা...
রাজ্জাকঃ বউ দোয়া কর আমাগো স্বপ্ন সত্যিই পূরণ হইব।
জেবুঃ অবশ্যই দোয়া করি রাজ্জাক সাব।
রাজ্জাকঃ সব টাকা দেও তো জেবু।
জেবুঃ কেন আইজ কি রিক্সা কিনবা?
রাজ্জাকঃ রিক্সা না কার কিনি তা পরে দেখা যাইব।
স্ত্রী থেকে কিছু টাকা নিয়ে বাইরে গেল সে, খেতে ঢুকল ভালো একটা হোটেলে। খেয়ে আসার সময় বাজারে যায় এবং ভালো খাবার ও অন্যান্য বাজার করে সাথে জেবুর জন্য আনে ৭৫০ টাকা মূল্য মানের দুটি ভালো শাড়ি। দুপুরে ভাত খেল আড়াইটায়। পরক্ষনে সে ভাবল আজকে একা একা শহরে ঘুরলে মন্দ হয় না। তাই রাজ্জাক ঘুরতে বের হয় তার সব চেয়ে ভালো কাপড় দুটোর একটি পড়ে।
রাজ্জাক চট্টগ্রাম শহরে গত সাড়ে তিন বছর ধরে ঘুরছে, কিন্তু কেন জানি আজ তার কাছে এই শহরটা অনেক সুন্দর ও মায়াবি লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে সে এসে দাঁড়ালো নাসিরাবাদ ওমেন কলেজের মোড়ে। আজ এখানে অনার্স প্রথম বর্ষের মেয়েদের নবীন বরন অনুষ্ঠান হয়েছিল যা এইমাত্র শেষ হয়েছে। সে এত মেয়ের ঝাঁক দেখে থমকে দাঁড়ালো। সে দেখল প্রায় সব মেয়েই অনেক সুন্দর অনেক আকর্ষণীয়, অন্তত জেবুর তুলনায় আর সত্যিকার অর্থে জেবুর সৌন্দর্য রাজ্জাকের সাথেও যায় না, রাজ্জাক জেবুর চেয়েও ছেলে হিসেবে সুন্দর। এখানে সে ঘোরের মাঝে পড়েই যেন মেয়েদের দেখছিল এবং কি যেন ভাবছিল। হটাৎ সে ভাবল হায়রে! আমিতো জেবুকে কখনো অন্যের সাথে তুলনায় আনি নি! আজ কেন এমন হচ্ছে? রাজ্জাক তৎক্ষণাৎ জেবুর মায়ায় ঐ স্থান হতে বাসায় চলে আসল। বাসায় এসেও কেন জানি তার চোখ থেকে ঐ সুন্দর মেয়েদের মুখ সরাতে পারছিল না। এরই মধ্যে জেবু বললঃ “কাজির দেওড়ির ওইখানে ফিরি মেডিকেল ডাক্তার বইছে আমি ওইখানে রিয়াদরে নিয়া যাইতেছি”।
রাজ্জাকঃ যাও কখন আইবা?
জেবুঃ সন্ধ্যা ছয়টা হইতে রাত দশটা পর্যন্ত ডাক্তার থাকবো এর মধ্যে দেখাইয়া চইলা আমুনে।
রাজ্জাকঃ যাও তাইলে, তয় সাবধানে যাইও। (রাজ্জাক ভাবল এটাই সুযোগ বিদেশী টাকা গুলো ভালো করে দেখার, তাই সে জেবু বের হবার পর পর তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল)
রাজ্জাকের মনে এখন রাজ্যের খুশি ভর করেছে, সে একবার ট্র্যাঙ্কের সামনে যায় আমার বুক দুরু-দুরু করে ফিরে আসে। আকস্মিক তার মাথায় আসল অজু করে নিলে মনে হয় তার সাহস বাড়বে। যদিও ধারণাটা অদ্ভুত, তবুও রাজ্জাক অজু করে আসলো ও মনের জোর নিয়ে ট্র্যাঙ্ক খুলল। সুন্দর বিদেশী টাকার বস্তা খুলল। সে অবাক হয়ে দেখল এখানে ৫০০ টাকা মূল্য মানের ১১০ টি বিদেশী টাকার ব্যান্ডেল আছে। রাজ্জাক আনন্দে আত্মহারা সে কোটিপতি হয়ে গেছে। পরক্ষনেই ভাবল টাকাটা কোন দেশের তা দেখে নেয়া যাক, তাই সে তার দশম শ্রেণী পর্যন্ত অর্জিত বিদ্যার জোরে কষ্ট করে পড়ে বের করল এখানে সুন্দর ভাবে ব্যাংক অব ইন্দোনেশিয়া লিখা আছে। সে এবার টাকাগুলোর কয়েকটি ব্যান্ডেল গুনল সে দেখল এখানে প্রতি ব্যান্ডেলে ১০০টা করে নোট আছে। মানে প্রতি ব্যান্ডেলে পঞ্চাশ হাজার বিদেশী টাকা আছে! এবার সে হিসেব করে....আল্লাহ!!! ৫৫ লাখ বিদেশী টাকা!!! এই টাকার মান যদি এক টাকাও হয় আমি ৫৫ লাখ টাকার মালিক। কিন্তু বিদেশী টাকার মান তো ১ টাকা হবে না কমপক্ষে ২০ টাকা তো হবেই!... সে ভাবল। তবুও ঘোর কাটিয়ে রাজ্জাক বস্তাটি ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখল এবং আরও বেশী লুকিয়ে থাকে এমন করেই রাখল।
সকালে উঠে রাজ্জাক আর কাজে গেল না, সে চলে গেল বহদ্দার হাটের জিয়া স্মৃতি পার্কে, উদ্দেশ্য নিরিবিলি বসে চিন্তা করে একটা উপায় বের করা। সে ১০০ টাকায় টিকিট কেটে পার্কে প্রবেশ করল এবং মোবাইল বন্ধ করে দিল। এবার পার্কের পূর্ব পাশটাই বেছে নিল নিরিবিলি ভাবনার জন্য। সে শান্ত হয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিল এই টাকার মান কত তাকে এটা জানতে হবে পরে শহরের মাঝে টাকা ভাঙ্গানোর জন্য সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানটি খুঁজে নেবে। আরঃ... না থাক আগে টাকারই ব্যবস্থা হোক রাজ্জাক ভাবে...
রাজ্জাক সন্ধ্যায় এলাকায় ফিরল এবং বন্ধু টমটম চালক মতিনকে ডেকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। মতিনের আজ কাজের চাপ নেই বিকেলে টমটম স্টার্ট নিচ্ছিল না তখন সে মেরামতের জন্য ‘মটর রিপেয়ার’ গ্যারেজে দিয়ে, টমটমের চাবি মালিকের ঘরে দিয়ে এসেছে। তারা দুজন হাঁটছে হটাৎ মতিন বললঃ তুই নাকি কিছুদিন ধইরা কাজে না গিয়া জমানো টাকা জেবু থেইকা নিয়া বইসা বইসা খাচ্ছিস?
রাজ্জাক বললঃ দোস্ত সমস্যা হইব না তুই নিশ্চিত থাক। আমি অন্য একটা কাজ-কাম করার চিন্তা করতাছি।
মতিনঃ কি?
রাজ্জাকঃ কমুনে আগে চল আলী ভাইয়ের দোকান থেইকা একটা চা খাইয়া আসি।
মতিনঃ ঠিক আছে চল...
চায়ে চুমুক দিয়ে রাজ্জাক কিছুক্ষন নিশ্চুপ আর আলী ও মতিন কথা বলছে। এরই মাঝে রাজ্জাক বলে উঠলঃ আইচ্ছা আলী ভাই তোমার একটা ভাই নাকি মালয়েশিয়া থাকে?
আলীঃ হ থাকে তো।
রাজ্জাকঃ আচ্ছা আলি ভাই মালয়েশিয়ার টাকার মান কত?
আলিঃ হুম শেষ বার তো ২৫ টাকাই শুনছিলাম, আমার আম্মার লাইগ্যা বড়ভাই টেকা পাডাইছিল তহন জানছিলাম।
রাজ্জাকঃ ভাই ইন্দোনেশিয়ার টাকার মান জানো?
আলীঃ না-তো! (মতিন এবার মুখ খুলল)
মতিনঃ শুনছি ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া থেইকা গরিব দেশ তবে বাংলাদেশ থেইকা বহুত ভালো ওগো ইনকাম... তাইলে ধরি নাও ২০-২১ টাকা হইব। (রাজ্জাক হাঁ সুচক মাথা নাড়ে আর আলীও মতিনের কথায় সায় দিল)... আড্ডা শেষে রাজ্জাক বাড়ি ফিরলো রাত এগারটায় মনে রাজ্যের চিন্তা ও খুশির মিশ্রণ... কত টাকার মালিক আমি!!!
সকালে রাজ্জাক ঘুম থেকে উঠেনা; জেবু ডাকে ওগো উঠো কাম কাজ না করলে তো রাজার ভাণ্ডারও ফুরাইয়া যায় আর তুমি তো রাজা না রিক্সা ওয়ালা রাজ্জাক। তবুও রাজ্জাক ওঠেনা জেবুকেও কোন উত্তর দেয় না। জেবু সাড়া না পেয়ে চলে যায় চুলায়। রাজ্জাক হটাৎ উঠে জেবুকে কিছু না বলে চলে যায় বাইরে, আজকের উদ্দেশ্য বিদেশী টাকা ভাঙ্গায় কোথায় তা জানা। রাজ্জাক ঘুরল কখনো লাল দীঘি,কখনো লাল দীঘি আবার কখনো আগ্রাবাদ এভাবেই তিনদিন চলল। এভাবেই রাজ্জাক জেনে গেল কোথায় কিভাবে টাকা ভাঙ্গানো যায় এবং সে কিছু দালাল ও কিছু লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবে জানলো।
আবার রাজ্জাক কিছুদিন সময় নিল কিভাবে টাকা ভাঙ্গাবে সে পরিকল্পনা করার জন্য। এমনই একদিন সে বসে আছে দুই-নাম্বার গেটের মোড়ে পার্কের ভেতরে... এমন সময় সে দেখতে পেল তার দিকে একটি মেয়ে খুব মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে। মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী ও পরিপাটি। হটাৎ সে রাজ্জাককে বললঃ ‘এই যে ভাই, শুনছেন’...
রাজ্জাকঃ আমারে ডাকছেন?
অচেনা মেয়েঃ হ্যাঁ অবশ্যই আপনাকেই ডাকছি; আপনার কাছে মোবাইল হবে?
রাজ্জাকঃ হ্যাঁ,কেন?
অচেনা মেয়েঃ আমার মোবাইলটা ভুলে বাসায় ফেলে এসেছি সকালেই, এখন আমি কলেজ থেকে আসছি। আম্মুর সাথে স্যানমার যাওয়ার কথা তাই এখানে অপেক্ষা করছি; অথচ অনেকক্ষণ হল মা আসছে না। আপনার মোবাইল থেকে একটি কল দেয়া যাবে? প্লিজ।
রাজ্জাকঃ কুনো সমস্যা নাই ম্যাডাম দশটাও দিতে পারবেন(ভাব নিল)।
মেয়েটি মায়ের কাছে কল দিলো এবং মায়ের সাথে কথা বলল, পরে মেয়েটি রাজ্জাকের সাথে আলাপ জুড়ে দিল, (রাজ্জাক মেয়েটির সাথে যথা সম্ভব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেছে, চট্টগ্রামে আশার পর থেকেই রাজ্জাক শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টায় লিপ্ত); ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই মেয়েটির মা আসলো এবং রাজ্জাককে মেয়েটি বন্ধু হিসেবে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটির মা রাজ্জাককে আনন্দের সাথেই গ্রহন করলো এবং বাসায় যাওয়ার জন্য বলল। রাজ্জাক তো মহাখুশি এ যেন রাজ্য(বিদেশী টাকা) পাবার পর রাজকন্যা পাবার হাতছানি। এই হাতছানির কারনেই রাজ্জাক মেয়েটির মা আসার আগেই মেয়েটির সাথে মোবাইলে যোগাযোগ রাখার অনুমুতি নিয়ে রেখেছিল। মেয়েটির নাম শাম্মি আক্তার শান্তা, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে পড়ে। রাজ্জাক মেয়েটির চোখের ভাষায় প্রেমের হাতছানি দেখতে পেয়েছে আহা! কি অপরূপ চাহনি!!!
রাজ্জাক খুশি মনে বাসায় আসলো এবং জেবুকে বলল ভাত দিতে। ভাত খাবার সময় জেবু রাজ্জাককে অনেক কথা বলল, যার মধ্যে রাজ্জাকের সাম্প্রতিক ভিন্ন আচরণে ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনেক শঙ্কাও ছিল, কিন্তু রাজ্জাক জেবুর এসব কথাকে অবজ্ঞার সাথে কানেই নিল না শুধু বলল “দেখবা আমাগোর দিন ফির্যাআ যাইব”।
জেবুঃ কচুর দিন ফিরব বইয়া বইয়া খাইলে দিন ফেরে না, কাম করন লাগে।
রাজ্জাকঃ (উত্তর না দিয়েই) বাইরে যাইতাছি ফিরতে ২টা বাজবো।
জেবুঃ কই যাও?
রাজ্জাকঃ চিন্তা কইরো না কাম আছে।
রাজ্জাক হাঁটতে হাঁটতে পুলিশ লাইনের সামনে আসলো এবং মোবাইল বের করে শান্তাকে কল দিল; এখন রাত সাড়ে এগারোটা। শান্তা কল রিসিভ করলো এবং বলল রাজ্জাক ভাই কেমন আছেন?
রাজ্জাকঃ আমি ভালো আপনে?
শান্তাঃ আমি কি ভালো না থেকে পারি? আপনি কল দিলেন!
বিষয়: সাহিত্য
১৩৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন