অন্ধকারে ছেলের মুখটাও দেখা হলো না

লিখেছেন লিখেছেন ডোসট ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:০৫:৩১ রাত



সিদ্দিক আলম দয়াল, উত্তরাঞ্চল থেকে: মৃত ছেলের মুখ দেখতে পেলেন না হতভাগা জননী। নামাজ পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ফিরেছে রক্তাক্ত লাশ হয়ে পরদিন শনিবার রাতে। সঙ্গে বিজিবি-পুলিশ। তাড়াহুড়া করে রাতের অন্ধকারে ছেলেকে কবর দিতে বাধ্য করায় আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীদের মুখ দেখতে দেয়া হলো না। এ অভিযোগ পুলিশের গুলিতে নিহত মজনু মিয়ার স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাতা মনোয়ারা বেগমের।

পলাশবাড়ি উপজেলার মহেশপুর গ্রামের মহেশপুর গ্রামের দরিদ্র বাসিন্দা মনছুর আলীর প্রথম ছেলে মামিনুল ইসলাম মজনু। জমিজমা নেই তাই বড় ছেলে সহ সবাই অন্যের জমিতে বর্গা চাষ ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। মাঝে মধ্যে ভ্যান চালাতেন মজনু মিয়া। শুক্রবার ভ্যান চালিয়ে নামাজ পড়েন বাড়ির পাশের মসজিদে।

নামাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে ভ্যানের প্যাডেল হাতে ধরতেই স্ত্রী পিয়ারা তার কোলের শিশু মোজাহিদকে নিয়ে আসেন স্বামীর কাছে। স্ত্রী তাকে দুপুরে ভাত খেয়ে ভ্যান নিয়ে যেতে বলেন। মজনু সন্তানকে আদর করে স্ত্রীকে বলেন ভাড়াটা নামিয়ে দিয়ে বাড়ি এসে এক সঙ্গে খাবো। কিন্তু এই যাওয়াই যে তার শেষ যাওয়া হবে তা স্ত্রী পেয়ারা খাতুন বুঝতে পারেননি। স্বামী ফিরে আসবেন- এই আশায় থালে ভাত তৈরি করে স্ত্রী পেয়ারা খাতুন অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ পর তার কাছে খবর আসে পলাশবাড়ি চৌমাথায় পুলিশের সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছে। পুলিশ গুলি করেছে। কিন্তু তার স্বামী কোথায় আছে কিছু হয়েছে কিনা তা পেয়ারার কানে যায়নি। অপেক্ষা করে যখন সন্ধ্যা নামে তখন গ্রামের মানুষের কাছে জানতে পারেন, তার স্বামী মজনু থানায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তখনও তিনি জানেন না তার স্বামী আর নেই। জানেন ভাড়া নিয়ে গেলে কখনও কখনও ফিরতে দেরি হয়। জুম্মার নামাজের পর মুসল্লিরা যখন পলাশবাড়ি বন্দরে আসেন তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পাশ দিয়েই ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছিলেন মজনু মিয়া। বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে এসে বিদ্ধ হয় পুলিশের গুলি। আশপাশের লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানে তুলে নিয়ে যেতেই পুলিশ তাদের নিয়ে যায় পলাশবাড়ি থানায়। তাদের অভিযোগ পুলিশের ওপর হামলা করেছেন তিনি। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসী ও নিহতের পিতা-মাতার কথা ভিন্ন। মজনু একজন ভ্যান চালক। তিনি যখন ভ্যান নিয়ে পলাশবাড়ি কালিবাড়িতে যান তখন শুরু হয় সংঘর্ষ। জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষ। চারদিকে গুলির শব্দ আর পুলিশের বাঁশি আর ঢিল। ধোঁয়ায় অন্ধকার গোটা এলাকা। অবস্থা বেগতিক দেখে মজনু ভাড়া নামিয়ে দেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে বিদ্ধ হয় পুলিশের গুলি। গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ তাকে নিয়ে যায় পলাশবাড়ি থানায়। তখনও তিনি ভ্যানে শুয়ে নড়াচড়া করছিলেন বলে ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পুলিশ মজনু সহ ২ জন গুলিবিদ্ধকে থানায় নিয়ে রাখে। তখনও তার বাড়িতে কেউ জানেন না মজনু কোথায়। স্বামীর জন্য অনেকক্ষণ ভাত নিয়ে বসে থাকার পর দেরি হওয়ায় খোঁজ নিতে বের হন পাশের রাস্তায়। তখন তিনি শুনতে পান পলাশবাড়িতে গোলমাল হয়েছে। পুলিশ গুলি করেছে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা জানাজানি হলে বন্দর ছেড়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন অবস্থান নেয় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের দুই পাশে। তারপর লোকমুখে খবর পৌঁছে যায় মজনু পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। খবর শুনে পেয়ারা বেগম ও মা মনোয়ারা বেগম ছেলেকে খুুঁজতে যান থানায়। থানা থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন মনোয়ারা বেগম। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসেন বাড়িতে। বাড়ি এসে শুনতে পারেন মজনু আর নেই। বাড়ি সহ মহেশপুর গ্রাম জুড়ে শুরু হয় হাহাকার। স্ত্রী পেয়ারা বেগম, মা মনোয়ারা বেগম সহ স্বজনদের গগনবিদারী কান্নায় মহেশপুর গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন স্ত্রী পেয়ারা বেগম ও মা মনোয়ারা বেগম। শুরু হয় খোঁজখবর, লাশ কোথায়? থানা থেকে নাকি বলা হয় যথাসময়ে লাশ দেয়া হবে। নিহতের ফুপা রিয়াজ মিয়া বলেন, মজনু কোন দলের লোক নয়। সে ভ্যানচালক। বিকালে পলাশবাড়ি থেকে লাশ গাইবান্ধা হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে রাখা হয় শনিবার বিকাল পর্যন্ত। নিহতের গ্রামের বাড়িতে খবর দেয়া হয় কবর তৈরি করতে। এখবর পেয়ে পলাশবাড়িতে গায়েবানা জানাজা হয়। তারপর রাতে কড়া পুলিশ ও বিজিবি প্রহরায় লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রাতে। সোজা কবরের পাশে। হস্তান্তর করা হয় নিহতের স্বজনদের হাতে। কিন্তু শর্ত দেয়া হয় তাড়াতাড়ি কবর দেয়ার। লাশ এসেছে খবর পেয়ে হাজার হাজার লোক জড়ো হতে থাকে নিহত মজনুকে এক নজর দেখতে। কিন্তু অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায়নি। লাশ এসেছে শুনে স্ত্রী বার বার বুক ফাটা কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ পিতা মুনছুর আলী বলেন, ছেলের মুখটাও ভাল করে দেখা হলো না । জানাজা হয়েছে কিনা জানি না। গোসল কাফন কিছুই নিজ হাতে করতে পারলাম না। মা মনোয়ারা বেগম বলেন- রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়া করে ছেলের মুখ বোঝা যায়নি। তাড়াহুড়া করে কবর দেয়ায় গ্রামের কেউ তাকে শেষ বারের মতো দেখতে পায়নি। বাড়ির লোকজনও অন্ধকার আর তাড়াহুড়ার মধ্যে নিহত মজনুর মুখটাও ভাল করে দেখতে পায়নি। স্ত্রী পেয়ারা বেগম বলেন- আমার স্বামী নিরীহ। তার কোন দল নাই। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। চাই আমার ছেলের বাঁচার গ্যারান্টি।

বিষয়: বিবিধ

১১৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File