শরীয়াতের মানদন্ডে শবে বরাতঃ ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী
লিখেছেন লিখেছেন বিভীষিকা ২২ মে, ২০১৬, ০৮:৫২:৩৮ সকাল
ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
‘শবে বরাত’ নাকি ‘লাইলাতুন নিসফি মিন সাবান’?
আমাদের দেশে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ফারসী ভাষায়, শব অর্থ রজনী। আর বরাত অর্থ ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাতের অর্থ দাঁড়ায়, ভাগ্য রজনী। মূলত: এই পরিভাষাটি কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং একটি আয়াতের অসতর্ক ব্যাখ্যা থেকেই এ ধরনের নামকরণ হতে পারে।
সূরা দুখানে বলা হয়েছে,
﴿ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ . فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴾
“নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়”(সূরা দুখান:৩,৪)।
‘বরকতময় রাত’ বলতে অসাবধানতাবশত কেউ কেউ মধ্য শাবানকে বুঝেছেন। অথচ এর দ্বারা যে রমাদান মাসে অবস্থিত কদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে, তা একটি অকাট্য বিষয়।
এজন্যই ইবনুল কায়্যীম (র.) বলেন,
” وهذه هي ليلة القدر قطعا لقوله – تعالى -: إنا أنزلناه في ليلة القدر ومن زعم أنها ليلة النصف من شعبان فقد غلط “
“এটি অকাট্যভাবে কদরের রাত্রি। কারণ আল্লাহ বলছেন, নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। আর যারা শাবানের মধ্য রাত্র ধারণা করছে, তারা আসলে ভুল করছে”।
ইবনু কাসিরও বলছেন,
"ومن قال :إنها ليلة النصف من شعبان فقد أبعد النَّجْعَة فإن نص القرآن أنها في رمضان “
“যারা শাবানের মধ্য রাত্রি বলছেন, তারা বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। বরং এটি যে রমাদান মাসের একটি রাত, সে ব্যাপারে কুরআনের ভাষা সুস্পষ্ট”।
আল্লামা শানকিতী বলেন, ” إنها دعوى باطلة ” (মধ্য শাবানের দাবী) একটি ভিত্তিহীন দাবী”।
এভাবে প্রমাণিত হলো, কুরআনের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ রাতের কোন উল্লেখ নেই। বরং একাধিক হাদীসে এ রাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটু পরেই যেগুলোর আলোচনা আসবে। যেথায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবানের ১৫তম রজনী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই শবে বরাত না বলে এ রাতকে হাদীসের দেয়া ভাষায় নামকরণ করাই বাঞ্জনীয়।
তবে হা, বরাত বলতে যদি আরবী براءة (বারাআত) কে বুঝানো হয়, তাহলে অনেকটা মেনে নেয়া যায়। যার অর্থ, মুক্তি বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। তাহলে পুরো অর্থ দাঁড়াবে, গুনাহ বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত। কারণ হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, এ রাতে এমনটি ঘটে থাকে।
শরীয়তের মানদন্ডে শাবানের ১৫তম রজনীর মাহাত্ম্য:
শাবানের মধ্য রজনী একটি পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনী। এর রয়েছে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ করুণা ধন্য এ রাত। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা উত্তম। এ মর্মে কুরআনে কিছু না থাকলেও হাদীসের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট বক্তব্য। একাধিক হাদীস দ্বারা এই মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। হযরত মু‘আয বিন জাবাল, আবু বকর, আবু ছা‘লাবাহ, আবু মুসা আশ‘আরী, আবু হুরায়রা, ‘আইশা, আবদুল্লাহ বিন ‘উমার ও আওফ বিন মালিক (রা.) প্রমুখ সাহাবী থেকে এ সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
নিন্মে হাদীসগুলো সূত্র ও স্তর বিবরণসহ উল্লেখ করা হলো:
১. মু‘আয বিন জাবালের হাদীস:
হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন,
يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
“আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির দিকে শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি দেন। অতঃপর তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে মাফ করে দেন, শুধুমাত্র মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত”।
এ হাদীসটি ইবনি হিব্বান তাঁর ছহীহের বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাইসামী এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন:
رواه الطبراني في الكبير والأوسط ورجالهما ثقات.
“হাদীসটি ইমাম তাবারানী তাঁর আল-মু‘যাম আল-কাবীর ও আছ-ছগীরের মধ্যে রিওয়ায়িত করেছেন। এ দুটোতেই হাদীসটির বর্ণনাকারীরা নির্ভরযোগ্য”।
২. হযরত আবু বকরের হাদীস:
হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন,
(إذا كانت ليلة النصف من شعبان ينزل الله تبارك وتعالى إلى سماء الدنيا فيغفر لعباده إلا ما كان من مشرك أو مشاحن لأخيه
যখন শাবানের মধ্য রাত আসে, আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন। তারপর সব বান্দাকে মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন তাদেরকে ছাড়া”।
ইমাম হাইসামী مجمع الزوائد এ বলেন:
رواه البزار وفيه عبد الملك بن عبد الملك ذكره ابن أبي حاتم في الجرح والتعديل ولم يضعفه وبقية رجاله ثقات
হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে আবদুল মালিক বিন আবদিল মালিক নামে একজন রাবী আছেন। ইবনু আবি হাতিম আল-জারহ অত-তাদিল কিতাবে তার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেন নি। এছাড়া, সনদের অন্যান্য সব রাবী (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত”।
৩. আবু ছা‘লাবাহর হাদীস:
হযরত আবু ছা‘লাবাহ থেকে বর্ণিত। নবী (স.) ইরশাদ করেন,
يطلع الله إلى عباده ليلة النصف من شعبان فيغفر للمؤمنين ويمهل الكافرين ويدع أهل الحقد لحقدهم حتى يدعوه
“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অর্ধ শাবানের রাতে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং সমস্ত মুমিনকে মাফ করে দেন। তবে কাফিরদেরকে অবকাশ দেন। আর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে পরিত্যাগ করেন, যতক্ষণ না তারা হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করে”।
হাদীসটি ইমাম বাযযার তার মুসনাদে ও ইমাম বায়হাকী তার আস-সুনান আছ-ছুগরাতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাইসামী বলেন:
رواه الطبراني وفيه الأحوص بن حيكم وهو ضعيف
তাবারানী হাদীসটি বেওয়ায়েত করেছেন। এর মধ্যে আল-আহওয়াস বিন হাকীম নামে একজন রাবী আছেন। তিনি দুর্বল”।
৪. আবু মুসা আশ‘আরীর হাদীস:
আবু মুসা আশ‘আরী (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ في لَيْلَةِ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خلقة إلا لِمُشْرِكٍ أو مُشَاحِنٍ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাত্রিতে তাকান। তারপর মুশরিক ও মুশাহিন (অন্যের প্রতি বৈরিভাব পোষণকার) ব্যতীত তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন”।
ইমাম ইবনু মাজাহ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। مجمع الزوائد (মাজমাউয যাওয়াইদ) নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, إسناده ضعيف এর সনদটি দুর্বল। তবে ইমাম আলবানী বলছেন, حديث حسن এটি একটি হাসান হাদীস।
৫. হযরত আবু হুরায়রার হাদীস:
عن أبي هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: إذا كان ليلة النصف من شعبان يغفر الله لعباده إلا لمشرك أو مشاحن
হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেন, “যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে, আল্লাহ তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক ও মুশাহিন ব্যতীত”।
ইমাম ইবনুল হাইসামী এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন, “হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে হিশাম বিন আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি আছেন। তাকে আমি চিনি না। তবে অন্যান্য সবাই নির্ভরযোগ্য”।
৬. হযরত ‘আইশার হাদীস:
ক. ইমাম তিরমিযি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
فَقَدْتُ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فإذا هو بِالْبَقِيعِ فقال: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ الله عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ، قلت: يا رَسُولَ اللَّهِ إني ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فقال: إِنَّ اللَّهَ عز وجل يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ من شَعْبَانَ إلى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ من عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
“একদা রাত্রিতে আমি রাসূল (স.) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই তার সন্ধানে বের হলাম। জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে তাকে পেলাম। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভেবেছিলাম, আপনি অপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন এবং বনী কালবের ছাগল পালের লোমের চেয়ে অধিক পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন”।
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,
حَدِيثُ عَائِشَةَ لَا نَعْرِفُهُ إلا من هذا الْوَجْهِ من حديث الْحَجَّاجِ وسَمِعْت مُحَمَّدًا يُضَعِّفُ هذا الحديث
‘আইশার হাদীসটি হাজ্জাজের এই সূত্র ছাড়া অন্য কোন ধারা থেকে আমাদের জানা নেই। মুহাম্মাদ এই হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন বলে শুনেছি’।
হাদীসটি আরো বর্ণনা করেছেন ইবনু মাজাহ, ইবনু আবি শাইবাহ, আহমাদ বিন হাম্বল। শুআইব আরনাউত বলেন, إسناده ضعيف এর সনদটি দুর্বল।
খ. ইমাম বায়হাক্কী বর্ণনা করেন,
أن عائشة قالت: قام رسول الله -صلى الله عليه وسلم- من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد قبض فلما رأيتُ ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت، فلما رفع الي رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال: يا عائشه أو يا حميراء: أظننت أن النبي قد خاس بك؟ قلت: لا والله يا رسول الله، ولكنني ظننتُ أنك قبضت لطول سجودك، فقال: أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت: الله ورسوله أعلم قال هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين، ويرحم المسترحمين، ويؤخر أهل الحقد كما هم)
হযরত ‘আইশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) রাতে নামাযে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো, তাঁর হয়তো ইনতেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে ‘আইশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা? নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদেও ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই”।
গ. ইমাম বায়হাকীর অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
فقال هذه الليلة ليلة النصف من شعبان، ولله فيها عتقاء من النار بعدد شعور غنم كلب،لا ينظر الله فيها إلى مشرك ولا إلى مشاحن ولا إلى قاطع رحم ولا إلى مسبل ولا إلى عاقّ لوالديه ولا إلى مدمن خمر، قال: ثم وضع عنه ثوبيه فقال لي: يا عائشة تأذنين لي في قيام هذه الليلة، فقلت: نعم بأبي وأمي فقام فسجد ليلا طويلا حتى ظننت أنه قبض، فقمت التمسته ووضعت يدي على باطن قدميه فتحرك ففرحت وسمعته يقول في سجوده: أعوذ بعفوك من عقابك، وأعوذ برضاك من سخطك، وأعوذ بك منك جل وجهك لا أحصي ثناءً عليك، أنت كما أثنيتَ على نفسك، فلما أصبح ذكرتهن له فقال يا عائشة: تعلمتِهنَّ؟ فقلت: نعم. فقال: تعلميهنَّ وعلميهنَّ؛ فإن جبريل عليه السلام علمنيهنَّ وأمرني أن أرددهن في السجود
‘অতঃপর তিনি বললেন, এই রাত্রিটি হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত্রি। এই রাতে আল্লাহ কালব গোত্রের ছাগলের গায়ে যে পরিমাণ পশম আছে, সেই পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। তবে আল্লাহ এ রাতে মুশরিক, বিদ্বেষপোষণকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, হাটুর নীচে পোশাক পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান এবং মাদকাসক্তের প্রতি তাকান না। অতঃপর আবরণ সরিয়ে বললেন, হে ‘আইশা! তুমি কি আমাকে এই রাত্রে ইবাদাত করার অনুমিত দিবে? আমি বললাম, অবশ্যই, আমার বাবা-মা আপনার জন্য কুরবান হোক। অতঃপর তিনি দাঁড়ালেন এবং এত লম্বা সিজদা করলেন যে, আমার ভয় হলো, তিনি মনে হয় ইনতেকাল করেছেন। তাই আমি উঠে তার শরীর স্পর্শ করলাম। তাঁর পায়ের তলদেশে হাত রাখলাম। তাঁর পা নড়ে ওঠলো। আমি খুশী হলাম। তাকে শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, (হে আল্লাহ) তোমার ক্ষমার দ্বারা তোমার শাস্তি হতে আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টির দ্বারা তোমার ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই। তোমার থেকেই তোমার কাছে আশ্রয় চাই। তোমার প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। তুমি তেমন, যেমনটি তুমি নিজেই নিজের প্রশংসা করেছ। অতঃপর যখন সকাল হলো, আমি এ দু‘আটি বললাম। রাসূল (স.) বললেন, ‘আইশা, তুমি মুখস্ত করে ফেলেছ? বললাম, হ্যাঁ। এগুলো মানুষকে জানিয়ে দাও, শিখিয়ে দাও। জিব্রাইল (আ.) আমাকে এগুলো শিখিয়েছেন এবং সিজদাতে এ দু‘আ পুনরাবৃত্তি করতে বলেছেন’।
ইমাম বায়হাকী হাদীসটি বর্ণনা করে বলছেন, এটির সনদ দুর্বল।
৭. হযরত আবদুল্লাহ বিন ‘উমরের হাদীস:
عن عبد الله بن عَمْرٍو انَّ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- قال: يَطَّلِعُ الله عز وجل إلى خلقة لَيْلَةَ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ الا لاِثْنَيْنِ: مُشَاحِنٍ وَقَاتِلِ نَفْسٍ
হযরত আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (স.) বলেন, “আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, দু’ শ্রেণী ব্যতীত: ক. মুশাহিন (বিদ্বেষপোষণকারী) ; খ. মানব হত্যাকারী”।
ইমাম হাইসামী বলেন,
رواه أحمد وفيه ابن لهيعة وهو لين الحديث وبقية رجاله وثقوا
“ইমাম আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে রয়েছে, ইবনু লাহীয়াহ। তিনি লাইয়্যেনুল হাদীস (হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কিছুটা কোমলাতা/দুর্বলতা বিশিষ্ট)। তবেঅন্যান্য সব রাবী নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত”।
এছাড়া, ইমাম বাযযারও এটি বর্ণনা করেছেন।
৮. আওফ বিন মালিকের হাদীস:
عن عوف بن مالك قال قال رسول الله: – الله عليه وسلم- (يطلع الله تبارك وتعالى على خلقه ليلةَ النصف من شعبان، فيغفر لهم كلِّهم إلا لمشركٍ أو مشاحن
হযরত আওফ বিন মালিক থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সৃষ্টির উপর শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি নিবন্ধন করেন। এবং তাদের সবাইকেই মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও মুশাহিন ছাড়া।
ইমাম হাইসামী বলেন,
رواه البزار وفيه عبدالرحمن بن زياد بن أنعم وثقه أحمد بن صالح وضعفه جمهور الأئمة وابن لهيعة لين وبقية رجاله ثقات
বাযযার হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এতে আবদুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউম রয়েছে। ইমাম আহমাদ তাকে নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে অধিকাংশ আলিম তাকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া , ইবনু লাহিয়াহও আছেন। যিনি একটু নরম। বাকী সব রাবী সিকাত”।
৯. কাসীর বিন মুররা আল-হাদরামীর হাদীস।
عن كثير بن مرة الحضرمي، قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: (إن اللهَ ينزل ليلةَ النصف من شعبان، فيغفر فيها الذنوب إلا لمشركٍ أو مشاحن
হযরত কাসীর বিন মুররা আল-হাদরামী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ শাবানের মধ্য রাতে অবতীর্ণ হন। তারপর এ রাতে মুশরিক ও মুশাহিনের গুনাহ ব্যতীত অন্য সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন”।
হাদীসটি ইবনু আবি শাইবাহ, আবদুর রাজ্জাক তাদের মুছান্নাফে এবং বাযযার তাঁর মুসনাদের বর্ণনা করেছেন।
এতক্ষণে আমাদের সামনে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তাহলো, উপরিউক্ত হাদীসগুলোর সনদসমূহ সমপর্যায়ের নয়। কিছু শুদ্ধ, আবার কিছু দুর্বল। তবে সবগুলো একত্রিত করলে এ কথা না বলে কোন উপায় নেই যে, এ রাতটির ফজিলত একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
এজন্য গবেষকগণ বলছেন,
أنَّ الأحاديثَ في فضل ليلة النصف من شعبان ثابتة وفي أقلِّ أحولها أحاديث حسنة لغيرها بمجوع طرقها، ومن العلماء من صرح أنها صحيحة لغيرها بمجموع طرقها لأنّ من طرقها حسنة بذاتها
বর্ণনার সবগুলো ধারা একত্রিত করলে হাদীসগুলোর সর্ব নিন্মস্তর হবে ‘হাসান লিগইরিহা’।অনেকগবেষক আবার স্পষ্ট করে বলছেন যে, এদের সবগুলো ধারা সমন্বিত করলে ‘ছহীহ লিগইরিহা’র পর্যায়ভুক্ত হবে। কারণ এগুলো যে সব ধারাই বর্ণিত হয়েছে, তাতে নিজেরাই ‘হাসান’ হিসেবে গণ্য।
এ প্রসঙ্গে শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ সর্বজন স্বীকৃত আলেমদের বক্তব্য বিষয়টিকে আরো প্রতিভাত করবে।
নিন্মেতা প্রদত্ত হলো,
হাফিজ ইবনু রজব বলেন,
اختلف فيها، فضعفها الأكثرون، وصحح ابن حبان بعضها، وخرجه في صحيحه.
অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। অনেকেই এগুলোকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হিব্বান এদের কিছুকে ছহীহ বলেছেন এবং তার ছহীহ কিতাবের মধ্যে তাখরীজ করেছেন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেন,
وأما ليلة النصف من شعبان ففيها فضلٌ، وكان في السلف من يصلي فيها، لكنَّ الاجتماع فيها لإحيائها في المساجد بدعةٌ، وكذلك الصلاة الألفية
“অর্ধ শাবানের রাতের মাহাত্ম্য রয়েছে। সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে নামায পড়তেন। তবে মসজিদের মধ্যে এ রাতে ইবাদাতের জন্য একত্রিত হওয়াটা বিদ‘আত। তদ্রƒপ আলফিয়্যাহ নামক বিশেষ নামায আদায় করা”।
তিনি আরো বলেন,
ليلةُ نصف شعبان رويَ فيها من الأخبار والآثار ما يقتضي أنها مفضلة ومن السلف من خصَّها بالصلاة فيها وصوم شعبان جاءت فيه أخبار صحيحة أما الصوم يوم نصفه مفرداً فلا أصل له، بل يكره، قال: وكذا اتخاذه موسماً تصنع فيه الأطعمة والحلوى وتظهر فيه الزينة وهو من المواسم المحدثة المبتدعة التي لا أصل لها، وما قيل من قَسْمِ الأرزاق فيها لم يثبت
অর্ধ শাবানের রাত্রির ব্যাপারে অনেক হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। যদ্বরা এ রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাফ বা পূর্বসুরীদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে বিশেষ করে নামায আদায় করতেন। শাবান মাসের রোজার ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীস এসেছে। তবে শুধুমাত্র পনেরতম দিবসে একটি রোজা পালন করার কোন মূলভিত্তি নেই। বরং তা মাকরূহ। তিনি আরো বলেন, তদ্রƒপ এটিকে রকমারী খাদ্য, হালুয়া তৈরি ও সাজ-সজ্জা প্রকাশের উপলক্ষ বানানো বিদআত। যার কোন ভিত্তি নেই। আর এ রাতে রিযিক বন্টিত হয় এ মর্মে যা কিছু বলা হয় তা প্রমাণিত হয়নি” ।
ইমাম ইবনু নুজাইম আল-মাসরী বলেন,
ومن المندوبات إحياءُ ليالي العشر من رمضان وليلتي العيدين وليالي عشر ذي الحجة وليلة النصف من شعبان كما وردت به الأحاديث وذكرها في الترغيب والترهيب مفصلة والمراد بإحياء الليل قيامه وظاهره الاستيعاب ويجوز أن يراد غالبه، ويكره الاجتماع على إحياء ليلة من هذه الليالي في المساجد،
যে রাতগুলোকে জাগ্রহ রাখা মুস্তাহাব, সেগুলো হচ্ছে: রমাদানের দশরাত্র, দুই ঈদের দুই রাত্র, জিলহাজ্জ মাসের দশ রাত্র ও শাবানের মধ্যরাত্র। এ মর্মে একাধিক হাদীস রয়েছে। তারগীব ও তারহীব কিতাবে এগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। রাতকে জাগ্রহ রাখার অর্থ হলো, ইবাদাতের মাধ্যমে বিনিদ্র রজনী কাটানো। পুরো রাত বা রাতের বেশির ভাগ সময়, দুটোই হতে পারে। এ সব রাতে ইবাদাতের জন্য মসজিদের একত্রিত হওয়া মাকরুহ”।
আল্লামা মুবারাকপুরী তার তুহফাতুল আহওয়াজী নামক গ্রন্থে বলেন,
اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلاً… فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء والله تعالى أعلم
“অর্ধ শাবানের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে একাধিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলো সামষ্টিকভাবে প্রমাণ করে যে, এ রাতের একটি ভিত্তি আছে”। এসব হাদীস সামষ্টিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যারা মনে করে অর্ধ শাবানের রাতের ব্যাপারে কিছুই সাব্যস্ত হয়নি। আল্লাহই ভালো জানেন”।
আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি কথা শুরু করেছেন এভাবে,
্রحديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضاًগ্ধ،
“হাদীসটি ছহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। যাদের একটি আরেকটিকে মজবুত করে”।
আরশেষ করেছেন এ কথা বলে,
্রوجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب، والصحة تثبت بأقل منها عدداً، مادامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديثগ্ধ،
মোটামুটি কথা হলো, এই সব ধারায় বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে ছহীহ বা বিশুদ্ধ। এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্র দিয়েও হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়। যদি না তাতে প্রবল কোন দুর্বলতা থাকে। যেমনটি এই হাদীস”।
এ রাতের ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই, এ মতের প্রবক্তাদের দাবী খন্ডন করতে গিয়ে আল্লামা আলবানী বলেন,
্রليس مما ينبغي الاعتماد عليه، ولئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول، فإنما أتي من قبل التسرع، وعدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديكগ্ধ.
এটা নির্ভরযোগ্য কথা নয়। এ ধরনের কথা যদি কেউ সাধারণভাবে বলেও থাকে, তবে তা নিতান্তই তাড়াহুরোপ্রসূত। হাদীসটির সবগুলো সূত্র বা বর্ণনার ধারা গবেষণায় যথাসম্ভব শক্তি ব্যয় না করেই এমনটি বলা হতে পারে”।
এ রাতে করণীয়:
উপরোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা এ রাতের মাহাত্ম্য প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে এ রাতের করণীয় কি তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। শুধুমাত্র হযরত আইশার হাদীসে কিছু নমুনা পাওয়া যায়। তবে করণীয়র চেয়ে এগুলোতে বর্জণীয় কাজের প্রতিই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আর সে গুলো হচ্ছে: ১. শিরক ২. অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ হওয়া, ৩. কাউকে হত্যা করা, ৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা; ৫.টাখনুর নীচে কাপড় পরা. ৬. মা-বাবার অবাধ্য হওয়া ৭. মদ সেবন করা। তাই এ রাত্রির মাহাত্ম্য অর্জন করতে হলে প্রথমেই এ সব কাজ থেকে নিজেকে পবিত্র করতে হবে। তাওবাহ ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুসংহত করে নেয়ার মাধ্যমে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানির মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে।
বেশির হাদীসে দুটো জিনিস বেশি এসেছে। শিরক ও বিদ্বেষ। কারণ এদুটো এমনই মারাত্মক অপরাধ, যা মানুষের ধার্মিকতার মূলে কুঠারাঘাত করে। শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ধার্মিকতার কোন লেশমাত্র থাকে না। আর হিংসা-বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। মুসিলম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়। তাদের শক্তি খর্ব হয়ে যায়। বিজাতীয় অধিপত্য বিস্তৃত হয়। ইসলামের পতাকা হয় অবনমিত। এভাবে এক পর্যায়ে ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজাতীয় কৃষ্টিকালচার ও জীবনধারার প্রবল আঘাতে। তাছাড়া, যে ব্যক্তি অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করে তার ধার্মিতাবোধ ও ধর্মানুশীলন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে পেয়ে তা শুন্যের কোটায় চলে যায়। কারণ ইসলামের প্রতীকী পর্যায়ের ইবাদাতগুলো সামষ্টিক চেতনাদীপ্ত। নামায, রোজা, যাকাত, হাজ্জ ও আমরু বিল মারুফ, অননাহই আনিল মুনকার ইত্যাদি। মুশাহিন অন্যদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে যেমন পছন্দ করেনা, তেমনি অভাবীদের প্রতি যাকাতের হাত প্রসারিত করতে পারে না….এভাবেই তার ধর্মবোধ নষ্ট হয়ে যায়। এক কথায়, শিরক আল্লাহর সাথে আর বিদ্বেষ মানুষের সাথে সম্পর্ক বিনষ্ট করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ধর্মকেই ধ্বংস করে দেয়।
এছাড়া ও যে কাজ গুলো করা যেতে পারে, তাহলো,
ক. নফল নামায, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত,ইলম চর্চা, দুআ ইত্যাদি। তবে তা একাকী করাই উত্তম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ রাতের কোন নির্দিষ্ট নামায বা অন্যকোন নির্দিষ্ট ইবাদাত নেই। যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ রাত উপলক্ষ্যে, জামাতের সাথে বিশেষ ধরনের নামায আদায় করা, কিংবা অনিবার্য মনে করে মিলাদ মাহফিল করা বা মিষ্টি-হালুয়া ইত্যাদি বিরতণ, কিংবা ভাগ্য রজনী মনে করে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে এ নিয়্যতে এ রাতে রকমারী সুস্বাদু খাদ্য ব্যঞ্জনা খাওয়া, মসজিদ-মাজার ইত্যাদি আলোকসজ্জিত করা, ঈদ উৎসবের আমেজ নিয়ে আড়ম্বতাপূর্ণ পরিবেশে একত্রিত হওয়া, এ রাতকে লাইলাতুল কদরের সমপর্যায়ে নিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অধিক প্রদান করা এগুলো সবই হচ্ছে বাড়াবাড়ি।
পরের দিন রোজা রাখা যাবে কিনা?
প্রথম কথা হলো, রাসূল (স.) শাবান মাসের বেশির ভাগই রোজা রাখতেন। মেযনটি নিচের হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয়।
روى أسامة بن زيد عن رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم، أنه سأله قائلاً: يا رسول الله لم أرك تصوم من شهر من شهور العام كما تصوم من شهر شعبان ! فقال عليه الصلاة والسلام: ذلك شهر يغفل عنه كثير من الناس بين رجب ورمضان، وهو شهر ترتفع فيه الأعمال إلى الله عز وجل، فأحب أن يرتفع عملي إلى الله وأنا صائم
হযরত উসামাহ বিন যাইদ থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূল স. কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, শাবান মাসে আপনি যে পরিমান রোজা রাখেন, আপনাকে অন্য কোন মাসে এত রোজা রাখতে দেখিনা। তখন রাসূল বললেন, রজন এবং রমাদানের মধ্যে অবস্থিত শাবান সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই উদাসীন। তাছাড়া, এ মাসে মানুষের আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়, তাই আমি চাই রোজাদার অবস্থায় যেন আমার আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়”।
খ. হযরত আইশা থেকে বণিত।
وَلَمْ أَرَهُ صَائِمًا مِنْ شَهْرٍ قَطُّ أَكْثَرَ مِنْ صِيَامِهِ مِنْ شَعْبَانَ ، كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ كُلَّهُ ، كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ إِلا قَلِيلا .
রাসলূকে (স.) শাবান মাসের মত এত রোজা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি । তিনি পুরো শাবান কিংবা এর অধিকাংশ অংশই রোজা রাখতেন।
দ্বিতীয়ত: শুধু ১৫ই শাবান দিবসে একটি রোজা রাখা যাবে কিনা, এ ব্যাপারে একটি হাদীস রয়েছে। তবে হাদীসটি বিশুদ্ধ না হওয়ায় তা প্রমাণযেগ্য নয়।
হাদীসটি হচ্ছে:
عن عَلِيِّ بن أبي طَالِبٍ قال، قال رسول الله –صلى الله عليه وسلم-: (إذا كانت لَيْلَةُ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا فإن اللَّهَ يَنْزِلُ فيها لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إلى سَمَاءِ الدُّنْيَا فيقول: ألا من مُسْتَغْفِرٍ لي فَأَغْفِرَ له، ألا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ، ألا مبتلى فَأُعَافِيَهُ، ألا كَذَا ألا كَذَا حتى يَطْلُعَ الْفَجْرُ
“হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, অর্ধ শাবান যখন আসে, তখন তোমরা এর রাত্রিটিকে (ইবাদাতের মাধ্যমে) জাগ্রত রাখো এবং তার (পরবর্তী) দিবসে রোজা রাখ। কারণ আল্লাহ এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আকাশে নাযিল হন এবং বলতে থাকেন, কেউকি আছো ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো, কেউ কি আছো রিযিক অন্বেষণকারী, তাকে রিযিক দেবো, কেউ কি আছো বিপদাপন্ন/অসুস্থ, তাকে বিপদমুক্ত/সুস্থতা দেব। কেউ কি আছো…কেউকি আছো..? এভাবে সুর্যাস্ত পর্যন্ত বলতে থাকেন”।
এ হাদীসটি ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তবে হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এ জাতীয় দর্বল সনদবিশিষ্ট হাদীস দিয়ে প্রমাণ পেশ করা সমীচিন নয়। এ ব্যাপারে সরাসরি হাদীসবিশারদদের মতামত দেখা যাক:
ইমাম ইবনুল যাওযী বলছেন, هذا حديث لا يصحُّ হাদীসটি শুদ্ধ নয়। ইরাকী ও ইমাম আইনী বলেন, إسناده ضعيف এর সনদ দুর্বল। ইমাম ইবনু শিহাব আল-বুসাইরী বলেন,
هذا إسناد فيه ابن أبي سبرة، واسمه أبو بكر بن عبد الله بن محمد بن أبي سبرة. قال أحمد بن حنبل، ويحيى ابن معين: يضع الحديث
এর সনদের মধ্যে রয়েছেন ইবনু আবী সুবরাহ। তার পুরো নাম, আবু বকর বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আবি সুবরাহ। ইমাম আহমাদও ইয়াহইয়া বিন মায়ীন বলেন তার সম্পর্কে: তিনি হাদীস জাল করেন।
ইমাম বুখারী বলেন: লোকটি দুর্বল। নাসাঈ বলেন, متروك الحديث তার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। ইবনু হিব্বান বলেন,
كان ممن يروي الموضوعات عن الثقات، لا يجوز الاحتجاج به.
আবু সুবরাহ জাল হাদীস বর্ণনাকারীদের একজন। তার বর্ণনা দিয়ে প্রমাণ পেশ করা বৈধ নয়।
ইমমা আলবানী বলেন: হাদীসটি খুবই দুর্বল কিংবা বানোয়াট।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,
أنّ من صام هذا اليوم بنية صوم يوم من شعبان، أو الأيام البيض أو وافق يوم الاثنين أو الخميس فلا شيَء عليه، بل أصاب السنة كما هو معلومٌ عند أهل الشأن؛ فالنية هي الحدّ الفاصل في صيام هذا اليوم، وصدق الصادق المصدوق بقوله: (إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى..)
যদি কেউ এ নিয়্যাত করে ১৫ শাবানের রোযা রাখে যে, এটি শাবান মাসের একটি দিনের রোযা কিংবা বেজোড় দিবসসমূহ অথচা তা সোম ও বৃহস্পতিবারের অভ্যাসগত রোযার সাথে মিলে যায়, তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং এর মাধ্যমে সে সুন্নতেরই অনুসরণ করলো। নিয়্যাতই এখানে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রাসূল (স.) বলেন, নিয়্যাতের উপরই নির্ভরশীল মানুষের আমল”।
মোট কথা, এ রাতের মাহাত্ম্য আছে, তবে সীমালংঘনের সুযোগ নেই।
বিষয়: বিবিধ
১৮৮৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক কিছু ক্লিয়ার হলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
কিন্তু "ভাগ্য" এ কথাটি কোথাও পাচ্ছি না, যার উপর ভিত্তি করে আপনার এত বড় পোষ্ট, অবশ্য "ভাগ্য" বললে আপনার মত আমারও আপত্তি থাকতো।
নিসফ শাবানের ব্যপারে আপনার সাথে একমত হতে পারছিনা, কারণ এ ব্যপারে কিছু সহীহ পাওয়া যায়, এখানে একটি হাদিস তাহকীক সহ দিলাম।
আশাকরি বুঝবেন, বিস্তারীত জানতে এখানেও দেখতে পারেন। Click this link
শেষ কথা হলো, আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, কিছু এলাকায় শবে বরাতকে কেন্দ্র করে কিছু সংখ্যক লোক সম্মেলিত অমল করে থাকে। আমাদের এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। এখানে কিছুতেই সম্মেলিতভাবে কিছু করার সুযোগ নাই।
এশার নামায তো অবশ্যই মসজিদে জামাতের সহিত আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে একে অপরকে ডেকে ডেকে মসজিদে নিয়ে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না।
(মারাকিল ফালাহ ২১৯)
অবে হ্যাঁ কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, আর তারা সবাই নিজ নিজ আমলসমূহ একা একা আদায় করে তাহলে কোন সমস্যা নাই।
কোন কোন জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল। তবে হ্যাঁ কেউ রাতে আমল করতে আসলে ইমাম সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করলে ইমাম সাহেব সে বিষয়ে কিছু বললে তখন যদি তা শুনার জন্য কয়েক জন লোক একত্রিত হয়ে যায় তাতে কোন সমস্যা নাই।
শবে বরাতে বর্জনীয় কাজঃ
আমাদের শবে বরাতে সে সব কাজ বর্জন করতে হবে তা হলো,
এক, হালুয়া রুটির আয়োজন করা।
দুই, মসজিদে মসজিদে আলোকসজ্জা করা।
তিন, হিন্দুদের মত আতশবাজি পুটানো।
চার, দলবদ্ধ ইবাদতকে আবশ্যক মনে করে মসজিদে বা কোথাও একত্র হওয়া এবং এবাদত করা।
পাঁচ, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা।
এবং ছয়, দলবদ্ধ হয়ে কবর যেয়ারত করা। শবে বরাতে রাসূল সাঃ এর কবর যেয়ারত করার যে হাদীসটি আছে তা যয়ীফ হাদীস। তাই এই রাতে বকর যেয়ারত করাকে আলাদা ফযীলতের মনে করে কবর যেয়ারত করা জায়েয হবে না।
সম্মানীত ভাইয়েরা, আসুন আমরা এই রাতে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি না করে সঠিক মতটা গ্রহন করে আল্লাহ তায়ার ইবাদতে মশগুল হই।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে যথাযথ মর্যাদায় শবে বরাতে সঠিক নিয়মে আমল করার তৌফিক দান করুন।
আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন