ডঃ ইউসুফ আল-ক্বারাদাওয়ী রচিত অনন্য সাধারণ গ্রন্থ "ফিক্হ আল-জিহাদ" এর পাঠ পর্যালোচনা (পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন বিভীষিকা ২৮ মার্চ, ২০১৫, ০৮:০৯:৪৪ সকাল
রশীদ আল ঘান্নুশী |
৪। সামরিক জিহাদঃ আত্মরক্ষামূলক (দাফ’) ও আক্রমণাত্মক (তালাব) জিহাদ
মুতাকাদ্দিমীন এবং সমসাময়িক ফক্বীহদের ধারা অনুসরণ করে, আল ক্বারাদাওয়ীও জিহাদের প্রকৃতি এবং ইসলামে এর অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। এটির প্রকৃতি কি ধর্মীয়; অর্থাৎঅমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত অথবা ইসলামের কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তাদের সাথে লড়াই করা কি মুসলিমদের উপর আবশ্যক যেটাকে জিহাদ আত তালাব তথা স্বেচ্ছাপ্রসূত আক্রমণাত্মক জিহাদ বলা হয়ে থাকে? নাকি এর প্রকৃতি রাজনৈতিক যার প্রয়োজনীয়তা আগ্রাসীদের থেকে ইসলামের ভূমিকে রক্ষা করা এবং যারা মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে তাদের থেকে মুসলিমদের ও সাধারণভাবে নিপীড়িতদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্যযাকে নাম দেয়া হয়েছে জিহাদ আদ দাফ’তথা আবশ্যক আত্মরক্ষামূলক জিহাদ? মুসলিমরা যদি এতে অংশগ্রহণ করে তবে তাদের তা খালেসভাবে আল্লাহর জন্যই করতে হবে এবং কঠোর নৈতিক নিয়মাবলী মেনে করতে হবে যেগুলো উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।
পুরনো ও অধুনা যুগের ফক্বীহগণ এ ব্যাপারে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়েছে যাদের আল ক্বারাদাওয়ী এভাবে নামকরণ করেছেনঃ হুজুমিয়্যীন (আক্রমণাত্মক জিহাদের প্রস্তাবকগণ) এবং দিফায়িয়্যীন (আত্মরক্ষামূলক জিহাদের প্রস্তাবকগণ)। তিনি নিজেকে দ্বিতীয় শিবিরের একজন গর্বিত অনুসারী হিসেবে দাবী করেন। হুজুমিয়্যীনগণ ইসলামের দাওয়াত এবং এর সীমা বিস্তৃতির জন্য বছরে অন্তত একবার অমুসলিমদের ভূমিতে আক্রমণ করাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য আবশ্যক মনে করেন। তারা অবিশ্বাসকেই যুদ্ধ শুরু এবং বৈধ হত্যাকান্ডের জন্য যথেষ্ট কারণ মনে করে থাকেন যদিও অমুসলিমরা মুসলিমদের আক্রমণ বা ক্ষতি না করে থাকে। এমনকি মুসলিমরা যদি এ আক্রমণ না করে থাকেতবে গুনাহগার হবে। বিরাট সংখ্যক ফক্বীহগণ এ মতের সমর্থক। এ শিবিরের অন্তর্ভুক্ত পুরনো যুগের আলেমদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথিতযশা হলেন ইমাম শাফিঈ আর আধুনিক যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে মাওলানা মাওদুদী এবং সাইয়্যেদ কুতুব, যাদের দুজনই নিজেদের মতের সমর্থনে কোরআন ও সুন্নাহ এবং ঐতিহাসিকভাবে যে চর্চা হয়ে আসছে তা থেকে দলিল পেশ করেছেন। কোরআনের যেসব আয়াতসমূহ সকল মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহবানের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলো হচ্ছে সূরা তাওবার ৩৬ নং আয়াত“মুশরিকদের সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করে।”, সূরা তাওবার ৫নং আয়াত“মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা কর।”, এবং ২৯নং আয়াত“যারা আল্লাহ এবং আখিরাতে বিশ্বাস করে না…যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা স্বেচ্ছায় পদানত হয়ে জিযিয়া দেয়।”কিন্তু তাঁরা এগুলোর মধ্যে কোনটি আয়াত আস সাইফ বা তলোয়ারের আয়াত সেটা নিয়ে মতপার্থক্য করেছেন। তাঁদের মতে এই তলোয়ারের আয়াত এর বিপরীতে যায় এমন ২০০টিরও বেশী আয়াত রহিত করে দিয়েছে, যে আয়াতসমূহ দয়া, ক্ষমাশীলতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মীয় ব্যাপারে জোরজবরদস্তি ও কঠোরতার উপর নিষেধাজ্ঞা, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারটিকে একমাত্র আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়ার দিকে আহবান করে। তাঁরা নিজেদের মতের সমর্থনে রাসূলের এ হাদীসকেও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেনঃ“মানুষ লা ইলাহা ইল্লাহ না বলা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি” (বুখারী কর্তৃক বর্ণিত)। এছাড়াও তাঁরা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে মুসলিমদের যুদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের ইতিহাসকে তাঁদের এ মতের সমর্থনে দলিল হিসেবে পেশ করেছেনঃ মুসলিমদের সাথে অন্যদের স্বাভাবিক সম্পর্ক শান্তি নয় বরং যুদ্ধ।
উপরোক্ত দলের সাথে নিজের মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আল ক্বারাদাওয়ী তাঁদের জন্য, বিশেষ করে পুরনো আলেমদের জন্য কৈফিয়ত দিতে বিরত হন নি। কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যেসে সময়ে জাতিসমূহের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ক্ষমতা ও যুদ্ধ এবং আরব উপদ্বীপে ইসলামের আবির্ভাবের সূচনা থেকেই ইসলামের অস্তিত্ব বহির্শক্তির হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল।
পুরনো ও সমসাময়িক আলেমদের মত আল ক্বারাদাওয়ীও এই ইজমার উপর জোর দেনঃ কোন মুসলিম ভূমি আক্রান্ত হলে অথবা মুসলিমরা কোন ফিতনায় পতিত হলে (ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হলে) জিহাদ তখন প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয হয় এবং প্রত্যেক মুসলিমকেই কোন না কোন প্রকারের জিহাদ পালন করতে হয়, হোক সেটা নিজের বিরুদ্ধে বা দুর্নীতি ও মন্দের বিরুদ্ধে কিংবা সৎ কাজের আদেশ ও নিজ সাধ্যমত ধর্মকে সাহায্য করার ব্যাপারে। আল ক্বারাদাওয়ী তাঁর গবেষণা এবং জিহাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধর্মীয় নির্দেশনা ও পুরনো এবং আধুনিক আলেমদের মতামত বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত উপসংহারগুলোতে পৌঁছেছেনঃ
১) কোরআনের যেসব আয়াতগুলোতে, বিশেষ করে সূরা তাওবার যে আয়াতগুলোতে সকল মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ এসেছে সেগুলোকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া এবং উপযুক্ত শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত হিসেবে গণ্য করা উচিত যেমন একটি আয়াতে এসেছে“যেমন কিনা তারা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে লড়াই করে।”এটি কোন সাধারণ নির্দেশনা বা সকল অমুসলিমদের সাথে আচরণের ভিত্তি নয় বরং আরব মুশরিকদের একটি নির্দিষ্ট দলের সাথে সম্পর্কিত যারা শুরু থেকেই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, একে তাড়া করে বেরিয়েছে এবং এর নতুন আবাস পর্যন্ত একে অনুসরণ করেছে; যারা চুক্তিভঙ্গ করেছে এবং একে নির্মূল করার জন্য সবাইকে জড়ো করেছে।“তোমরা কি সেসব লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না যারা নিজেদের চুক্তি ভঙ্গ করেছে, রাসূলকে বিতাড়ির করার চক্রান্ত করেছে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির সূচনা করেছে” (কোরআন-৯:১২)। ঠিক একই সূরা এবং অন্যান্য সূরায় উপরোক্ত নির্দেশনাগুলোর সাথে কিছু বিধিনিষেধ ও শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ নির্দেশনা।“যদি তারা শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তোমরাও শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ো” (৮:৬১)। কোরআনের আয়াতসমূহকে পরস্পরের বিরুদ্ধে স্থাপন করার কোন প্রয়োজন নেই বরং এ বিষয়সংক্রান্ত কোরআনের সকল আয়াত ও হাদীসসমূহের দিকে তাকানো উচিত যেগুলো এ নীতিকেই প্রতিষ্ঠিত করে যে, ইসলাম শান্তিকামীদের সাথে শান্তি চায় এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
২। শাহাদাহ, সালাত, রোযা, যাকাত এবং হজ্জ্বের মত সামরিক জিহাদ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয নয় কেননা, ইসলামে এর গুরুত্বপূর্ণ স্থান থাকা সত্ত্বেও সূরা বাক্বারায় মুত্ত্বাকীদের অন্তস্থিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে, সূরা আনফাল ও সূরা মু’মিনুনে ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে, সূরা রা’দে সত্যিকার বুঝের অধিকারী লোকদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে, সূরা ফুরক্বানে আল্লাহর বান্দাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে, সূরা যারিয়াতে ধর্মপরায়ণদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে, সূরা ইনসানে ধর্মনিষ্ঠ লোকদের বৈশিষ্ট্যেগুলোর মধ্যেসামরিক জিহাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। সেজন্য মুসলিমদের উপর সামরিক জিহাদ তখনই ফরয হয় যখন এর শর্ত আবির্ভূত হয় যেমনঃ মুসলিমদের উপর বা তাদের ভূমি ও ধর্মের উপর আক্রমণ হওয়া। অন্যদিকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য সাধ্যমত প্রস্তুত থাকা মুসলিমদের উপর ফরয যাতে শত্রুদের নিরুদ্যম করা যায় এবং শান্তি বজায় থাকে।
৩। অমুসলিমদের থেকে নিরাপদ থাকলে তাদের ভূমি হামলা করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই মুসলিমদের উপর। সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করতে জন্য মুসলিমদের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তাদের প্রশিক্ষিত সৈনিক ও সর্বশেষ প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকবে যারা সীমান্ত প্রহরা দেবে এবং শত্রুদের নিরুদ্যম করবে যাতে তারা মুসলিমদের আক্রমণ করার চিন্তাও না করে (পৃষ্ঠা ৯১)। আরেকটি বিষয় খেয়াল করার মত যে, আল ক্বারাদাওয়ী‘কুফফার’বা‘অবিশ্বাসী’শব্দটি ব্যবহারের চাইতে‘অমুসলিম’শব্দটিই বেশী ব্যবহার করেছেন। এটিই আল কোরআনের পদ্ধতি। কোরআন“হে আহলে কিতাব”, “হে মানবজাতি”, “হে মানুষ”, “হে বনী ইসরাইল”, “আমার জাতি”, “হে আদমসন্তানেরা”এসব সম্বোধনই ব্যবহার করেছে। এটি কখনোই অমুসলিমদের অবিশ্বাসী হিসেবে সম্বোধন করেনি কিছু ব্যাতিক্রমী ঘটনা ছাড়া যেখানে বিশ্বাসের বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া হয়েছে।
৪। ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং আল্লাহর সামনে প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে দায়বদ্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে। এ কারণেই মুসলিম সমাজগুলো সামগ্রিকভাবে কখনো ধর্মীয় যুদ্ধের সম্মুখীন হয় নি। ইসলামে যিম্মী ব্যবস্থার ছায়াতলে তাই বিভিন্ন একত্ববাদী ও বহুত্ববাদী ধর্মগুলো টিকে থেকেছে এবং এখনো টিকে আছে যা অমুসলিমদের তাদের ধর্মবিশ্বাস সত্ত্বেও নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিমদের পাশাপাশি নিরাপত্তার অধিকার পেতে তাদেরকে শুধুমাত্র জিযিয়া প্রদান করতে হয়েছে যা অনেক আধুনিক ব্যবস্থায় সামরিক সেবা করের (Military Service Tax) সমার্থক। আল ক্বারাদাওয়ীর মতে, করের হার একীভূতকরণ এবং সামরিক সেবার বিষয়টিকে সাধারণীকরণের কারণে এই (যিম্মী) ব্যবস্থা এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে যা অনেকসময় ভুল বোঝা হয়েছে ও ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
৫। ইসলামের ধর্মগ্রন্থসমূহ নয় বরং ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই ফক্বীহদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে, অমুসলিমদের ভূমি আক্রমণ করার জন্য যে আক্রমণাত্মক জিহাদ তা বাধ্যতামূলক। উম্মাহ বিরতীহীনভাবে পারস্য ও রোমানদের মত শক্তিশালী প্রতিবেশীসমূহ দ্বারা হুমকির সম্মুখীন ছিল (পৃষ্ঠাঃ ৮২) এবং সেসময় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং শত্রুতা পরিহারকরণের উপর ভিত্তি করে আজকের মত কোন আন্তর্জাতিক আইন ছিল না।যদিও বর্তমানে ক্ষমতাশালীদের দ্বারা এ আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে।
৬। মুসলিম এবং অন্যদের মধ্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক এবং ভালোকাজে পারস্পরিক সহযোগিতা। ইসলাম যুদ্ধকে অপছন্দ করে এবং এতে কেবল অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনের খাতিরে অংশগ্রহণ করে।“যুদ্ধ তোমাদের উপর ধার্য করা হয়েছে যদিও তা তোমাদের অপছন্দ” (কোরআন ২:১১৬)। শান্তি ইসলামের অপরিহার্য অংশ, এটি মুসলিমদের এবং বেহেশতের অধিবাসীদের সম্ভাষণ এবং আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে একটি। অন্যদিকে আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপছন্দীয় নাম হল‘হারব’যার অর্থ যুদ্ধ এবং যা আরবদের প্রাচীন নামসমূহের মধ্যে একটিযেহেতু আরবরা ছিল যোদ্ধা। যখন রাসূল (সা)তাঁর জামাতা থেকে জানতে পারলেন তাঁর কন্যা ফাতিমা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে যাকে হারব নাম দেয়া হয়েছে তখন, রাসূল (সাঃ) তাঁকে আদেশ করলেন তার নাম হাসান (যার অর্থ সুন্দর) রাখতে।
৭। ইসলাম এমন আন্তর্জাতিক সমঝোতাকে সমর্থন করে যা আগ্রাসনের বিরোধিতা করে এবং জাতিসমূহের মধ্যে শান্তিকে উৎসাহিত করে। জাতিসংঘ, ইউনেস্কোর মত যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এসব আইনকে বলবৎ রাখে তাদের ইসলাম স্বাগত জানায়। তবে পাশ্চাত্য এখনো অন্য জাতি ও রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার নীতিতে বিশ্বাস রাখে। এর একটি উদাহারণ হল, সমতার নীতিকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্যের প্রধান রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা একচেটিয়াভাবে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা যেটার মাধ্যমে পাশ্চাত্য নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করে এবং এ নীতি লংঘনের কারণে সম্ভাব্য যেকোন প্রতিবাদ এড়িয়ে চলে। যেমন কিনা আমরা দেখেছি কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কোন বৈধতা ছাড়াই যে কোনপ্রকার নিন্দার ঝুঁকি থেকে ঊর্ধ্বে থেকে ইরাক আক্রমণ করেছে এবং একইভাবে কিভাবে ফিলিস্তিন ও এর জনগণের বিরুদ্ধে যায়োনিষ্টদের বিভিন্ন রকম শত্রুতাকে বিরামহীনভাবে সুরক্ষা দিয়ে চলছে।
৮। ধর্ম বিশ্বাস ও প্রচারের স্বাধীনতা, প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের রক্ষাসহ বিভিন্ন মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার কারণে জিহাদ আত তালাবের অন্যতম মূল কারণটি অপ্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। আর তা হচ্ছে, ইসলামের দিকে আহবান করার জন্য স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা যা জনগণকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং শাসকের ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে বাধা দিত। যেমনটি কিনা ফেরাউন বনী ইসরাইলকে তার অনুমতি ব্যতীত ঈমান আনার জন্য তিরস্কার করেছিল।“সে বললঃ আমি অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি ঈমান এনেছ” (আল কোরআন ২০:৭১)। অন্যদিকে বর্তমানে মসজিদ ও মুসলিম সংখ্যালঘু সব অঞ্চলে পাওয়া যায় যা ইসলামের ইতিহাসে অভুতপূর্ব। তাই আমাদের এখন আরো বেশী প্রয়োজন“দক্ষ দা’য়ী, শিক্ষক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের এক বিশাল বহর যারা সকলেই হবে উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষিত এবং পৃথিবীকে এর বিভিন্ন ভাষায় সম্বোধন করবে ও যারা এ কাজে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করবে, দুঃখজনকভাবে, যার এক হাজার ভাগের এক ভাগেরও কম আমাদের রয়েছে।” (পৃষ্ঠা ১৬)। আল ক্বারাদাওয়ী দুঃখের সাথে বলেন, এমন অনেককেই আপনারা পাবেন যারা আল্লাহর জন্য মরতে রাজি আছে, কিন্তু এমন খুব কমই পাবেন যারা তাঁর রাস্তায় বাঁচতে প্রস্তুত।
৯। ইসলামের ধর্মীয় উৎসসমূহ থেকে এটা পরিষ্কার যে, ইসলামের মতে, পৃথিবী তিনটি ভাগে বিভক্তঃ দার আল ইসলাম তথা ইসলামের ভূমি যেখানে ইসলামের আইন প্রতিষ্ঠিত আছে, এর রীতিনীতিগুলো প্রকাশ্যে চর্চা করা হয় এবং এর অনুসারী ও এর দিকে আহবানকারীগণ নিরাপদে থাকে; দার আল আহদ তথা চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ যাদের এবং মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক স্বীকৃতি ও শত্রুতার নিবৃত্তিকরণ; এবং সর্বশেষ হল দার আল হারব তথা মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র। আল ক্বারাদাওয়ী মনে করেন, জাতিসংঘের ব্যবস্থার অংশীদার হওয়ার কারণে মুসলিমরা অন্যান্য সব দেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ অবস্থায় আছে একমাত্র ইসরাইল ব্যতীত কেননা এ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে জবরদখল করে রেখেছে এবং এর জনগণকে উৎখাত করেছে এবং যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রধান রাষ্ট্রসমূহের সহায়তায় সংঘটিত হয়েছে। সেজন্য আল ক্বারদাওয়ী পাশ্চাত্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্যের অবিরত সীমাহীন সমর্থন এবং ফিলিস্তিন ও এর জনগণের বিরুদ্ধে এর লাগাতার আগ্রাসনকে দায়ী করেন।
১০। আল ক্বারাদাওয়ী জিহাদ এবং ইরহাব তথা সন্ত্রাস অন্যকথায়, বৈধ ইরহাব ও অবৈধ ইরহাবের মধ্যে পার্থক্য করেন। বৈধ ইরহাব হচ্ছে শত্রুর ভীতির পাত্র হওয়া যা শত্রুকে যেকোন প্রকার আগ্রাসন থেকে বিরত রাখবে। অপরপক্ষে অবৈধ ইরহাব হচ্ছে নিরীহ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করা যেমন কিনা কিছু দল ইসলামের নামে করে থাকে। এরা জিহাদের অপব্যবহার করে অনুপযোগী পরিস্থিতে পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুসলিম দেশসমূহের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামে জিহাদের মূলনীতি ও নৈতিক বিধিবিধানসমূহের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে নিরাপরাধ মানুষদের ভীতসন্ত্রস্ত করে। এজন্যই আল ক্বারদাওয়ী মুসলিম ও অমুসলিম দেশসমূহে চরমপন্থী দলগুলো দ্বারা পর্যটক ও অন্যান্য নিরাপরাধ মানুষদের বিরুদ্ধে চালানো সহিংস কর্মকান্ডের সমালোচনা করেন। এছাড়াও তিনি এ দলগুলো দ্বারা সংঘটিত বাছবিচারহীন হত্যাকান্ড ও নিরাপরাধ জীবন নেয়াকে যেকোন বৈধতা থেকে বঞ্চিত করেন।
১১। আল ক্বারাদাওয়ী খুবই সতর্কতার সাথে চরমপন্থী দলসমূহ, যারা পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং বাছবিচারহীন হত্যাকান্ড চালিয়ে ইসলামের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে ও এর শত্রুদের হাতে এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ভয়াবহ অস্ত্র তুলে দিচ্ছেএবং যারা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রতিরোধযোদ্ধা এদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি যেভাবে পূর্বোক্ত দলসমূহকে সমালোচনা করেছেন এবং তাদের ভিত্তিমূলকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করেছেন তেমনি শেষোক্ত দলসমূহের পক্ষ সমর্থন করেছেন এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনে তাদের সাহায্য সমর্থনে পুরো উম্মাহকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে সামরিক। তিনি আত্মঘাতী হামলাসমূহকেও কোন দ্বিধা ছাড়াই সমর্থন করেছেন এবং একে নিরুপায় ব্যাক্তির একমাত্র অস্ত্র হিসেবে গণ্য করেছেন যে কিনা নিজের আবাসভূমিকে রক্ষা করার জন্য শত্রুর সমপর্যায়ের অস্ত্র থেকে বঞ্চিত। আল্লাহর সুবিচার দুর্বল ব্যক্তিকে পুরোপুরি অস্ত্র থেকে বঞ্চিত করে না আর এজন্যই এরুপ ব্যক্তি নিজ দেহকে নিবৃত্তকারী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তবে যেকোন পরিস্থিতে জিহাদের নৈতিক বিধান মেনে চলতে হবে। তাই শুধুমাত্র যোদ্ধাদেরকেই হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানো যেতে পারে।
১২। আল ক্বারাদাওয়ী জোর দিয়ে বলেন, এ যুগে উম্মাহর উপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ হচ্ছে উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতা লাভ করা বিশেষ করে ফিলিস্তিনে। কিন্তু তিনি সতর্কতার সাথে তাদের ভুলও তুলে ধরেন যারা বিশ্বাস করে, যায়োনিষ্টদের সাথে আমাদের লড়াই তাদের সেমিটীয় হওয়ার কারণে, কারণ আমরাও সেমিটীয় তথা ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর অথবা যারা মনে করে এ লড়াই ধর্মীয় লড়াই, কেননা মুসলিমরা ইহুদীদের আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত মনে করে যাদের খাদ্য আমাদের জন্য হালাল, যাদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করা হালাল এবং যারা মুসলিমদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করেছে। যখন স্পেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে তাদের বিতাড়িত করা হচ্ছিল তখন তারা আমাদের ভূমিগুলোতে আশ্রয় খুঁজেছে। মুসলিমদের ছাড়া আর কারো কাছে ঠাঁই পায় নি তারা। বাস্তবতা হচ্ছে, যায়োনিষ্টদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ সূচনা হওয়ার একটাই কারণ আর তা হচ্ছে তাদের দ্বারা ফিলিস্তিনের ভূমি আত্মসাৎকরণ, সেখান থেকে এর জনগণকে উৎখাত করা এবং তাদের উপর সহিংসতা চাপিয়ে দেয়া। এ সংঘর্ষ ততদিন চলবে যতদিন এর কারণগুলোও জারি থাকবে। কোন মুসলিম ভূমির উপর অধিকার ত্যাগ করা সম্ভব নয়। তবে ইসরাইলের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তি হতে পারে। আর‘শান্তির বিনিময়ে ভূমি’তত্ত্বখানা শত্রুপক্ষের পাশবিক শক্তির যুক্তিতে চাপিয়ে দেয়া উদ্ভট একটি তত্ত্ব বটে। কারণ, এটি আমাদের ভূমি, শত্রুপক্ষের নয় যে তারা এটিকে শান্তির বিনিময়ে দর কষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবে।
১৩। চরমপন্থী দলগুলোর মোকাবেলায় তাঁর এবং তাঁর শিক্ষক শাইখ মুহাম্মাদ আল গাজ্জালীর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর ভেতরে-বাহিরে জিহাদের নামে এসব দলগুলো দ্বারা সংঘটিত কর্মকান্ডকে তাঁরা বৈধতা দেননি। তাঁরা এদেরকে ইসলাম ছিনিয়ে নিয়ে একে মূলধারা থেকে বিচ্যুত করে প্রান্তিকতায় নিয়ে যেতে দেন নি। এসব দলগুলোর মধ্যে মুখ্য দলগুলো দ্বারা নিজেদের কর্মপদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করার ব্যাপারটিকে আল ক্বারাদাওয়ী প্রশংসা করেছেন। এসব দলগুলো প্রথমে তাঁর লেখাগুলোকে আক্রমণ ও অগ্রাহ্য করলেও পরবর্তীতে নিজেদের পুনর্বিবেচনার কাজে তাঁর লেখা থেকে সাহায্য পেয়েছে যেটাকে আল ক্বারাদাওয়ী সাহসী ও আলোকিত পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ১১৬৮)।
৫। জিহাদের নৈতিক বিধান
“ইসলামে যুদ্ধ নৈতিকতাপূর্ণ যেমন কিনা রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অন্যান্য কাজ কোন কিছুই নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অপরদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতায় যুদ্ধ সবসময় নৈতিকতা দ্বারা সীমিত থাকে না।” মুসলিমদের জন্য যুদ্ধ নৈতিক বিধান দ্বারা পরিচালিত কেননা নৈতিকতা কোন ঐচ্ছিক ব্যাপার নয় বরং দ্বীনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ইসলামী নৈতিকতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেঃ ক) শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশ এবং গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য যৌনতা ও মাদকের মত অনৈতিক উপকরণ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা, খ) সীমালংঘন না করা যেমন কিনা কোরআনে নির্দেশনা এসেছেঃ“আল্লাহর পথে লড়াই কর তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালোবাসেন না” (কোরআন ২:১৯০)। লেখক সীমালংঘনকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ, কৃষক এবং অন্যান্য যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না তাদের হত্যা করা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন (পৃষ্ঠা ৭২৮)। এছাড়াও রয়েছে শত্রুপক্ষের মৃতদেহের বিকৃতিসাধনের উপর নিষেধাজ্ঞা। গ) চুক্তি মেনে চলা এবং ধোঁকাবাজি ও বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার করে চলা, ঘ) গাছ কেটে ফেলা এবং ইমারত ধ্বংসের উপর নিষেধাজ্ঞা, ঙ) জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র ও নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মত গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা। এসব অস্ত্র দোষী-নিরাপরাধের মধ্যে কোন বৈষম্য না করেই হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে একসাথে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। জীবন ও জীবিত সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। ইসলাম এ সমস্ত অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধী কারণ যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না তাদের হত্যাকান্ড ইসলাম সমর্থন করে না। যেমনটি কিনা আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একবার একটি যুদ্ধে একটি মহিলাকে হত্যা করার নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু এরপরেও তা উম্মাহকে এসব নিবৃত্তকারী অস্ত্র অধিকারে রাখতে নিষেধ করে না কেননা অন্যরাও এসব অস্ত্রের অধিকারী এবং উম্মাহকে এসব অস্ত্রের মাধ্যমে হুমকির সম্মুখীন করতে পারে। এক্ষেত্রে যায়োনিষ্ট শত্রুপক্ষের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যারা মুসলিমদের ভূমি জবরদখল করে রেখেছে এবং এসব অস্ত্রের অধিকারী। তাদের ধর্মগ্রন্থও সব প্রতিবেশী জাতিকে সমূলে ধ্বংস করাকে বৈধতা দান করে। অবাক করা ব্যাপার হল, আমেরিকা ও অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অন্যদের এসব অস্ত্রের অধিকারী হওয়া থেকে বারণ করলেও নিজেরাই এসব অস্ত্রের অধিকারী। তারা আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এসব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে বিরত রাখলেও, ইসরাইল দুইশোরও বেশী নিউক্লিয়ার হেডের মালিক। পশ্চিমা ও পূর্বের ব্লকসমূহের পারস্পরিক নিবৃত্তকরণ বিশ্বশান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। একই ব্যাপার ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তবে এসব অস্ত্র অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতি ছাড়া ব্যবহার করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যখন একটি জাতি বাহ্যিক হুমকির সম্মুখীন হয়। চ) ইসলাম এর মুজাহিদদের যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। যুদ্ধবন্দী বিশেষ করে তাদের হত্যা করা যাবে কিনা এ সংক্রান্ত কোরআন-সুন্নাহর সকল নির্দেশনা এবং সকল ফিক্বহী মতামত বিশ্লেষণ করার পর লেখক উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, এ ব্যাপারে সর্বশেষ নির্দেশনা সেটিই যা সূরা মুহাম্মাদে এসেছে, “তাদেরকে অনুগ্রহ করে ছেড়ে দাও অথবা মুক্তিপণ গ্রহণ করো” (কোরআন ৪৭:৪)। তবে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারটি সম্ভবত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সামগ্রিকভাবে লেখক যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশনের ধারাগুলোকে অনুমোদন করেছেন।
উপসংহারে এটাই বলা যেতে পারে যে, জিহাদের ফিক্বহের উপর আল ক্বারাদাওয়ীর এ গবেষণা একটি প্রামাণ্য ইসলামী ইজতিহাদ হিসেবে গণ্য হতে পারে যেটি জিহাদের তত্ত্বকে আত্মরক্ষার চিরন্তন ইসলামী ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরেছে এবং যা অনেক বড় ভুল উপস্থাপনার শিকার হয়েছে ও ইসলামের সুনাম ক্ষুন্নের কারণ হয়েছে। আল ক্বারাদাওয়ী চরমপন্থীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও মধ্যমপন্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে সাহসিকতার সাথে তিনি ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানের বিরুদ্ধে চালানো নেতিবাচক প্রচারণার মোকাবেলা করেছেন ঠিক একই সাহসের সাথে তিনি চরমপন্থীদের যুক্তি খন্ডন করেছেন যারা সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি আক্রমণাত্মক জিহাদকে সমর্থনকারী এক বিশাল সংখ্যক ফক্বীহগণকে সমালোচনা করতে যেমন দ্বিধাবোধ করেন নি তেমনিজিহাদকে কেবল আত্মরক্ষামূলক গণ্য করা শিবিরের একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে নিজেকেদাবী করতেও লজ্জিত হন নি। কোনপ্রকার ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই, কোনপ্রকার অবিচার না করে কিংবা কোন রকমের হেয় বা ভুলভাবে উপস্থাপন না করে এখনো তিনি পূর্বোক্ত দলের যুক্তি খন্ডন করে চলেছেন, যাদের সাথে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বরং তাঁদের জন্য কৈফিয়ত তালাশ করেন। তিনি এভাবে জিহাদ আত তালাবের ভিত্তিমূলকে প্রায় অকার্যকর প্রতিপন্ন করে আত্মরক্ষামূলক জিহাদের ভিত্তিকে এর বিস্তৃত অর্থে সুসংহত করেছেন, যে জিহাদের গায়ে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগের কোন চিহ্ণ পর্যন্ত নেই। এ সন্ত্রাসবাদকে তিনি আবার সুস্পষ্টভাবে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে চলা প্রতিরোধযুদ্ধের থেকে পৃথক করেছেন। এটি এমন এক নৈতিক জিহাদ যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, মূলনীতি, মূল্যবোধ ও আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেগুলো আগ্রাসন, দখলদারিত্ব, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধবন্দীদের উপর নির্যাতনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটি এমন এক জিহাদ যা মুক্ত পৃথিবীকে বরণ করে নেয় যেখানে বিভিন্ন ভাবধারা ও ব্যক্তিবর্গ মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারবে; সহিংসতা ও ক্ষমতার পরিবর্তে যেখানে প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে মানুষ একে অপরের সাথে মতের আদান-প্রদান করবে; যেখানে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে সঠিক চিন্তার অধিকারীগণই বিজয়ী হবেন। জিহাদের এরূপ উপস্থাপনার মাধ্যমে আল ক্বারদাওয়ী ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম, মানবীয় মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের মধ্যে সংলাপ, সহনশীলতা, ঐক্যমত ও সম্প্রীতির এমন এক বিশাল দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যা কোরআনের এ আয়াতের প্রতি সাড়া দেয়ার একটি সুযোগ করে দিয়েছেঃ“হে মানবজাতি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম যারা উত্তম আচরণের অধিকারী” (৪৯:১৩)।
লেখাটি মূলত ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ এ এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত একটি ভাষণ থেকে নেওয়া হয়েছে।
সূত্রঃ VirtualMosque.com
বিষয়: বিবিধ
১২০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন