সুন্নাহ সভ্যতার একটি উৎস। ডঃ ইউসূফ কারজাভী

লিখেছেন লিখেছেন বিভীষিকা ১১ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:১৭:৩১ দুপুর

ইসলাম মানুষকে ‘বেদুইনবাদ’-এর বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে সভ্যতার স্বাধীনতায় অভিষিক্ত করেছে

মহানবী সা:-এর সুন্নাহ কুরআনের পরই ইসলামি শরিয়াহ বা আইনের শুধু দ্বিতীয় উৎসই নয়, এটি কুরআনের পরই তারও দ্বিতীয় উৎস, যার থেকে জ্ঞান ও সভ্যতা, দু’টিই প্রবাহিত হয়ে থাকে।

প্রাথমিকভাবে আল কুরআন আইন ও বিধির ভিত্তি ও মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে; আর সুন্নাহ দিয়ে থাকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং সেই সাথে দৃষ্টান্ত ও বাস্তব প্রয়োগ। সুন্নাহতে নবীজীর সা: পথনির্দেশনার যে নজির বিদ্যমান, তা মুসলমানদের সভ্যতার তিনটি মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের দিকে পরিচালিত করে। এই বিষয়গুলো হচ্ছে সুসভ্য ফিকহ (আইনশাস্ত্র), সুসভ্য আচরণ ও সুসভ্য কাঠামো।

সভ্যতার এই তিন দিকের ওপর আলোচনার প্রয়াস পাওয়ার আগে সর্বপ্রথমে আমরা সভ্যতার অর্থবোধক সংজ্ঞা নির্ণয় করব। শুরুতেই প্রশ্ন আসে, সভ্যতা সম্পর্কে ইসলামি ধারণা কি এর আগের বা পরের অন্যান্য সভ্যতার দেয়া ব্যাখ্যা থেকে পৃথক ও অনন্য? নাকি দেশ-কাল-নারী-পুরুষ ধর্ম-জীবন দর্শন নির্বিশেষে একই উৎস থেকে সব সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে? সভ্যতার একটি সাধারণ সংজ্ঞা রয়েছে যা ‘সভ্যতা’ শব্দটির উৎপত্তিকাল থেকেই এর সাথে জড়িত বলা চলে। তা হচ্ছে, ‘কোনো একটি সামজে কিংবা একই ধরনের সমাজগুলোতে আর্থিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পকলাগত, সাহিত্যিক ও সামাজিক উন্নয়নের সার্বিক প্রতিফলন।’

ইসলাম মানুষকে অর্থ, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সমাজ সেই সাথে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার দিক দিয়ে উন্নত করতে চায় আরবিতে ‘সভ্যতা’ শব্দটি ‘বেদুইনত্ব’-এর বিপরীত। বেদুইনত্ব বলতে এখানে বর্বরতাকে বোঝানো হচ্ছে। একইভাবে পরিশীলিত জীবন ও বেদুইন জীবন পরস্পরের বিপরীত। এক দিকে রয়েছে শহর, নগর ও গ্রামের বাসিন্দারা; অপর দিকে বেদুইন জীবনযাত্রা যাদের, সেসব লোক মরুভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে বাস করে। বেদুইনরা কঠোরতা, নির্দয়তা, অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার জন্য কুখ্যাত।

এ কারণে আল্লাহতায়ালা তাদের মধ্য থেকে কোনো নবী সা: পাঠাননি। এর পরিবর্তে দেখা যায়, তিনি যত নবী-রাসূল সা: পাঠিয়েছেন, তাদের সবাই ছিলেন গ্রাম বা শহরের বাসিন্দা (অবেদুইন)। আল্লাহ তাঁর নবীকে সা: বলেছেন : আর আমরা তোমার পূর্বে এমন কাউকে পাঠাইনি, যিনি ওই সব লোকের শহরের অধিবাসী ছিলেন না, যাদের প্রতি (আমার বাণী) নাজিল করেছি (আল কুরআন, ১২ রুকু : ১০৯ নং সূরা)। আমরা জানি, কুরআন এবং রাসূলের সা: সুন্নাহ, এ দু’টির উভয়ের মাধ্যমেই ইসলামকে উপস্থাপন করা হয়। দু’টিতেই আমরা দেখি, ওই সব লোককে সুশৃঙ্খল শহুরে সভ্যতায় উন্নীত করার লক্ষ্যে দৃঢ়তার সাথে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই মানুষদের আর্থিকভাবে, বৈজ্ঞানিকভাবে, শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং সামাজিক দিক দিয়ে, একই সাথে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকভাবে উন্নত করাই ইসলামের লক্ষ্য ছিল। প্রজ্ঞাপূর্ণ উপায়ে ও ক্রমান্বয়ে উপদেশমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের সুশিক্ষিত ও পবিত্র করতে হয়েছে ওই লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আর তা করেছেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: নিজে।

রাসূল সা: মক্কা থেকে মদীনায় চলে যাওয়া হিজরত নামে অভিহিত। মক্কা বিজয়ের আগে আরব গোত্রগুলোকে বলা হয়েছিল হিজরত করতে। হিজরতের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বেদুইনদের ইসলামের নতুন ধরনের সংস্কৃতি শিখে আত্মস্থ করার সুযোগ দেয়া। আর এই সংস্কৃতিতে জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করা আবশ্যকীয় বলে গণ্য হয়ে থাকে। অধিকন্তু, এটা তাদেরকে হেদায়েত লাভের সমাবেশগুলোতে হাজির হতে উৎসাহ দেয়। উদ্বুদ্ধ করে ইসলামি বিধিব্যবস্থাকে পুরোপুরি গ্রহণ করার ব্যাপারে। আর ইসলামে জীবনের সব দিক অন্তর্ভুক্ত : খাওয়া-পিনা, পোশাক পরিধান, হাঁটাচলা এবং জীবনের ছোট-বড় অন্য সব কিছু।

ইসলামি সভ্যতা আল্লাহর সাথে মানুষকে এবং বেহেশতের সাথে পৃথিবীকে করেছে ঐক্যবদ্ধ

তুলনা করলে আমরা দেখব একটি বিষয়। মসজিদে নবীয়ে করীম সা: ও তাঁর সাহাবারা বসে ছিলেন। তা সত্ত্বেও এক বেদুইন এই মসজিদের ভেতরেই এক কোণে প্রস্রাব করতে বিন্দুমাত্রও বিব্রতবোধ করেনি। এটা দেখে লোকজন তাকে চিৎকার করে ধমক দিল। রাসূল সা: তাদের থামিয়ে দিলেন এবং মাফ করে দিলেন বেদুইন লোকটার অজ্ঞতাকে। তিনি তাঁর সঙ্গীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘সে প্রস্রাব শেষ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তারপর এক বালতি পানি এনে জায়গাটায় ঢেলে দিয়ো। কারণ, তোমাদের পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন বিষয়কে সহজ করার জন্য, কঠিন করে দিতে নয়’ (আল বুখারি)।

অন্য দিকে আমরা দেখতে পাব রাসূল সা:-এর সঙ্গী মুসলমানরা ইসলামের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়েছিলেন। পারস্য সাম্রাজ্যের সেনাপতি রুস্তম যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মুসলমানের পরিচয় কী?’ তখন তারা জবাব দিলেন, ‘আল্লাহর গোলামদের উপাসনা থেকে ফিরিয়ে কেবল তাঁর উপাসনার দিকে যাদেরকে আনার ইচ্ছা তিনি পোষণ করেন এবং সঙ্কীর্ণ বিশ্ব থেকে বিশাল বিশ্বে এবং বিভিন্ন ধর্মের অবিচার থেকে ইসলামের সুবিচারের দিকে যাদের আনার ইচ্ছা করেন, তাদের জন্য তা করার উদ্দেশ্যেই আমাদের আল্লাহ পাঠিয়েছেন।’ নিঃসন্দেহে, ইসলাম হচ্ছে সভ্যতার বাণী। এর লক্ষ্য মানব জীবনকে উন্নত করা এবং বেদুইনবাদের কবলমুক্ত করে তাকে সভ্যতার স্বাধীনতায় ভূষিত করা।

এটা জোর দিয়ে বলা দরকার, ইসলাম যে সভ্যতা বিনির্মাণ করতে চায়, সেটা অন্য যেকোনো সভ্যতা থেকে পৃথক। অন্যান্য সভ্যতা জীবনের বস্তুগত দিকগুলো এবং মানুষের দৈহিক ও জৈবিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তা ছাড়া, এসব সভ্যতা তাৎক্ষণিক আনন্দের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে এবং ইহ জাগতিকতাকেই তাদের সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর জ্ঞানের লক্ষ্য বলে বানিয়ে নেয়। তাদের দর্শনে, কিংবা সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় আল্লাহ অথবা পরকালের কোনো স্থান নেই। এর বিপরীতে, ইসলামের সভ্যতা মানুষকে আল্লাহর সাথে এবং দুনিয়াকে বেহেশতের সাথে এক করেছে। এটা পরলোকের প্রস্তুতির জন্য জীবনকে করেছে উৎসর্গ। বস্তুর সাথে আত্মাকে দিয়েছে মিলিয়ে।

ইমান ও বিজ্ঞানের ঘটিয়েছে সুন্দর মিলন। লালন করে এসেছে বস্তুগত উন্নয়নের সাথে নৈতিক উন্নতিকেও। এটাকে ‘আধ্যাত্মিক বস্তুবাদী সভ্যতা’ বলাই ন্যায়সঙ্গত। এই সভ্যতা এক সাথে ভাবজগতের ও বাস্তবধর্মী, পবিত্র ও মানবিক, নৈতিক ও জনসংখ্যাগত এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী ও নৈর্ব্যক্তিক।

সত্যিই, এই সভ্যতা ভারসাম্যপূর্ণ ও উদার। এ সবই ন্যায়ানুগ বৈশিষ্ট্যের জাতি গঠনের ভিত্তি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আর এ জন্য আমরা তোমাদের ন্যায়ানুসারী ও আলাদা জাতি হিসেবে করেছি মনোনীত (আল কুরআন, সূরা ১৪৩, রুকু ২)।

(লেখকের ‘সুন্নাহ : সভ্যতার একটি উৎস’ শীর্ষক লেখা থেকে সংক্ষেপিত)

ভাষান্তর : মীযানুল করীম

বিষয়: বিবিধ

৯৪৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

283231
১১ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৩
ফেরারী মন লিখেছেন : আমরা ইসলামী সমাজই বিনির্মাণ করতে চাই কারণ মুসলিমরা বিশ্বাস করে পৃথিবীর পরে আরেকটি জীবন আছে। সে জীবনে থাকতে অনন্তকাল।
283345
১১ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৫৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
283443
১২ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:১০
আফরা লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খাইরান ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File