ফতোয়া ও রাজনীতিঃ- ডঃ ইউসুফ আল কারাদাভি
লিখেছেন লিখেছেন বিভীষিকা ০৭ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:৪৩:৫৪ সকাল
আলেমদের ফতোয়া এবং দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই ফতোয়া আর রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, তা জানা দরকার। ফতোয়া হচ্ছে, ফিকহ সম্পর্কিত নির্দেশনা। আর ফিকহর দু’টি ধরন আছে। একটি হলো, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই একজন আইন বিশেষজ্ঞ আলেম কর্তৃক নির্দেশনা উপস্থাপনের উদ্যোগ নিজেই নেয়া।
বিষয়টির উল্লেখ আছে আল কুরআনের অনেক আয়াতে। যেমন, তোমরা যারা ঈমান এনেছ, বাধ্যবাধকতা পূরণ করো (আল মায়িদাহ, আয়াত-১)। আর দ্বিতীয় ধরনের ফিকহ হলো, কোনো প্রশ্নের জবাবে নির্দেশনা দেয়া। এ প্রসঙ্গে সূরায়ে বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। বলে দিন, ‘এগুলোতে মানুষের জন্য রয়েছে মহাপাপ এবং কিছু উপকারিতা; কিন্তু কল্যাণের চেয়ে পাপ বেশি।’ অপর দিকে ইসলামে রাজনীতি বা ‘সিয়াসা’ হচ্ছে, শরিয়াহর লক্ষ্যগুলোর আলোকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে উম্মাহর জনস্বার্থ ও ধর্মীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা; এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো শরয়ি ভাষ্য বা নির্দেশ লঙ্ঘন করা যাবে না।
আজকের বিশ্বে যে রাজনীতি প্রচলিত, তার সাথে শরিয়াহসম্মত রাজনীতির পার্থক্য আছে। ইসলামের শরয়ি রাজনীতির বিষয়ে আল আজহার ও অন্যান্য ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এ রাজনীতিতে সব নির্দেশনার ভিত্তি শরিয়াহ। অপর দিকে বর্তমান বিশ্বে চালু রয়েছে জাতীয় স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি; এসব স্বার্থ ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক বা না হোক।
এই জটিল বিশ্বে ইসলামের আওতায় রাজনীতি করা কি সম্ভব? এর জবাবে বলতে হয়, ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। কোনো শাসক কিংবা ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বেশেষে কোনো নাগরিকের কোনো একটি কাজও শরিয়াহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। শরিয়াহর আওতায় পড়ে ব্যক্তি ও পরিবার জীবনের সাথে রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও। ‘রাজনৈতিক ফতোয়া’ নিছক রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তার গণ্ডিতে সীমিত নয়। শাসক ও জনজীবন সংশ্লিষ্ট সব ফতোয়াকেই জনগণ রাজনৈতিক ফতোয়া বলে গণ্য করে থাকে।
কোনো মুসলিম রাষ্ট্র আইন করে বহুবিবাহ বন্ধ করতে চাইলে (যেমন, তিউনিসিয়ায় করা হয়েছে) সরকার প্রথমে আলেমদের এ বিষয়ে মতামত দিতে বলে। এরপর তার নিজের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের অনুকূল ফতোয়া পেলে তা গ্রহণ করে। তবে সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে খুশি রাখার জন্য রাজনৈতিক ফতোয়া দেয়া হয় না। বরং প্রায় ক্ষেত্রে সঠিক ফতোয়া বাস্তবায়নে রাষ্ট্র সম্মত থাকে। একজন নিষ্ঠাবান আলেমের উচিত, রাষ্ট্র পছন্দ করুক কিংবা না করুক, যা যথার্থ সে মত দেয়া। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি গভীরভাবে অধ্যয়নের পর বিবেকবান হিসেবে অভিমত দেয়ার সময়ে তিনি শুধু আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করার কথা। আদর্শ মুফতি হওয়ার আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো বাস্তবতা, সমসাময়িক জনজীবন ও এর সমস্যা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা। শরিয়াহর লক্ষ্য উপলব্ধি না করে কোনো মুফতির ফতোয়া ঘোষণা করা উচিত নয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, ফিকহ এসেছে আগে, আর শরয়ি রাজনীতির আবির্ভাব পরে। তা হলে আলেমরা রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দেবেন কী করে? এমন প্রশ্নের জবাবে জানাতে হয়, ফিকহ শাস্ত্রের আদি পর্বের কিতাবগুলো প্রকাশিত হয়েছিল রাজনীতিবিষয়ক কিতাবের আগে। কিন্তু এরও অনেক আগে রাসূলুল্লাহ সা: ইসলামের সূচনা থেকেই রাজনীতি করেছেন। শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি অনেক রায় দিয়েছেন। ‘বিরান জমি যে চাষ করে, এটা তার সম্পত্তি বলে পরিগণিত হবে’ তিনি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সমাজের আইনগত বিষয়গুলোর দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে। একই কথা খোলাফায়ে রাশেদিন তথা হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত উসমান রা:, হজরত আলী রা:-এর ব্যাপারেও প্রযোজ্য। তারা জনস্বার্থে অসংখ্য রায় দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসকের ভূমিকায়।
আজকের আধুনিক দুনিয়ায় জ্ঞানের সব শাখায় বিশেষজ্ঞ হওয়া বাস্তবে আলেমদের পক্ষে অসম্ভব। এ কারণে মুসলমানরা সামষ্টিক ফতোয়া প্রদানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও পরিষদ গড়ে তুলেছে। ইসলামিক ওয়ার্ল্ড লিগের ফিকহ কাউন্সিল কিংবা ওআইসি’র ফিকহ কাউন্সিল এর নজির। রাজনীতি, অর্থনীতি অথবা আধুনিক জীবনের আর কোনো বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হলে উপরিউক্ত কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত আহ্বান করে থাকে। যাতে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সম্যক অবগত হয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, সে জন্যই এটা করা হয়। যেমন চিকিৎসা সম্পর্কিত ক্ষেত্রে আমরা মতামত নিই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের। এভাবে সামষ্টিক বিতর্ক ও সংলাপের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটা হয়ে থাকে।
রাজনৈতিক ফতোয়া ও গাজার ইস্পাত দেয়াল
আলেমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য। তাই যখন তাদের কাছে আইনি মতামত চাওয়া হয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে, তারা যেন জ্ঞান অনুযায়ী তা দেয়া থেকে বিরত না থাকেন।
সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ফতোয়া দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেমন দেশের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ইরাকি নাগরিকদের বাধ্যবাধকতা এবং গাজার সাথে মিসরীয় সীমান্তে ইস্পাতের দেয়াল নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, রাজনীতি কেবল রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব নাগরিকেরই অংশ নেয়া উচিত।
রাজনীতি বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখার কোনো কারণ নেই। অপর দিকে মোটামুটি জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি যার আছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়া দরকার।
আলেমরা অভিমত দেয়ার মাধ্যমে তাদের কর্তব্য পালন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ ও দিকনির্দেশনা আমরা নাজিল করেছি। এটা মানুষের জন্য কিতাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা সত্ত্বেও যারা তা গোপন রাখে, নিশ্চিত যে, তাদের আল্লাহ অভিশাপ দেবেন এবং যারা অভিশাপ দিয়ে থাকে, তারাও অভিশাপ দেবে ওদের। তবে যারা অনুতপ্ত, নিজেদের শুধরে নেয় এবং সত্যকে তুলে ধরে, তাদের দিকে আমি ফিরি (করুণা সহকারে); আর আমি প্রায়ই (ক্ষমার প্রতি) প্রত্যাবর্তনকারী, ক্ষমাশীল [সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৫৯-১৬০]
গাজা সীমান্তে ইস্পাত প্রাচীরের বিরুদ্ধে আমার যে ফতোয়া, এর ভিত্তি হলো গাজায় আমাদের ভাইদের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও কল্যাণ। কোনো মুসলিমকে অনুমতি দেয়া হয়নি তার ভাইদের সাহায্য না করা ও হতাশ করার। গাজা-মিসর সীমান্তে ইস্পাত দেয়াল তৈরি হলে গাজাবাসীকে সাহায্য করার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে; গাজার অবরোধে এবং বাসিন্দাদের দুর্ভোগে মদদ দেয়া হবে। এতে তাদের অনাহার বাড়বে। সেই সাথে, ইসরাইলের কাছে নতিস্বীকার ও আত্মসমর্পণের জন্য যে চাপ, তা বৃদ্ধি পাবে। যদি এই দেয়াল তৈরির অনুমতি দেয়া হয় ফতোয়ার মাধ্যমে, তা হলে কেবল ইসরাইল লাভবান হবে। তখন তারা গাজা অবরুদ্ধ রাখতে উৎসাহ পাবে। এক বছর আগে নির্বিচারে হত্যা এবং ধ্বংসতাণ্ডবেও গাজায় যা অর্জন করা যায়নি, তার জন্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ হতে পারে এই অবরোধ। তা ছাড়া, আল কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে, সব মুসলমান এক জাতি। তাই মিসরের একটি দায়িত্ব হচ্ছে গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করা; তাদের নির্মূল করায় ‘অবদান’ রাখা নয়। আলেমদের এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে, অমুসলিম দুশমন মুসলিম অধ্যুষিত কোনো ভূমি আক্রমণ করে দখল করে নিলে এই ভূখণ্ডের জনগণের দায়িত্ব আত্মরক্ষা এবং শত্রুর কবল থেকে মুক্ত হওয়া। যদি তারা তা করতে অক্ষম হয়, এ দায়িত্ব বর্তায় প্রতিবেশী এলাকার মুসলমানদের ওপর। এভাবে ক্রমান্বয়ে তা সব মুসলমানের সামষ্টিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়।
গাজার ক্ষেত্রে বলতে হয়, নিকট অতীতেও এটা ছিল মিসরের শাসনাধীন। মিসর গাজাকে মুক্ত করতেই সাহায্য করা উচিত, সেখানে ইসরাইলি অবরোধ জোরদার করতে নয়। শত্রুর হাত থেকে মুসলমানদের ভূখণ্ড রক্ষা এবং মুক্তিলাভের জন্য সাহায্য করাকে কুরআন, সুন্নাহ এবং সব মজহাব অন্যান্য মুসলমানের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেছে। অতএব, গাজার ব্যাপারে মিসরের দায়িত্ব রয়েছে। মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অত্যাচারিতকে সাহায্য করা এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। তাই তাদের করণীয় হলো, গাজাবাসীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং তাদের প্রতি অবিচার হতে না দেয়া। মুসলমানরা দেয়াল তুলে গাজা অবরোধে অংশ নিতে পারে না। সুতরাং বিষয়টা নিছক একটা দেয়াল তোলাই নয়। এ ক্ষেত্রে সব মুসলিম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই গাজাকে সাহায্য করা উচিত।
ইস্পাত প্রাচীর নির্মাণের ফলাফল
আল আজহারের ইসলামি গবেষণা পরিষদ দাবি করেছে, মিসরের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই দেয়ালটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই দাবি অযৌক্তিক। কেননা নিজের ভাই থেকে নিজেকে রক্ষার প্রয়োজন হয় না। ফিকহ শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো কিছুর ফলাফল কী দাঁড়াবে (ফিকহ আল-মা’য়ালাত)। গাজা সীমান্তের দেয়ালের ফল কী হতে পারে? জবাব হলো, এর দ্বারা আমরা নিজ ভাইদের হত্যা করব এবং তাদের বঞ্চিত করব বেঁচে থাকার সুযোগ কিংবা অবরোধ এড়ানো থেকে। এটাকে আলেমরা বলেছেন, আল কাতল বিল তার্ক, অর্থাৎ কাউকে পরিত্যাগের মাধ্যমে হত্যা করা। যেমনÑ কোনো ব্যক্তিকে একটি ঘরে তালা মেরে আটকে রাখা হলো এবং তাকে খাদ্য-পানীয় কিছুই দেয়া হলো না। কয়েক দিন পর দেখা গেল, লোকটি ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করেছে। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারী সে মানুষটি, যে তাকে বেঁচে থাকার উপকরণ না দিয়ে আটক রেখেছিল। গাজায় আমাদের ভাইদের প্রতি মিসরের আচরণও এমন। কারণ, সীমান্তে রাফাহর প্রবেশপথ বন্ধ এবং দেয়াল নির্মাণ করা হলে গাজার মানুষেরা একটি বড় কারাগারে ‘সম্পূর্ণ তালাবন্দী’ হয়ে পড়বেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মহিলা একটি বিড়ালকে আটকে রেখেছিল। সেটিকে কোনো খাবার দেয়নি কিংবা বাইরে যেতে দেয়নি খাবারের সন্ধানে। সে মহিলাকে মৃত্যুর পর দোজখের আগুনে পাঠানো হয়েছে। আর গাজা সীমান্তে দেয়াল দিয়ে মিসর একটি বিড়াল নয়, ১৫ লাখেরও বেশি বনি আদমকে আটকে রাখবে।
এ বিষয়ে নির্দেশনা এতই সুস্পষ্ট যে, কোনো আলেমের ফতোয়া দেয়ার দরকারই হয় না। কারণ, নিছক কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয়, কী করতে হবে। ইসলাম, আরব সংহতি ও মানবতার নামে বলছি, এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলতে দেয়া যায় না।
ফতোয়া : স্থানীয় না বিশ্বজনীন
কোনো কোনো আলেমের ফতোয়া স্থানীয় হতে পারে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য ফতোয়া দেয়ার প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে মুফতি নিয়োগ করতে পারে। তার দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার দায়িত্ব তিনি পালন করেন। বিশ্বজনীন ফতোয়া এর থেকে ভিন্ন। আল-আজহার বিশ্বজনীন ইসলামি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে দেয়া ফতোয়াগুলো স্থানীয় পর্যায়ের হতে পারে না, যা শুধু মিসরে প্রযোজ্য। আল-আজহারের ইসলামি গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই পাকিস্তান, লেবানন, মরক্কোসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় আলেমরাও এর সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তাই এটি স্থানীয় নয়, বিশ্বজনীন ইসলামি প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বেই মুসলমানরা আল-আজহারকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। অন্য দিকে মিসরের স্থানীয় মুফতি সিরিয়া বা আর কোনো দেশের মুসলমানদের জন্য ফতোয়া দেয়ার দায়িত্বশীল নন।
প্রথম ও দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন আরব দেশে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া দেয়া হয়েছিল। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর ফতোয়া আলজেরিয়া বা আর কোনো দেশ থেকে পৃথক হওয়া মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় নয়। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে আমি ছিলাম আলজেরিয়ায়। ফ্রান্সের সাদ্দামবিরোধী অবস্থান আলজেরিয়ার মানুষ মেনে নেয়নি। দেখেছি, তারা ফ্রান্সের বিরোধিতা করে তখন ইরাক সরকারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে। মুফতিদের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকায় তাদের ফতোয়াও পরস্পর থেকে পৃথক হতে পারে। কোনো মুফতি স্বভাবের দিক থেকে নরম মানুষ বলে ‘সহজ’ ফতোয়া দিতে পারেন। অন্য একজন মুফতি কঠোর প্রকৃতির কারণে ‘কড়া’ ফতোয়া দিতে পারেন। এসব মতপার্থক্য ফিকহর মূলনীতির ভিত্তিতে হলে সমস্যা হয় না। ফিকহর যাবতীয় বিষয়ে পুরো ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। কারণ, মুফতি নানা দিক বিবেচনা করেই ফতোয়া দিয়ে থাকেন। একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যায় এ ব্যাপারে।
এক দিন এক লোক এলো হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা:-এর কাছে। সে জিজ্ঞেস করল, কোনো খুনির তওবা আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন কি না। ইবনে উমর রা: তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, না এমন লোকের তওবা গ্রহণ করা হবে না। প্রশ্নকারী ব্যক্তি চলে গেলে ইবনে উমর রা:-এর বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন এই ফতোয়া সম্পর্কে। তারা তার কথা শুনে অবাক হয়েছিলেন। কারণ, এর আগে ইবনে উমর রা: লোকজনকে বলতেন, খুন করে কেউ তওবা করলে তা কবুল হবে। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলো। তিনি জবাব দিলেন যে লোকটি এসেছিল, তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, সে ওই মুহূর্তে এতটাই ক্রুদ্ধ যে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আমি তখন চেয়েছি তাকে এই অপরাধ থেকে বিরত রাখতে। সে জন্যই তাকে ‘না’ বলেছি।
আলেমদের অভিমত, ফতোয়া স্থান, কাল ও পরিস্থিতির নিরিখে বদলে যেতে পারে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মুফতির থাকা চাই বাস্তবতার সম্যক উপলব্ধি যাতে সঠিক মতামত প্রকাশ করা যায়। রাজনীতিবিষয়ক ফতোয়ার বেলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউসুফ আল কারাদাভি : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ
ভাষান্তর : মীযানুল করীমআলেমদের ফতোয়া এবং দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই ফতোয়া আর রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, তা জানা দরকার। ফতোয়া হচ্ছে, ফিকহ সম্পর্কিত নির্দেশনা। আর ফিকহর দু’টি ধরন আছে। একটি হলো, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই একজন আইন বিশেষজ্ঞ আলেম কর্তৃক নির্দেশনা উপস্থাপনের উদ্যোগ নিজেই নেয়া।
বিষয়টির উল্লেখ আছে আল কুরআনের অনেক আয়াতে। যেমন, তোমরা যারা ঈমান এনেছ, বাধ্যবাধকতা পূরণ করো (আল মায়িদাহ, আয়াত-১)। আর দ্বিতীয় ধরনের ফিকহ হলো, কোনো প্রশ্নের জবাবে নির্দেশনা দেয়া। এ প্রসঙ্গে সূরায়ে বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। বলে দিন, ‘এগুলোতে মানুষের জন্য রয়েছে মহাপাপ এবং কিছু উপকারিতা; কিন্তু কল্যাণের চেয়ে পাপ বেশি।’ অপর দিকে ইসলামে রাজনীতি বা ‘সিয়াসা’ হচ্ছে, শরিয়াহর লক্ষ্যগুলোর আলোকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে উম্মাহর জনস্বার্থ ও ধর্মীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা; এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো শরয়ি ভাষ্য বা নির্দেশ লঙ্ঘন করা যাবে না।
আজকের বিশ্বে যে রাজনীতি প্রচলিত, তার সাথে শরিয়াহসম্মত রাজনীতির পার্থক্য আছে। ইসলামের শরয়ি রাজনীতির বিষয়ে আল আজহার ও অন্যান্য ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এ রাজনীতিতে সব নির্দেশনার ভিত্তি শরিয়াহ। অপর দিকে বর্তমান বিশ্বে চালু রয়েছে জাতীয় স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি; এসব স্বার্থ ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক বা না হোক।
এই জটিল বিশ্বে ইসলামের আওতায় রাজনীতি করা কি সম্ভব? এর জবাবে বলতে হয়, ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। কোনো শাসক কিংবা ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বেশেষে কোনো নাগরিকের কোনো একটি কাজও শরিয়াহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। শরিয়াহর আওতায় পড়ে ব্যক্তি ও পরিবার জীবনের সাথে রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও। ‘রাজনৈতিক ফতোয়া’ নিছক রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তার গণ্ডিতে সীমিত নয়। শাসক ও জনজীবন সংশ্লিষ্ট সব ফতোয়াকেই জনগণ রাজনৈতিক ফতোয়া বলে গণ্য করে থাকে।
কোনো মুসলিম রাষ্ট্র আইন করে বহুবিবাহ বন্ধ করতে চাইলে (যেমন, তিউনিসিয়ায় করা হয়েছে) সরকার প্রথমে আলেমদের এ বিষয়ে মতামত দিতে বলে। এরপর তার নিজের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের অনুকূল ফতোয়া পেলে তা গ্রহণ করে। তবে সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে খুশি রাখার জন্য রাজনৈতিক ফতোয়া দেয়া হয় না। বরং প্রায় ক্ষেত্রে সঠিক ফতোয়া বাস্তবায়নে রাষ্ট্র সম্মত থাকে। একজন নিষ্ঠাবান আলেমের উচিত, রাষ্ট্র পছন্দ করুক কিংবা না করুক, যা যথার্থ সে মত দেয়া। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি গভীরভাবে অধ্যয়নের পর বিবেকবান হিসেবে অভিমত দেয়ার সময়ে তিনি শুধু আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করার কথা। আদর্শ মুফতি হওয়ার আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো বাস্তবতা, সমসাময়িক জনজীবন ও এর সমস্যা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা। শরিয়াহর লক্ষ্য উপলব্ধি না করে কোনো মুফতির ফতোয়া ঘোষণা করা উচিত নয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, ফিকহ এসেছে আগে, আর শরয়ি রাজনীতির আবির্ভাব পরে। তা হলে আলেমরা রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দেবেন কী করে? এমন প্রশ্নের জবাবে জানাতে হয়, ফিকহ শাস্ত্রের আদি পর্বের কিতাবগুলো প্রকাশিত হয়েছিল রাজনীতিবিষয়ক কিতাবের আগে। কিন্তু এরও অনেক আগে রাসূলুল্লাহ সা: ইসলামের সূচনা থেকেই রাজনীতি করেছেন। শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি অনেক রায় দিয়েছেন। ‘বিরান জমি যে চাষ করে, এটা তার সম্পত্তি বলে পরিগণিত হবে’ তিনি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সমাজের আইনগত বিষয়গুলোর দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে। একই কথা খোলাফায়ে রাশেদিন তথা হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত উসমান রা:, হজরত আলী রা:-এর ব্যাপারেও প্রযোজ্য। তারা জনস্বার্থে অসংখ্য রায় দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসকের ভূমিকায়।
আজকের আধুনিক দুনিয়ায় জ্ঞানের সব শাখায় বিশেষজ্ঞ হওয়া বাস্তবে আলেমদের পক্ষে অসম্ভব। এ কারণে মুসলমানরা সামষ্টিক ফতোয়া প্রদানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও পরিষদ গড়ে তুলেছে। ইসলামিক ওয়ার্ল্ড লিগের ফিকহ কাউন্সিল কিংবা ওআইসি’র ফিকহ কাউন্সিল এর নজির। রাজনীতি, অর্থনীতি অথবা আধুনিক জীবনের আর কোনো বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হলে উপরিউক্ত কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত আহ্বান করে থাকে। যাতে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সম্যক অবগত হয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, সে জন্যই এটা করা হয়। যেমন চিকিৎসা সম্পর্কিত ক্ষেত্রে আমরা মতামত নিই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের। এভাবে সামষ্টিক বিতর্ক ও সংলাপের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটা হয়ে থাকে।
রাজনৈতিক ফতোয়া ও গাজার ইস্পাত দেয়াল
আলেমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য। তাই যখন তাদের কাছে আইনি মতামত চাওয়া হয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে, তারা যেন জ্ঞান অনুযায়ী তা দেয়া থেকে বিরত না থাকেন।
সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ফতোয়া দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেমন দেশের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ইরাকি নাগরিকদের বাধ্যবাধকতা এবং গাজার সাথে মিসরীয় সীমান্তে ইস্পাতের দেয়াল নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, রাজনীতি কেবল রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব নাগরিকেরই অংশ নেয়া উচিত।
রাজনীতি বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখার কোনো কারণ নেই। অপর দিকে মোটামুটি জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি যার আছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়া দরকার।
আলেমরা অভিমত দেয়ার মাধ্যমে তাদের কর্তব্য পালন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ ও দিকনির্দেশনা আমরা নাজিল করেছি। এটা মানুষের জন্য কিতাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা সত্ত্বেও যারা তা গোপন রাখে, নিশ্চিত যে, তাদের আল্লাহ অভিশাপ দেবেন এবং যারা অভিশাপ দিয়ে থাকে, তারাও অভিশাপ দেবে ওদের। তবে যারা অনুতপ্ত, নিজেদের শুধরে নেয় এবং সত্যকে তুলে ধরে, তাদের দিকে আমি ফিরি (করুণা সহকারে); আর আমি প্রায়ই (ক্ষমার প্রতি) প্রত্যাবর্তনকারী, ক্ষমাশীল [সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৫৯-১৬০]
গাজা সীমান্তে ইস্পাত প্রাচীরের বিরুদ্ধে আমার যে ফতোয়া, এর ভিত্তি হলো গাজায় আমাদের ভাইদের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও কল্যাণ। কোনো মুসলিমকে অনুমতি দেয়া হয়নি তার ভাইদের সাহায্য না করা ও হতাশ করার। গাজা-মিসর সীমান্তে ইস্পাত দেয়াল তৈরি হলে গাজাবাসীকে সাহায্য করার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে; গাজার অবরোধে এবং বাসিন্দাদের দুর্ভোগে মদদ দেয়া হবে। এতে তাদের অনাহার বাড়বে। সেই সাথে, ইসরাইলের কাছে নতিস্বীকার ও আত্মসমর্পণের জন্য যে চাপ, তা বৃদ্ধি পাবে। যদি এই দেয়াল তৈরির অনুমতি দেয়া হয় ফতোয়ার মাধ্যমে, তা হলে কেবল ইসরাইল লাভবান হবে। তখন তারা গাজা অবরুদ্ধ রাখতে উৎসাহ পাবে। এক বছর আগে নির্বিচারে হত্যা এবং ধ্বংসতাণ্ডবেও গাজায় যা অর্জন করা যায়নি, তার জন্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ হতে পারে এই অবরোধ। তা ছাড়া, আল কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে, সব মুসলমান এক জাতি। তাই মিসরের একটি দায়িত্ব হচ্ছে গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করা; তাদের নির্মূল করায় ‘অবদান’ রাখা নয়। আলেমদের এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে, অমুসলিম দুশমন মুসলিম অধ্যুষিত কোনো ভূমি আক্রমণ করে দখল করে নিলে এই ভূখণ্ডের জনগণের দায়িত্ব আত্মরক্ষা এবং শত্রুর কবল থেকে মুক্ত হওয়া। যদি তারা তা করতে অক্ষম হয়, এ দায়িত্ব বর্তায় প্রতিবেশী এলাকার মুসলমানদের ওপর। এভাবে ক্রমান্বয়ে তা সব মুসলমানের সামষ্টিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়।
গাজার ক্ষেত্রে বলতে হয়, নিকট অতীতেও এটা ছিল মিসরের শাসনাধীন। মিসর গাজাকে মুক্ত করতেই সাহায্য করা উচিত, সেখানে ইসরাইলি অবরোধ জোরদার করতে নয়। শত্রুর হাত থেকে মুসলমানদের ভূখণ্ড রক্ষা এবং মুক্তিলাভের জন্য সাহায্য করাকে কুরআন, সুন্নাহ এবং সব মজহাব অন্যান্য মুসলমানের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেছে। অতএব, গাজার ব্যাপারে মিসরের দায়িত্ব রয়েছে। মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অত্যাচারিতকে সাহায্য করা এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। তাই তাদের করণীয় হলো, গাজাবাসীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং তাদের প্রতি অবিচার হতে না দেয়া। মুসলমানরা দেয়াল তুলে গাজা অবরোধে অংশ নিতে পারে না। সুতরাং বিষয়টা নিছক একটা দেয়াল তোলাই নয়। এ ক্ষেত্রে সব মুসলিম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই গাজাকে সাহায্য করা উচিত।
ইস্পাত প্রাচীর নির্মাণের ফলাফল
আল আজহারের ইসলামি গবেষণা পরিষদ দাবি করেছে, মিসরের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই দেয়ালটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই দাবি অযৌক্তিক। কেননা নিজের ভাই থেকে নিজেকে রক্ষার প্রয়োজন হয় না। ফিকহ শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো কিছুর ফলাফল কী দাঁড়াবে (ফিকহ আল-মা’য়ালাত)। গাজা সীমান্তের দেয়ালের ফল কী হতে পারে? জবাব হলো, এর দ্বারা আমরা নিজ ভাইদের হত্যা করব এবং তাদের বঞ্চিত করব বেঁচে থাকার সুযোগ কিংবা অবরোধ এড়ানো থেকে। এটাকে আলেমরা বলেছেন, আল কাতল বিল তার্ক, অর্থাৎ কাউকে পরিত্যাগের মাধ্যমে হত্যা করা। যেমনÑ কোনো ব্যক্তিকে একটি ঘরে তালা মেরে আটকে রাখা হলো এবং তাকে খাদ্য-পানীয় কিছুই দেয়া হলো না। কয়েক দিন পর দেখা গেল, লোকটি ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করেছে। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারী সে মানুষটি, যে তাকে বেঁচে থাকার উপকরণ না দিয়ে আটক রেখেছিল। গাজায় আমাদের ভাইদের প্রতি মিসরের আচরণও এমন। কারণ, সীমান্তে রাফাহর প্রবেশপথ বন্ধ এবং দেয়াল নির্মাণ করা হলে গাজার মানুষেরা একটি বড় কারাগারে ‘সম্পূর্ণ তালাবন্দী’ হয়ে পড়বেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মহিলা একটি বিড়ালকে আটকে রেখেছিল। সেটিকে কোনো খাবার দেয়নি কিংবা বাইরে যেতে দেয়নি খাবারের সন্ধানে। সে মহিলাকে মৃত্যুর পর দোজখের আগুনে পাঠানো হয়েছে। আর গাজা সীমান্তে দেয়াল দিয়ে মিসর একটি বিড়াল নয়, ১৫ লাখেরও বেশি বনি আদমকে আটকে রাখবে।
এ বিষয়ে নির্দেশনা এতই সুস্পষ্ট যে, কোনো আলেমের ফতোয়া দেয়ার দরকারই হয় না। কারণ, নিছক কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয়, কী করতে হবে। ইসলাম, আরব সংহতি ও মানবতার নামে বলছি, এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলতে দেয়া যায় না।
ফতোয়া : স্থানীয় না বিশ্বজনীন
কোনো কোনো আলেমের ফতোয়া স্থানীয় হতে পারে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য ফতোয়া দেয়ার প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে মুফতি নিয়োগ করতে পারে। তার দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার দায়িত্ব তিনি পালন করেন। বিশ্বজনীন ফতোয়া এর থেকে ভিন্ন। আল-আজহার বিশ্বজনীন ইসলামি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে দেয়া ফতোয়াগুলো স্থানীয় পর্যায়ের হতে পারে না, যা শুধু মিসরে প্রযোজ্য। আল-আজহারের ইসলামি গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই পাকিস্তান, লেবানন, মরক্কোসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় আলেমরাও এর সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তাই এটি স্থানীয় নয়, বিশ্বজনীন ইসলামি প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বেই মুসলমানরা আল-আজহারকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। অন্য দিকে মিসরের স্থানীয় মুফতি সিরিয়া বা আর কোনো দেশের মুসলমানদের জন্য ফতোয়া দেয়ার দায়িত্বশীল নন।
প্রথম ও দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন আরব দেশে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া দেয়া হয়েছিল। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর ফতোয়া আলজেরিয়া বা আর কোনো দেশ থেকে পৃথক হওয়া মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় নয়। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে আমি ছিলাম আলজেরিয়ায়। ফ্রান্সের সাদ্দামবিরোধী অবস্থান আলজেরিয়ার মানুষ মেনে নেয়নি। দেখেছি, তারা ফ্রান্সের বিরোধিতা করে তখন ইরাক সরকারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে। মুফতিদের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকায় তাদের ফতোয়াও পরস্পর থেকে পৃথক হতে পারে। কোনো মুফতি স্বভাবের দিক থেকে নরম মানুষ বলে ‘সহজ’ ফতোয়া দিতে পারেন। অন্য একজন মুফতি কঠোর প্রকৃতির কারণে ‘কড়া’ ফতোয়া দিতে পারেন। এসব মতপার্থক্য ফিকহর মূলনীতির ভিত্তিতে হলে সমস্যা হয় না। ফিকহর যাবতীয় বিষয়ে পুরো ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। কারণ, মুফতি নানা দিক বিবেচনা করেই ফতোয়া দিয়ে থাকেন। একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যায় এ ব্যাপারে।
এক দিন এক লোক এলো হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা:-এর কাছে। সে জিজ্ঞেস করল, কোনো খুনির তওবা আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন কি না। ইবনে উমর রা: তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, না এমন লোকের তওবা গ্রহণ করা হবে না। প্রশ্নকারী ব্যক্তি চলে গেলে ইবনে উমর রা:-এর বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন এই ফতোয়া সম্পর্কে। তারা তার কথা শুনে অবাক হয়েছিলেন। কারণ, এর আগে ইবনে উমর রা: লোকজনকে বলতেন, খুন করে কেউ তওবা করলে তা কবুল হবে। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলো। তিনি জবাব দিলেন যে লোকটি এসেছিল, তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, সে ওই মুহূর্তে এতটাই ক্রুদ্ধ যে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আমি তখন চেয়েছি তাকে এই অপরাধ থেকে বিরত রাখতে। সে জন্যই তাকে ‘না’ বলেছি।
আলেমদের অভিমত, ফতোয়া স্থান, কাল ও পরিস্থিতির নিরিখে বদলে যেতে পারে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মুফতির থাকা চাই বাস্তবতার সম্যক উপলব্ধি যাতে সঠিক মতামত প্রকাশ করা যায়। রাজনীতিবিষয়ক ফতোয়ার বেলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউসুফ আল কারাদাভি : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন