মুরসী সরকারের উৎখাত এবং বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পবির্তন ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন হলদে ডানা ১২ জুলাই, ২০১৩, ০১:০০:০৯ দুপুর
ইসলাম বিজয়ী হওয়ার জন্য এসেছে, সুতরাং পরাজয় কিংবা পতন মানেই সেখানে শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে আছে। মিশরে ইখওয়ান তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয় ছিল বর্তমান সময়ের ইসলামী আন্দোলনগুলোর সেরা অর্জন। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সে বিজয় নস্যাত হওয়াটা বিশ্বের সকল ইসলামী সংগঠনের জন্যই বার্তা বহন করছে। বাংলাদেশের ইসলামী সংগঠনগুলো বিশেষত জামায়াতে ইসালামীর জন্যও এ ঘটনা পরম্পরায় রয়েছে বার্তা
পরিবর্তনের জন্য চাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন
ইরানে আশির দশকে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে যে বিপ্লব হয়েছিল, সে বিপ্লব আজো টিকে আছে। বর্তমান সময়ের চেয়ে সে সময়টি ইসলামপন্থীদের জন্য আরো কঠিন ছিল। তবু সে বিপ্লব টিকে থাকার নেপথ্যে রয়েছে ইরানবাসীর জাতীয় ঐক্য। সেদেশের ৯০ ভাগ মানুষ বিপ্লবের পক্ষে একাট্টা থাকায় আমেরিকার নের্তৃত্বাধীন পরাশক্তিগুলো আজো বিপ্লবে হাত দিতে পারেনি। কিন্তু ২০১১ এর মিশরের বিপ্লবের পর সেদেশের জনগণ স্পষ্টত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বিপ্লব নস্যাতে এ সুযোগটিই কাজে লাগানো হয়েছে।
সবগুলো আসনে এককভাবে নির্বাচন না করায় জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটের পরিমান বলা কঠিন। তবে দুই যুগ আগে ১৯৯১ সালে দু’শো আসনে নির্বাচন করে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে প্রাপ্ত ভোট ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। ভোটার নয় কিন্তু সহানুভুতিশীল এমন সংখ্যা হিসেব করলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ অথবা ২০ শতাংশও যদি ধরা হয়, সে সংখ্যা মোট জনসাধারণের খুব বড় অংশ নয়। ব্রাদারহুড যেখানে ৫২ শতাংশ জনসমর্থন নিয়েই টিকে থাকতে পারেনি, সেখানে ১৫-২০ ভাগ জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রথম কাতারে দাঁত কামড়ে পরে থাকার চেষ্টা করাটা জামায়াতে ইসলামীর জন্য সঠিক কর্মপন্থা হতে পারেনা।
রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিই জনসমর্থ তৈরী করে
ব্রাদারহুডের জনসমর্থনের ভিত্তি অত্যন্ত শক্ত। জনগণের নিরন্তর সেবা করে, পাশে থেকে তারা জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। জামায়াতে ইসলামী সে তুলনায় এখনও অনেক দূরে। জামায়াতের কর্মীরা যেমন ব্যক্তিগতভাবে জনগণ থেকে দূরে, দলগতভাবেও জামায়াত জনগণ থেকে দূরে। একজন নিয়মিত জামায়াত কর্মীর সাংগঠনিক কাজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোরআন ও হাদিস পাঠ, পিওর রাজনৈতি কর্মসূচিতে যোগদান এবং রিপোর্টিং, অডিট, কালেকশন প্রভৃতি রুটিন বৈঠকাদিতে যোগদানের মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ। এর বাইরে পারিবারিক, আত্মীয়তা, সামাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন কোন কর্মী গঠনমূলক কিছু করলেও তা সাংগঠনিক তাকিদের চেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বেশি হয়ে থাকে।
জামায়াতকে ব্রাদরহুড পর্যায়ে পৌঁছতে দলীয় কর্মসূচিতে জনসেবার বিষয়টি ব্যাপক ও মৌলিকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে, অন্যদিকে জনশক্তির মানোন্নয়নে পরিবার গঠন, আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং প্রতিবেশি ও সাধারণ মানুষের সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি মৌলিক কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রসূল স. মাক্কী জীবনে যত নির্যাতনের শিকারই হোন, সেই বুড়ির খেদমত ঠিকই করেছিলেন রাতের আঁধারে। আর আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী সাহাবাগণ যখন নতুন দ্বীন সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছেন, জবাব দিয়েছেন, “আমাদেরকে আমাদের নবী আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করতে নিষেধ করেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখতে বলেছেন, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন…”। এই ছিল তাদের ইসলাম।
জামায়াতের যে জনসমর্থন তাতে এই মুহুর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে মূল প্রভাবক হওয়ার চেষ্টা করার চেয়ে স্থানীয় পরিষদগুলোতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার রাজনৈতিক অভিলাষ নেয়া উচিত। ব্রাদারহুড স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিত্বে সবার আগে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। জামায়াতের টার্গেট থাকতে পারে আগামী পঞ্চাশ বছর কি তিরিশ বছর পর আমরা ক্ষমতার রাজনীতিতে মূল প্রভাবক হবো। পর্যাপ্ত জনসমর্থন সংগ্রহ না করে ক্ষমতার রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়া মানে অনাহুতভাবে নির্যাতন নিগ্রহের শিকার হওয়া। রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য উপযুক্ত স্তম্ভ তৈরী বাধাগ্রস্থ হয় সরাসরি রাজনৈতিক নিগ্রহে। সম্ভাবনাময় ইসলামী ছাত্রশিবির রাষ্ট্রপরিচালনার যোগ্য নেতৃত্ব তৈরীতে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়ছে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। মুসলিম ব্রাদারহুড সে তুলনায় অনেক যোগ্য লোক তৈরী করেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল।
ইসলামপন্থীদের ঐক্য ছাড়া বিপ্লব টিকে থাকবেনাঃ
অর্ধেকের বেশি জনসমর্থন নিয়েও বিপ্লব ধরে রাখতে না পারার পেছনে অন্যতম কারণ বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্রাদারহুডের ব্যর্থতা। ব্রাদারহুডের পেছনের ইচ্ছা যা-ই হোক, নির্বাচন ও সরকার গঠনটি ইসলামপন্থীদের না হয়ে ব্রাদারহুডের বলেই পরিচিতি পেয়েছিল। সালাফীদের আন নূর পার্টিকে যদি বাদারহুড পাশে নিতে পারতো, তাহলে সরকারটি হতো ইসলামপন্থীদের সরকার এবং এত সহজে সরকারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া সম্ভব হতোনা। সালাফি আন নূরের সমর্থন ব্রাদারহুড ঠিকই পেল, কিন্তু ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে সেনাবাহিনীর গনহত্যার শিকার হওয়ার পর। হতে পারে ক্ষমতায় থাকতে একটু বেশি সেক্রিফাইস করলে আগেই তাদের সমর্থন আদায় করা যেত।
মিশরে এত বিশাল জনসমর্থন নিয়ে, নিরপেক্ষ মন্ত্রীসভা বানিয়েও সরকারটি ইসলামপন্থীদের সরকার হিসেবে পরিচিতি না পেয়ে ব্রাদারহুডের সরকারই থেকে গেল। এ থেকে শিক্ষণীয় হলো বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামী যদি এককভাবে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে স্বপ্ন কখোনোই সফল হওয়ার নয়। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ মিশরের চেয়েও মারাত্মক। তবে আশার কথা হচ্ছে, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সরকারের গণহত্যার ফলশ্রুতিতে এদেশের অধিকাংশ ইসলামী দলগুলো এখন ইতিহাসের সবচেয়ে কাছাকাছি নৈকট্যে অবস্থান করছে। জামায়াতে ইসলামী সেক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোকে যে কোন মূল্যে বন্ধূ ও সহযোগী বানাতে পারলেই কেবল পঞ্চাশ বছর পরের বিপ্লবকে স্থায়ী করার স্বপ্ন দেখতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপিকে সর্বস্তরের বন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে প্রাণের দুশমন ভাবনাটা জামায়াতের জন্য ইসলামী দল হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। জামায়াতে ইসলামীকে মনে রাখতে হবে, মুসলমানের বন্ধু কেবল মুসলমানই হতে পারে এবং একই সাথে সাথে ইসলামী কোন দলের জন্য কোন একটি গোষ্ঠীকে স্থায়ী দুশমন বানিয়ে রাখা নীতি সম্মত নয়।
জনগণের মনস্তত্বকে ইসলামী সমাজের জন্য তৈরী করাঃ
একটি বিপ্লবের প্রকৃত বার্তা যদি জনগণ হৃদয়োঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়, সে বিপ্লব বেশিদিন স্থায়ী হয়না। মিশরের জনগণ দীর্ঘদিন পাশ্চাত্যপন্থী মোবারকের শাষনে থেকে জীবনকে বুঝতে শিখেছে রুটি আর বিনোদনের সমষ্টি হিসেবে। মোবারককে হঠিয়ে তাই তারা অস্থির চিত্তে অপেক্ষায় ছিল কবে তাদের চাকরী বেতন বোনাসে শনৈ শনৈ উন্নতি হবে। একটি সমাজে মানব জীবনের অর্থ কি, দায়িত্ব কি, লক্ষ্য কি,এ বিষয় তারা ইসলামের দৃষ্টিতে ভাবতে ভুলে গিয়েছিল দীর্ঘদিনের পাশ্চত্য ধারার সংস্কৃতি ও জীবনের কল্পনায়। সন্দেহ নেই ইসলামী বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে জীবন যাত্রার উন্নতি, কিন্তু জীবন মানের উন্নতিই যে একমাত্র ফলাফল নয় এবং মৌলিক পরিবর্তনগুলো পার হয়ে যে জীবন মানের উন্নতি হবে, এই ব্যাপকভাবনা বিপ্লবী জনতার মধ্যে অনুপস্থিত থাকাতেই ড. মুরসির কাজের সাথে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় ফারাগ তৈরী হয়।
বাংলাদেশের অবস্থান সে হিসেবে আরো দূরে। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝে এমন মানুষের সংখ্যা এখানে অতি অল্প। ইসলামের প্রতি আবেগ এখানে অনেক কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা যে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এই মৌলিক উপলব্ধিটুকুই এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী দল ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। ইসলামের প্রকৃত বুঝ অধিকাংশ জনগণের মাঝে প্রথিত না করে রাষ্ট্রক্ষমতায় ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক কাজ করলে যদিওবা জনগণের আবগকে পুজি করে ইসলামকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, সে বিপ্লব বেশিদিন স্থায়ী হবেনা। জামায়াতের কর্মসূচিতে জনগণের চিন্তাজগতে বিপ্লব সৃষ্টির কাজ এক সময়ে থাকলেও বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মসূচির ভীড়ে আছে শুধু কাগজে কলমে। এক্ষেত্রেও জামায়াতকে কর্মসূচিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে রুট লেভেলের একজন কর্মী পর্যন্ত মিশরের বিপ্লবকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলছে এবং চলছে পর্যালোচনা। মিশরের সাম্প্রতিক পরিবর্তন থেকে তারা নিজেদের জন্য কি শিক্ষা বের করতে পারে এবং কতটুকু মৌলিক পরিবর্তনে হাত দেয়, সেটিই এখন দেখবার বিষয়।
বিষয়: বিবিধ
২৪৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন