বাবা অখ্যাত, তাই বলে কি বিখ্যাত খালুকেই বাবা?
লিখেছেন লিখেছেন লেখক ভাই ০৩ মে, ২০১৭, ১২:২৬:৪৫ রাত
এইতো সেদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সোনারবাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে পাশের সিটে যাত্রী পেলাম এক ভদ্র মহিলা। মহিলা বললে একটু ভুল-ই হয়ে যায়, মেয়ে বললেই বোধহয় সঠিক হবে! কারন তিনি বিবাহিত নন, আবার ষ্টুডেন্ট, তাই বলতে পারি ভদ্র মেয়ে! যাইহোক তার ভারী লাগেজ'টা হ্যাঙ্গারে তুলে দিয়ে সাহায্য করার সুবাদে পরিচয়টা হয়ে গেল!
পরিচয়ের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকলেন, কোথায় যাবেন, কোথায় থাকেন, কি করেন, বাড়ি কোথায়, পড়াশুনা কোথায়, মনে হলো আমি যেন ইন্টারভিউ দিচ্ছি! ধীরে ধীরে প্রশ্ন চলে এলো পরিবারের দিকে! পরিবারে কে কে আছে, ওহ্... ভাবির বাড়ি কোথায়? কি করেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। একপর্যায়ে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি করেন?
সরাসরি উত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করি।
খুব ভাল, কোন ডিপার্টমেন্টের?
হোম ইকোনোমিক্স।
এবার তাকে ধরার পালা আমার। এতক্ষণের অঘোষিত ইন্টারভিউ-এর যন্ত্রনা মেটাতে হবে! বললাম, হোম ইকোনোমিক্স কলেজ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যেটা?
হ্যাঁ।
আপনারাই না কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট হওয়ার জন্য আন্দোলন করছিলেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তো, হোম ইকোনোমিক্স কলেজকে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট করা হয়েছে?
না, এখনও হয়নি, হয়ে যাবে!
এটা কি আপনি নিজে করবেন, নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করবে?
ঞ্যাঁ... না... হাসি দিয়ে... আমি করব কিভাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করবে!
তো আপনি এত কনফিডেন্সের সাথে কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?
ঢাবি কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি বিবেচনা করবে বলেছে, আশাকরি হয়ে যাবে। আমাদের দাবি তো অযৌক্তিক না!
ওহ্ তাহলে সম্প্রতি ঢাকার সাতটি কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়েছে, ওরাও কি আপনার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টুডেন্ট?
না, ওরা কেন হবে? আমরা তো সবার আগে এবং অনেক আগে থেকে অধিভুক্ত আছি। আমারা তো সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি।
তো, ঢাবির নতুন অধিভুক্ত কলেজগুলোর ষ্টুডেন্ট'রা যদি ঢাবির ষ্টুডেন্ট না হয়, তাহলে আপনি নিজেকে ঢাবির ষ্টুডেন্ট বলছেন কিভাবে?
ম্যাডামের মুখে কুলুপ, চান্দি গরম! মনে হলো দুনিয়ার যত্তসব বিরক্তি তার পাশে বসে আছে। মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়ার মতো করে নিশ্বাস ছাড়ছে! আমি একটু ভয়-ই পেয়ে গেলাম, আবার উত্তেজনায় কি নাকি করে বসে!
তারপরও সাহস নিয়ে বললাম, আপু একটা কথা বলি?
বলেন..
মানুষের জন্য সেটাই গর্বের, যেটা তার নিজের। সেটাই তার সম্পদ, যে সম্পদ তার নিজের। নিজের পরিচয়ে টিকে থাকতে পারাটাই গর্বের। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারাটাই স্বার্থকতা। কেন আপনি অন্যের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাইবেন?
এবার ম্যাডামের মুখে কিছু প্রতিবাদী ভাব দেখা গেল। আপনি এখন আমাকে এটা শেখাবেন, কোনটা ঢাবি আর কোনটা ঢাবি না?
স্যরি, আপনাকে শেখাবো, এত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ তো আমি নই।
ওহ্ ভাব নিচ্ছেন না?
কি যে বলেন, নগন্য মানুষ আমি, নগন্য মানুষের আবার ভাব!
.....বুঝলাম, "ঢাবির অধিভুক্ত" বিষয়'টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। যেটুকু তাকে বলেছি, এই ঢের। এতটুকুতেই যখন ম্যাডামের চান্দি গরম, এরচাইতে বেশি হলে ম্যাডাম যদি রাগে কাঁদতে শুরু করে, তাহলে আমার কপালে শনি আছে! তাই কৌশলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিলাম! এভাবে কথা বলতে বলতে সময় কেটে গেল। একসময় ট্রেনের স্লো গতি দেখে বুঝলাম চট্টগ্রাম ষ্টেশনে পৌছে গেছি। ম্যাডামের অনুরোধে আবারও তার সেই ভারী লাগেজটা নামিয়ে দিয়ে একসাথে ট্রেন থেকে নামলাম। ম্যাডামকে নিতে তার বাবা এসেছেন, ম্যাডাম তার বাবার সাথে দাড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আমি দ্রুত একটা সিএনজি নিলাম, সিএনজিতে উঠার আগে ম্যাডামের দিকে এবার তাকিয়ে দেখলাম, ম্যাডামের ঠোঁটে হাসি। বুঝলাম ম্যাডামের রাগ'টা তাহলে এতক্ষনে পানি হয়ে গেছে! সিএনজি ষ্টার্ট নিল, আমি ছুটে চললাম আমার গন্তব্যে।
আসলে যে উদ্দেশ্যে লেখা....
সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি....
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। কিন্তু সেটা কোন এক সময়। বর্তমানে নয়। বর্তমানে ঢাবি'কে আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা চলে না। কারণ, I am GPA 5 মানের ষ্টুডেন্টও এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়! প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাচ্ছে অযোগ্যরা। একজোড়া বুট, কিংবা ব্যাট-বল হাতে নিয়ে খেলোয়াড় কোটায় ঢাবিতে ভর্তি হয় অযোগ্যরা! রাজনৈতিক কোটা, বাপের কোটা, মায়ের কোটা, আত্নীয়-স্বজন কোটা, আরো কতশত কোটা আছে ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার জন্য! এত কোটার ভিড়ে আসল মেধাবীরাই এখন ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়!
মেধাবী'রা যে ঢাবিতে একেবারেই নেই তা নয়, আছে, কিন্তু যা থাকার কথা ছিল, তার তুলনায় একেবারেই নগন্য।
এখনকার ঢাবির ষ্টুডেন্ট হচ্ছে কোটার ষ্টুডেন্ট। মেধার ষ্টুডেন্ট নয়। যারা ঢাবির ষ্টুডেন্ট না হয়েও ঢাবির নামে পরিচিত হতে চায়, তাদের অবস্থা'টা এমন যে, নিজের বাবা অখ্যাত তাই, বিখ্যাত খালুকে বাবা হিসেবে পরিচয় দেওয়া! যারা এমন ভাব নেয়, তাদের জন্য করুনা!
আগেকার দিনের চৌধুরী এবং বর্তমানের চৌধুরীদের মধ্যে পার্থক্য হলো, বর্তমানের চৌধুরী'রা না খেয়ে মরে। অনেক ফকিরও পাওয়া যাবে যাদের নামের শেষে চৌধুরী লাগানো আছে! সেরকম, আগেকার ঢাবির ষ্টুডেন্ট আর এখনকার ঢাবির ষ্টুডেন্টদের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য! এখনকার ঢাবির ষ্টুডেন্টদের ভাল প্রতিষ্ঠানগুলো চাকুরীতে নিতে চায় না! ভাল প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝে, এরা কোন কোটার ফসল! এখনকার ঢাবির ষ্টুডেন্টদের সেন্ডেলের তলা ক্ষয়ে যায় চাকুরী খুঁজতে খুঁজতে।
সুতরাং কোন খালু বিখ্যাত, তার খোঁজ না করে, নিজের বাবা যদি অখ্যাত হলেও সেই বাবার পরিচয়ই অনেক সম্মানের। তেমনি, কোন ভার্সিটির নাম বেশি, তার পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা না করে, নিজেকে নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ষ্টুডেন্ট হিসেবে পরিচয় দেওয়াটাই সম্মানের। সফল তো সেই ষ্টুডেন্ট, যে সকল প্রতিযোগীতার জন্য নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
বিষয়: বিবিধ
৯৭৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন