সাহানা মাফ করে দিও
লিখেছেন লিখেছেন উদাস পথিক ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:৪৪:৩১ সন্ধ্যা
প্রিয় সাহানা, মাফ করে দিও আমাকে। আমি তোমার করুন পরিণতি দেখে চোখের পানি বিসর্জন ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার তোমার আকুতি কিছুটা হলেও আমার মত কাপুরুষের অন্তরে নাড়া দিয়েছিল। একই সাথে তোমার প্রতি অন্তপ্রান উদ্ধারকারীদের নিরলস প্রচেষ্টা আমার মত স্বার্থপর লোকরা টিভি পর্দায় দেখে পুলকিত বোধ করছিল। তোমার হাতে হাত রেখে তোমাকে মৃত্যুকূপ থেকে তুলে আনার প্রতিশ্রুতি দেন দেশের বীর পুরুষ উদ্ধারকারীরা। সোফার নরম আসনে বসে সত্যি সত্যি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম তুমি ফিরে এসো স্বপ্নের এ ভুবনে, আবার ফিরে এসো তোমার দেড় বছরের ছেলের কাছে, তুমি ফিরে এসো তোমার স্নেহময়ী বাবা-মার কাছে, তুমি ফিরে এসো তোমার প্রাণপ্রিয় পরিবারের কাছে, তুমি ফিরে এসো এ পৃথিবীর আলো-বাতাসে। সারাটা দিন অপেক্ষায় ছিলাম এই বুঝি তুমি ফিরে আসলে। ক্ষণে ক্ষণে উদ্ধার সুড়ঙ্গের উত্তেজনা যেন অন্তরে ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছিল। জীবনে তো শুধু তোমাদের প্রতি স্বার্থপরদের অবহেলা দেখেছিলে, তোমাদের জন্য থেমে থাকেনি পদ্মা-মেঘনার ঢেউ, থেমে থাকেনি রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যাল। বরং স্বার্থপরদের জন্যই তোমাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে। কিন্তু এই প্রথমবার তোমার ক্ষমতা দেখার সুযোগ হয়েছিল! যন্ত্র দানবের মত বিশাল বিশাল ক্রেন, বুলডেজার থেমে গিয়েছিলে শুধু তোমার প্রতীক্ষার প্রহর গুনে। মৃত্যুকুপের ভয়াবহ যন্ত্রনায় তুমি হয়ত তা জানতে পারোনি। কিন্তু রাতের বেলা যখন দেখলাম অগ্নিকান্ডের ঘটনা এবং উদ্ধারকারীদের আর্তনাদ তখন মনে হল এ স্বার্থপরের সমস্ত অনুভূতি যেন এক প্রবল টর্নেডোর আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল, প্রকান্ড গর্জণে দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছিল। তোমাকে আনা গেল না। তোমার হাতে হাত রেখে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখা গেলনা। রাতের বেলা টকশোতে বড় বড় বুদ্ধিজীবিদের আলোচনার শিরোনাম হলো ”সাহানাকে বাঁচানো গেল না”। জীবিত সাহানাদের খোঁজ কেউ কোনদিন নিল না কিন্তু মৃত সাহানা জাতীয় সংবাদের শিরোনাম। তুমি দেখতে পেলে অবাক হতে যে, আমার মত আরামপ্রিয় স্বার্থপররাও তোমার জন্য অশ্রু বিসর্জন দিতে জানে।
স্বার্থপর হলেও তো মানুষ! তাই বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ফায়ার সার্ভিসের খায়ের ভাইয়ের কাছে তোমার আকুতি শুনে। তুমি বলেছিলে চারদিন ধরে তোমার ছেলেটি বুকের দুধ খেতে পারছে না। তুমি চেয়েছিলে শেষ বারের মত তোমার আদরের ধন ছেলেটির মুখটি দেখতে। কিন্তু আমার মত এই কাপুরুষদের পক্ষে সম্ভব হলো না তোমার শেষ আকুতিটি পুরণ করার। ক্ষমা করো বোন আমাকে/ আমাদেরকে, ক্ষমা করে দিও।
তোমরা যারা ডলার কন্যা নামে খ্যাত ছিলে তারা জিডিপির, জিএনপি, সিপিআই ইত্যাদির মত কঠিন কঠিন শব্দের সাথে পরিচিত না হয়েও অব্যাহত ভাবে এতে অবদান রেখে গিয়েছিলে। বিনিময়ে শুধু চেয়েছিলে ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকার। নিজের স্বপ্নটিকে ধারণ করার অধিকার। নরপিশাচ অর্থলোভী হায়েনারা তোমাদের সে অধিকারটুকুও দিল না। শুনে অবাক হলাম রক্তপিপাসুরা তোমাদের ১৫ টাকার টিফিনেও ভাগ বসিয়েছেল!!
অভাগা বোনটি শুনলে হয়ত কষ্ট পাবে। ওহ “কষ্ট” বলতে কোন কিছু তো তোমাদের অভিধানে ছিল না, ওটা আমাদের মত আরামপ্রিয়দের শব্দ। তুমি খুশি হবে যে, তোমার ভোটে জয়ী ডিজিটাল সরকার বাহাদুর দেশের “সুনাম” রক্ষার্থে উন্নত বিশ্বের আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত চৌকষ বাহিনীর উদ্ধার অভিযানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। একথা শুনে তুমি হয়ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে এই ভেবে যে, তোমার মত এক থেকে দেড় হাজার সাহানাদের বিনিময়ে ডিজিটাল দেশের “সুনাম” রক্ষা হয়েছে। অবশ্য জানি যে, তোমার সে অট্টহাসিটি বেশীক্ষন স্থায়ী হবেনা। কারন তুমি তো তোমার দেড় বছরের আদরের ধন ছেলেটিকে সাথে নিয়ে যাওনি, রেখে গেছ এই স্বার্থপরদের কাছে। তুমি নিজের জীবন দিয়ে দেশের ”সুনাম” রক্ষা করেছ বটে কিন্তু নিশ্চয়ই মানবে না যে তোমার ছেলের জীবন দিয়েও দেশের “সুনাম” রক্ষা করবে। বোধ করি এতোটা দেশপ্রেমিক হয়ে উঠোনি, কারণ তুমি যে ”মা”। এবিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি তোমার মৃত্যুকুপের আরেক সহযাত্রী তোমার বোন মানিক গঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানার উত্তর বাসাইল গ্রামের নাজমার কথায়। মৃত্যুর পূর্বে মোবাইলে সে তার স্বামীকে বলেছিল- ”আমাকে বাঁচাও, তাড়াতাড়ি মুক্ত করো। না পারলে আমার মেয়েটিকে মানুষ করো। আমার মতো গার্মেন্টেসে পাঠিওনা।” মায়ের জন্য প্রতীক্ষায় থাকা ৮ বছরের মেয়ে হাফেজার ভবিষ্যত চিন্তা করে নাজমা কথাগুলো বলেছিল।
ভাই হিসেবে বোন সাহানা তোমার কাছে একটি কৈফিয়ত চাইব। যখন কয়েকটি রডের জন্য তোমাকে বের করে আনা যাচ্ছিল না, তুমিও তো বের হওয়ার জন্য একবার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু পারছিলেনা । শরীর আর জামা আটকে যাচ্ছিল বিমে। ভাই ডাকা সেই উদ্ধারকারী খায়ের ভাই তোমাকে গায়ের জামা খুলে ফেলতে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, শ্যাম্পু দিচ্ছি। গায়ে মেখে পিচ্ছিল করে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। বোন শাহানা, তুমি অন্ধকার মৃত্যুকূপেও শরীরের জামা খুলতে চাওনি। খায়ের ভাইকে বলেছিলে, একটু চেষ্টা করে রডগুলো কেটে নিন। ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করবো। তুমি নিজেও করাত দিয়ে একটি রড কাটার চেষ্টা করছিলে।
কিন্তু তোমার অপেক্ষার প্রহর তো আর শেষ হল না। চলে গেলে ওপারে। তুমি তো তোমার ছেলের কথা ভেবেও জামা খুলে গায়ে শ্যাম্পু দিয়ে শেষ চেষ্টাটা তো করতে পারতে! কিন্তু করলে না। ছেলের মুখটিকে সামনে রেখে মৃত্যুর দরজায় দাড়িয়েও একটু আপস কি করা যেত না! ডিজিটাল সভ্য সমাজে যেখানে কাপড় খোলার প্রতিযোগীতা সেখানে মৃত্যুর সাথেও আপস করলে না তুমি!! কি আশ্চর্য তোমার মূল্যবোধ!!!
বোন ক্ষমা করো এই অধম-অক্ষম ভাইটিকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য। অতীতের জন্য এ কারনে যে তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি শুধু অশ্রু বিসর্জন ছাড়া। বর্তমানেও তোমার পরিবার ও ছেলের জন্য কিছুই করছিনা শুধু সমবেদনা জানানো ছাড়া। আর ভবিষ্যতের জন্য একারণে যে হয়ত সপ্তাহ, মাস, বছর পরে তোমাকে ভুলে যাব বলে। হয়ত মনে রাখব না তোমাকে। তবে কথা দিচ্ছি- ভবিষ্যতে পথ চলতে যদি সাহানা নামের কোন মেয়ের নাম শুনি সেদিন নিশ্চিত করেই তোমার কথা মনে করব। স্মৃতিতে নিশ্চিত ভেসে উঠবে তোমার নাম, সাহানা!!!সাহানা!!!!সাহানা!!!
বিষয়: বিবিধ
২৪২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন