সাহাবাদের সমালোচনা। বাস্তবতা কতটুকো ?

লিখেছেন লিখেছেন মেঘনা নদীর মাঝি ০৮ অক্টোবর, ২০১৩, ০৬:৪৪:৫২ সন্ধ্যা

মওদূদী সাহেব সাহাবাদের সমালোচনা করার জন্য ইয়াহুদী, নাসারা আর খৃষ্টানদের ইতিহাস থেকে তথ্য নিয়ে খেলাফত আওর মুলুকিয়াত নামক কিতাবটি লিখেছে।....... ইয়াহুদী,নাসারা, খৃষ্টানদের কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে সাহাবাদের সমালোচনার উদ্ধেশ্য হলো ইয়াহুদী নাসারাদের এজেন্ট হয়ে ইসলামের ক্ষতি করা, কোরআন কে বিতর্কিত করে ইসলাম কে ধ্বংস করে দেওয়া। এরা ইসলামের দুষমন। এদের থেকে সাবধান থাকা দরকার।

উপরোক্ত মধুমিশ্রিত বয়ানগুলো আর কারো নয়, বর্তমান সময়ের আলোচিত হকের ডিলার, ইসলামের একমাত্র হোল সেলার, ওয়ারিশ সুত্রে দলের ইমারত প্রাপ্ত পীর সাহেব চরমোনাইর। মওদুদীর লিখিত কিতাব খেলাফত আওর মুলুকিয়াতের ওপর সমালোচনা মুলক কিতাব রয়েছে কয়েকটি। কিন্তু তাদের কেউ এই দাবি করার সাহস করেননি যে, মওদূদী সাহেব খৃষ্টানদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন। ওয়াজের রেকর্ড আমাদের কাছে আছে, কেউ চ্যালেঞ্চ জানালে দেওয়া যাবে।

আসুন এবার আমরা দেখি মাওলানা মওদূদী (রহ) পীরসাহেব কর্তৃক খেতাব পাওয়া কতজন ইয়াহুদী, নাসারা আর খৃষ্টান (???) থেকে ইসলামের ইতিহাস বা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যকার বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস গ্রহণ করে তার বিখ্যাত, বহুল আলোচিত, সমালোচিত ইতিহাসের কিতাব খেলাফত আওর মুলুকিয়াত রচনা করেছেন।

১। ইবনে সা’য়াদ রহ।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, মুহাদ্দিস এবং স্বনামধন্য তাবে তাবেয়ীন। যার ওপর দুনিয়ার বিশিষ্ট ঐতিহাসিকরা ইতিহাস বিষয়ে সম্পুর্ণ নির্ভর করতেন। তিনি খেলাফতে রাশেদার অতি নিকটবর্তি একজন ব্যক্তি। আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামায়াতের প্রত্যেক ইমাম তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তার ব্যাপারে শীয়া হওয়ার কল্পনাও করা যায় না।

২। ইবনে জারির তাবারী রহ।

মুহাদ্দিস, মুফাস্সির এবং ঐতিহাসিক হিসেবে তার মর্যাদা সর্ব মহলে স্বিকৃত। তার বিষয়ে হাদিসের প্রখ্যাত হাফেজ, সমালোচক হাফেজ খোযায়মা রহ বলেন, ততকালিন বিশ্বে তার থেকে বেশি জ্ঞানী আর কেউ ছিলো না। কিন্তু সমকালিন সময়ে একই নামে আরেকজন শীয়া ব্যক্তি ছিলো বলে ভূলক্রমে অনেকে ইবনে জারির তাবারী কে সেই শীয়া বলে মনে করে থাকেন কিন্তু তার ইতিহাস গ্রহনের পদ্ধতি সম্পর্কে যারা সচেতন তারা সবাই স্বিকার করেন যে, তিনি আহলুল সুন্নাহর অর্ন্তভুক্ত একজন। দু একজন ছাড়া তাকে দুনিয়র মুসলিম উম্মাহ ইমাম বলে স্বিকৃতী দিয়েছে।

৩। ইবনে আব্দুর বার রহ।

হাদিসের হাফেজ হিসেবে তিনি মশহুর ছিলেন। তাকে শাইখুল হাদিস উপাধি দেন হাফেজ যাহাবী রহ। আল রাজি বলেন, আন্দালুসে আবু ওমরের (ইবনে আব্দুর বার) সমকক্ষ কোন হাদিস বিশারদ ছিলো না। তিনিও আহলুস সুন্নাহর ভুক্ত শীয়া তো ননই।

৪। ইবনে আসীর রহ।

আহলে সুন্নাহর এমন কোন লেখক নেই যারা ইতিহাস বর্ননার ক্ষেত্রে তার ওপর নির্ভর করেননি। শীয়াদের নাম শুনলেও তার এলার্জি হয়ে যেত। শীয়া বর্ননাকারীদের বিষয়ে তার এত এলার্জি ছিলো যে, তিনি একজন শীয়া বর্ননাকারী থেকে প্রাপ্ত তথ্য নাকচ করে দিয়ে সত্যাশ্রয়ী কোন ব্যক্তির রেফারেন্স গ্রহন করার চেষ্টা করতে কসুর করতে না, এই কাজে যতটা হোক তিনি কষ্ট স্বিকার করতেন।

৫। ইবনে কাসির রহ।

মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, ঐতিহাসি হিসেবে সর্ব মহলে স্বিকৃত। গোটা মুসলিম উম্মাহ তার তাফসির তাফসিরে ইবনে কাসিরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার রহ যোগ্য শাগরেদ হিসেবে তিনি তার সুযোগ্য উত্তরসুরী হয়েছিলেন। শীয়াদের ব্যাপারে তিনি তাইম্যিয়া থেকেও কঠোর ছিলেন।

এরা ছাড়াও আরো কিছু খৃষ্টান রয়েছেন (???) যাদের কাছ থেকে মওদূদী ইতিহাস গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলেন.............................

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ, ইবনে খাল্লাকান রহ, ইবনে খালেদুন রহ, আবু বকর জাসসাস রহ, কাযূ আবু বকর ইবনুল আরাবী রহ, মোল্লা আলী কারী, মুহিব্বদ্দীন আত-তাবারী রহ, বদরুদ্দিন আইনী রহ সহ আরো অনেকে।

মুসলিম উম্মাহর সর্বজন স্বিকৃত এই সব মনিষীদের কে খৃষ্টান আখ্যা দেওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে বলে আমি মনে করছি। এই গুলো হলো।

এক।------ পীরসাহেব হয়তো খেলাফত আওর মুলুকিয়াত কিতাবটি না পড়েই মওদূদীর বিরুদ্ধে সাহাবা সমালোচনার বয়ান করছেন যেটা সম্পুর্ণ রুপে হারাম ছিলো। এই হারাম কার্যের কারনে তিনি না জেনে উম্মাতের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, আলেম, মুফাসিসর দের কে খুষ্টান বলার মতো সাহস করেছেন। এত বড় দৃষ্টতা দেখানো পরেও তিনি হক্কানী পীর। অন্ধ অনুশরন করতে তাদের দলিল লাগে না। কারন তাদের কাছে মুরব্বিরা হরো মিয়ারে হক।

দুই-------। না হয় তিনি বইটি পড়েছেন এবং যেসব ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে মাওলানা মওদূদী রেওয়াত গ্রহণ করেছেন তাদের কেও তিনি ইসলামের দুষমন,সাহাবাদের সমালোচক বলে মনে করে থাকেন বিধায় তাদের কেও খৃষ্টানদের এজেন্ট হিসেবে ঘোষনা দেওয়ার সাহস করেছেন। এ জাতিয় দৃষ্টতা কেবল মাত্র কোন আহাম্মকের পক্ষেই দেখানো সম্ভব। সামান্য ইলম রাখা ব্যক্তিও উম্মাতের এই সকল হক্কানী মুজতাহিদ দের কে খৃষ্টানদের এজেন্ট ভাবার মতো দুঃসাহস দেখাবে না।

প্রশ্ন হলো এই দুইটির মধ্যে তিনি কোন অপরাধটি করেছেন ? এর উত্তর খোজার ভার পীর সাহেরব মুরিদ ও সচেতন পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।

প্রশ্ন হচ্ছে, একমাত্র মওদূদী কি এই সমস্ত বুজুর্গদের থেকে রেওয়াত নিয়েছেন, আর কেউ কি এই সকল ইতিহাস আগে পরে নিজেদের কিতাবে উল্লেখ্য করেন নি ? অবশ্যই না, গোটা পৃথিবীর সকল আলেমরা যে সকল ইতিহাসের কিতাব লিখেছেন তার সেগুলোর উৎসও এরাই। এই একই ব্যক্তিদের কিতাব থেকে রেওয়াত নিয়েছেন দেওবন্দ সহ গোটা পাক ভারতের বহু বুজুর্গ তথা আকাবাররা। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, তাদের প্রত্যেকে একই রেওয়াত উদ্ধৃত করে সাহাবাদের দোষ ত্রুটি জনসমক্ষে হাজির করে ইসলাম ধ্বংসে খৃষ্টানদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন। নইলে একই কর্মের জন্য দুইজন দুই রকম ফতোয়ার স্বিকার কেন হবেন। একই অপরাধ করার পরে মওদূদী সাহাবাবিদ্ধেষী, আর অন্যরা হক্কানী। এ কেমন ইনসাফ বলতে পারেন ?

তিনি ও তার মরহুম পিতা আরেকটি অদ্ভুদ যুক্তি দাড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, পিতা যদি উলুঙ্গ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, পুত্রের কাজ হলো ঢেকে দেওয়া। ধরে নিলাম সাহাবারা ভুল করেছেন ( এটা বলে তিনি নাউজুবিল্লাহ পড়েছেন, তার মানে তিনি মনে করেন সাহাবারা কোন ভুল করতে পারেন না। এই যদি হয় তার আকীদা তাহলে তো বলে দেওয়া জরুরী যে, এমন আকীদা যিনি লালন করেন তিনি শিরক করেন। কারন নির্ভুল থাকা একমাত্র আল্লাহ পাকের সিফাত। এই গুন অন্য মানুষকে দেওয়া না জায়েজ হারাম), ভূল যদি করেই থাকেন তাহলে মওদূদী কোন নিয়তে লোকজনের সামনে সেগুলো উপস্থাপন করলো। এতে বুঝা যায় ইয়াহুদী, নাসারা আর খৃষ্টানদের এজেন্ট হয়ে সাহাবাদের কে বিতর্কিত করার মাধ্যমে কোরআন কে বিতর্কিত করে ইসলাম কে ধ্বংস করে দেওয়া তার উদ্ধেশ্য ছিলো।

আমি এই বয়ান শুনার সময় কেবল হেসেছি আর চিন্তা করেছি যে, আল্লাহ পাক মানুষকে আবাল বানান, কিন্তু এতটা আবাল কেন বানান। আমার মতো সাধারন লোকেরাও আলেম নামের এই সকল মানুষগুলো দেখলে করুনা করতে ইচ্চে করে। সাহাবাদের মধ্যকার বিরোধপুর্ন ঘটনা পজ্ঞি কেবল মাত্র মওদূদীই প্রথম বর্ননা করে লোজনের সামনে এনেছেন এরুপ মুর্খতা সূলভ বয়ান যে করে তার যে ইসলামের ইতিহাসের বিষয়ে নুন্যতম কোন ধারনা নেই এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। সাথে সাথে এও পরিস্কার হয়ে যায় যে, কেবল মাত্র পিতার মাদ্রাসা থাকার কারনেই তিনি মুফতি উপাধী পেয়েছেন নতুবা নামের আগে মাওলানা শব্দটি যোগ করার যোগ্যতাও পেতেন না। অথচ তিনিই আবার আমীরুল মুজাহিদিন। ইসলামের বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখা যে কোন আলেমের জন্য জরুরী কেননা এই বিষয়ের ওপর অনেক আকীদা নির্ভর করে এবং মুফতিদের কেও ইতিহাসের প্রামান্য ঘটনাবলী থেকে উদ্দৃতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করতে হয়। অথচ বেচারা হক্কানীর এই বিষয়ে নুন্যতম কোন ধারনা নেই।

কে কি বিষয়ে কিতাব লিখে সেটা তার অন্তরের বিষয়, এই বিষয়ে নিজের মনগড়া মন্তব্য করার মানে হলো কারো নিয়তের বিষয়ে জেনে নেওয়ার দাবি করা। এই গুন তো আল্লাহর পাকের জন্য খাস, কোন মানুষ এই দাবি করতে পারে না বা কার্যের মাধ্যমেও প্রকাশ করতে পারে না যে, অমুকে নিয়তের খবর তিনি জানেন। তাহলে পীরসাহেব ও তার মুরব্বিরা কি করে বুঝলেন যে, মওদূদীর ইতিহাসের কিতাব লেখার উদ্ধেশ্য হলো সাহাবায়ে কেরাম কে বিতর্কিত করা। অথচ এই সব ইতিহাস কোন গর্তে লুকানো ছিলো না যে, মওদূদী তা মাটি খুড়ে বের করে এনেছেন। এসব ইতিহাস হাজার বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ পাঠ করছেন, ইয়াহুদী আর খৃষ্টানরাও এসব ইতিহাস থেকে বিভিন্ন দলিল প্রদান করে নিজেদের মনের ঝাল মিটাচ্ছে। এই অবস্থায় ইতিহাস রচনার অভিযোগে কেবল মাত্র মওদূদী সাহাবা বিদ্ধেষী হয়ে যাওয়ার মারেফাত বুঝা খুবই কঠিন কাজ। মাওলানা জয়নুল আবেদীন দেওবন্দীরা (রহ) কি মওদূদীর পরে কিতাব লিখেছিলেন না আগে ? কোন টা জানতে চাই।

বিষয়: বিবিধ

২৩৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File