সুখের খোঁজ পেয়েছি আমি বস্তির ঐ ছেলের ঠোঁটের কোণের হাসিতে.......
লিখেছেন লিখেছেন পেন্সিল ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০১:২৯:০৫ রাত
সেদিন আমাদের ক্লাসে কনভারসেশন চলছিল ঈদ নিয়ে। ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- هل اشتريت ملابس جديده للعيد؟ (তুমি কি ঈদের জন্য নতুন কাপড় কিনেছ?) জবাবে বললাম- لا يا استاذة، ما اشتريت ملابس جديده للعيد. ( না ম্যাম, আমি ঈদের জন্য নতুন কাপড় কিনি নাই।) ম্যাম আমার পাশে বসা তাসমিয়াহকেও একই প্রশ্ন করলেন। ওর-ও আমার মত জবাব। ম্যাম খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন- لماذا؟... না কেনার কারণ হিসেবে ম্যাম হয়তো অন্যকিছু ভেবেছিলেন। আমি জবাবে বললাম- "يا استاذة، عيد يعني الفرح، عيد يعني سعيد. لذلك، وسرور هذا العيد أود أن أجده بطريقة مختلفة.." (ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। সেকারণে আমি এই ঈদের আনন্দ অন্যভাবে খুঁজে পেতে চাই।) ম্যাম বললেন, "এই বয়সেই তোমরা কিরকম কথা বলছো? এখন তো তোমরা জামা-কাপড় কিনবে, হাসবে-খেলবে.... সুন্দরভাবে ঈদ উৎযাপন করবে। আর তোমরা কিনা......"
..ম্যামকে বলেছি ঠিক কিন্তু কিভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে এই টেনশনে আর এগোতে পারছিলাম না। তাছাড়া আমি একা, যদি কিছু করতে চাই সেজন্য একটা সাপোর্টের দরকার হবে। কে দেবে? পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষাও দিচ্ছি। কিন্তু ঐ যে কিছু একটা করার বাসনা বারবার কড়া নাড়ছিল মনের দরজায়। তারপর শেষ পরীক্ষার দিন সবাইকে বললাম আমার ইচ্ছের কথা। "বন্ধুরা! আসছে ঈদে তো অনেকেই অনেক কিছু কিনেছ কিংবা কিনবে। আমি চাইছিলাম এবারের ঈদটা আমরা অন্যভাবে করি, যাতে আমাদের খুশির সাথে সাথে অন্য কেউ-ও খুশি হতে পারে। আমরা সবাই মিলে পথশিশুদের ঈদের জামা কিনে দিতে চাই। হয়তো এতে ওদের প্রয়োজন খুব একটা মিটবে না কিন্তু আমাদের কাজটা ছোট্ট পরিসরে শুরু করলে মন্দ কি? আগামীবার থেকে আরো বড় পরিসরে করবো। কাউকে জোর করছিনে, মন থেকে যে চাইবে শুধু তার দানকেই আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।" ভেবেছিলাম সাড়া পাবো না। কারণ পরীক্ষা শেষ, ঈদ উপলক্ষ্যে সবাই বাড়ি যাবে। কার হাতে কত অর্থ আছে কে জানে! কিন্তু সেটা ছিল আমার ভুল ভাবনা। সবার আগে আমার বন্ধু তাসমিয়াহ-ই এগিয়ে আসলো। তারপর একে একে আরো অনেকে। আমি অবাক হলাম, প্রথম দিনেই ৫০০ টাকা!! নাহ! বুঝলাম সবার ইচ্ছে-ই আমার ইচ্ছের মত। এরপর আরো অনেকেই এগিয়ে আসলো। সুমাইয়া, বিলকিস, নাসরিন, মাওয়া, তাসমিয়াহ্, পুষ্প আপি, তাশরিফা আপি, খুকি, নারগিস আপি, মুর্শিদা, আয়িশাহ্।
দিন-ক্ষণ ঠিক করে একদিন বের হলাম আমরা চারজন। আমি, তাসমিয়াহ, মাওয়া, মুর্শিদা। সেদিন ছিল প্রখর রোদ। মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা, তার উপর রোজা। তবুও আমাদের ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে এই আনন্দে ওসব কিছুই আমাদের দমন করতে পারলো না। অনেকগুলো জামা কেনা হলো। জামা কেনার সময় খানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হয়েছিল। দোকানদার জানতে চাইলো, 'কার বাচ্চা?' তাসমিয়াহ্ আর আমি মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম। কি বলবো তাই ভাবছিলাম। হঠাৎ তাসমিয়াহ্ বলে উঠলো- 'আমাদের বাচ্চা! দুই-আড়াই আর পাঁচ-ছ' বছরের বাচ্চার জামা দেখান।' আমি সত্যিই অবাক হলাম ওর কথায়। মেয়ে বলে কি এসব?!! পরে ভাবলাম আসলেই তো তাই, এই সব অসহায় পথশিশুরা তো আমাদেরই বাচ্চা। ওরা এই সমাজের, এই দেশের, এই মাটির সন্তান। ওদের আমরা অবহেলা করি কি করে! আমরা এই দেশের নাগরিক হয়ে যদি নাগরিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারি তবে ওরা দোষ করলো কোথায়? আর আল্লাহর নির্দেশ আমি অমান্য-ই বা করি কি করে? যখন আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন- "আত্নীয়-স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দিন এবং মিসকীন ও মুসাফিরদেরও। এটা তাদের জন্যে উত্তম, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। তারাই সফলকাম। (Ar-Room: 38)"
এবার বাচ্চাদের খুঁজে বের করে দেয়ার পালা। আমাদের দেশ এখনো কোনকিছুতে খুব বেশি উন্নত করেনি কিংবা গরীব মানুষের অভাবও খুব একটা হয়নি এখনো। তাই ওদের খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না।
দেখলাম আমাদের অদূরে একটা ছোট ছেলে উদোম শরীরে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়াচ্ছে। কাছে ডাকলাম- "এই পিচ্চি, একটু এদিকে এসো তো" আসলো, দিলাম আর চলে গেল। (veni vidi vici --julius caesar) হিহিহিহি..... ছেলেটা ওর নামটা জানতে চাওয়ারও সুযোগ দিল না। যখন দেখলো শপিং ব্যাগে নতুন জামা, ব্যাগটা নিয়ে সেকি দৌঁড় ছেলের। এভাবে কারও নামই জানা হলো না।
এভাবে এক এক করে সবাইকে দিলাম। আপনি হয়তো ভাবছেন এ আর এমন কি! কত লোকই তো এমন করছে। কত সাহায্য করছে। কিন্তু আপনি জানেন ওরা যখন জামাগুলো হাতে পেয়েছিল তখন ওদের হাসিমাখা মুখটা কত সুন্দর দেখাচ্ছিল? নাকের কাছে শুকিয়ে থাকা শ্লেষ্মা, ময়লা ছেঁড়া হাফ প্যান্ট কিংবা ওদের উদোম শরীর ঐ সুন্দর হাসিটাকে কোনভাবেই ম্লান করতে পারেনি। আপনি কি বলতে পারবেন এই শিশগুলো সদ্য ফোটা পুষ্পের চেয়ে কম সুন্দর-নিষ্পাপ?
ফিরতি পথে আরো দুজনকে দিলাম। তখন হাতে আরো তিনটে জামা। দেখলাম একটা বৃদ্ধা মহিলা পাতা কুড়োচ্ছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, আপনার নাতি-নাতনি আছে? জবাবে মাথা নাড়ালো আর ইশারায় জানাল কথা বলার শক্তি তার নেই। ছেলে না মেয়ে? ইশারায় বলল, মেয়ে। আমি মেয়ের জামাটা দিয়ে আবার বাড়ির পথ ধরলাম।
পথের বাঁকে গিয়ে পিছে ফিরে দেখলাম সেই বোবা মহিলা তার পান খেয়ে কালো হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসছে। এই হাসি হয়তো আপনার কাছে কিছুই না। কিন্তু এই হাসিতে লেগেছিল কিছু পাওয়ার সুখ আর আমিও কিছু পাওয়ার সুখ খুঁজে পেয়েছিলাম। কারণ এই গরীব মানুষগুলো আপনাকে কখনো কৃত্রিম হাসি উপহার দেবে না। কারণ সে কৃত্রিম হাসি হাসতে জানে না। সে আপনাকে তখনই অকৃত্রিম হাসি উপহার দেবে যখন সে প্রকুতপক্ষে খুশি হয়, সুখ পায়। আমিও আমার হৃদে সেই সুখ অনুভব করছিলাম কারণ ওদের সুখি করাই ছিল আমার একান্ত ইচ্ছা। এভাবে বিক্ষিপ্ত সুখ বিলিয়ে ঘরে ফিরলাম। "যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন। (Al-Baqara: 271)"
আমার পরিবার এইসব কাজে কখনোই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি বরং উৎসাহ দিয়েছে। শুধু পরিবার না আমি এমনসব মানুষের কাছ থেকে উৎসাহ, প্রেরণা খুঁজে পাই যাঁরা হয়তো জানেনই না তাঁদের কাজগুলো কারো প্রেরণার উৎস হতে পারে। এই ব্লগেও আছেন অনেকে। যেমন, রেহনুমা আন্টি, ফাতিমা মারিয়াম আপি, সাদিয়া মুকিম আপি, শুকনো পাতা আপুনি, বইয়ের পাতায় রোদের আলো আপুনি, জোছনার আলো, আফরোজা আপি, ডাক্তার (ভিশু) ভাইয়া, ইক্লিপ্স আপি, আবদুল্লাহ্ মাহমুদ নজীব ভাইয়া, সিটিজি৪বিডি ভাইয়া, নীল ভাইয়া, হাসান ভাইয়া, মুহতারাম প্রবাসী মজুমদার, আবু জারীর ভাইয়া, বাকপ্রবাস ভাইয়া, মহতারামা নূরে আয়েশা সিদ্দিকা, নোমান সাইফুল্লাহ্ ভাইয়া, জনাব মাই নেম ইজ খান......... এরকম আরো অনেকে আছে। যাদের নাম হয়তো আমি এখানে উল্লেখ করতে পারিনি। আর আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে DECLAN GALBRAITH এর গাওয়া TELL ME WHY এর এই দুটি লাইন- "When Somebody Needs Somebody, We Don't Give A Helping Hand...Tell Me Why"
ক'দিন আগে দেখলাম আমার ছোট আপি তাসনীমও এই কাজে খুব উৎসাহ দেখাচ্ছে। ও ওর বন্ধুদের জানালো। ওর বন্ধু রিহা, খাদিজা, সায়মা....মা শা আল্লাহ্ পিচ্চি মেয়েগুলোও এগিয়ে এসেছে। আজ আবারো বিক্ষিপ্ত সুখ বিলাতে গিয়েছিলাম। বাইরে খুব বৃষ্টি ছিল। কিন্তু আমাদের বাঁধা দেয় কে! আমরা যদি একটা সাহায্যের হাত, একটা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েই না দিলাম তবে মুখে বড় বড় কথা বলে কি লাভ?
আমি জানি আমার রব আমাকে উত্তম জাযাহ দেবেন। কারণ তিনি ঘোষণা করেছেন- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ.
যখন ওরা একটু সহানুভূতি, একটু সাহায্য, একমুঠো ভালবাসার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তখন আমরা কি করে অস্বীকার করবো কুরআনের বাণী-" আত্নীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। (Al-Israa: 26)"
মহান মা'বুদ আরো বলেছেন- "সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।
(সুরা-বাকারাহ, আয়াত-১৭৭)"
এটা ছিল আমাদের বিক্ষিপ্ত সুখ বিতরন। এতে হয়তো ওদের খুব একটা উপকার হবে না। কিন্তু ক্ষণিকের সুখ তো পাবে। আসলে মানুষকে দান করলে অনুগ্রহ করলে এমন ভাবে করা উচিৎ যেন পরবর্তীতে ঐ লোক আর মানুষের কাছে হাত না পাতে। আমাদের সম্পদ সমস্তটাই ব্যয় করা উচিৎ আল্লাহর নির্দেশিত পথে। তবে কুরআন আমাদের বলছে- "আর ব্যয় কর আল্লাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন। (Al-Baqara: 195)"
আমাদের একটু ভালবাসা, আমাদের একটু সহানুভূতি ওদের অনেক বড় করে তুলতে পারে।
...আর আমি আমার বন্ধুদের নিকট সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ। কারণ ওরা আমার পাশে না থাকলে আমি একা কখনোই এতদূর এগোতে পারতাম না। বন্ধু তোদের ধন্যবাদ।
এটা ছিল ছোট্ট একটা কাজ। কিন্তু আমি জানি এটা আমাদের কাছে কত বড়। একজন মা তার সদ্য প্রসূত সন্তানকে দেখে যেমন সকল ব্যথা ভুলে যান (আমি জানি না মায়ের অনুভূতিটা কেমন), তেমনি আমরা ভুলে গিযেছিলাম রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ওদের খুঁজে বেড়ানোর কষ্ট।
আমাদের সেই সুখানুভূতির সংজ্ঞা কি, এর ব্যাখ্যা কি আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি এসবই ছিল আমাদের রবের প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর আমরা আমাদের সমস্ত খারাপ কৃতকর্মের জন্য ছিলাম অনুতপ্ত, ছিলাম ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- " বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। (Aali Imraan: 31"
(স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়ার জন্য অনেকেই হয়তো ছবি তুলে রাখতেন, কিন্তু আপনি কি বলতে পারবেন ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ওদের অকৃত্রিম হাস্যজ্জল মুখ বাস্তব হাসির মত কতখানি প্রকাশ পেতো? ওদের নাম হয়তো জানা হয়নি, কিন্তু এই নাম না-জানা পথশিশুদের হৃদয়ে গেঁথে রাখার জন্য নাম জানা খুব বেশি জরুরী না)
(ছবি: প্রতিকী)
বিষয়: বিবিধ
৩৬৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন