বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি’র বর্তমান নেতৃত্ত্ব-কাঠামো এবং শেক্সপিয়ারের একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য- একটি আপেক্ষিক পর্যালোচনা
লিখেছেন লিখেছেন আবুলকালাম ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:২৪:১৬ বিকাল
১.১ ভুমিকা:
বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামি ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ ইসলামি আন্দোলন, ইসলামি রাজনীতি, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বলতে জামায়াত-শিবিরকেই বুঝে। জামায়াত- শিবিরের সাবেক বা বর্তমান কর্মী, সমর্থক বা সাথীদের নিকট এদেশে ইসলামি বিপ্লব শব্দটি উচ্চারিত হলেই, অনেকটা আবশ্যকীয়ভাবে, তাদের সামনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি’র (জামায়াত’র) নাম চলে আসে। ইসলামি বিপ্লব বা ইসলামি-ফেইথ-বেজড সোসাইটি বা রাষ্ট্র গঠন বা নির্মানের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভুমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এদেশে জামায়াত ও ইসলামি বিপ্লব বা ইসলামি রাষ্ট্র প্রত্যয়গুলো যেহেতু অনেকটা সিনোনিমাস, আমরা তাই ইসলামি বিপ্লব সংঘটনের ক্ষেত্রে মূল অংশীদারিত্বের স্বীকৃত দাবিদার দল জামায়াতের নেতৃত্বের গঠন-কাঠামো এবং ইসলামি বিপ্লব বা ইসলামি-ফেইথ-বেজড রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তার অতীত ও বর্তমানের ভুমিকা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
১.২ বিপ্লব: সমাজ পরিবর্তনের হতিয়ার:
বিপ্লব। পরিবর্তন। শব্দদ্বয় আপাতভাবে সিনোনিমাস। নির্দিষ্ট আঙ্গিকে ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষন না করলে সাধারনত শব্দ দুইটির মাঝে তেমন পার্থক্য দৃশ্যমান নয়। আমরা সিনোনিমাস হিসাবেই এখানে শব্দ দুইটিকে ব্যবহার করব। বিপ্লব শব্দটি বহুমাত্রিক ও দ্ব্যার্থক। বহুমাত্রিকতার এবং দ্ব্যার্থকতার সুবাদে এর ক্লাসিফিকেশনও অনেক। বিপ্লব শব্দটি কখনো সাম্প্রদায়িক কখনো অসাম্প্রদায়িক, কখনো ধার্মিক কখনো বকধার্মিক, কখনো আস্তিক কখনো নাস্তিক, কখনো লিবারেল কখনো কনজারভেটিভ। কখনো ধর্মাশ্রয়ী কখনো বা ধর্মনিরপেক্ষ। নানামাত্রিকতার মাঝে আমরা কেবল এর ইসলামি আদর্শাশ্রয়ী অর্থটিই গ্রহন করব। আমরা এখানে বিপ্লব বলতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের স্ট্রাকচারাল কাঠামো এ্যাস্পেক্ট্-এ ইসলাম-ভিত্তিক সমাজ-বিনির্মানকেই বুঝাব। মুসলিম কালচার, পাশ্চাত্য কালচার, ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক ভাবাদর্শ সংমিশ্রিত এক (অনেকটা) অধরা, অজানা, অনির্ণেয়, অনুক্ত, অসংঙ্গায়িত আদর্শকে ধারন করে বর্তমান বাংলাদেশে পরিচালিত সমাজ-ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ইসলামি-ফেইথ-বেজড সোসাইটি নির্মাণকেই আমরা বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তন হিসাবে ডিফাইন্ড্ করব।
১.৩ ডিসক্লেইমার :
প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের পেছনে কার্যকারণ আবশ্যক। আর এ কার্যকারন অবশ্যই ব্যক্তি, গ্রুপ বা দল নির্ভর। বাংলাদেশে ইসলামি-ফেইথ-বেজড সোসাইটি নির্মানের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান প্রধানত যে শক্তিগুলো কাজ করছে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতই তাদের মধ্যে প্রধান এবং অন্যতম। ইসলামপন্থী আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও দলটি বর্তমানে, কার্যত, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে/ দলে পরিণত হয়েছে (কমপক্ষে সাংবিধানিক ও অনুসৃত কার্যপ্রণালী অনুসারে)।
এদেশে যারা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় ইসলামি-ফেইথ-বেজড গুনাবলীর প্রকাশ দেখতে চায়- তাদের একটা বড় অংশই মূলত জামায়াত কিংবা জামায়াতের (কার্যত) স্টুডেন্ট উইং শিবির ও ছাত্রীসংস্থার অথবা পাকিস্থান পিরিয়ডের ছাত্রসংঘের সাবেক সমর্থক কিংবা কর্মী। ইসলামি-ফেইথ-বেজড সোসাইটি বিনির্মানের কোন কথা উঠলেই তাই প্রাসঙ্গিকভাবে জামায়াতের নামটি অনেকটা অপরিহার্যভাবেই চলে আসে।)) ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনার কথা উঠলেই অতীত কিংবা বর্তমানের পর্যালোচনা অনেকটা আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই পর্যালোচনায় অন্যান্য অনেক পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ বিষয়ের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অনুপেক্ষনীয়ভাবে পর্বতসদৃশ দৃষ্টিগোচরীভুত হয় তা হচ্ছে সমাজ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জামায়াতের শম্বুক গতি। সঙ্গত কারনেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনভাবেই এটিকে আমরা উটপাখির মত ওভারলুক করতে পারিনা, যদি আগামি দিনে অমানিশার অন্ধকার দূরীভুত করে পূর্ণিমার আলোয় উদ্ভাসিত একটি সমাজ গড়তে চাই। আর তাই অনেকটা কম্পেল্ড্ হয়েই এ বিষয়ে আমাদের মুক্ত আলোচনা ও মতামত প্রকাশ। দল হিসেবে জামায়াত কিংবা জামায়াতের কোন নেতা-কর্মীকে হেয়-প্রতিপন্ন করা নয় বরং সকল বন্ধুরতার বাধা ডিঙ্গিয়ে আমরা যারা ভবিষ্যতের পথ নির্মান করতে চাই তাদের পথনির্দেশিকা লাভের এটি একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
চিত্র-১: কচ্ছপের গতি
১.৪ কনসেপ্ট ক্লারিফিকেইশন:
যিনি কোন বিষয়ে থিওরি, তত্ত্ব বা মূলনীতি দেন, জেনারেলী, তিনিই থিওরিষ্ট। ইসলামি-ফেইথ-বেজড আন্দোলনের ক্ষেত্রে মূল সোর্স অফ ল’ হচ্ছে আল-কুরআন ও সুন্নাহ। আল কুরআন যেহেতু রিভিল্ড্-কিতাব, তাই আমরা বলতে পারি, মহান আল্লাহই হচ্ছেন এই আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান (ফার্স্ট-স্টেপের) থিওরীদাতা বা মূলনীতি-প্রণেতা। সর্বশেষ রাসূল সা. হলেন আল্লাহর তত্ত্বাবধানে এই আল কুরআনের বাস্তবায়নকারি- কাজেই তিনি হচ্ছেন ব্যক্তি হিসাবে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ (সেকেন্ড স্টেপের) মূলনীতি প্রণয়নকারি, থিওরাইজার বা থিওরিস্ট। আল-কুরআনের বর্ণনামতে ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধানের থিওরাইজেশনের কাজ মূলত এখানেই শেষ। পরবর্তীতে, কুরআন ও সুন্নাহর বিধিবিধানকে মানবসমাজের উপযোগী ও বোধগম্য করে উপস্থাপনের জন্য যে সকল ঋষী-মনীষি ও আলেমসম্প্রদায় কাজ করেন তারা সবাই হলেন, এ ক্ষেত্রে, তৃতীয় স্টেপের মূলনীতিপ্রণেতা বা থিওরাইজার বা থিওরিস্ট। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যারা ইসলামি জ্ঞানের চর্চায় ও থিওরাইজেশনে নিয়োজিত তারা সবাই হলেন এই থার্ড স্টেপের। এ সকল জ্ঞান-গবেষক ব্যক্তিবর্গকে বুঝাতেই আমরা মূলত থিওরাইজার, থিওরিস্ট বা ইন্টেলেকচুয়াল (বুদ্ধিজীবি) শব্দটি ব্যবহার করব।
১.৫ ইন্টেলেকচুয়াল: কর্ম ও পরিধি:
আমাদের বর্তমান সমাজে যারা উচ্চতর ডিগি অর্জন করার পর শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত তাদেরকে আমরা প্রফেসর, টিচার বা শিক্ষক অভিধায় অভিহিত করে থাকি। এরাই হচ্ছেন জাতির কান্ডারি। আলোর মশালচি। সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালনায় রয়েছে এদের চরম ও পরম ভুমিকা। অতীত ইতিহাস, ভবিষ্যতের ঘটনাপঞ্জি কিংবা বর্তমানের চলমান ধারা সবকিছুর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষনই এদের চিন্তা-রাজ্যের পরিসীমার অন্তরীন। ফিজিওলজি থেকে সোশিওলোজি, সাইকোলজি থেকে কজমোলজি, ইকোনোমিক্স থেকে পলিটিক্স, স্টাটিস্টিক্স থেকে রেবোটিক্স; সবই এদের হাতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রুপ পরিগ্রহ করছে। মানুষ প্রতিমুহুর্তের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যে অনাগত ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন দেখে, তা বাস্তবায়নের ফর্মূলা ও কলাকৌশল এসব শিক্ষক বা গবেষকের হাতেই তৈরী। এরা সবসময় জ্ঞান-গবেষনায় অন্যদের চেয়ে অগ্রগামি। ম্যাস পিপল যখন চলমান ধারার সবকিছু উপভোগে ব্যস্ত-তখন এসব শিক্ষকেরা রিসার্চ-ল্যাবের কোন এক প্রান্তসীমায় বসে আগামীর সমস্যা সমাধানের সমীকরন মিলাতে গলদঘর্ম। রাষ্ট্রনায়ক বা সমাজ-পরিচালকেরা যখন জনগনের জীবন-ঘনিষ্ঠ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, ক্রমাগত উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত তখন এসব বুদ্ধিজীবি, গবেষক ও শিক্ষকেরাই ছুটে আসেন সমাধানের আলোকবাতি হাতে। বর্তমান হাইটেক জেনারেশনের তরুন-তরুনিরা যখন এনজিএন প্রযুক্তির থ্রি-জি , ফোর-জি কিংকা মাইক্রোসফট ২০০৮ বা ২০০৯ এর হাইটেক পারফমেন্সে আত্মমগ্ন, তখন তাদেরই তুল্য একদল গবেষক, সাধক ভবিষ্যতের কোন এক উচ্চতর টেকনোলজির উন্নয়নে বা কোন সমস্যার সুন্দরতম সমাধান আবিস্কারের নেশায় আত্মনিবিষ্ট। এসব শিক্ষক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবিরা তাই যুগে-যুগে, কালে-কালে পূজনীয়, বরনীয়। শুধু কি ভৌত বিজ্ঞান বা চিকিৎসা বিজ্ঞান; সমাজবিজ্ঞান কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান সাধনাতেও এসব জ্ঞান-সাধকরা অপ্রতিদ্বন্দী, অদ্বিতীয়। অমর, অক্ষয়। কাল পরিক্রমায় সাধারন মানুষ যখন স্বৈরাচারি শাসকের কালা-কানুনের নিগড়ে বন্দী, অত্যাচারিত, অসহায়, দিশেহারা; তখন এসব জ্ঞান-সাধকরা মুক্তির বাণী, মুক্তির পথ-নির্দেশিকা নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হন । এসব মুক্তির পথ কখনো শান্তিকামি কখনো বা তা বিপ্লবী অথবা প্রতিবিপ্লবী। শান্তিকামি কিংবা বিপ্লবী / প্রতিবিপ্লবী এই মুক্তির আন্দোলনকে তারা পথ-নির্দেশনা দিয়ে অত্যাচারিত, অধিকার বঞ্চিত, নীপিড়িত সাধারন জনগনের নিকট গ্রহনযোগ্য করার মাধ্যমে সফল করে তোলেন । কখনো যুক্ত থেকে নেতৃত্ব দেন স্বশরীরে, কখনো বা নির্দেশনা প্রদান করেন ঘটনার অন্তরালে থেকে।
১.৬ সমাজ বিপ্লব ও ইন্টেলেকচুয়াল (বুদ্ধিজীবি):
সমাজ-বিপ্লবের মূল কথা হলো প্রচলিত কোন নিয়ম-নীতিমালার চেয়ে (সাধারনত বেটার) অন্য কোন অল্টারনেটিভ পূর্বের স্থলে প্রতিস্থাপিত করা। আর এই জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বেটার ফরমূলা, তত্ত্ব বা নিয়ম-নীতিমালার থিওরাইজেশন এবং ফরমুলেইশন, তত্ত্ব বা থিওরির ব্যাপক প্রচার-প্রসার, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সকলের নিকট একে গ্রহনযোগ্যকরন এবং তার বাস্তবায়নের জন্য প্রচলিত ও প্রবর্তিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে উত্থিত আন্দোলনে জনগনকে সম্পৃক্তকরন। ফরমুলেইশন এবং বাস্তবায়ন , উভয়ই প্রক্রিয়াই এই বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় জড়িত। তারা শুধু কোন তত্ত্ব বা থিওরির থিওরাইজেশনই করেননা; বরং সেই আদর্শ প্রচার- প্রসারের নব-নব পদ্ধতি আবিস্কারও করেন। তাছাড়া পূর্বের কিংবা বর্তমানে গৃহীত পথ ও পদ্ধতির কোন মৌলিক সমস্যা আছে কিনা সেই বিষয়টিও তারা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন। তাছাড়া পূর্বের গৃহীত কোন পথ ও পদ্ধতির কাংঙ্খিত ফলাফল আসছে কিনা, দলীয় কর্মী-সমর্থক-নেতা কিংবা সংশ্লিষ্ট সমাজের উপর তার কাংঙ্খিত ভুমিকা রাখতে পারছে কিনা কিংবা প্রত্যাশিত ফলাফলের বিপরীত হচ্ছে কিনা সেটিরও লক্ষ্য রাখেন। ফলে প্রতিনিয়ত তাঁকে যেমন ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হয়, অতীতের গৃহীত পথ-পদ্ধতি ও তার প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষন করতে হয়, তেমনি বর্তমানের গৃহিত সকল কলা-কৌশল, তার ইপ্সিত ফলাফলও তার আয়ত্বসীমার মধ্যে রাখা চাই। আর এভাবেই একজন শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবি নিজেকে সমাজ-বিপ্লব বা সমাজ-কাঠামো পরিবর্তনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করেন। তাই সমাজ-বিপ্লব এবং তাত্ত্বিক, শিক্ষক, গবেষক, ইন্টেলেকচুয়াল ইত্যাদি শব্দ ও প্রত্যয়গুলো একই-ধারায়, একই-মাত্রায় এবং একই-সঙ্গে আলোচিত হয়।
সমাজ-বিপ্লবের ডায়াগ্রামাটিক চিত্র এবং এ্যাক্টিভিস্ট ও থিওরিস্ট এর তুলনামূলক ভুমিকা:
০১ বিপ্লবের বাণী প্রণয়ন বা কনসেপচুয়ালাইজেশন = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এর কাজ
০২ সংশ্লিষ্ট সমাজের গঠন- কাঠামো বিশ্লেষণ = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এর কাজ
০৩ সমাজ বিপ্লবের রুপরেখা তৈরী = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এর কাজ
০৪ সাবডিভিশন অনুযায়ী বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এর কাজ
০৫ বিপ্লবের বাণীকে সহজবোধ্য করে জনগনের উপযোগী করন = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এবং এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ
০৬ জনমত তৈরী ও জনমত গঠন ও যোগ্যতাসম্পন্ন ম্যান পাওয়ার তৈরী = (প্রধানত) থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এবং (আংশিক) এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ
০৭ জনমতকে একত্রীকরন/ সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালকদের দাওয়াত প্রদান = (প্রধানত) থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এবং (আংশিক) এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ
০৮ ফিজিক্যাল আন্দোলনের প্রস্তুতিগ্রহন/ সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালকদের বাধা, দমন- নির্যাতন = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এবং এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ
০৯. লড়াই, সংগ্রাম অথবা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবসাধন = থিওরিস্ট বা পলিসি মেকার এবং এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ
১.৭ নেতৃত্ব: ইন্টেলেকচুয়াল (থিওরিস্ট) বনাম এ্যাক্টিভিস্ট:
যিনি থিওরাইজেশনের কাজ করেন, মূলত তিনিই থিওরিষ্ট অর্থাৎ ইন্টেলেকচুয়াল এবং গৃহিত থিওরীর আলোকে যারা কাজ করেন তিনি বা তারা এ্যাক্টিভিস্ট। ভিন্ন ভিন্ন শব্দ। ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। কাজও ভিন্ন ভিন্ন। আন্দোলন বা সমাজ-বিপ্লবের জন্য উভয়ের প্রয়োজন হলেও উভয়ের মাঝে রয়েছে একটি মৌলিক পার্থক্য; আর সেটি হলো: একজন ইন্টেলেকচুয়াল থিওরাইজেশন ও ইমপ্লিমেন্টেশন (এ্যাক্টিভিস্ট এর কাজ) উভয়ই কাজ একইসাথে করতে পারেন, কিন্তু একজন এ্যাক্টিভিস্ট শুধুমাত্র ইমপ্লিমেন্টেশন এর কাজ করতে পারেন। থিওরাইজেশনের প্লান আউট তার দ্বারা অসম্ভব। তাই যার যে বিষয়ে ও যতটুকু দক্ষতা তাকে সে বিষয়েই এবং ততটুকুই কাজ করতে হবে। তবে উভয়ের মধ্যে একটি সুসামঞ্জস্যতা থাকতে হবে; নতুবা কাজ অসম্ভব। তাই বলা যায়, এ থিওরিস্ট মে বি এ্যান এ্যাক্টিভিস্ট বাট এ্যান এ্যাক্টিভিস্ট নেভার মে বি এ্যা থিওরিস্ট। যে কোন সমাজ-বিপ্লব বা সমাজ-কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের বিষয়টি সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ন এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যিনি যত বেশি দক্ষ তিনি তত বেশি যোগ্য। সমাজ-বিপ্লব বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেহেতু থিওরাইজেশন ও ইমপ্লিমেন্টেশন- উভয়ই কাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই নিংসন্দেহে থিওরিস্ট কাম এ্যাক্টিভিস্ট-ই এই বিপ্লবের কাজে সবচেয়ে দক্ষ, যোগ্য এবং ফলত কাংঙ্খিতও বটে।
১.৮ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি (বাজাই): প্রেক্ষিত সমাজ বিপ্লব:
বাজাই বাংলাদেশের ইসলামি আদর্শ-ভিত্তিক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। সাম্রাজ্যবাদি, পুজিঁবাদি, ভোগবাদি চিন্তাধারাপুষ্ট বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামি মূলনীতি ও মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মত জটিল ও কঠিন কাজ বাস্তবায়নই এর লক্ষ্য। এই জন্য আবশ্যক এক পরিপক্ক ও পরিপূর্ণ সমাজ-বিপ্লব। আর তাই সাম্রাজ্যবাদি-পাশ্চাত্য সভ্যতার অত্যাধুনিক কলাকৌশল ও হাতিয়ারের বিপরীতে ইসলামি আদর্শ প্রচারের কাজটি চরম প্রতিযোগীতা ও প্রতিদ্বন্দীতার সম্মুখীন। বিশ্বায়নের এই সকল হামলা মোকাবিলা করে সমাজ-কাঠামো পরিবর্তনে তাই দরকার ইসলামি আদর্শ প্রচারের অত্যাধুনিক কলাকৌশল, হাতিয়ার ও উপস্থাপনা।
আর এই জন্য প্রয়োজন জ্ঞানের রাজ্যে এক বলিষ্ঠ পদচারনা। বর্তমান বিশ্ব-কাঠামোর গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবহতি। প্রয়োজন মুসলিম ইতিহাসের সঠিক,গভীর ও বিশ্লেষনধর্মী অধ্যায়ন। কুরআন, হাদিস ও ফিকহের রাজ্যে গভীর ব্যুৎপত্তি। প্রয়োজন মানব জীবন ও মানব-বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সামগ্রিক উপলব্ধি যাতে কুরআন ও সুন্নাহর বিধিমালাকে আত্মস্থ করে স্থান-কালের প্রেক্ষিতে যুগোপযোগীভাবে প্রয়োগ করা যায়। আর এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হলে চাই একদল একনিবিষ্ট জ্ঞান-তাপস, জ্ঞান-সাধক এবং জীবন-জগতের চলমান ঘটনা প্রবাহের সাথে একনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একদল সমাজ-বিশ্লেষক, সমাজ-গবেষক ও সমাজ-বিজ্ঞানী (শুধুমাত্র সমাজ-বিজ্ঞানের অধ্যাপক বা শিক্ষক অর্থে নয়)।
শতভাগ শর্ত পূরন করতে না পারলেও মূলত এ কাজটি করে থাকেন (বাংলাদেশে) বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (জেনারেল, প্রকৌশল, মেডিক্যাল, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি), বিভিন্ন সমাজ গবেষক, অন্যান্য পেশার প্রফেশনালরা। যেহেতু বাজাই বাংলাদেশের সংবিধানের আওতাধীন হলেও বর্তমান সমাজের প্রচলিত আদর্শের কেন্দ্রীয় ধারা পরিবর্তন করে সেখানে ইসলামি-ফেইথ-বেজড সোসাইটি স্থাপন করতে চাই, তাই বাজাইকে সমাজ বিপ্লবের তত্বায়ক, ব্যবস্থাপক, সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত সকলের কর্মকান্ডকে এক কেন্দ্রবিন্দুতে সম্মিলন করতে হবে।
১.৯ জামায়াত বনাম অন্যান্য রাজনৈতিক দল:
বাংলাদেশের প্রচলিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জামায়াতের রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। সেটি হচ্ছে- জামায়াত হলো একটি ইসলামি আদর্শ-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল কিন্তু অন্য দলগুলো হলো পার্থিব দফা-রফা ও দাবি-দাওয়া ভিত্তিক দল (যাদের সাথে ইসলামি আদর্শের কোন সম্পর্ক নেই) ।
জামায়াত ইসলামি আদর্শকে ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অপরিহার্যভাবে অনুস্মরনীয় আদর্শ বলে মনে করে এবং তা সর্বস্তরে প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে, অন্যান্য দলগুলো সাম্রাজ্যবাদি, পুঁজিবাদি চিন্তাপুষ্ট কায়েমীস্বার্থবাদিদের দল। দলের বিজয়ের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে তাদের কোন দ্বিধা নেই। শঠতা, প্রতারনা, মিথ্যাচার তাদের নিকট কৌশল বলে গৃহীত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো, রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামিলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এসব দলগলো জামায়াতের বিরোধী হলেও মূলত আদর্শগতভাবে জামায়াতের মূল বিরোধী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদি-পুঁজিবাদি-ভোগবাদি আদর্শপুষ্ট বিশ্বব্যাপি যত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি আছে তারা। বিশ্বায়নের নামে এ সকল শক্তি যেহেতু মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে যেখানে দেশীয় কোন রাজনৈতিক দল -তা আওয়ামিলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা জামায়াত যেই হেকনা কেন- পৌঁছতে পারছেনা। এদের সকল কার্যক্রম ইসলামি আদর্শের বিপরীত হওয়ায় এরা ইসলামি ধ্যান-ধারনামুক্ত, আদর্শহীন ও ভোগবাদি মানসিকতাসম্পন্ন জেনারেশন তৈরী করছে। আর ইসলামি আদর্শচ্যুত এই ডিমোরালাইজড ও ডিজুস জেনারেশনের পুরো সুফল ভোগ করছে জামায়াত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তবে মূলত আওয়ামি লীগ। ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো নয় বরং পুজিবাঁদি ও পাশ্চাত্যপন্থী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সীমাহীন শক্তি ও আধুনিক কলাকৌশলসহ নিয়োজিত এ-সকল আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোই আজ জামায়াতের, কার্যত, অন্যতম প্রধান বিরোধী শক্তির ভুমিকা পালন করছে (বিস্তারিত- আমরা পূর্ণশক্তি দিয়ে লড়াই করছি বাট ভুল ভাবে ও ভুলপথে; We are struggling & jihading but in wrong way and wrong play-ground)। বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার নিয়ন্ত্রকরা যেহেতু আদর্শগতভাব জামায়াতের মূল শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই জামায়াতের কার্যক্রমের মাত্রা, পরিধি ও সীমা আজ দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও বহুগুনে বেড়ে গেছে। এ বিষয়টি আজ জামায়াত ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের ভালভাবে অনুধাবন করতে এবং তার মোকাবিলায় গৃহীত ডিপ্লোমেটিক পদক্ষেপের অনুসরন ডিপ্লোমেটিক ওয়েতে করতে হবে।
১.১০ পলিসি মেকিং বা থিওরাইজেশনে শিক্ষা ও জ্ঞানের স্টান্ডার্ড:
প্রেক্ষিত জাময়াত: জ্ঞান হলো চন্দ্র ও সূর্যের প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই সত্য ও সার্বজনীন। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পরেও এটাই সার্বজনীন যে, (মোরালিটিসহ) বর্তমান ধারার শিক্ষা পদ্ধতিতে জ্ঞানার্জনকারি ব্যক্তিরাই সমাজ, দল বা রাষ্ট্র পরিচালনায় তুলনামূলক বেশি দক্ষ ও যোগ্য। তাই এসব শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ দেশ ও জাতির সম্পদতুল্য। কার যোগ্যতা বেশি এবং কোথায় কোন যোগ্যতা কতটুকু কাজে লাগে সে বিষয়টি আপেক্ষিক। কাজের ভলিউম যত বেশি হবে, যত উঁচু মানের হবে, কাজের লক্ষ্য যত বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী হবে - সেই কাজের জন্য জ্ঞান বা যোগ্যতা তত বেশি মাত্রার প্রয়োজন হবে। প্রাইমারি বা হাইস্কুলের শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কলেজ ও ভার্সিটির শিক্ষকের, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অথের্, শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমন সমান নয়, তেমনি সমান নয় সাধারন পুলিশ সদস্য ও পুলিশ অফিসারের যোগ্যতা, সাধারন আরমী সদস্য ও আরমি অফিসারের শিক্ষা ও জ্ঞানের যোগ্যতা ও উচ্চতা। আবার ছোট্ট একটি গ্রামের গ্রাম-প্রধান কিংবা ইউনিয়ন প্রধানের জ্ঞান ও দক্ষতার যেমনি পার্থক্য থাকে, তেমনি পার্থক্য থাকে ইউনিয়ন প্রধানের ও এমপির জ্ঞান ও দক্ষতার। আর ঠিক তেমনি পার্থক্য থাকে কর্মী ও পলিসি মেকারদের কাংঙ্খিত জ্ঞান ও দক্ষতার মাত্রায় ও উচ্চতায়।
ইসলামপন্থী মুসলিম সংগঠন বা রাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি যেহেতু জাতীয়তাবাদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক, সকল সীমাবদ্ধতার গন্ডি পেরিয়ে সার্বজনীন এবং মুসলিম কমিউনিটির উর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবতাবাদ পর্যন্ত-তাই এখানে পলিসি মেকিং-এ প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের বিষয়-ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতার। আর এই জ্ঞান ও দক্ষতার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জ্ঞান-গবেষনা, বাস্তব কার্যক্রম পরিচালনা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আলোচনা-পর্যালোচনা ও পারস্পরিক ভিউ এক্সচেঞ্জ -এর । ইংরেজী ও আরবী ভাষার জ্ঞান, তাই, এই পর্যায়ের জন্য একটি প্রাথমিক উপাদান। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাধারার শুধুমাত্র মাস্টার্স, ফারেগ, ডাবল কামেল, এমবিবিএস, বা মাস্টার্সতুল্য প্রকৌশল-বিদ্যার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান তাই এখানে অপর্যাপ্ত নয়ই বরং বেমানানও বটে। কিন্তু আনফরচুনেটলি, এখনও জামায়াতের নেতৃত্বে জ্ঞান ও দক্ষতা রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর-উপযোগী ব্যক্তিদের হাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্মর্তব্য যে, তীক্ষè পর্যবেক্ষন ও সঠিক বিশ্লেষনে সক্ষম না হলে শুধুমাত্র চারপাশের আলামত ও নিদর্শন (জ্ঞান বিশ্লেষনের ক্ষমতাহীন অভিজ্ঞতার ঝুড়ি) দেখেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব নয়। পদ্ধতিগত নির্ভুলতা ছাড়া অভিজ্ঞতা সম্ভার মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত করেনা। আর তীক্ষè পর্যবেক্ষন, সঠিক বিশ্লেষন ও পদ্ধতিগত নির্ভুলতা অর্জন করতে চাই জ্ঞান রাজ্যের প্রাথমিক লেভেলের নয় বরং সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষার্থী হওয়া- কামিল, মাস্টার্স বা শুধুমাত্র ডাক্তারি ও প্রকৌশল বিদ্যার মাধ্যমে যা সম্ভব নয়।
১.১১ জামায়াত নেতৃত্বের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত: একটি বিশ্লেষন:
১৯৪১ সাল। ব্রিঠিশ আমল। শুরু হয় জামায়াতের পথচলা। ১৯৪১ সাল ও তৎপরবর্তীতে যারা জামায়াতে যোগদান করে, তারা ছিলো আরবী, উর্দূ ও ফারসী ভাষার দক্ষতাসহ তথাকথিত ইসলামি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের দক্ষ আলেম-সম্প্রদায়। তাছাড়া ১৯৪০ সাল হতে ১৯৭০ পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষা-কাঠামো ছিলো বর্তমান সময়ের থেকে ভিন্ন। মুসলিম কালচার, ইথিকস, মোরাল কোড মেনে চলার ব্যাপারে তৎকালীন মুসলিম পরিবার ও সমাজ কাঠামোয় এক সামস্টিক আন্দোলন সেই সময় বিদ্যমান ছিলো। ফলে তৎকালীন সময়ের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা-কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তা পরিপালনের অনুকুল পরিবেশ ছিলো। সেই কারনে, তৎকালিন সময়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক লোকও পরিবারিকভাবইে আরবী, উর্দু ও ফারসী ভাষার মাধ্যমে ইসলাম-বিষয়ক জ্ঞান চর্চা করতো। এই সকল আধুনিক শিক্ষিত ইসলাম জানা লোকেরাও অনেকে সেই সময়ে (১৯৪১ ও তৎপরবর্তী) জামায়াতে যোগদান করে। ফলে বর্তমান পূর্ববর্তী সময়েও তৎকালীন জামায়াতের নেতৃত্বে ১০০% যোগ্য, দক্ষ, জ্ঞানী ও বিশ্ব পরিচালনার মতো না থাকলেও বর্তমান সময়ের মতো এত ক্রাইসিস ছিলনা। ইসলামি ইথিকস ও মোরালিটির প্রতি কমিটমেন্ট তাদের পার্থিব যোগ্যতার ঘাটতি পূরন করতে পারতো। কিন্তু সত্তর বা আশির দশকের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের কারনে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা পদ্ধতিতে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মুসলিম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট-কাঠামোয় মুসলিম কালচার ও ইথিকস এর অনেকটা বিলুপ্তি ঘটে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জামায়াত এদেশে ইসলামি তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে রিক্রুটমেন্ট শুরু করে। জামায়াত যেহেতু নানাবিধ পারিপার্শ্বিক কারনে শিবির কর্মীদের আরবী ও কুরআনিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করতে ব্যর্থ হয়, তাই ছাত্রজীবনে শিবির কর্মীরা শুধুমাত্র অনুবাদকৃত বইয়ের (যার অধিকাংশই সাবস্টান্ডার্ড এবং টার্মিনোলজিক্যাল ও ট্রান্সলিটারেইশনালগত ভুলে ভরা) উপর নির্ভর করে ইসলামের প্রাথমিক কোডসমূহ জানার চেষ্টা শুরু করে। পরবর্তীতে, শিবির কর্মী বা উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের কুরআনিক বা আধুনিক ‘বিষয়-ভিত্তিক’ সাবজেক্টে উচ্চশিক্ষার সূযোগ না দেয়ায় / থাকায় ছাত্রজীবনের অর্জিত জ্ঞানের উপরই শিবির কর্মী বা উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের নির্ভর করতে হয়। ফলে তারা ইসলাম বিষয়ক কোডসমূহ জানার জন্য-ভাষাগত দূর্বলতা বা ইনএফিসিয়েন্সীর কারনে- না আরবী বা ইংলিশ কোন বই পড়তে পারে আর না -বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের দূর্বলতার কারনে- বাংলা ভাষায় লিখিত ‘বিষয়ভিত্তিক’ কোন গবেষনামূলক প্রবন্ধ বা বই পড়ে তার মর্মোদ্ধার করতে পারে। ফলে পরিবার কিংবা অফিসে বিশাল লাইব্রেরী থাকা সত্বেও সেখান থেকে কোন জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়ে হয়না। তাই কবি নজরুলের ভাষায় -
''বহিয়াছ ফল, পাওনিকো রস, হায়রে ফলের ঝুড়ি
হাজার বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায়নাকো নূড়ি''
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শিবিরের স্ট্রাকচারাল কাঠামোর কারনে (অনেক বেশি সময় বিনিয়োগ করার কারনে) এখানে যারা নেতৃত্বে উঠে আসে তাদের অবস্থা, কমপক্ষে বিষয়-ভিত্তিক বিবেচনায়, জ্ঞানগতভাবে খুব দূর্বল। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যাদের রেজাল্ট তুলনামূলকভাবে চোখে পড়ার মতো না; পড়াশুনা করে জ্ঞান অর্জন বা দক্ষতাবৃদ্ধি নয় বরং ব্যবসাই যাদের মূল টার্গেট; জ্ঞান, দক্ষতা বা পেডাগগি নয় বরং ডেমাগগিতে যারা সেরা, তারাই উঠে আসে এ সংগঠনের মূল নেতৃত্বের আসনে। ফলে ইসলামিক প্রিন্সিপল বা মূলনীতি জানার জন্য আরবী বা ইংলিশ তো দূরে থাক, বাংলা ভাষার সাবস্টান্ডার্ড বইগুলো পড়ার মতো সময়ই ও যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা কোনটাই এসব নেতাদের থাকেনা। অথচ এরাই হতে যাচ্ছে জামায়াতের আগামীর নেতৃত্ব তথা পলিসি মেকার বা থিওরাইজার। মাওলানা মওদূদীর স্বপ্নের (!!!) উত্তরসূরী। পৃথিবীর সবকিছুর ক্ষেত্রে ঘটে ক্রমাগত উন্নয়ন, আর জামায়াতের- শিবিরের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ঘটছে ক্রমাগত অবনমন; প্রথম কাল ছিলো ভালো, পরবর্তীকাল মোটামুটি কিন্তু ভবিষ্যত অজানা .. .. ..।
১.১২ মিসগাইডিং ও মিসলিডিং কিছু মিথ: একটি বিশ্লেষণ:
প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে নতুন সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজটি কখনোই যে সহজ ছিলোনা তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু এই সত্যকে অবলম্বন করে জামায়াত- শিবিরের নেতৃত্বের মুখে এমন কিছু কথা শোনা যায় যা চরম হাস্যকর ও বিভ্রান্তিকর। এমন কিছু চর্চিত বাক্যের উদাহরণ হলো: টেবিলে বসে বড় বড় কথা বলা সহজ, কিন্তু মাঠে গিয়ে কাজ করা কঠিন; রাজনীতি আসলে তাদের জন্য যারা জীবন দিতে পারে, বুদ্ধিজীবীদের পান্ডিত্য এখানে কম প্রয়োজন; রাজনীতিতে রাজপথে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হয়, তাই এখানে পান্ডিত্য দরকার নেই; এখনি বুদ্ধিজীবীদের এত কি দরকার, ক্ষমতায় আসলে কত বুদ্ধিজীবী পেছনে ঘুরবে, তখন এসব বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগানো যাবে; এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট বেশি ক্ষমতাশালী না এসব বুদ্ধিজীবীরা বেশি ক্ষমতাশালী; এ জাতীয় আর কিছু কথা ...
এসকল প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। এসকল মন্তব্য নিংসন্দেহে অজ্ঞতাপ্রসুত এবং অনেকটা আত্মশ্লাঘা ও আত্ম-অহংকার থেকে জন্মলাভ করে। এ সকল বাক্য কর্মীদের মিসগাইড করে, জ্ঞান অর্জনে থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কর্মীদের মাঝে জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত না করে বরং তাদের মাঝে মূর্খতা ও আত্মশ্লাঘার জন্মদানে উৎসাহিত করে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের চারপাশের সকল বিল্ডিং, অট্টালিকা, ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি-গাড়ি, ইত্যাদি তৈরীতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বা সাধারন শ্রমিকরা জড়িত থাকলেও এগুলোর মূল নক্শাকারি কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ার যিনি প্রফেশনাল গবেষক। ছোট ছোট ফার্মেসী, ক্লিনিক ও হাসপাতালে ওষুধ সহজলভ্য হলেও এগুলোর আবিস্কারক কিন্তু একজন উচ্চ শিক্ষিত, বিষয়-ভিত্তিক জ্ঞানে দক্ষ ও যিনি প্রফেশানালি একজন জ্ঞান-গবেষক। গ্রাম- গ্রামান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় স্থানীয় শিক্ষকরা জ্ঞান বিতরনে যুক্ত থাকলেও এগুলোর তত্বায়ক, সমন্বয়ক, চিন্তক কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়বাহী জ্ঞান-গবেষক বিজ্ঞানীরা। মুসলিম হিসাবে ইসলামি জ্ঞান অর্জনের জন্য যে সকল বই পুস্তক আমরা অধ্যায়ন করি তা কোন লেম্যানদের লিখিত বা ব্যাখ্যাত নয় । সিয়াহ সিত্তার সংকলক, চার মাজহাবের ঈমামগন, কিংবা হাদিস বর্ননাকারি রাবিগন ( আসহাবে সুফ্ফা) জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে মহান কার্য সাধন করেছেন বিধায় বিশ্ব মানব সভ্যতা আজ এসব মনি-মুক্তাসম বাক্য (হাদিস/ ইসলামি শাস্ত্রের) থেকে জীবন-পরিচালনার নির্দেশনা লাভ করছে। আমাদের পরনের যে পোশাকটি তা যদিও আমরা স্থানীয় দর্জির কাছে খুব সহাজই তৈরী করতে পারি কিন্তু এর লাগসই প্রযুক্তি একজন গবেষক ফ্যাশান ডিজাইনারের তৈরী। তাই বলা যায়, জীবন ও জগতের যত অর্জন, যত আবিস্কার, যত সমস্যার সমাধান তার সবকিছুই জ্ঞান-তাপস, জ্ঞান-সাধক, জ্ঞান-গবেষক বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার বিজ্ঞানীদের অবদান। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার যত তন্ত্র, মন্ত্র কিংবা মতবাদ - এসবও কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-গবেষনার ফসল।
এবার আসি ত্যাগ-তিতিক্ষার কথায়। বিশ্বাসী মুসলিম মাত্রই জানে সকল মানুষকে অবশ্যই মরতে হবে এবং মৃত্যুর পরের সফলতাই একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা। আর এ সফলতা নির্ভর করে পার্থিব জীবনে সম্পাদিত কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দ্বারা। মুমিনের পুরো জীবন জিহাদসম এবং সাক্ষ্যদান তথা শাহাদাত মুমিন জীবনের মিশন। যে কোন পরিবেশে যে কোন বাধার মোকাবিলা ও পরিবেশ পরিস্থিতির বিপরীতে প্রয়োজনীয় কৌশল নির্ধারন করে সাক্ষ্যদান তথা শাহাদাতের কাজ তাকে চালিয়ে যেতে হয়। এতে যদি মৃত্যুর কোন আশংকা দেখা দেয় তবুও সে পিছপা হয়না। আর মহান আল্লাহর এই বিধান যে যত ভাল ভাবে জানে সে তত সুন্দরভাবে তা আমল করতে পারে। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানকে যে যত ভাল বুঝে সে তত ভাল ভাবে আমলে করে বিধায় মহান আল্লাহর প্রেরিত কিতাবের প্রথম বাক্য- জ্ঞানার্জন কর (পড়)।
যুগে যুগে, কালে কালে এটা প্রমানিত। এটা স্বত:সিদ্ধ। তাই বর্তমানে শিক্ষার এত গুরুত্ব্। এই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই বর্তমানে পশ্চিমাবিশ্ব বিশ্ব শাসকের মর্যাদায় সমাসীন। এই বিষয়গুলো আজ তাই সাধারন কথা থেকে প্রবাদ-বাক্যে পরিণত হয়েছে; যেমন - দ্যা পেন ইজ মাইটার দ্যান দ্যা সোডর্, ইগনোরেন্স ইজ লাইক ডার্কনেস এবং নলেজ ইজ পাওয়ার। মানব জীবনের এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই যেখানে শিক্ষার গুরুত্ব নেই। ইসলামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এটা অরো ভালোভাবে প্রযোজ্য, কারণ ইসলামপন্থী (রাজনৈতিক) আন্দোলন গুলো মূলত জ্ঞান-ভিত্তিক আন্দোলন । তাই মাওলানা মওদুদী তার আন্দোলনের জন্য তৎকালীন সময়ের সেরা ইসলাম-বিষয়ক জ্ঞানে দক্ষ ব্যক্তিদের জামায়াতের ছায়াতলে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এটা যদি সত্য হয়েই থাকে- তাহলে এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায় যে, ত্যাগ-তিতিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান-তাপস, জ্ঞান-সাধক, জ্ঞান-গবেষক বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার সমঝদার ব্যক্তিরা পিছিয়ে থাকবে। আসলে জ্ঞান-তাপস, জ্ঞান-সাধক, জ্ঞান-গবেষক ব্যক্তিবর্গ কখনোই ত্যাগ-তিতিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলোনা, এখনও নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবেনা। আসলে এখানে রয়েছে একটি বিরাট ইনফরমেশনাল ও এ্যানালাইটিক্যাল জ্ঞাপ-আমরা এটি অমরা একটি উদাহরনের মাধ্যমে দেখবো: (ক.- ধরা যাক) একটি জেলা শহরে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ন ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে এবং সেখানে অংশগ্রহনের জন্য কিছু শর্তাবলী সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে কিছু অসাধারন খেলোয়াড় থাকলেও তারা শর্তের কারনে সেই খেলায় অংশগ্রহন করতে পারেনি। অথচ খেলা শেষে বিজয়ী দলকে ঘোষনা করা হলো সেই জেলার সর্বকালের সবচেয়ে ভাল দল।
অথবা (খ.- ধরা যাক) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সাবজেক্টের বি প্লাস প্রাপ্ত কিছু ছাত্র পরিকল্পনা করল ক্যাম্পাসের কিছু ছিন্নমূল লোকদের সাহায্য করার এবং এটা নিয়ে তারা কাজও শুরু করলো। একই ক্লাসের কিছু এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্র তাদের উদ্দ্যোগের কথা শুনে খুব খুশি হলো এবং তাতে যোগদান করতে চাইলো কারণ এই কাজ নিয়ে তাদেরও কিছু পরিকল্পনা ছিলো। এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রদের চিন্তা-ভাবনা ছিলো আরো বিস্তারিত এবং সফিস্টিকিটেড ওয়েতে তা সম্পন্ন করার। সকলে মিলে সেই কাজ করতে গিয়ে দেখলো চমৎকার কাজটি করতে গিয়ে উদ্দ্যোক্তা বি প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রগন এমনসব উপায় অবলম্বন করছে যা কিছু ক্ষেত্রে নন-সাইন্টিফিক, কিছু ক্ষেত্রে দূরদর্শীতাহীন, কিছু ক্ষেত্রে উদ্দ্যেশের সাথে বৈপরীত্যমূলক, কিছু ক্ষেত্রে পূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীত, কিছু ক্ষেত্রে সোশাল ও সিভিল কোডের বিপরীত, কিছু ক্ষেত্রে গৃহীত পন্থা সামগ্রিক সমাজে অগ্রহনযোগ্য, কিছু ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর মেীলিক নীতিমালার সাংঘর্ষিক, কিছু ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুত্রের বিপরীত । এইসব অবস্থা দৃষ্টে এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্ররা তাদের শুধরানোর চেষ্টা একাধিকবার করে শেষমেষ সেখান থেকে বের হয়ে চলে আসল। অথচ বি প্লাস প্রাপ্ত কিছু ছাত্ররা পরবর্তীতে সকল কাজের উপযোগী বলে তাদের দাবী করলো এবং এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রদের এ কাজের অযোগ্য বলে প্রচার করলো। অথচ তারা যে কাজটি করছে সে কাজটি পূর্বতন সময়ে সিনিয়র কোন ব্যাচের এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রদের মাথায় জন্মলাভ করে ঐতিহ্য হিসেবে চালু হয়েছে; কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি (বি প্লাস প্রাপ্ত ছাত্ররা) দৃষ্টিনিক্ষেপ না করে তারা অন্ধের মতো শুধু তাদের মতামত প্রচারে ব্যস্ত (প্রয়োজনমত)।
বর্তমানে জামায়াত নেতৃত্বের যারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন, তাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা। যেই আন্দোলনের সূচনা করলেন মাওলানা মওদূদীর মতো শতাব্দীসেরা বিখ্যাত তাত্বিক ও বুদ্ধিজীবী- সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বর্তমান নেতৃবৃন্দ কিভাবে- একেবারেই আমাদের মস্তিস্কে তা ধরেনা। মাওলানা মওদূদীর প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে তাঁরা (বর্তমান নেতৃবৃন্দ) তাঁর (মাওলানা মওদূদীর) কর্মপন্থা ফলো করে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপযুক্ত লোকদের এখানে স্থান দেয়াকে তারা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করতো এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহন করতো।
১.১৩ জামায়াতের নেতৃত্ব সৃষ্টির ধারা: চলমান বনাম প্রত্যাশা :
আজ জামায়াতের কার্যাবলির প্রতি অনুসন্ধানি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হতাশ হতে হয়। ১৯৪১ সালে কার্যক্রম শুরুর পর সুদীর্ঘ এই সময়ে জামায়াতের বেশ কিছু অর্জন রয়েছে; কিন্তু প্রয়োজন ও প্রত্যাশিত ফলাফলের তুলনায় তা একবারে যৎসামান্য। যে কারনেই হোকনা কেন, জামায়াতের নেতৃত্বে এখনও আধুনিক শিক্ষিত, ইসলামি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত (???) বিষয়-বিশেষজ্ঞ পেশাজীবি লোকদের আমরা নেতৃত্বের আসনে স্থান করে দিতে পারিনি। ফলে দীর্ঘ সাত দশক পরেও জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল বা নেতৃবৃন্দ দেশের আধুনিক উচ্চ শিক্ষিত মহলে, অনেকটা, গ্রহনযোগ্যতার বাইরে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে শিক্ষক সমাজে জামায়াতের কাজ আছে, শিবিরের সুবাদে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য পেশাজীবিদের মাঝে জামায়াতের পরিচিতি আছে, জামায়াতের পেশাজীবি বিভিন্ন ফোরামও আছে কিন্তু শুধুমাত্র স্ট্রাকচারাল ডিফিকাল্টিজের কারনে সে সকল ফোরাম থেকে মূল নেতৃত্বে প্রফেসনাল কাউকে আনা সম্ভব হয়নি এবং এখনও হচ্ছেনা। জামায়াতে নেতা তৈরীর মূলনীতি হলো এ্যাক্টিভিস্ট টু থিওরিস্ট (কর্মী টু নেতা- ভার্টিক্যাল সিস্টেম) ।
অথচ এটা হওয়া উচিত ছিলো থিওরিস্ট টু থিওরিস্ট (হরিজোন্টাল সিস্টেম- অথাৎ যোগ্যতাসম্পন্ন ডেডিকেটেড ইসলামপন্থী লোকেরা যে কোন পর্যায় থেকে এসে নেতা হতে পারবে; পৃথিবীর উন্নত দেশের মত)।
ফলে জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে আজ এ্যাক্টিভিস্টতুল্য লোকদের ছড়াছড়ি। সিকুয়েন্সিয়ালি, ফলাফল যা হবার তাই। দলের নেতা বা দায়িত্বশীলদের মূল কাজ যেহেতু পলিসি মেকিং যা থিওরাইজেশনতুল্য; তাই এখানে আবশ্যক ছিলো বিভিন্ন পেশাজীবি ফোরামের তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদদের সমন্বয় ঘটানো যারা সমাজ-বিপ্লবের মূল হাতিয়ার। আর এই জন্য প্রয়োজন ল্যাটেরাল এন্ট্রির পথ খোলা রাখা। কারন বর্তমানে এদেশে সত্তর-দশক পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মাধ্যমে তথাকথিত বামপন্থি ও তাদের তথাকথিত উত্তরসূরীরা তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি ও দেশবিধ্বংসী স্ট্রীট বেজড প্রতিহিংসার যে কালচার জাতীয় রাজনীতিতে চালু করেছে তা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ইসলামি সমাজ-বিপ্লবের জন্য যে কাংঙ্খিত নেতৃত্ব তা তৈরী করা সম্ভব নয়। তাই ভার্টিক্যাল সিস্টেমে ফিল্ড পর্যায় থেকে অর্থাৎ শিবির থেকেই নয় বরং হরিজোন্টাল সিস্টেম ফলো করে দেশ-বিদেশের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতদের নেতৃত্বে স্থান করে দিতে হবে এবং সাংগঠনিক স্ট্রাকচার এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এসব যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকেরা এখানে আসতে অনুপ্রাণিত হয়। পুরানো চিন্তার বন্ধ্যাত্ব, ধর্মের নামে অধর্মীয় কালচার, ডিফেক্টিভ ও প্যারালাইজড স্ট্রাকচার বজায় রেখে যোগ্যতা ও দক্ষতা-সম্পন্ন মেধাবী লোকদের সংগঠনে না আসার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার তথাকথিত কালচার থেকে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে বের হয়ে আসতে হবে।
১.১৪ বিরোধী দলের বিশ্লেষনে জামায়াত নেতৃত্বের একটি ভুল:
জামায়াত যেহেতু - অনেকটা আনকনশাসলি - নিজেদেরকে বৃহত্তর পরিসরের ইসলামপন্থী আন্দোলন থেকে সংকীর্ণ পরিসরের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনের মাঝে বৃত্তবন্দী করে ফেলেছে, তাই সর্বতোভাবে তারা রাজনৈতিক ময়দানের বিপরীত আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোকেই কেবল নিজেদের প্রতিদ্বন্দী ভাবছে এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোকেই মোকাবিলা করার কাজে তাদের সকল শক্তি ও কর্মকৌশল নিয়োজিত করার চেষ্টা করছে। অন্যান্য সকল কর্মসূচীর ন্যায় নেতৃত্ব তৈরীর ক্ষেত্রেও তারা একই পলিসির প্রয়োগ করছে। তারা ভাবছে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এবং অন্যান্যরা যদি কোন টিএস, টিসি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়াই সাধারন সমাজ থেকে বাছাইকৃত কর্মীবাহিনী দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারে, তাহলে জামায়াত তুলনামূলকভাবে যোগ্য সাবেক শিবিরকর্মী থেকে বাছাইকৃত নেতৃত্ব দিয়ে পারবেনা কেনো। আর এখানেই ঘটেছে সমাজ-কাঠামো বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে জামায়াত নেতৃবৃন্দের সবচেয়ে বড় মৌলিক ত্রুটিটি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা-গবেষনা, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে স্কলারশিপ, ফরেনএইড, পেশাগত ট্রেনিং, ঋণ, গ্রান্ট ইত্যাদির নামে সাম্রাজ্যবাদি শক্তি যে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে তা শিবিরের যে কোন টি এস, টিসির চাইতে হাজার গুণ শক্তিশালী, আধুনিক ও সুদূরপ্রসারি ফলদায়িনী। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো লড়াই করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্জনের জন্য আর জামায়াতকে লড়তে হবে ইসলামি আদর্শের ফেরী করার জন্য। বিশ্বায়নের বাজারে আজ যে দায়িত্বজ্ঞানহীন, পুঁজিবাদি, ভোগবাদি, অর্থলিপ্সু, রিপু-বিলাসি সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠছে তা আদর্শহীন কোন দলের কর্মী বা সমর্থক হবার যোগ্য; ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনের কর্মী বা সমর্থক হবার যোগ্য নয়। তাই জামায়াতের কর্মপরিধি ও কর্মসীমা যেমন ভিন্ন তেমনি এর কর্মকৌশল এবং কর্মপথও হতে হবে ভিন্ন্। তাই জামায়াতকে অবশ্যই নেতৃত্ব-কাঠামোর ব্যাপারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনুসরনে ও অনুকরনে নির্মিত পথ ও পন্থা থেকে বের হতে হবে।
১.১৫ রাষ্ট্র বা সংগঠন পরিচালনায় শুরাভিত্তিক নেতৃত্বের গুরুত্ব: প্রেক্ষিত জামায়াত:
একটি দল বা গ্রুপ বা সংগঠন পরিচালনায় নেতৃত্বের ভুমিকা বা গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দলের সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদ তা- অভিভাবক পরিষদ, প্রেসিডিয়াম কমিটি, নির্বাহি বা কার্যকরি পরিষদ বা শুরা যে নামেই হোকনা কেন- হচ্ছে দলের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহনকারি ফোরাম। এটি হচ্ছে পুরো দলের মস্তিষ্কের ন্যায়। এখানে যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তাই বাস্তবায়িত হয় পুরো দল বা সংগঠন জুড়ে। এই সিদ্ধান্তই মেনে চলে সকল নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। কাজেই সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়া যত সুন্দর হবে, ফোরামের সিদ্ধান্তও তত সুচিন্তিত এবং সুদুরপ্রসারি হবে। আর এই সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় যত সমাজ-সেবক, সমাজ-কর্মী, সমাজ-উন্নয়নে নিয়োজিত সমাজ-বিজ্ঞানী জড়িত থাকবে, সমাজ পরিচালনা ও সমাজ পরিবর্তনের জন্য গৃহিত কর্মকৌশলগুলোও তত বাস্তব-সম্মত, বিজ্ঞান-ভিত্তিক, সুদূরপ্রসারী ও মানব কল্যানকামি হবে। অন্যদিকে সমাজ-গবেষক, সমাজকর্মী, সমাজ-উন্নয়নে নিয়োজিত সমাজ-বিজ্ঞানী হতে হলে যেটি, আনডাউটেড্লি, প্রয়োজন সেটি হলো জ্ঞান। কারন জ্ঞানের মাধ্যমে অতীতকে জানা যায়, বর্তমানের সমস্যা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করা যায় এবং ভবিষ্যতের পথ কন্টকমুক্ত করা যায়।
আর জ্ঞান বলতে বুঝায় (১) মোরালিটি- যা মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে সচেতন করে, দূর্নীতি ও অন্যের অধিকারহরন করতে বাধা দেয়, জবাবদিহীতার অনুভুতি তৈরী করে- ও (২) আর্থলি কোয়ালিটি- যা মানুষকে পার্থিব সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে- উভয়ই।
মুসলিম ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, আল-কুরআন ও আল-হাদিস হচ্ছে মুসলমানদের মূল সোর্স অফ ল’ যা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যামূলক যত পুস্তক ও গ্রন্থরাজি তার সবই- আমাদের সাব-কন্টিনেন্টের প্রেক্ষিতে- আরবী, উর্দূ , ফারসী এবং বর্তমান সময়ে ইংরেজী ভাষায় লিখিত। তাই কুরআন ও সুন্নাহর প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য আরবী ও ইংরেজী ভাষার দক্ষতা অপরিহার্য। ভাষার দক্ষতা কমপক্ষে এতটুকু হতে হবে যে, যাতে আরবী ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত কোন ট্রিটিজ বা ডিসার্টেইশন পড়ে তার মর্ম উপলব্ধি করা যায়। যদিও এটা বাস্তব সত্য যে, আল-কুরআন ও হাদিস যেহেতু মানব-জীবনের নানাবিধ বিষয়-ভিত্তিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে, তাই শুধু আরবীর ভাষাজ্ঞান দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ কে অনুধাবন সম্ভব নয়; যেমন সম্ভব নয় বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের জ্ঞান দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা প্রকৌশল, ডাক্তারি, রসায়ন, প্রাণরসায়ন, পদার্থ বিদ্যা কিংবা প্রানী বিদ্যার জ্ঞান অর্জন। বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের জ্ঞান থাকার পাশাপাশি চাই এসব বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের দক্ষতা অর্জন। অন্যদিকে আর্থলি কোয়ালিটি অর্জন করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অধ্যায়ন আবশ্যক।
বর্তমান বিংশ শতাব্দীতে এই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের জগতে- চাই তা অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজ পরিচালনানীতি, সরকার পরিচালনা নীতি, দল বা সংগঠন পরিচালনানীতি, ডমেস্টিক পলিসি, ফরেন পলিসি অথবা ভৌত বিজ্ঞানের যে কোন শাখাই হোকনা কেন- পুরো নেতৃত্ব দিচ্ছে অমুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে ইংরেজ ভাষাভাষীর পাশ্চাত্য সমাজ। এই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের জন্যও ইংরেজী ভাষার দক্ষতা অপরিহার্য। আর বিষয়ভিত্তিক এই জ্ঞান অর্জনের জন্য পুরো বিশ্ব আজ তাদের মুখাপেক্ষী। গোটা বিশ্বজুড়ে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অস্ত্রে সজ্জিত এই গবেষকদের তাই এত কদর। এত সম্মান। এত অনুকরন, অনুসরন। মানবজীবনের সকল সমস্যা সমাধানে এদের দ্বারস্থ হচ্ছে গোটা বিশ্ব। ইউনিপোলার বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দী দেশ আমেরিকা থেকে শুরু করে একেবারেই নতুন রাষ্ট্র দক্ষিন সুদান কিংবা ভবিতব্য রাষ্ট্র প্যালেস্টাইনের কাছেও এদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশ বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়-কাঠাসোর সকল ধাপ ও পর্যায়ে, সকল সমস্যার সমাধানে এসব শিক্ষক, গবেষক ও অভিজ্ঞতাম্পন্ন লোকেরা নীরবে অবদান রেখে চলছে। শুধু তাই নয়- অনৈসলামিক আদর্শের প্রচার- প্রসার ও বর্তমান আওয়ামি লীগ সরকারের পলিসি নির্ধারন ও বাস্তবায়নে এরা মশালচির ভুমিকা রেখে চলছে। পার্থিব সমস্যা সমাধানের পন্থা বাতলে দিতে এঁরা অপ্রতিদ্বন্দী। এদের কোন বিকল্প নেই। অন্যদিকে, বর্তমানে যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারনে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করতে পারছেনা। আবার তথাকথিত আরবী শিক্ষিত (ইসলামি শিক্ষিত বা কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী বলা যাবেনা) লোকদেরও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনেরও কোন সূযোগ তেরী হয়নি; তাই কষ্টকর হলেও, ইসলামি-ফেইথ-বেজড রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারনে, জামায়াতকে তার পলিসি মেকিং বডি বা শুরা কমিটিতে (নির্বাহি ও কর্মপরিষদসহ) এই উভয়ই শ্রেনীর লোকের সম্মিলন ঘটাতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত দু:কজনক হলেও সত্য, জামায়াতের সেন্ট্রাল এবং পেরিফেরাল উভয়ই লেভেলেই কাংঙ্খিত মানের লোকের বড়ই অভাব। কি জেলা, কি মহানগরী, কি কেন্দ্র; সর্বত্রই এক অবস্থা। কি শুরা, কি সেক্রেটারিয়েট, কি নির্বাহী, কি কর্মপরিষদ; সর্বত্রই একই নীতি অনুসৃত। দলের সর্বোচ্চ পলিসি মেকিং বডি হিসেবে শুরা, নির্বাহি, কর্মপরিষদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে চমকে যেতে হয়। ইসলামে শুরা সদস্যের গুরুত্ব যে কারনে এত বেশি, কার্যগতভাবে, ঠিক তার বিপরীত ফল উপহার দেওয়ার মত যোগ্যতাসম্পন্ন (!!!) লোকদের দিয়ে চলছে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের এই ফোরামটি। যেখানে কুরআন ও সুন্নাহর প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং চলমান বিশ্বেও ঘটনাপ্রবাহ জানার জন্য আরবী ও ইংরেজী ভাষার মিনিমাম পর্যায়ের দক্ষতা অপরিহার্য- সেখানে সর্বোচ্চ ফোরামের সদস্যদের যে অবস্থা তা অনেকটা সুনামির মত।
১.১৬ সেক্সপিয়ারের উক্তির প্রাসঙ্গিকতা ও সমাপ্তি মন্তব্য:
পৃথিবীর কোন কিছুই ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। ভুল থাকাই স্বাভাবিক। আর এটাও স্বাভাবিক যে, যে কোন কর্ম বা গৃহিত পথ ও পন্থা মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে ভুল প্রমানিত হলে সে পথ ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসা। কিন্তু এটা চরম অস্বাভাবিক যে, কোন পূর্ব গৃহীত সিদ্ধান্ত ভুল হলেও আঁকড়ে থাকতে হবে এই মানসিকতা পোষন করা । জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব কাঠামো এবং নেতৃত্ব তৈরীর পলিসির ক্ষেত্রে বিপরীত, উল্টা ও আন-ন্যচারাল থিওরির কারনেই সমাজ বিপ্লবের যে সঠিক কর্মপন্থা তা যেমন গৃহিত হচ্ছেনা তেমনি বেগবান হচ্ছেনা আমাদের গতি। শুধু শ্লথ বা শম্বুক গতিই নয়; সঠিক কর্মপথ ও কর্মকৌশল অবলম্বন না করলে উন্নয়নের গতি যেমন ধীর হয় তেমনি ভবিষ্যতে অজানা বিপদের আশংকাও বাড়ে। রেলইঞ্জিন রেললাইন দিয়ে না চললে কিংবা বাস-ট্রাক সড়কপথ এর পরিবর্তে রেললাইন দিয়ে চললে যেমন কিছু দুরত্ব অতিক্রম করার পরই জীবন-নাশী বিপদের আশংকা থাকে; তেমনি বর্তমানে জামায়াতের (শিবির) গৃহীত পলিসি থেকেও এমন আশংকা থেকে যাচ্ছে। আর এই আশংকা যে পুরোপুরি অমূলক তা কিন্তু নয় । বর্তমানে জামায়াত ও শিবিরের কর্মী রিক্রুটমেন্ট, নারচারিং এবং নেতৃতের¡ চিন্তাভাবনা, আচার-আচরন, গৃহিত কর্মপথ ও কর্মকৌশল কিন্তু আমাদের সেই আশংকারই এক বহি:প্রকাশ। আকস্মিক ঘটে যাওয়া কোন দূর্ঘটনা নয়। আর এখানেই রয়েছে বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কিং লেয়ার নাটকের সেই উক্তির প্রাসঙ্গিকতা ‘‘May not an Ass know when the cart draws the Horse”। ঘোড়া যেমন নিজে পথ চলতে পারে তেমনি গাড়িকেও টেনে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বিপরীতটি অসম্ভব। এমনিভাবে সত্য পথে চলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একজন জ্ঞান-গবেষক, জ্ঞান-সাধকের পক্ষে জাহিলিয়াতের বেড়াজাল ছিন্ন করে সত্য পথ আবিস্কার ও সে পথের অনুসরন যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব অন্যদেরকেও সেই পথ চালিত করা। এটাই সত্য, সঠিক ও সার্বজনীন। এর বিপরীতটি করতে গেলে প্রত্যাশিত নয় বরং অপ্রত্যাশিত ফলই পাওয়া যায়। তাই সময় থাকতেই সতর্ক, সাবধান ও কৌশলী হতে হবে। গ্রহন করতে হবে সত্য, সঠিক ও সার্বজনীন পথ; তাহলেই মিলবে কাংঙ্খিত গতি, প্রত্যাশিত ফলাফল।
চিত্র-২ : ঘোড়া গাড়ি টানে
চিত্র-৩: গাড়ি ঘোড়া টানে
১.১৭ ফাইন্ডিংস:
সকল কার্যরই থাকে কার্যকারন। সকল পরিবর্তনেই থাকে নিয়ামক। কোন ঘটনার একটির বেশি নিয়ামক থাকেনা- একথা যেমন সঠিক নই, তেমনি সকল ঘটনারই অনেক কারণ থাকে- একথাও সত্য নয়। তবে বাংলাদেশে জামায়াতের নেতৃত্বের শম্বুক গতি, নেতৃত্বের একমুখিনতা, পেশাগত ও বিষয়-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মূল নেতৃত্বে না আসা ইত্যাদি ঘটনার পেছনে রয়েছে নানান কার্যকারন। এর জন্য জামায়াতের চলমান ধারার মূল নেতৃত্ব যেমন দায়ি তেমনি সম-পরিমাণে দায়ি হচ্ছে এদেশে ইসলাম-পন্থী হিসাবে খ্যাত বা অখ্যাত আধুনিক শিক্ষিত, বিষয়-বিশেষজ্ঞ, সমাজ- গবেষক, জ্ঞান-সাধক, জ্ঞান-তাপস, এবং দেশ-বিদেশে উচ্চ শিক্ষাগ্রহনকারি বিশ্ববিদ্যালয়-লেভেলের শিক্ষক-সমাজ, সিভিল- সোসাইটির উচ্চ-শিক্ষিত, জ্ঞানবান, ধনবান ব্যক্তিবর্গ। এদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী-রাজনৈতিক দলের এই দৈন্যদশা দেখে তারা কী ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন তা আমাদের নিকট দৃশ্যমান নয়। হয়তো তারা পরামর্শ দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন, এবং এই বিষয়ে তাদের মনোমালিন্য হয়েছে- এরপর তারা নিশ্চুপ। কিন্তু ব্যক্তিক জীবনে, নিজস্ব পারিবারিক জীবনে এমন সুনামি তুল্য ঘটনা ঘটলে আমরা কি এতটুক ব্যবস্থা গ্রহন করেই নিশ্চুপ থাকতাম।.. .. ... .. .. ..
জামায়াতে যে জিনিসটি নেতৃত্বের মাঝে সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে সেটি হলো ইসলামের 'শুরার কনসেপ্ট'।
যেহেতু শুরা সদস্যের বাইরে গিয়ে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ার কোন ইসলামি মডেল এখনও থিওরাইজড্ করতে সক্ষম হয়নি, তাই টিচার বা শিক্ষক অভিধায় অভিহিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহনকে তাঁরা ম্যানডেট্রী ভাবতে পারছেনা। তাই প্রচলিত শুরা কাঠামোর বাইরে এসে নতুন শুরার মডেল নির্মাণ করতে হবে।
আপাত সমাধান হিসাবে জামায়াতের শুরার-গঠন যেমন হতে পারে:
জামায়াতের সর্বোচ্চ পলিসি মেকিং বডি হিসেবে শুরা, নির্বাহি ও কর্মপরিষদ কমিটি যেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহন বা থিওরাইজেশনের কাজটি করে থাকে; তাই সর্বোচ্চ পলিসি মেকিং বডিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।
আপাতত, সমস্যার 'আপাত' সমাধান হিসেবে জমায়াতের শুরা, নির্বাহি ও কর্মপরিষদ কমিটিগুলো নিম্নোক্তভাবে গঠন করা যেতে পারে:
(ক) মোট শুরা সদস্যের ৫০% ফিল্ড পর্যায় থেকে ও ৫০% বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠন থেকে আনতে হবে।
(খ) বিভাগীয় সেক্রেটারিয়েট ও নায়েবে আমীরদের মধ্যেও (ফিল্ড পর্যায়ের ও প্রফেশনালদের জন্য) ৫০: ৫০ অনুপাত বজায় রাখতে হবে।
(গ) পেশাভিত্তিক ফোরামগুলোর সবাইকে অবশ্যই আপন আপন পেশার হতে হবে।
(ঘ) মোট সদস্যের এক পঞ্চমাংস অবশ্যই বিদেশে কর্মরত সাবেক ইসলাম-ভিত্তিক আন্দোলনের কর্মীদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
(ঙ) সকল সিদ্ধান্ত একটি শরীয়াহ কাউন্সিলে অনুমোদিত হতে হবে। শরীয়াহ কাউন্সিলে দেশের এবং দেশের বাইরের ইসলাম-ভিত্তিক আন্দোলনের সাথে সম্পকির্ত আলেম-ওলামাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে।
(চ) বিভিন্ন বিষয়-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়ন ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(ছ) নেতৃত্ব- তৈরীর ক্ষেত্রে ভার্টিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তে ল্যাটেরাল এন্ট্রির পথ উন্মুক্ত করে হরিজোন্টাল সিস্টেম ফলো করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
(ক) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের অধীনে ক্ষমতাশালী, স্বায়ত্বশাসিত ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গবেষনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
(খ) স্বল্প সময়ে ইসলামি চিন্তাবিদ তৈরীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে স্কলারশিপের মাধ্যমে ৬ বছর (৩+৩) যথাক্রমে মিডল ইস্ট ও ওস্টোর্ন কোন দেশে আরবী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে (যার যে বিষয়ে গ্রাজুয়েশন থাকবে) পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(গ) একটু দীর্ঘমেয়াদে বিষয়ভিত্তিক ও কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানে সমৃদ্ধ ২৫০০ ইন্টেলেকচুয়াল তৈরীর জন্য স্কলারশিপের মাধমে মধ্যপ্রাচ্য ও ওয়েস্টার্ন কান্ট্রি থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঘ) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামপন্থী শিক্ষক বৃদ্ধি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের অধীনে শিবির হতে ভিন্ন অরাজনৈতিক ছাত্রফোরাম গড়ে তুলতে হবে।
(ঙ) ভিন্ন ভিন্ন দফা-ভিত্তিক কমপক্ষে ১০টি কালচারাল-বেজড শিশু ও ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(চ). ছাত্রশিবিরের উপর ডিপেন্ডেন্সি কমিয়ে প্রয়োজনে ছাত্রজীবন পরবর্তী প্লাটফরম হিসাবে যুবশিবির, তরুনশিবির ইত্যাদি গঠন করতে হবে - যাতে ছাত্রজীবনে সংগঠনের কার্যক্রম পালন করতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের লেখাপড়ার কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে আর পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছোঁড়ি না করে সকলে মিলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমতের ভিত্তিতে জাতীয় ও আন্তর্জতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ইসলামের সামগ্রিক ও মৌলিক বিধিবিধানকে মাইলপোষ্ট হিসাবে স্থাপন করে সামনের দিকে মুক্তির পথ অন্বেষন যদি করা হয়; তাহলেই শম্বুক গতি পেছনে ফেলে কাংঙ্খিত গতি অর্জন করে দ্রুত মানবতার কল্যাণে বৃহত্তর ভুমিকা রাখার মত সূযোগ পাওয়া যাবে ইন-শা-আল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
৩৪১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন