একালের একুশ সে কালের একুশঃ শ্রদ্ধাঞ্জলি ভাষা শহীদদের

লিখেছেন লিখেছেন সুশীল ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:০৯:০৬ রাত



একুশের মিনার সম্ভবত একমাত্র স্মৃতির মিনার যার একক কোনো স্থপতি নেই। বায়ান্নোর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঘাতকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে গড়ে উঠে প্রথম মিনার। বাঙালির স্মৃতির আকাশে আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ড’র মতোই ছিল তেজদৃপ্ত এবং ক্ষণস্থায়ি। বায়ান্নোর ড্রাকুলারা শুধু প্রাণ নিয়েই, রক্ত পান করেই তৃপ্ত থাকতে পারে নি। ভেঙ্গে দেয় বাঙালির অশ্রু থেকে গড়ে উঠা প্রথম স্মৃতির মিনার দু’দিনের মাথায়।

সেই মিনারের কোনো জৌলুস ছিল না, ছিল না হয়তো কোনো অমূল্য স্থাপত্য কৃতি, কিন্তু ছিল শাসকের দমন পীড়নকে প্রতিহত করে সহযোদ্ধার স্মৃতিকে সমুন্নত ও সুমহান করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষা সত্যিকারভাবে ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম-গঞ্জ-লোকালয়সহ সকল বাংলা ভাষীর অন্তরে। তাইতো স্মৃতির মিনার তৈরি হয়েছে হাতের কাছে যখন যা পাওয়া গেছে তা দিয়েই। কখনো কাঁদামাটি কখনো বাঁশের কঞ্চি কিংবা তিনটি ইট পাশাপাশি সাজিয়েও তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার। বাঙালির অশ্রু থেকে গড়ে উঠা স্মৃতির সেই মিনারটি প্রতিটি প্রেমিকের হৃদয়ে যে চেতনার মশাল জ্বালিয়েছিল সেই মশাল যেখানেই সুযোগ পেয়েছে সেখানেই আলোকিত হয়ে জয় করেছে ভয়ের অন্ধকূপ, বেদনায় নীল হয়ে বসে থাকে নি হয়ে উঠেছিল অক্লান্ত বিদ্রোহী এক প্রলয় শিখা। যে শিখা জ্বালিয়ে দেয় ঘাতকের বুলেটের ধাতব পিণ্ড, নিঃশেষ করে দেয় ঘাতকের বুটের শব্দের হিংস্র তাণ্ডব।

বায়ান্নোর পর যেখানেই শহীদ মিনার উঠেছিল সেখানেই পৌঁছেছে ঘাতকের বিষাক্ত থাবা। ১৯৫৩ সালে আরেকটি শহীদ মিনার গড়ে তুলেছিল ইডেন কলেজের ছাত্রীরা, কয়েকটি ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করেছিল আরেকটি প্রোজ্জ্বল স্মৃতি ফলক। সেখানেও পৌঁছে যায় ঘাতকের প্রতিনিধি, গুড়িয়ে দিয়েছিল প্রাণের মিনার। শহীদ মিনার বানানোর মতো ধৃষ্টতার অপরাধে ছাত্রিত্ত্ব বাতিল হয়েছিল বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের। বায়ান্নো থেকে তিপ্পান্নো ছিল ভাষা বিপ্লবীদের কেবলই অশ্রু মোছার কাল। যেখানেই শহীদ মিনার উঠেছিল সেখানেই হাজির হয়েছে রক্ত চক্ষু পশ্চিমা দোসর।

তিপান্নোর পর থেকে ঘাতকের রক্তচক্ষু হয়ে উঠে নিতান্তই বালির বাঁধ। এটাকে উপেক্ষা করার সূচনা সংগীত বেজে উঠে ঐ সময়টায়। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাস, ঢাকা হল এমনকি সারা দেশে মাথা উঁচু করে উঠতে থাকে এক একটি মিনার। মাটির জমিন ফুড়ে সাদা মাটা প্রতিটি স্তম্ভ প্রাণে সঞ্চার করে নব চেতনার। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের নতুন আত্মপরিচয়বোধ সৃষ্টি হয়, এক নতুন জাতির ভিত্তি ফলক নির্মাণ করে একুশের রক্তাক্ত প্রভাত।

স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিটি মিনার ছিল মহান ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতির ফলকে যুক্ত করে নতুন তারা। বাংলার গ্রামে গ্রামে শহরের মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠেছে শত সহস্র মিনার। এখন একাত্তরের মিনার এবং বায়ান্নোর মিনার একাত্ম হয়ে আছে বাংলার প্রতিটি লোকালয়ে। তবে সব মিনারের কেন্দ্রবিন্দু নিঃসন্দেহে জাতীয় শহীদ মিনার। অনেক মিনার ধারণ করছে একাত্তরের স্মৃতি কিন্তু তা আবার সঙ্গে সঙ্গে বায়ান্নোকে ধারণ করেছে। তাই একথা অকাট্য বায়ান্নোর ভাষা বিপ্লবীরাই নির্মাণ করেছিল একাত্তরের বিপ্লবের পটভূমি।

বাংলার স্থায়ি-অস্থায়ি প্রতিটি মিনারই ধারণ করে আমাদের একুশের চেতনাকে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে। কিন্তু আমাদের শৈশবে সামরিক শাসনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে শহীদ মিনারকে উপস্থাপণ করা হোতো বিকৃতভাবে। তারা কখনো কখনো আমাদের শহীদ মিনার নির্মাণ এবং পুস্প-অর্ঘ প্রদানকে কলঙ্কিতভাবে উপস্থাপন করেছে, বিকৃত করেছে আমাদের চেতনার উৎস স্থলকে। কৈশোরে যখন বিদ্যালয়ে রাত জেগে কখনো বাঁশের কাঠামো কখনো মাটি এবং ইট মিশিয়ে স্মৃতির মিনার নির্মাণ করতাম পরেরদিন একটি মহল এটাকে শিরক-মূর্তিপূজা-কবরপূজা-কিংবা বেদাত নানা অভিধায় বিজ্ঞাপিত করতো। কিন্তু আমাদের বাঁধ ভাঙ্গা আওয়াজকে কখনো তারা বন্ধ করতে পারে নি। আজ দীর্ঘদিন পর যখন নিজের কৈশোরের সেই আবেগভরা দিনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তখন এটাকে আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হয় না। এগুলো সব পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা যুগে যুগে কীভাবে যেন পরজীবীর মতো টিকে আছে এই বাংলায়। তখনো ভাষা সৈনিক গোলাম আযম সেই গালভরা বুলির খুব একটা প্রকাশ ছিল না। তাই একদম একাত্তরের কায়দায় তারা শহীদ মিনারকে বেদাতি কাজ ঘোষণা করতো।

আকস্মিকভাবে ৯০ এর দশক থেকে গোলাম আযমের ভাষা সৈনিক হিসেবে আবির্ভাবের পর থেকে সেই একাত্তরের পরাজিত শক্তি তাদের অপবিত্র পা আমাদের পবিত্র মিনারে ফেলা শুরু করেছে। কিন্তু এই পা ফেলা কোনো ভক্তির নয়, নয় কোনো বায়ান্নোর প্রতি আবেগের বহিপ্রকাশ। এটা স্রেফ রাজনৈতিক ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। আজকে সকালে চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য একটি কলেজের প্রভাতফেরীর প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর ভেতর কোনো নারী শিক্ষার্থীকে আমি দেখিনি। এটা কি শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে পরাজিত শক্তির পদযাত্রা কিনা তা নিয়ে দ্বিধান্বিত। আমার ধারণা ভুল হলেই খুশি হবো। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্র সংগঠনের প্রধান ঘাটি চট্টগ্রামের এই কলেজটির একুশের প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ আমি সহজভাবে না দেখার অনেকগুলো কারণের ভেতর দুটো কারণ সংখ্যায় ছিল তারা অনেক বেশি এবং কোনো নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল না, যদিও প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাতফেরীতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল।

আজকের সকালের প্রভাতফেরি অন্য প্রভাত ফেরিগুলোর থেকে ব্যতিক্রম ছিল। অতীতের কোনো প্রভাতফেরিতে কিংবা শহীদ মিনারের বেদীতে দাঁড়িয়ে কেউ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় নি, রাজাকারের ফাঁসির দাবীতে কেউ কখনো স্লোগান দেয় নি। আজকের শহীদ মিনারে, প্রভাতফেরিতে এই আওয়াজ সত্যিই আমাদের আশান্বিত করেছে। আজ প্রতিটি স্লোগান একাত্তর আর বায়ান্নোকে এক সাথে ধারণ করেছে। একাত্তরের চেতনাকে বায়ান্নো থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের দিন মনে হয় শেষের দিকে। বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের যে অমিয় ধারা বায়ান্নো থেকে শুরু হয়েছে একাত্তরের সুমহান অর্জন এবং সেই সাথে একাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীদের নিশ্চিহ্ন করার উপযুক্ত সময় এখনই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই জাতির কোনো অর্জন সহজভাবে আসে নি, বায়ান্নোর রক্ত একাত্তরের রক্ত- সব রক্ত একসাথে মিলিত হয়ে এই বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বায়ান্নোর চেতনা এবং একাত্তরের চেতনা এখনো ষড়যন্ত্রের বাইরে নয়। ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় এসেছিল পঁচাত্তর, পরিবর্তিত হয়েছে সংবিধানের মূলমন্ত্রসমূহ। ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশকে বারবার ধর্মীয় বর্ম দ্বারা আবৃত করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত অব্যাহত আছে। এদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সকল শোষণ বঞ্চনা ও ধর্মীয় উগ্রপনার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে বাংলার সকল সম্প্রদায়ের আত্মবলিদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তার পরিপূর্ণ অবয়ব লাভ করে। এদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মের অস্তিত্বহীনতা নয় বরং ধর্মীয়ে পরিচয়ে কাউকে অবমুল্যায়িত হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ধর্ম নিরেপেক্ষতার এ মহান বার্তাটি সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কানে পৌঁছেছে ভুলভাবে। এখানেই প্রতিক্রিয়াশিলতার আপত বিজয়। আজ আমরা মোটামুটিভাবে সকল প্রতিক্রিয়াশিলতার বিরুদ্ধে জয় লাভের প্রক্রিয়ায় কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। একাত্তরে যেমন অনাহার অর্ধাহারে থেকে যুদ্ধ করে পাকসেনাদের পরাজিত করেছিল বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা, আজও একই প্রক্রিয়ায় অনাহারে অর্ধহারে শুয়ে আছে রাজপথে প্রজন্মের বিপ্লবীরা। তাদের কণ্ঠে শুধু একটি দাবি একাত্তরের ড্রাকুলাদের ফাঁসি কার্যকর করা। ৯০ পরবর্তী বাংলার সবচেয়ে বড় যুব সমাজ তথা গণমানুষের আত্মত্যাগ আজ প্রজন্ম চত্বর, শাহাবাগ থেকে সারা বাংলায়। এই সংগ্রামে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন শহীদ- রাজীব, জাফর মুন্সি প্রমুখ।

আমাদের ভালোবাসার জায়গাগুলো ঐশ্বর্যের ঝলকানিতে কখনো বিচ্ছুরিত ছিল না বরং হৃদয়ের উষ্ণ আলোয় ছিল সদা আলোকিত। তাইতো শৈশবে মাটির মিনারকে নিতান্ত মাটির মনে হয় নি কখনো, বাঁশের কঞ্চির মিনারকে কখনো নিতান্ত কঞ্চির মনে হয় নি, সব সময়ে মনে হয়েছে এটাই সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-সফিউর, এটাই আমাদের ভাষা আন্দোলন, এটাই আমার বাংলা ভাষা। দু-পয়সার রঙিন কাগজ জড়িয়ে শহীদ মিনার সাজানো, পুরোনো ক্যালেন্ডারের উলটো পিঠে অ-আ, ক-খ লিখে কোনো জঙ্গল থেকে একটি ঝোপ জাতীয় গাছ কেটে নিয়ে এসে বর্ণমালা বৃক্ষ বানাতে আমাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তখনো আমরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস খুব বেশি জানতাম না। আমরা শুধু জানতাম একুশ মানে মাথা নত না করা। আমাদের বুকে থাকতো কালো সস্তা কাপড়ের ব্যাজ। আকবরি সন আর ইসায়ি সনের হের ফেরে ৯ই ফাল্গুন কি ৮ই ফাল্গুন তা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। আমাদের প্রভাতফেরির শ্লোগানে থাকতো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। সুরে কিংবা বেসুরে সবাই একযোগে গেয়ে উঠতাম হঠাৎ করে। আমাদের স্লোগানে থাকতো ৮ই ফালগুণ অমর হউক। তখন আমাদের গোলাপ কিংবা দামি ফুলের ডালা কেনার সামর্থ্য ছিল না। নিজের বাগান- অন্যের বাগান থেকে গাঁদা ফুল কিংবা দুই একটা গোলাপ ফুল চুরি করে বুনো গাছের পাতা দিয়ে ফুলের ডালা বানাতাম, যখন কোনো ফুল পেতাম না তখন হয়তো রাস্তার পাশে অনাদৃতভাবে বেড়ে উঠা সাদা রঙের ভাটফুল, হলুদ সরিষা ফুল কিংবা সাদা রঙের মূলা ফুল দিয়েও কখনো শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। আমাদের স্মৃতির মিনার হয়ে উঠতো প্রেম-ভালোবাসা আর শোকের অপূর্ব নিদর্শন। আজকের নাগরিক একুশ উদযাপনে ঐশ্বর্যের কিঞ্চিৎ উপস্থিতি থাকে, বড় ফুলের ডালা থাকা কিন্তু শৈশবের সেই আবেগ থাকে না থাকে শুধু দায়িত্ববোধ। কিন্তু শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চির অম্লান।

ছবিঃ একুশের প্রথম শহীদ মিনার, সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি গ্রন্থ থেকে।

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File