বাংলার মুসলমানদের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস।
লিখেছেন লিখেছেন তৃতীয় নয়ন ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:৩২:০৪ রাত
বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম প্রধান দেশ। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আদর্শ যাই বলি মানুষই তার আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধানত দুটি ধারা মুসলমান ও হিন্দু। এই দুটি ধারার রাজনীতিই এদেশের রাজনীতির প্রবাহমান ধারা। হাজার বছরের মুসলিম মিশনারী শাহ জালাল ও শাহ মাখদুমের পূণ্যস্নাত এই বাংলা শাসিত হয়েছিল মুসলমানদের হাতে ১২০৩ থেকে মাঝখানের ১৯০ বছর ইংরেজদের গোলামীর শাসন ছাড়া । তারও পূর্বে হিন্দু সেন রাজাদের শাসন ছিল ১০৬ বছর। তারও আগে ছিল বৌদ্ধ পাল বংশের রাজার শাসন ৩৪৭ বছর। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি তারই উত্তরাধিকারী। ১৯৫৭ সালের পলাশীর পতনের পর মুসলমানদের শুধু রাজনৈতির শক্তি হারায়নি হারিয়েছে অর্থনীতিও । "একদিন যাদের দরিদ্র হওয়া অসম্ভব ছিল, সেই মুসলমানরা কাঠুরিয়া ও ভিস্তিওয়ালায় পরিণত হলো।"১ ইংরেজদের শাসন প্রত্যাখান করে মুসলমানরা প্রতিরোধ সংগ্রামকে বেচে নেয় আর হিন্দুরা ইংরজদের তেল দিয়ে দু'হাতে নেয় সকল সুযোগ সুবিধা। ইংরেজদের ছত্রছায়ায় ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,শিক্ষক,কেরাণী হতে শুরু করে সার্বিক বিকাশে মনোযোগী হয়। মুসলমানদের রাজত্বকালে মুসলমানরা হিন্দুদের জাতীয় অস্তিত্বের গায়ে কখনো হাত দেয়নি কিন্তু ইংরেজদের আনুগত্যের মধ্যদিয়ে মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতার জন্ম দেয় হিন্দুরা। বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমি নতুনরুপে রূপায়িত হয়। ইংরেজদের পরাধীনতার শাসন প্রতিরোধে মুসলমানদের ত্যাগ কুরবানীই ছিল সবচেয়ে বেশী এবং বলা চলে সর্বাত্বক। ১৭৬৩ সালের ফকির বিদ্রোহ,১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ স্বরণীয়। ইতিহাস ফকির মজনু শাহ, মুসা শাহ,চেরাগ আলী, সোবহান শাহ, মাদার বক্স,করিম শাহ দের কখনো ভুলবেনা। মুসলমানদের বিপ্লব স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়েছিল সারা ভারতবাসীর। ডব্লিই হান্টার এই বিদ্রোহকে বলেছিলেন " ইতিহাসের এক বৃহত্তম ধর্মীয় পুণরুত্থান।" ১৮৩১ সালে বালাকোটের রক্তাক্ত বিপ্লব এনে দেয় স্বাধীনতার জাগানিয়া উ্ত্তেজনা। মুসলমানদের এই সর্বাত্বক জিহাদে শুধু সচ্ছলরা নয় গরীব কৃষকরাও নিয়মিত অর্থ প্রদান করতো। মুসলানরা আরো পরিচালিত করে তিতুমিরের মুক্তি সংগ্রাম, হাজী শরীয়ত উল্লাহর ইসলামী বিপ্লব এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এভাবেই মুক্তির সূর্য ধরা দেয় ১৯৫৭ সালে। ২৩ শে মার্চ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি হিন্দুরা। হিন্দুরা লাহোর প্রস্তাবকে কাল্পনিক আখ্যা দিলেন। গান্ধী বললেন" মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব আমাকে হতবুদ্ধি করেছে, ভারতের অংগচ্ছেদ করার পূর্বে আমার অংগচ্ছেদ কর। "
দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল গান্ধী সহ কংগেস নেতাদের গ্রাত্রদাহের কারণ। গান্ধী এ বিষয়ে জিন্নাহকে বলেছিলেন " ধর্মান্তরিত একদল মানুষ ও তাদের বংশধররা পূর্ববর্তীদের থেকে স্বতন্ত্র জাতীয়তা দাবী করার নজির আমি ইতিহাসে খূজেঁ পাইনা। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ভারতে যদি একজাতি থেকে থাকে তাহলে তাদের সন্তানদের বড় একটা অংশ ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও সেই একজাতিই থাকে।" উত্তরে কায়েদে আযম বলেন "জাতিয়তার যেকোন সংগায় মুসলমান ও হিন্দুরা আলাদা দুটো প্রধান জাতি। আমাদের রয়েছে সুনির্দিষ্ট(স্বতন্ত্র) সংস্কৃতি ও সভ্যতা, আচার ও পঞ্জিকা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যোগ্যতা ও আকাংখা। আন্তর্জাতিক আইনের সব নিয়মে আমরা একটা আলাদা জাতি।"
অতপর কৌশলী গান্ধি বলেছিলেন " দ্বিজাতিতত্বের বিতর্ক বাদ দিয়ে আত্ন নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ভিত্তি করে কি সমাধান করতে পারিন?" উত্তরে জিন্নাহ বলেছিলেন "মুসলমানেরা আঞ্চলিক ভিত্তিতে আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার দাবী করেনা,তারা এই দাবী করে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে। সুতরাং দ্বিজাতিতত্ব বাদ দিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়।" এভাবে মুসলমানদের তীব্র আন্দোলনের ফলে্ই ১৯৪৭ সালে একটি জাতির জন্ম হয়েছিল। এটি ছিল এমনই একটি বিশ্বয়কর ঘটনা যে, বিশ্বব্যাপী যখন ভাষা ও অঞ্চল ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র গঠনের বন্যা বেয়ে চলছে ঠিক সে সময়ে মুসলিম জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হলো। জাতির জন্মটাই হচ্ছে মূখ্য বিষয়। মুসলমানদের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের ছিল প্রচন্ড বাঁধা। যে কারণে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ টিকেনি। হিন্দুরা গোটা বাংলাকে মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। তাদের আশা ও চাওয়া ছিল যাতে মুসলিম স্বতন্ত্র আভাসভূমিটি না টেকে-- মুসলিম জাতিসত্তা বিসর্জন দিয়ে যেন আবার মিলিত হয় ভারতের সাথে। পাকিস্তানী শাসকদের পাঞ্চাব দর্শন, স্বৈরচারী মনোভাব, নির্যাতন, বাংলাদেশীদের প্রতি অন্যায় আচরনের কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি টিকলনা আড়াই যুগও। ২৫তম স্বাধীনতা দিবসের আগেই ভেংগে গেল পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযু্দ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপ ও সাহায্য ইতিবাচক হলেও ভারতের স্বার্থ ছিল পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করা। এতে বাংলাদেশ উপকৃত হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামে বিশ্ব মানচিত্রে পরিণত হলো। বাবু বসন্ত চ্যাটার্জীরা চিৎকার দিতে থাকলো দ্বিজাতি তত্ব ধংস হয়েছে কিন্তু পাকিস্তান ভাংলেও ভাংগেনি দর্শণ। ।৭১ এ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়েছে, পতাকা পাল্টেছে, জাতীয় সংগীত পাল্টেছে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান যেমন ছিল মুসলিম আবাস ভূমি, বাংলাদেশও সেই পরিচয়কেই ধারণ করল। ব্যাপারটা নাম পাল্টানোর মত, পরিচয় এবং চরিত্র পাল্টানো নয়। আর পাল্টানোও সম্ভব নয়। সুতরাং দ্বিজাতিতত্বই বাংলাদেশ। ৪৭ এর হিন্দুবাদী নেতাদের স্বপ্নও আবারও গুড়েবালি। আঞ্চলিক স্বার্থ ও ভাষার জাতিয়তাকে বড় করে দেখিয়ে দুই বাংলা এক হওয়ার কথা যারা বলতেন তাদের মাথায় বজ্রপাত হলো। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগঠন "স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের" নেতা আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফদের গোপন ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়ে গেলো।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভূদ্যয়েই আবার শুরু হলো নতুন ষড়যন্ত্র। ১৯৭১সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণায় 'বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার এই লক্ষ্যগত ঘোষণায় কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়নি। কিন্তু বামপন্থীদের নতুন ষড়যন্ত্রে '৪৭ এর দ্বি জাতিতত্ব ভিত্তিক স্বাধীনতার চেতনা এবং '৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা পদদলিত করে ভারতের পদলেহী হয়ে সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ ও চরিত্র বদলানো চেষ্ঠা চালিয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়--সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নামের থেকে মুসলিম শব্দ বাদ, জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ, কবি নজরুল ইসলাম কলেজ নাম থেকে ইসলাম বাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে খঁচিত কুরআনর শিক্ষা মূলক আয়াত বাদ দেয়া । আর এত সব করা হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে। আর সংবিধানে এমন বিধান রাখা হলো যাতে ইসলাম ও মুসলিম নামের কোন রাজনৈতিক দল দেশে গড়ে উঠতে না পারে। শুধু মুসলিম তাহজিব তামাদ্দুন নয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীন অস্তিত্ব মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু হলো। তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-- ১৯৭৩ সালে কোলকাতার "দেব সাহিত্য কুঠির" তাদের বিখ্যাত Student Favorite Dictionary তে একটি ম্যাপে বাংলাদেশকে ভারতের একটা প্রদেশ হিসেবে দেখানো হয়। ১৯৭৪ সালের ১৮ই মে কোলকাতার 'দৈনিক অমৃত বাজার' পত্রিকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রাদেশিক প্রধানের পদবী "চীপ মিনিস্টার" বলে অভিহিত করে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে ফেলার জোর প্রচেষ্টা চলছিল। এ ক্ষেত্রে ভারতের চাইতেও অগ্রণী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার। ভারতে এখনও আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিন্তু বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সাথে ইসলাম ও মুসলিম শব্দও রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালে ভারত সিকিমকে দখল করে নিলে বাংলাদেশের জনগণ আরো আতংকিত হয়ে পড়েন। একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক বললেন "১৯৭১ সালে যখন নয়াদিল্লী বাংলাদেশকে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্বান্ত নিল, তখন থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভংগি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে ভারত মুখ হা করে এগিয়ে আসবে এবং যখন মুখ বন্ধ করবে তখন বাংলাদশে ভারতের পেটের ভিতরে।" শেখ মুজিবের ভারতপ্রীতি সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক উক্তি "পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মুক্তি আমাদের আসে নাই, কেননা আগেকার প্রাদেশিক গর্ভণর ও মন্ত্রীদের চাইতে অধিকতর নগ্নভাবে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা নয়াদিল্লীতে সপ্তায় সপ্তায় গমন করেন, সেখান হইতে যে নির্দেশ দেয়া হয় ঠিক সেভাবে দেশ চালানোর এস্তেমাল হইতেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ভারতের অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা হয়না, বাণিজ্য চুক্তির নাম করিয়া অর্থমন্ত্রী নয়াদিল্লীর প্রভুদিগকে পরিকল্পনার খসড়া দেখাইয়া আনেন। সবচাইতে লজ্জার ব্যাপার হইল, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জনগণের পবিত্রতম সনদ শাসনতন্ত্রের খসড়া হইবার পর আইনম্ত্রী কামাল হোসেন শাসনতন্ত্রের খসড়া বগলদাবা করিয়া বিলাত যাইবার নাম করিয়া দিল্লীর প্রভুদের খেদমতে হাজির হইয়াছেন।" শেখ মুজিবের সরকারের ভারতঘেষা ও ইসলাম বিদ্বেষী ভূমিকায় সদা আতংকিত ছিল বাংলাদেশের মানুষ । ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্রী ও ভারতঘেষা রাজনীতি ও শাসন কর্তত্বের পতন ঘটল। একজন বিদেশী সাংবাদিক শেখ মুজিবের বিপর্যয়ের ৩টি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, তম্মধ্যে অন্যতম কারণটি ছিল ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। "এক হাজার মসজিদের শহর ঢাকা" বলে ঢাকা বরাবরই গর্ব করেছে এবং বাংলাদেশীর পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাইতে ছিল বেশী ধর্মানুরাগী। অপরদিকে বাংগালী মুসলমানরা উপমহাদেশে আলাদা মুসলিম রাষ্টের পরিকল্পনা অবিচলিত ভাবে সমর্থন করেছিল বলে '৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। এই পশ্চাদভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগনের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই '৭৫ পরবতী নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারতি জনসমর্থন লাভ করেছেন।"
মুজিবের মৃত্যুর নির্মম পরিহাস যে, পাকিস্তানীরা তাকে হত্যা করেনি, তার দেশবাসীরাই তাকে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগের ভেতর ও বাইরে প্রাচীনপন্থী মুসলমানরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।
মুজিব শাসনামলের অব্যাবহিত পরেই শাসনতন্ত্রের মৌল ভিত্তির আসন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বিদায় করা হলো এবং তার জায়গায় প্রতিস্থাপিত হলো 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস'। একদলীয় বাকশালী রাজনীতি থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও ইসলামী রাজনীতির ধারা পুণ: চালু হলো। বিলোপ ঘোষিত সংবাদ পত্র গুলো পুণরায় প্রকাশ পেল। ইসলামী রাজনীতি সাড়ে তিন বছরের বন্ধীদশা থেকে মুক্তি পেল। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলণ প্রভৃতি ইসলামী রাজনৈতিক দল সমুহ আবার জনতার সামনে দৃশ্যমান হলো। '৭৫ সালে বাংলাদেশকে ইসলামী রিপাবলিক ঘোষণা করা হলেও পরবতী সময়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তা আর রক্ষা করেনি। জাতীয় পার্টির শাসনামলে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে।
সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক দল আত্নপ্রকাশ করলেও রাজনৈতিক ধারা মূলত দু'টি। প্রথম ধারাটি হচ্ছে- ইসলামী আদর্শ ও জাতিসত্তা বিরোধী ধারা। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে বাম ও সমাজতন্ত্রী দল গুলো আর তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামীলীগ ও তাদের গোত্রভূক্ত দল সমুহ। পার্শবতী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তাদের সার্বিক তত্বাবধান করছে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারাটি হচ্ছে ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক ধারা। এ ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী সহ অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন সমুহ। আর বিএনপি নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োজনে যখন যেখানে যতটুকু সহায়তা দরকার তা দেয়ার চেষ্ঠা করছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের ও বাম রাজনীতিবিদদের তৎপরতা কিন্তু থেমে নেই বরং ৭৫ পরবতী ও জিয়া, এরশাদের সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অর্থাৎ নব্বই এর দশকে আরো জোরদার করা হয়। একশ্রেণীর রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিসেবীদের ডানায় ভর করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে দেশের নামীদামী বুদ্ধিজীবিদেরকে ভারতবান্দ্বব করে নেয়। স্রোতের মত বেরুতে থাকে বিভ্ন্নি দৈনিক,সপ্তাহিক ও মাসিক পত্র পত্রিকা, সাময়িকি ইত্যাদি। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত যে বক্তব্যগুলো প্রকাশ্যে বলা ও লিখা অসম্ভব ছিল ৯০সালের শেষ দিকে তা বলা শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ব বিরোধী ও অখন্ডভারতপন্থী আন্দোলন জোরদার করা হলো। "অসাম্প্রদায়িক উপমহাদেশের ইশতেহার" নামক পুস্তিকা প্রকাশ, ৯১ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর "উপমহাদেশ পুর্ণজীবন আন্দোলন" ইত্যাদির লক্ষ্য উপমহাদেশের অখন্ডতা ও ভারতপ্রীতির জয়গান প্রচার করা। দূর্ভগ্যবশত: এক্ষেত্রে তারা মওলানা আসাদ মাদানীকেও ব্যবহার করে। মওলানাও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন । সে মঞ্চে আ'লীগ নেতা মরহুম আবদুস সামাদ আযাদ, জাসদ নেতা কাজী আরেফও বক্তব্য রাখেন। গল্প কবিতা ও সাহিত্যেও দ্বি-জাতি তত্বের বিরুদ্বে প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত 'পূর্ব -পশ্চিম' তারই অংশ বিশেষ।
১৯৯১ সালের অবাধ নিবাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৮ টি আসন লাভ করে এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। এখানে উল্লেখ্য যে, ধর্মভি্ত্তিক রাজনীতির নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামী ঘটনাক্রমে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে মুসলমান বিরোধী ভারতের একটি অপতৎপরতা বলে অভিহিত করে। এটা বাম, ধর্মবিরোধী ও সমাজতন্ত্রী কমিউনিষ্ট রাজনীতির জন্য এক ঐতিহাসিক রাজনীতির সুযোগ এনে দেয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে আর তা দিয়ে জামায়াত সহ অপরাপর ইসলামী দল গুলোর মুন্ডপাত করার কাজে ব্যবহার করছে। গঠন করা হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯৩ সালের ২২ জুন ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে কংগ্রেসের উত্তর পূর্বঞ্চলীয় সমন্বয় কমিটির ৮ম বিশেষ সাধারণ সভার রাজনৈতিক মূল্যায়নে বলা হয় " বাংলাদেশে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সম্ভবত এটাই শেষ যুদ্ধ। এক দল চাইছে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অপর দল চাইছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অধ্যায় মুছে দিতে এবং প্যান ইসলামিক স্রোতের সাথে মিশে যেতে। এই শক্তি প্রফেসর গোলাম আযম, তা্কেই এরা নেতা মানছে..........। অশুভ মৌলবাদী শক্তিগুলো সুপরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে। একটি আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির পতাকা সমুন্নত রাখতে ভারতের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। "
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর উত্তরোত্তর সাফল্য ধর্মনিরপেক্ষ ভরত সহ পরাশক্তি গুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের বাম দলগুলো, আওয়ামী লীগ ও ভারতের কংগেস সহ ধর্মবিরোধী রাজনীতির প্রথম ও প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার বলে জামায়াতকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হলেও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে জামায়াতকে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন জামায়াতের সেক্রেটারী মতিউর রহমান নিজামীকে এক মঞ্চে বক্তব্য রাখতেও দেখা গেছে।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে অন্যতম শক্তিশালী দল হিসেবে জামায়াতের ভূমিকা ছিল অনন্য। চারদলীয় জোট বিজয়ী হলে ক্ষমতার অংশীদারীত্বে যায় জামায়াত। প্রথম রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে জামায়াত দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।
জামায়াতকে ঠেকাতে আবার সক্রিয় করা হলো এদেশীয় শক্তিকে। জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী বিশেষণ দেয়া হলো। পত্র -পত্রিকা, সাময়িকী, পথ নাটক, যাত্রা, কবিতা মঞ্চ, মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হলো। যুদ্ধাপরাধকে জামায়াত ঘায়েল করার ইস্যুতে পরিণত করা হলো।
২০০৭ সালের সাধারণ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করা হলো। দেশকে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হলো। ২০০৬ সালের আটাশে অক্টোবর ঢাকার রাজপথে লগী বৈঠার নির্মমতায় জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকশুণ্য গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হলো ফলে গণতন্ত্র ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে লাগলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক সামরিক নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় জেনারেল মইনকে ভারত ঘোড়া উপহার দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বশ্যতা আদায় করে নিল। মইন ইউ আহমদ নিয়ন্ত্রিত ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলো। জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে মজবুত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলো। জামায়াতের সকল শীর্ষ নেতাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আটক ও বিচারের মুখামুখী করা হলো। কয়েকজনের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের দিকে । শুধু জামায়াত নয় ভারতের আগ্রাসন বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে গোটা দেশবাসীই যুদ্বাপরাধীর তালিকায় থাকবে। সুতরাং ফ্যাক্টর জামায়াত নয় ভারত বিরোধিতা ও ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই জামায়াত নিধনের মূল বক্তব্য বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই অনিবার্য সংঘাতকেই ভারতের কংগ্রেস "বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ বলেছেন? যদি এটিই শেষ যুদ্ধ হয় তাহলে যুদ্ধের বিজয় যদি আসেও পরাজয় আসবে তার পর পরই। কারণ বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর রাজনৈতিক ইস্যু সমুহ বিদেশাগত ও অনুপ্রবেশ। এই সকল ইস্যু এদেশের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাষের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিপরীত। এখনো এদেশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে মুয়াজ্জিনের আযান শুনে, তুরাগ তীরে লক্ষ লক্ষ মানুষের আমীন আমীন শব্দ শোনা য়ায়, আড়াই লক্ষ মসজিদ এখনো এ মাটির বুকে দাঁড়িয়ে আছে । সুতরাং কোন লড়াই শেষ লড়াই নয়, সত্য ও মিথ্যার লড়াই চলছে---চলবে পৃথিবীর প্রলয় দিন অবধি।
বিষয়: রাজনীতি
২৬৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন