শিশু যৌন হয়রানি ও আমাদের করণীয়
লিখেছেন লিখেছেন জাজাফী ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৮:৩৯:০৭ রাত
শিশু যৌন হয়রানি ও আমাদের করণীয়
আমাদের সমাজে শিশুরা কোন না কোন ভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ছদ্ম নাম রাফেল। তখন সে ক্লাস থ্রিতে পড়তো। বয়স আট কি দশ। একই সীমানা প্রাচীরে ঘেরা চারটি বাড়িতে চারটি পরিবার বাস করতো। দশ বার জন ভাই বোনের প্রায় সবাই সমবয়সী।খেলাধুলা আর ছোটাছুটিতে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো। ঘনিষ্ট আত্মীয়া তার এক মাত্র মেয়ে নিয়ে সীমানার মধ্যেই একটি বাড়িতে বাস করতেন। টাকার গরমে আর আভিজাত্যের অহংকারে সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন তিনি। বাকি সবার তেমন ভালো অবস্থা ছিলনা তাই তার একমাত্র মেয়েকে অন্য বাড়ীর সব ছেলে মেয়েদের সাথে মিশতে দিতেন না। রাফেলদের ওই আত্মীয়ার বেশি যাতায়াত ছিল তার মায়ের দিকের লোকজনের সাথে। তার বোনের ছেলে মেয়ে আসতো নিয়মিত এবং মেয়েটি তাদের সাথেই খেলাধুলা করতো। সেই সময় তাদের ঘরে ছিল রঙ্গিন টেলিভিষন। রাফেল যখন সাদাকালো টিভিতে নাটক দেখার বায়না করতো ঠিক সেই সময়ে ওই পরিবার রঙ্গিন টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখতো।রাফেলের আত্মীয়া ওই বোনটি এতো কড়া শাসনের পরও মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই রাফেলদের সাথে খেলতে আসতো চুপিচুপি।সে তখন ভীষণ খুশি হতো। তখন একদিন সে তার অনেক ঘটনা বললো। তার মায়ের দিককার এক কলেজ পড়ুয়া কাজিনের কথা বলতো। তার সেই কাজিন মাঝে মাঝেই তাদের বাড়ীতে আসতো। তাকে কোলে নিয়ে নানা ভাবে আদর করতো। সেই সব ধরনের আদরের কথা শুনে রাফেলরা সবাই হা হয়ে যেত। বাইশ তেইশ বছর বয়সে রাফেল সেই অদ্ভুত আদরের মর্মটা বুঝতে শিখেছে। সেই আদরের ইংরেজী নাম চাইল সেক্সুয়াল অ্যাবইউজ।খাটি বাংলায় শিশু যৌন হয়রানি।এই লেখাটি যারা পড়ছেন তাদের অনেকেরই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বা ভাই বোন আছে। ওপরের ঘটনা রাফেলের বোনের ক্ষেত্রে ঘটলেও আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি বলেই ধরে নিলাম। কিন্ত আমাদের কোমলমতি ভাই বোন ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে সত্যি হতে কতক্ষণ? আমি বিশ্বাস করি আপনারা আমরা কম বেশি সবাই বেশ সচেতন। নিজের সন্তান ও ভাই বোন সবার প্রতি কড়া নজর রয়েছে আপনারআমার সবার। সন্তান ও ভাই বোন কাদের সাথে মিশছে খেয়াল রাখেন।কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে অ্যাবইউজ ব্যাপারটা অপরিচিতদের বেলায় নয় বরংঞ্চ পরিচিত নিকটাত্মীয়দের বেলায় বেশি ঘটে। ছোট বড় কিংবা অনেক বড় আত্মীয় বলে কিছু নেই। এমন মানুষগুলো এই সব ব্যাপার ঘটাবে তা আপনি আমি বিশ্বাসও করতে পারবোনা। বিশ্বাস সবাইকেই করি কিন্তু নজর রাখি আমাদের ভাই বোন সন্তানদের উপর।
কিছু পরামর্শ যা আমরা জানি আবারও জেনে নিই।
১। আমাদের সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখি। তাদের কথা গল্প মন দিয়ে শুনি। তাদের যথেষ্ট সময় দিই যাতে যে কোন ব্যাপারে তারা আমাদের সাথেআলোচনা বা শেয়ারকরতে পারে।
২। মেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রেও সচেতন থাকি। ছোট ছেলেরাও ছোট মেয়েদের মত বা তার চেয়ে বেশি অ্যাবইউজড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কেননা মেয়েদের সাধারণত আমরা কারো কাছে যেতে দিতে চাইনা তবে ছেলেদের যে কেউ আদর করলেও আমরা কিছু মনে করিনা। অথচ সেই আদরের নামে সর্বনাশ করে ফেলতে পারে।লজ্জায় আমার আপনার ভাই বোন ছেলে মেয়ে হয়তো সেটা কাউকে বলবেই না। আর সর্বনাশকারী নিয়মিত সেই সুযোগ নিতে থাকবে।
৩। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ভাই বোনের কাছে নিজেদের কিনে দেয়া খেলনার অতিরিক্ত কোন খেলনা,চকলেট বা উপহার সামগ্রী দেখলে এই ব্যাপারে সর্তকতার সাথে খোজ খবর নিতে হবে। কোথা থেকে এলো কে দিলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
৪। ছোট্ট ভাই বা বোনটিকে বা সন্তানটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন সে কি সেখানেও পুরোপুরি নিরাপদ? আমি বা আপনি তার কতটা গ্যারান্টি দিতে পারি। তাই ডাক্তারের সাথে সাক্ষাতে নার্সের বা অবিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
৫। শিক্ষক সে চাই প্রাইভেট শিক্ষক হোক বা কোচিং এর শিক্ষক হোক একা কোন নিরিবিলি কক্ষ না দিয়ে কিছু লোকজন আসা যাওয়া করে বা নজর রাখা যায় এমন কক্ষ নিবার্চন করুন। এতে আমার আপনার ছেলে মেয়ে ভাই বোন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেনা।
৬। যে কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটলে আপনার সন্তানকে তা শেয়ার করতে বলুন। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে ছোটরা সব সময় বেশি লাজুক হয়। লজ্জার কোন কথাই সে কাউকে সহজে বলতে চায়না। তাই তারা অ্যাবইউজড হলেও আমি আপনি জানতে পারিনা।
৭। আপনার আমার সন্তান ছোট ভাই বোনের আগ্রহ,আচরণ,চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করতে হবে। মা বাবা দুজনে মিলে দেখতে হবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা। কিছু পেলে তার কারণ খুজে বের করতে হবে।
৮। সবোর্পরি নিজের সন্তান ও ছোট ভাইবোনদেরকে সময় দিতে হবে। তাদের বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।
একটা কথা আমরা সবাই জানি একটি চারা গাছ ছোট বেলায় যত যত্নে রাখা যায় বড় হয়ে সে ততোটাই সুস্থসবল হবে এবং ভালো ফল দেবে।
আরো একটি সত্য ঘটনা ও একটি অনুরোধঃ
আমার এক কাজিন রাজধানীর নামকরা একটা স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তো। এখন সে স্বপরিবারে আমেরিকাতে থাকে। সে ছিল আমার একটা বন্ধুর মত। আমি কখনোই ওদের বাসায় যাইনি আর ও নিজেও কোন দিন আমাদের বাসায় আসেনি। ওর সাথে কেবল দেখা হতো খেলার মাঠে আর ফেসবুকে। তো একদিন চ্যাটিং এর সময় আমি ওকে বললাম বাজে ছেলে মেয়েদের সাথে মিশোনা,এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়িওনা ইত্যাদি ইত্যাদি। বললাম দুষ্টুমী করোনা। ও তখন আমাকে বলেছিল ভাইয়া তুমি কিছু মনে না করলে আমি কিছু কথা শেয়ার করতাম। শেষে ও যা শোনালো তাতে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।একটা বড় মানুষ যতটা না জানে তার চেয়ে এসব বিষয়ে ও বেশি জানে। আমি কিছু প্রশ্ন করলাম না ও নিজেই একে একে সব বললো। খুব আক্ষেপ নিয়ে বললো ভাইয়া অনেক মানুষ আছে তারা খুব খারাপ আর সব চেয়ে বেশি খারাপ বড় মানুষ। ইস কোন দিন যদি বড় মানুষ না হতাম! আমি চুপ করে শুনেযাচ্ছিলাম। শেষে ও বললো ওর অ্যাবইউজড হওয়ার গল্প। আমি আহত হলাম।আমার এই কাজিন তাই আমাকে বলতো ভাইয়া তোমরা যারা ব্লগে লেখালেখি করো তারা এসব বিষয়ে লিখে লিখে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াও যেন আমাদের মত আর কেউ কোনদিন অ্যাবইউজড না হয়। আসুন আমরা সচেতন হই এবং সচেতনতা বাড়াই। পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী হলো আমাদের শিশুরা। আসুন সেই শিশুদের জীবনে যেন কোন ধরনের অশুভ দৃষ্টি এবং অশুভ স্পর্শ তাদের কোমল মনে দাগ কাটতে না পারে তার জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।
জাজাফী
এসএমহল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইলঃ
বিষয়: বিবিধ
১৫৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন