আ:সরকারের গণতন্ত্র ও দূর্নিতী মুক্ত সরকার। 'কোন দেশে বাস করছি বলতে পারেন

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তপাতা ২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:২০:৩৫ সকাল



স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন উইংয়ের করিডরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক। হাতে একটি ফাইল। মুখের দিকে তাকাতেই দেখা যায় দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কারণ জানতে চাইলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, 'কোন দেশে বাস করছি বলতে পারেন! এই মহা অনিয়মের পদোন্নতি কি মেনে নেওয়া সম্ভব! চাকরিতে ১৬ বছরের জুনিয়র, বিসিএসে ১০ ব্যাচ জুনিয়র, এসিআর গড় অর্ধেকের কম, সহযোগী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্বে থাকার সময়কালও অর্ধেক- এমন ডাক্তারদের পদোন্নতি হয়ে গেল। কিন্তু সব যোগ্যতার মাপকাঠিতে তাঁদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকেও আমার পদোন্নতি হলো না। এখন তো সামনে পথ আছে দুইটা- হয় চাকরি ছেড়ে দেওয়া, আর না হয় গলায় দড়ি দেওয়া।' বলেই আবার রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। একপর্যায়ে আকুতি জানিয়ে বললেন, 'দয়া করে নাম-পরিচয় লিখবেন না, তাহলে চাকরি ছেড়েও আবার হয়রানির মুখে পড়তে হবে।'

গত বুধবার এ ঘটনার সময় ওই করিডরে উপস্থিত আরো কয়েকজন প্রায় একই রকম হতাশা এবং ক্ষোভ-আক্ষেপ ঝাড়েন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আর বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বর্তমান শীর্ষ পদে থাকা দুই নেতার নাম ধরে। তাঁরা বলেন, এই সরকারের সময়ে যেমন চিকিৎসকদের পদোন্নতি দিয়ে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তেমনি এই পদোন্নতির নামে অনিয়মও হয়েছে নজিরবিহীন। যোগ্যতার মাপকাঠি যে কোনটা ছিল তা বোঝা কঠিন, বিশেষ করে শেষবারে পদোন্নতিতে অনিয়মের চূড়ান্ত হয়েছে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও যেমন অনেকে পদোন্নতি পাননি, আবার এই সরকারের সময়ে তিন দফা পদোন্নতি পেয়েছেন, এমনকি চলতি বছরেই এক বা দুই দফা পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁদের নামও সর্বশেষ পদোন্নতির তালিকায় রয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. জিল্লার রহমানের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকা ধরেই মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ে কেবল উচ্চতর যাচাই-বাছাই করা হয়। আর পদোন্নতি দেয় বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি।

জিল্লার রহমান বলেন, 'আমাদের কাছেও ধরা পড়েছে অনেক কিছু। কিছু যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। এর মধ্যে কারো কারো নাম তালিকাতেই ছিল না। আবার এমন অনেকের নাম শেষবারের তালিকাতেও ছিল, যাঁরা চলতি বছরেই আরেক দফা পদোন্নতি পেয়েছেন।'

পদোন্নতিবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ-আক্ষেপ ও অভিযোগের সূত্র ধরে মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট নথি থেকে পাওয়া যায় বেপরোয়া অনিয়মের নানা চিত্র।

ওই সব নথির তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮তম বিসিএসের ডা. স্বপন কুমার সরকার ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে সহকারী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্বে ছিলেন। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজের এই চিকিৎসকের পাঁচ বছরের এসিআর গড় মাত্র ৩৭.৬০। তাঁর প্রথম চাকরিতে যোগদান হয় ১৯৯৯ সালে। গত ১৭ নভেম্বর জারীকৃত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিনি পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদোন্নতি প্রস্তাব তালিকায় ডা. স্বপন কুমারের নাম ছিল ১৭ নম্বর সিরিয়ালে। তবে একই তালিকায় ৪ নম্বর সিরিয়ালে থাকা একই সময়ের মধ্যে এসিআর গড় ৯২.৬০ নিয়েও পদোন্নতি জোটেনি ১৯৯১ সালে প্রথম চাকরিতে যোগদানকারী এবং ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর থেকে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্বে থাকা দশম বিসিএসের ডা. বিমল চন্দ্র শীলের। তিনি আছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাব তালিকার ২ নম্বরে থাকা এবং পাঁচ বছরের গড় এসিআর নম্বর ৯১.৪০ নিয়েও ১৯৮২ সালে প্রথম চাকরিতে যোগদানকারী এবং সপ্তম বিসিএসের ডা. আব্দুল কাদের পদোন্নতি পাননি। বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্বে থাকা এই চিকিৎসক আছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবে ঠিকই পদোন্নতি পেয়েছেন ১৭তম বিসিএসের ডা. মো. মখছুদুর রহমান, ডা. বিশ্বজিৎ দত্তসহ আরো অনেকে। যাঁদের প্রথম চাকরি হয় ডা. কাদেরের ১৫ বছর পরে ১৯৯৭ সালে। আবার ডা. কাদের সহকারী অধ্যাপক হয়েছিলেন ২০০৩ সালে আর মখছুদুর রহমান, বিশ্বজিৎরা সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) হন ২০০৯ সালে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের আমলে তিন দফা পদোন্নতি পান চিকিৎসকরা। প্রতিবারই পদোন্নতি নিয়ে অভিযোগ ওঠে কর্মকর্তা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ নেতাদের বিরুদ্ধে। এমনকি এসব পদোন্নতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার জন্য কেউ কেউ আদালতেও যান। তবে আগের অভিযোগগুলো ছাড়িয়ে যায় সরকারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এবং সদ্য বিদায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের বিদায়ের প্রক্রিয়া চলার সময়। এ সময় সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডর্-এসএসবির মাধ্যমে ১৩ নভেম্বর ৪২ জন এবং ১৪ নভেম্বর ৮৯ জনকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১১ নভেম্বর ডিপিসির (বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি) মাধ্যমে ৩৪৮ জনকে সহকারী অধ্যাপক পদে, ৬৩ জনকে সহযোগী অধ্যাপক পদে এবং ১৭ নভেম্বর ২৪২ জনকে সহকারী অধ্যাপক ও ২৩৮ জনকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একাধিক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, নিয়ম অনুসারে অধিদপ্তর থেকে পদোন্নতির যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। ডিপিসির বৈঠকে ওই তালিকার পর্যালোচনা বা মূল্যায়ন করেই পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে থাকে ভিন্ন চিত্র। মন্ত্রী, কর্মকর্তা, চিকিৎকদের পছন্দের জন্য পৃথক তালিকা করা হয়। ওই তালিকা ধরেই চূড়ান্ত পদোন্নতি হয়। ফলে অধিদপ্তরের তালিকার খুব একটা মূল্য থাকে না ডিপিসিতে। আবার তদবির বা ছপন্দের লোকদের নিয়েও একাধিক তালিকা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডিপিসিতে কোনোভাবেই যাঁদের পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিধিতে ফেলা যায় না, তাঁদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার জন্য আরেকটি তালিকা করা হয়। এসব তালিকার ফাঁকফোকর গলে পড়ে থাকেন প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন বেশির ভাগ পদোন্নতি প্রত্যাশীরা।

সূত্র জানায়, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রতিবার পদোন্নতি প্রক্রিয়ার পর ক্ষোভে-দুঃখে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। গত পাঁচ বছরে এসব কারণে চাকরি ছাড়ার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার শিফায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যাঁরা এবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন তাঁদেরকে আবেদন করতে বলা হয়েছে। আগামী ডিপিসিতে যোগ্য বাকি সবাই আশা করি পদোন্নতি পাবেন। আমরা সে অনুসারেই পদক্ষেপ নিচ্ছি।'

অতিরিক্ত সচিব জিল্লার রহমান বলেন, 'পদোন্নতি প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করতে আমরা এখন থেকে পুরোটাই ডিজিটাল পদ্ধতির আশ্রয় নেব। বিশেষ করে অধিদপ্তর থেকে প্রত্যেক কর্মকর্তার তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে এনে আমরা ওই তালিকা ও কর্মকর্তাদের পূর্বাপর সব যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতির জন্য ডিপিসির কাছে তালিকা পাঠাব।'

পদোন্নতির ক্ষেত্রে চিকিৎসক সংগঠনের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে বেশি প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে বিএমএ এবং স্বাচিপের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। তবে এ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও মোবাইল ফোনে সংযোগ না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।

বি:দ্র: গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় প্রতি পদউন্নতি ও পছন্দের স্থানে যেতে ২০ লক্ষটাকা করে নেয়া হয়েছে। যারা এই টাকা দিতে পেরেছে তাদেরই পদোন্নতি হয়েছে।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File