আন্দোলনে বিচারকরা শঙ্কাবোধ করতে পারেন : এইচআরডাব্লিউ
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তপাতা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০১:২৮:২২ দুপুর
'বাংলাদেশে : অতীত-পর্যালোচনামূলক সংশোধনী যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াকে কলুষিত করবে' শীর্ষক প্রতিবেদনটির হুবহু অনুবাদ প্রকাশ করা হল:
"ন্যায়বিচারের মান লঙ্ঘিত হয় এমন রায়-পরবর্তী আইন (সংশোধনী) বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কাজের বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করছে। আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তরিত করতে আপিল আদালতকে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে এ সংশোধনী আনা হয়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় করা অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচও (বাংলাদেশের) নিরাপত্তা বাহিনীকে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সেইসঙ্গে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গুলিবর্ষণ না করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেছেন, "১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের শিকার ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার জরুরি। কিন্তু আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত বলে ধরে নেয়া একটি সরকার শুধুমাত্র তার পছন্দ হয়নি বলে আদালতের সিদ্ধান্ত উল্টে ফেলার জন্য অতীত-পর্যালোচনামূলক আইন পাস করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখানেই থেমে গিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নেয়া এবং প্রস্তাবিত সংশোধনীর প্রক্রিয়া বাতিল করা, কারণ এটি গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করবে।"
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য আইসিটি গঠিত হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বেশিরভাগ ব্যক্তি বিরোধীদল জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘদিনের সিনিয়র নেতা, এ দলটি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আইসিটি তার প্রথম রায় দেয় আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। তার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিচারে তিনি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ও ফাঁসির দণ্ড পান।
আইসিটি গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মোল্লাকে হত্যা ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ছয়টি অভিযোগের পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন শ্রেনিপেশার মানুষ মোল্লার মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। (কাদের মোল্লার) ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাহবাগ এলাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হন।
(এ অবস্থায়) সরকার জনতার দাবির মুখে আইসিটি'র আইনে সংশোধনী আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। সংশোধনীতে বাদী পক্ষকে আপিল করার সুযোগ দেয়া হয় এবং আপিল করার সময় কমানো হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি সংশোধনীটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয় এবং আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি এটি পাস হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই মামলার রায়ের আগ পর্যন্ত বাদী পক্ষ শুধুমাত্র আসামী বেকসুর খালাসের আদেশ পেলেই কেবল আপিল করতে পারত এবং আপিলের জন্য ৯০ দিন সময় রাখা হয়েছিল।
এই সংশোধনীটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন (International Covenant on Civil and Political Rights) বা আইসিসিপিআর-এর লঙ্ঘন, বাংলাদেশ আইসিসিপিআর-এর সদস্য। আইসিসিপিআর-এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "একটি দেশের আইনি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রায়ে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী বা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর আবার তার বিচার করা বা তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না।"
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে জনমতকে বিবেচনায় আনার জন্য তাদেরকে রাজী করানোর চেষ্টা করবেন। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, সরকার এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়েছে। পার্লামেন্টে বিলটি উত্থাপন করার সময় ডেপুটি স্পিকার এই বলে একে স্বাগত জানিয়েছেন যে, "এটিই সংসদের দাবি।"
(শাহবাগে সমবেত) বিক্ষোভকারীরা জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। তারা আরো দাবি জানাচ্ছেন, আইসিটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা না করার বিধান রেখে এবং জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিতে প্রস্তাবিত খসড়ায় আরো কিছু সংশোধনী আনতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সরকার সমর্থিত বিক্ষোভ এবং প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মন্তব্য (আইসিটির) চলমান ও ভবিষ্যত বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে, প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে আসামীপক্ষের কোনো কোনো আইনজীবী আপিলের শুনানিতে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। (এ অবস্থায়) বিচারকরাও অন্যান্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো রায় ঘোষণা করতে শঙ্কিত বোধ করতে পারেন ভেবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
অ্যাডামস বলেছেন, "ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আইনের শাসন মানেই যে আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া- এই কথাটি জনগণকে বোঝানোর পরিবর্তে সরকার এখন সরাসরি বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে। ১৯৭১ সালের নৃশংসতায় জড়িতদের বিচার করা দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার মূল্য হিসেবে যে নীতিমালা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে তাকে বিসর্জন দেয়া যাবে না।"
(শাহবাগের) গণবিক্ষোভ প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ হলেও শেষ কয়েক দিনে সহিংস হয়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, শিবিরের কিছু ব্যক্তি পুলিশের প্রতি ঘরে তৈরি বোমা নিক্ষেপ করেছে এবং পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারী উভয়ে সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে। অন্তত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের দিকে তাক করে গুলিবর্ষণকারী বেসামরিক ব্যক্তিদের পাশে দাঙ্গা পুলিশ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছে, জামায়াতে ইসলামী দলের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে পরিচিত পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত অফিসে আগুন দেয়া হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তত ৩০ ব্যক্তি আহত হয়েছেন, এদের মধ্যে রয়েছেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক। বিভিন্ন সূত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে, তিনি (প্রথম আলো সম্পাদক) বুকে রাবার বুলেটের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছেন। (এ ছাড়া) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও যুদ্ধাপরাধ আদালতের সমালোচনা করে প্রবন্ধ প্রকাশকারী (পত্রিকা) দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক এবং অফিসেও হামলা চালানোর হুমকির খবর পাওয়া গেছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বলপ্রয়োগ ও গুলিবর্ষণ সংক্রান্ত জাতিসংঘের মূল নীতিমালায় বলা হয়েছে, "সমূহ মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত থেকে আত্মরক্ষা বা অন্য কাউকে এ ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গুলি ব্যবহার করতে পারবে না।"
অ্যাডামস বলেছেন, "বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার উচ্চ মাত্রার আবেগপ্রবণ ও রাজনীতি প্রভাবিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষের বিক্ষোভকারীরা দৃঢ়ভাবে মনে করছেন, সর্বশেষ রায়ে (কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন) তারা ন্যায়বিচার পাননি। নিরাপত্তা বাহিনী যাতে সংযমের পরিচয় দেয় সে ব্যাপারে পরিস্কার দিক-নির্দেশনা দেয়া এখন সরকারের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১০৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন