এবার পাঠ্য বইয়ে কোরআনের অর্থ বিকৃত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো !

লিখেছেন লিখেছেন সরকার বিরোধী ১৫ মার্চ, ২০১৩, ০৫:১১:০৭ সকাল

মহান আল্লাহ তায়ালাকে দেবদেবীর সাথে তুলনা এবং দেবদেবীর নামে জবাই করা পশুর গোশত খাওয়াকে হালাল আখ্যায়িত করার পর এবার পবিত্র কোরআনের অর্থ বিকৃত করার মতো চরম ধৃষ্টতার আরেকটি ঘটনা ধরা পড়েছে নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটিতে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক ২০১৩ সালের জন্যে প্রণীত নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ১০৭ পৃষ্ঠায় একটি পাঠ্য বিষয় হলো ‘জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ’।

সূরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতের অর্থ লেখা হয়েছে ‘তোমরা (ইসলাম ও মানবতাবিরোধী শত্রুর বিরুদ্ধে) লড়াই করবে। যতক্ষণ না ফিতনা-ফ্যাসাদ ও অশান্তি চিরতরে নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।’ সূরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতটি হলো ‘ওয়া কাতিলুহুম হাত্তা লা তাকুনা ফিতনাতুন ওয়া ইয়াকুনাদ্দিনু কুল্লুহু লিল্লাহ’।

আয়াতের এ অনুবাদ বিষয়ে কুরআন ও ইসলাম শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের কাছে তুলে ধরা হলে তারা জানান, এখানে পবিত্র কুরআনের আয়াতের অর্থ বিকৃত করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার যে কথা ব্র্যাকেটের মধ্যে বলা হয়েছে, তা আয়াতটির সম্পূর্ণ মনগড়া ও অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাসিক মদীনা সম্পাদক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত বহুল পঠিত মা’রেফুল কুরআনের অনুবাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেন, আয়াতে অর্থের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে স্পষ্টভাবে।

নরসিংদীর জামেয়া কাসেমিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা কামালউদ্দিন জাফরী বলেন, পবিত্র কুরআনের আয়াতের এ ধরনের অর্থ বিকৃত করা ইহুদি চরিত্রের অনুশীলন। অতীতে ইহুদিরা তাওরাতের অর্থ বিকৃত করেছে; কিন্তু পবিত্র কুরআনের মূল আয়াত যেহেতু বিকৃত করা সম্ভব নয়, তাই এর অর্থ বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এর শাস্তি খুবই ভয়াবহ।

সূরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতের সঠিক অর্থ তুলে ধরে মাওলানা কামালউদ্দিন জাফরী বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়’।

আমি যে অর্থের কথা বললাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদও ঠিক এ ধরনের, তবে তা সাধু ভাষায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান অনূদিত সরল রীতির কোরআন শরিফ বইয়ে আয়াতটির অর্থ করা হয়েছে ‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক, যাতে ফেতনা (শিরক, কুফর ইত্যাদি অধর্ম) না থাকে আর দ্বীন (এবাদত) সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়’।

প্রফেসর ফজলুর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্ট আয়াতে আল্লাহ যাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বলেছেন, তারা হচ্ছে কাফির ও মুশরিক। সুতরাং যারা এ ধরনের অনুবাদ করেছে, তারা অপরাধী।

বইটির রচয়িতা যারা : এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত ২০১৩ সালের নবম-দশম শ্রেণীর জন্য পাঠ ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটির রচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল মালেক ও ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ এবং আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউছুফ। বইটির সম্পাদনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই একই শিক্ষক কর্তৃক রচিত ও সম্পাদিত নবম-দশম শ্রেণীর জন্য প্রণীত একই বইয়ের ৮২ পৃষ্ঠায় দেবদেবীর নামে জবাই করা পশুর গোশত খাওয়াকে হালাল আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং দেবদেবীকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়েছিল। সেই রিপোর্ট গত ৮ মার্চ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বইটিতে জিহাদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আলেমসমাজ।

অর্থ বিকৃত করা প্রসঙ্গে বইটির রচয়িতারা যা বললেন : বইটির রচনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের একজন হলেন প্রফেসর আবদুল মালেক। তার কাছে কুরআনের আয়াতের অর্থ বিকৃত করা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না’।

তিনি আরো বলেন, ‘আসলে বিভিন্নজন বিভিন্ন অংশ লিখেছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, এরপর বিস্তারিত বলা যাবে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ভাই আমি আপনার কাছে মাফ চাচ্ছি।’

বইটির আরেকজন রচয়িতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। তদন্তের পর আপনারা সবাই জানতে পারবেন।’ এ ছাড়া বইটির আরেক লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউছুফকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

সম্পাদক যা বললেন : বইটির সম্পাদক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক। কুরআনের বিকৃত অনুবাদ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি প্রথমে বলেন, আমরা বইটি পড়ছি, দেখছি। এখন মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বইটি নিয়ে এক দিন আসেন। দেখে তার পর বলি। তখন তার কাছে প্রশ্ন করা হয় বইটি সম্পাদনা করেছেন আপনি। আপনাকে পৃষ্ঠা নম্বর, চাপ্টার নম্বর উল্লেখ করে অনুবাদ পড়ে শোনানো হলো। তার পরও দেখে বলতে হবে কেন আর এখনই বা আপনি কী পড়ছেন। সম্পাদনা করার সময় কি আপনি এটি দেখেননি এসব প্রশ্ন করার পর তিনি টেলিফোন লাইন কেটে দেন।

এ দিকে এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে গত রাতে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটি রচনা ও সম্পাদনার সাথে জড়িত সব শিক্ষকই আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দলের সাথে সম্পৃক্ত। বইটি প্রণয়নের সাথে জড়িত শিক্ষকেরা নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষাথী ও অন্যদের কড়া সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন আয়াতের অর্থ বিকৃত করা ও দেবদেবীর নামে পশু জবাই হালাল আখ্যায়িত করার বিষয়টি জানাজানির পর। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপকদের একটি সিএনডি সভা ছিল। সভা শেষে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউছুফের কাছে একাধিক সিনিয়র শিক্ষক প্রশ্ন করেন আপনি যে কুরআনের আয়াতের অনুবাদ করেছেন, তা কোথায় পেলেন এর কোনো উত্তর দিতে পারেননি অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউছুফ।

জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন : ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। বইটির জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ পাঠে সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো পাঠকদের সুবিধার্থে। ‘সন্ত্রাসবাদ বলতে আমরা বুঝি পার্থিব কোনো স্বার্থ লাভের আশায় বিশৃঙ্খলা ও তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে জনসাধারণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ও তাদের ক্ষতি করা। ইসলামি জ্ঞানের স্বল্পতা থাকায় একশ্রেণীর লোক জিহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে ফেলেছে। বস্তুত উভয়ের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। বলা যায়, এ দুটো পরস্পর বিপরীত। রাজ্য জয়, ক্ষমতা দখল, সম্পদের লোভ, খুন-খারাবি, লুটতরাজ ও অন্যায় রক্তপাত জিহাদের উদ্দেশ্য নয়; বরং মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসা এবং জুলুম ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়ের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে আসাই জিহাদের উদ্দেশ্য। মানুষকে সত্যনিষ্ঠ ও নৈতিক গুণে গুণান্বিত করাও জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা (ইসলাম ও মানবতাবিরোধী শত্রুদের বিরুদ্ধে) লড়াই করবে। যতক্ষণ না ফিতনা-ফ্যাসাদ ও অশান্তি চিরতরে নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ৩৯) পক্ষান্তরে, সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্য হলো অন্যায়ভাবে রক্তপাত করে রাজ্য জয়, ক্ষমতা দখল, সম্পদ অর্জন করা এবং লুটতরাজ ও খুন-খারাবির মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

ইসলাম জিহাদের মাধ্যমে মুসলমানদের রক্তপাত করতে শেখায়নি; বরং ইসলাম যে জিহাদের কথা বলে, তাতে রক্তপাত নয়, মানবতার দিকনির্দেশনা দেয়। মুসলমানদের কোনো জিহাদেই নিরপরাধ সাধারণ লোকজনের কোনো ক্ষতি হয়নি। রাসূল সা:-এর জীবদ্দশায় তিনি এক শ’র কাছাকাছি জিহাদে (যুদ্ধে) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। সব জিহাদের মিলিয়ে উভয়পক্ষে পাঁচ শ’র কম লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

বর্তমান যুগে জিহাদের নামে যেভাবে বোমাবাজি, জঙ্গিবাদ, খুন-খারাবি ও নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, তার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং এটি সন্ত্রাসেরই নামান্তর। ওপরের আলোচনা ও বাস্তব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, জিহাদে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। জিহাদের সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক নেই। সুতরাং আমরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও ইতিহাস জেনে জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করব এবং প্রকৃত মুসলমান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করব।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File