সম্ভাবনা [রহস্য গল্প]
লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ০৩ এপ্রিল, ২০১৫, ১২:২৮:৪৭ রাত
অনেকদিন পর আজ বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল লীনা। সে চিন্তাও করতে পারেনি এই বেড়াতে আসা তার জীবনকে এভাবে প্রভাবিত করবে।
পুকুরপাড়ে হাটতে হ্টাতে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিল লীনা। এরমধ্যেই সিয়াম এদিক-ওদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করছিল, পেছনে খাবার হাতে লীনা। তারপর একসময় ওরা ঘাটটার কাছে চলে এসেছিল, আর বর্ষাকালে পুকুরটা ছিল পানিতে একেবারে ভরাট।
হঠাৎ কি হল - লীনা একবার শুধু অন্যদিকে তাকিয়েছে - ফিরে দেখে, সিয়াম নেই। হাত থেকে থালাটা রেখে চীৎকার করতে করতে লীনা ঘাটের সিড়িতে নেমে পড়ল। সিয়াম ডুবে গেছে, লীনাও সাতার জানেনা, ঘাটটা অব্যবহারে অব্যবহারে অত্যন্ত পিচ্ছিল হয়ে আছে। লীনা এখন কাউকে ডাকতে পারে, কিন্তু সেটুক সময় তার হাতে নেই।
সে অত্যন্ত পিচ্ছিল ঘাটের সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল - নামতে নামতে পানি কোমর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনো সিয়ামকে দেখা যাচ্ছে না। সে আর নামতে সাহস পাচ্ছেনা, তাই পানির ভেতর পাগলের মত হাতড়াতে লাগল এদিক-ওদিক। হঠাৎ কাপড়ের মত কি যেন একটা হাতে লাগল, টান দিতেই সিয়ামের শার্টের রংটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
লীনা ওটা ধরে টান দেবার আগে চোখ বন্ধ করে ফেলল - একটা মুহূর্ত, এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ হবে তা। এই সামান্য একটা মুহূর্ত ঠিক করে দেবে, লীনার পরবর্তী জীবনটা কিভাবে কাটবে।
যদি শার্টটার মধ্যে সিয়াম থাকে, তাহলে সবকিছু আবার এমনভাবে চলতে থাকবে যেন কিছুই ঘটে নি কোনদিন। আর যদি শার্টটার মধ্যে বাচ্চাটা না থাকে!
সেক্ষেত্রে কি হবে তা লীনা চিন্তাও করতে পারেনা।
লীনা শার্টটা ধরে প্রাণপণে টানল। কিন্তু বাস্তবতা মানুষের আশা কিংবা আশংকার ধার ধারে না।
সুতরাং ওটা শুধুই একটা শার্ট ছিল। এরপরের ঘটনা লীনা কিছুই মনে করতে পারে না। হয়তো সে অজ্ঞান হবার আগে চীৎকার করেছিল, অথবা এমনিতেই কেউ চলে এসেছিল এদিকটায়। অথবা হয়তো সে অজ্ঞানই হয়নি, কারণ পরে ও আবছা আবছা মনে করতে পারছিল কিছু কিছু দৃশ্য আর শব্দ। নাকি ওগুলো অজ্ঞান অবস্থার মধ্যে অনুভব করা কোন কল্পনা বা স্বপ্নই ছিল!
ওরা বলেছিল, ওরা দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে জাল দিয়ে খোঁজাখুঁজির পর ওর নিথর শরীরটা খুঁজে পেয়েছিল। লীনা বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু লীনার কাছে সে কয়টা দিনের স্মৃতি বরং কিছুটা স্বপ্নের মত - ছাড়া ছাড়া, অনেকটা অপার্থিব। কিছু কিছু শব্দ সে স্পষ্ট মনেও করতে পারে, কিছু কিছু শব্দ ও দৃশ্য।
কারা যেন বলছিল, খোয়াজ খিজির নিয়ে গেছে।
খোয়াজ খিজির কে?
খিজির একজন ফেরেশতা, যিনি মানুষের বৃহত্তর ভবিষ্যত কল্যানের স্বার্থে মানুষকে বর্তমানে ক্ষতির সম্মুখীন করেন। তিনি একটি সুন্দর বালককে হত্যা করেছিলেন, কেননা সে বড় হলে ডাকাত হত এবং বংশের সবার দু:খের কারণ হত।
এসব কথা কি আসলেও কেউ বলেছিল!
সেরাতে অবশ্য লীনা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নটা দেখেছিল সে গোটা দশেক ঘুমের বড়ি খেয়ে অচেতন হয়ে যাবার পর পরই।
আপাদমস্তক সাদা পোশাকের এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওর বিছানার পাশে। তাঁর চেহারা ছিল অস্পষ্ট, কিন্তু দাড়ি ছিল লম্বা আর তুষারের মত শুভ্র। তিনি লীনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, আর বলছিলেন - তুমি এ ভুল করোনা। শান্ত হও, মা। এভাবে ভেংগে পড়ো না।
লীনা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল - আমাদের কিছুতেই খোদার কিছু আসে যায় না, আমাদের ব্যাপারে কোন তার মাথাব্যথাই নেই।
তুমি দু:খ করে তোমার ছেলেকে ফেরাতে পারবে না, এদিকে হয়তো তোমার ছেলে একসময় এমন কিছু হত যার জন্য তুমি নিজেই তার মৃত্যু কামনা করতে।
তার মানে আমার ছেলে বড় হয়ে খারাপ কিছু হত! কিন্তু তার প্রমাণ কি!
যাহোক, সত্য তো এই যে - একদিন না একদিন সে মারা যেতই।
তাহলে জগৎ সংসারের আর দরকারটা কি?
অবশ্যই দরকার আছে, কিন্তু সেটা কেন তা জানা মানুষের জন্য জরুরী নয়। জবাবদিহিতা মানুষের জন্য, খোদার জন্য নয়।
তাহলে মানুষ কিভাবে দায়ী?
খোদা ন্যায়বিচারক, সুতরাং মানুষ কোন না কোনভাবে দায়ী।
আমি এসব মানি না।
যাই ঘটে, ভালোর জন্যই ঘটে। না, বরং সব ঘটনার মধ্যেই সুপ্ত থাকে ভালো-মন্দ দুই রকমেরই সম্ভাবনা। আর ধৈর্যই কেবল মানুষকে নিয়ে যেতে পারে সেই কল্যানের দিকে, যা অঘটনের মধ্য দিয়ে আসে।
আমি এসব শুনতে চাইনা। আপনি এখান থেকে চলে যান।
তুমি ভালো মেয়ে। আমরা চাইনা, ধৈর্য হারিয়ে তুমি সেই কল্যান থেকে বঞ্চিত হও, যে কল্যানের জন্য তোমাকে এত বড় কষ্ট দেয়া হয়েছে।
তার মানে আপনারাই মেরেছেন আমার ছেলেকে? হায়, হায়, কি দোষ করেছিল আমার এতটুকু বাচ্চাটা?
সে তো বিনা হিসাবে বেহেশতে যাবে, মানুষ এ জীবন থেকে এর চাইতে বেশী আর কি চাইতে পারে!
আমি এতোকিছু বুঝি না। আমি আমার সিয়ামকে ফেরত চাই।
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন - আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বোঝাতে পারব।
বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর লীনা নিজেকে আবিষ্কার করল সেই পুকুরের ঘাটে - ওর হাতে শার্টের মত কিছু একটা লেগে আছে। আর সে এক মুহূর্তের জন্যই চোখ বন্ধ করেছিল - নিজের ভবিষ্যত জানার আগে।
সে কি এতক্ষণ চিন্তা করছিল! এতো অল্প সময়ে কি এতকিছু চিন্তা করা সম্ভব!
লীনা লালচে কমলা শার্টটা ধরে টানল, ভারী কিছু একটা আছে ওটার সাথে। সে আরো জোরে টানল, সিয়ামের পেছনটা দেখা যাচ্ছে। একটানে টেনে তুলে কিছু না ভেবেই পাড়ের দিকে উঠতে শুরু করল সে। ততক্ষণে ওর চীৎকারে বাসার সবাই জড়ো হয়েছে পুকুরঘাটে। না, সিয়াম সুস্থই আছে। সে হাসছে, যেন মজা একটা। ভেতরে পানিও যায়নি সম্ভবত: - আসলে পুরো ঘটনাটা তো ত্রিশ সেকেন্ডের বেশী সময়েরই না।
অবশ্য লীনা এরপর থেকে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। কি ভয়ংকর এক সম্ভাবনা তার মাথায় উঁকি দিয়ে গিয়েছিল এক সেকেন্ডের ক্ষুদ্র ঐ ভগ্নাংশের মধ্যে! মুহূর্তের মধ্যে পুরে দেয়া এক পুরো জীবন যেন সেটা। ভয়ে সে শিউরে উঠল কয়েকবার এই ভেবে - যদি এমন হয় যে ঐটাই বাস্তব, আর এইটাই স্বপ্ন। সেরাতে তাই সে ঘুমাতে যেতে ভয় পাচ্ছিল - যদি ঘুম থেকে উঠে দেখে, তার সিয়াম নেই।
ওর মনে হল, যা ঘটতে পারতো তাও সত্য এক অর্থে - যা ঘটে গেছে তা বাস্তব সত্য, আর যা ঘটতে পারত তাও সত্য তবে অবাস্তব ধরণের সত্য।
সে রাত আধো ঘুম আধো জাগরনের এক অদ্ভুত পালাবদলের মধ্যে কাটল লীনার। তারপর সকাল হল। তারওপর দিন যেতে থাকল। তারপর এ ঘটনাটার কথা সবাই একসময় ভুলে গেল।
সিয়াম আস্তে আস্তে বড় হল, বেশ বড় - ষোল বছর বয়স। কিন্তু কোথায় যেন একটা গন্ডগোল ছিল। এটা ঠিক যে - লীনা আর মিজানের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশী ছিল, আর মিজানও বাসায় খুব একটা সময় দিত না । কিন্তু গোলমালটা এরচেয়েও গভীর কোন ক্ষত থেকে যেন আসছিল।
লীনা আর মিজান পরস্পরকে দোষারোপ করত। মিজান বলত, ছেলে মায়ের মত জেদী হয়েছে। আর লীনা মনে করত, পিতার মধ্যে যা সুপ্ত থাকে সন্তানের মধ্যে তা প্রকাশিত হয়। যদিও ওরা দুজনই বারবার চেষ্টা করেছে ছেলেকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। বেশ কয়েকবারই ওকে নিরাময় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ফিরে আসার পর পুরনো মহলকে এড়িয়ে চলা আসলেও কঠিন।
দিন দিন ছেলেটার অত্যাচার বাড়তেই থাকল। মিজান না দেখার ভান করত। ব্যবসা নিয়ে আরো আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল যেন সে। ফলে লীনার ওপর ছেলেটার অত্যাচার আসলে দ্বিগুনই হয়ে গিয়েছিল। দিন দিন তার চাহিদাও বাড়তে লাগল - জোর করে আলমারী খুলে টাকা নিয়ে যেত, টাকা না পেলে ভাংচুর করত। একদিন সে বাসা থেকে টেলিভিশনটা উঠিয়ে নিয়ে গেল।
লীনা প্রায়ই নিজের মৃত্যু কামনা করত, কয়েকবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছে। একদিন সে চিন্তা করল, যদি শুনত তার ছেলে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে !
এরমধ্যে ওদের কারোরই কিন্তু পুকুরপাড়ের সম্ভাব্য সে দুর্ঘটনার কথা একবারও মনে আসেনি। মনে আসেনি অদ্ভুত সেই কল্পনার কথা, যেখানে অন্য এক জীবনে সে সিয়ামকে হারিয়েই ফেলেছিল।
এভাবেই দিন চলছিল। তারপর একদিন ছেলেটা তার মায়ের গায়ে হাত তুলল। লীনা মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। ছেলে ইতিমধ্যে লাথি মেরে বসার ঘরের চেয়ারটা ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। লীনা অনেকদিন থেকেই ঘুমের ওষুধ খায়। সেদিন একটু বেশিই খেয়ে ফেলল। মৃত্যুর মত গভীর একধরনের ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে অদ্ভুত একটা স্বপ্নের মত দেখল। দেখল - যেন শ্বেতশুভ্র পোশাক পরা একজন বৃদ্ধ তার মাথার কাছে এসে বসেছে। লীনা তাকে ক্ষীণস্বরে যেন পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিল। বৃদ্ধকে কেন যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল ওর।
আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি, মা।
আপনাকে কি আমি চিনি?
মানুষকে বৃহত্তর কল্যানের পথ বেছে নিতে সাহায্য করাই আমার কাজ।
আপনি আর কিভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। ওকে ঠিক করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
খোদার কুদরতে অনেক কিছুই সম্ভব। তুমি মিশরের সুলতানের ঘটনা শোনোনি, যিনি মুহাম্মাদের মিরাজের ঘটনাকে অবিশ্বাস করেছিলেন! শেখ শাহাবুদ্দিন যখন তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য পানিতে মুখ ডোবাতে বললেন, তখন সবাই দেখল তিনি কয়েক সেকেন্ড পরই পানি থেকে মুখ তুললেন, কিন্তু সুলতানের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি পানিতে মুখ ডোবানোর পর চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন অজানা এক রাজ্যে, সাত সাতটি বছর সে রাজ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন, তারপর হঠাৎ আবার সাত বছর পর একদিন মুখ তুলে দেখেছিলেন তিনি বসে আছেন নিজের রাজদরবারে।
কিন্তু কি প্রসংগে আসছে এসব কথা?
কিংবা সেই চীনা যুবকের কথা শোনোনি - যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল সে একটা প্রজাপতি হয়ে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে, তারপর ঘুম থেকে জেগে দ্বন্দ্বে পড়ে গেল যে - সে কি একজন যুবক যে প্রজাপতি হওয়ার স্বপ্নে দেখেছিল, নাকি সে সেই প্রজাপতি যে এখন একটা স্বপ্নের ভেতর একজন যুবকে পরিনত হয়েছে।
তুমি কি চাও না সে জীবন বেছে নিতে, যা খোদা তোমার জন্য মমতা দিয়ে নির্ধারিত করেছেন যদিও সে জীবন আপাতদৃষ্টিতে কষ্টের হয় - সে জীবনের তুলনায়, যাতে খোদার অনুমতি আছে কিন্তু ইচ্ছা নেই!
এ জীবন থেকে আমার আর পাবার কিছু নেই। - লীনা ক্লান্ত স্বরে বলেছিল।
কিন্তু তোমাকে যদি একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তুমি কি সেটা নেবে না?
কি বলছেন আপনি এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। - লীনা অধৈর্য হয়ে উঠছিল।
লীনা আবছা আলোতে দেখল, বৃদ্ধ যেন হাসছেন। অল্প সামনে ঝুঁকে এসে তিনি বললেন - মেয়ে, তুমি কি এই দীর্ঘ দু:স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে চাও না সেই জগতে যে জগতে তোমার ছোট্ট ছেলেটিকে তোমার কোল থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল!
বিষয়: বিবিধ
১৪১৭ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
আপনার গল্পগুলো সবসময়ই ভালো হয়। ভালো লাগলো,লিখবেন নিয়মিত
বহুদিন পর আপনার রহস্য গল্পের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরে আনন্দিত হলাম!
আশকরি বিডিব্লগে আপনার ভিন্ন ধর্মী- আকর্ষনীয়, রহস্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফিকশন লিখাগুলো নিয়মিত পাব!
জাযাকাল্লাহু খাইর!
মন্তব্য করতে লগইন করুন