স্বপ্ন [রহস্য গল্প]
লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ২৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:৩১:১৭ রাত
সন্ধ্যা থেকে টানা তিন ঘন্টা বসে থেকেও কোন রোগী এলো না। আমি অবশ্য সময়টা পড়ালেখা করে কাজে লাগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, যদিও কোনকিছুতেই মন বসছিল না। শেষে আমি যখন উঠে যাবার কথা ভাবছি, ঠিক সে মুহূর্তে লোকটা ঘরে এসে ঢুকল। ঢোকার আগে নক করা সাধারণ ভদ্রতা, সে ভদ্রতাটি লোকটা করে নি।
কোনভাবে সাহায্য করতে পারি? - যথেষ্ট অনীহা নিয়ে প্রশ্ন করি আমি। সে কোন রোগী হলেও আমার কিছু এসে যায় না - বাসায় গিয়ে মাথাধরার দুটা অষুধ খেতে পারলেই তখন বাঁচি আমি।
আমার নাম মিনহাজ, আপনিই তো ডাক্তার রাফিজ ইমতিয়াজ, তাই না? - লোকটা হাতের ব্যাগটা নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল।
আমি মাথা নাড়লাম।
তাহলে আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি - সে সামনের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসল। আমার মনে হল, এর বয়স পয়ত্রিশ কিংবা চল্লিশ হবে। লম্বাটে গড়ন, দেখতে বেশ সুদর্শন।
আমি কিন্তু বেরিয়ে যাচ্ছিলাম - আমি জানিয়ে দিলাম।
স্যরি, ডাক্তার সাহেব, কিন্তু আমার বিষয়টা জরুরী।
ভাই, আমি পুরোপুরি সুস্থ নই - মাথা ব্যথা করছে, যত রাত হবে এটা বাড়বে। আমি সম্ভবত চাইলেও আপনাকে সময় দিতে পারবনা।
সে চুপ হয়ে গেল, তারপর কি ভেবে বলল - তাহলে হয়তো ব্যাপারটার এখানেই শেষ . . .
এখানেই শেষ মানে? - আমি জানতে চাই।
চার বছর হয়ে গেল, কারো সাথে শেয়ার করা হয়নি। আজ হঠাৎ মনে হল আপনার সাথে শেয়ার করি - পৃথিবীতে কেউ একজন অন্তত: জানুক আমার বিষয়টা। কাল হয়তো আবার আমি আগের অবস্থায় ফিরে যাব, কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করবে না। অথবা অদ্ভুত ঘটনাগুলিই বন্ধ হয়ে যাবে।
কৌতূহলের কাছে আমার ক্লান্তি হার মানল, আমি তাকে বসতে বললাম। তারপর ড্রয়ার থেকে দুইটা প্যারাসিটামল নিয়ে একবারে খেয়ে ফেললাম। তারপর দুই মিনিট টানা চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। এই সময়টা মিনহাজ একটা কথাও বলল না।
মিনিট দুই পর চোখ খুলে তাকালাম - সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমার মাথাব্যথা কমার কোন লক্ষণ দেখলামনা, তবু লোকটাকে সময় দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফ্লাস্কে অল্প কিছু চা ছিল, গরম কমে গেছে, সেটাই গ্লাসে ঢালতে ঢালতে জানতে চাইলাম - তা আমার কাছেই কেন?
লোকটা হাসল, অমায়িক সুন্দর হাসি - শুনেছি আপনি অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে কাজ করেন, আমি এমন কাউকে খুজছিলাম যে একইসাথে মানসিক বিশেষজ্ঞ আবার অতিপ্রাকৃত ব্যাপারও বোঝেন। আপনিই একমাত্র লোক যার এমন অভিজ্ঞতা আছে।
আমি হেসে ফেললাম - আপনি ভুল শুনেছেন, আমি অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার একেবারেই বুঝি না। হ্যাঁ, একবার এক স্কিজোফ্রেনিক মহিলাকে নিয়ে কাজ করেছিলাম, পরবর্তীতে সেটার অপব্যাখ্যা করে একটা ভুল কাহিনী কোনভাবে প্রচার হয়। পুরো ব্যাপারটাই অতিরঞ্জন।
ভাই, আমি ভালো করে খোঁজ নিয়েই এসেছি। আপনার কথা জেনেছি এক বছরেরও বেশি হয়, কিন্তু আসার ব্যাপারে মন ঠিক করতে পারছিলাম না।
আমি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি - আচ্ছা, বলুন আপনার সমস্যার কথা।
এটাকে ঠিক সমস্যা বলা যাবে না - মিনহাজ বলতে শুরু করল - আর আমি আসলে এর সমাধানও চাই না। আমি শুধু জানতে এসেছি, এর কোন ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে কিনা।
মাথাব্যাথা নিয়েই আমি মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করি।
আমি একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ার। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কাজ করি। এরা বেতন-টেতন ভালোই দেয়, সবচেয়ে বড় কথা কাজ-কর্মে স্বাধীনতা আছে। পাশ করার পর থেকে দশ-পনর বছর হয় এখানেই আমি কাজ করছি। যাহোক সরাসরি মূল ঘটনায় চলে যাই।
তিন-চার বছর আগে একটা মেয়ে জয়েন করে আমাদের অন্য একটা ডিপার্টমেন্টে। মেয়েটার নাম বিথী। কমবয়সী একটা মেয়ে, মাত্র পাশ করে বের হয়েছে। কেমন যেন একটা বাচ্চা বাচ্চা চেহারা, কিন্তু আটোসাটো কাপড়ে কেন যেন খুব আকর্ষণীয় লাগে দেখতে। আমি প্রথম দিনেই মেয়েটার প্রতি একটা প্রচন্ড আকর্ষণ অনুভব করলাম, মনে হল তাকালে চোখ সরাতে পারব না।
আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি খুব নোংরা মনের একটা লোক - মেয়ে দেখলেই যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আসলে কিন্তু তা না। বরং আমি খুব অমিশুক, মানুষ-জন সাধারণত এড়িয়ে চলি, মেয়েদের আরো বেশি। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে কেন যেন মনে হল - এই মেয়েটিকে আমার চাইই চাই। আমি আপনাকে এটা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না, কারণ এরকম আমার আগে কোনদিনও হয় নি। ভয়াবহ একটা আকর্ষণ, যেন ওকে না পেলে আমার জীবনটাই অর্থহীন হয়ে যাবে . . .
এ পর্যায়ে আমি তাকে হাত দেখিয়ে থামালাম - আপনি কি বিয়ে করেছেন?
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, যেন প্রশ্নটা তাকে আহত করেছে। তারপর কিছুটা নীচুস্বরে বলল - হ্যাঁ, আমি বিয়ে করেছি, আমার একটা মেয়েও আছে - ওর বয়স এখন আট।
স্যরি বাধা দেবার জন্য, এটা আমার জানা দরকার ছিল। হ্যাঁ, আপনি বলে যান।
আপনি ঠিক জিনিসটাই ধরেছেন, বিবাহিত লোক হিসেবে আমার এরকম হবার কথা না। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক আমার মনের ভেতর এটা ঘটছিল। দেখুন, আমার চিন্তা পরিষ্কার - আমার কাজের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ আছে, কিন্তু মনের ওপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার মন যদি অন্যায় কোন চিন্তা করে, খারাপ কোন কিছু চায় - সেক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি তা আমার জানা থাকার কথা না, তাই না?
আপনি কোন দোষ করেন নি - আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম - আপনি যা ভেবেছেন, এরকম আমরা সবাই ভাবি। এটা কোন ব্যাপার না, বরং আপনার সৎসাহস আছে বলেই আপনি নিজের মনের এই অন্যায় আবদারটির কথা স্বীকার করতে পেরেছেন।
সে বোধ হয় একটু স্বস্তি পেল, সে আবার কথা বলা শুরু করল - আপনি যেরকম বলছেন, ব্যাপারটা মোটেই সেরকম সহজ ছিলনা। ওর প্রতি আমার এ আকর্ষন দিনের পর দিন বাড়তে লাগল। আমি একপর্যায়ে আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করা শুরু করলাম, এমনকি একদিন তার রিক্সা ফলো করে তার বাসা পর্যন্ত চলে গেলাম। এগুলো আমার কাজ-কর্মেও যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটাতে থাকল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এগুলিতে আমি নিজের বিবেকের কোন দংশন অনুভব করতাম না - আমার শুধু মনে হত, আমার এ চাওয়ায় অন্যায় কিছু নেই।
তারপর একদিন আমি এমন একটা কাজ করলাম, যা করব বলে কোনদিন কল্পনাও করি নি - পরিচিত একটা দোকান থেকে কিছু ঘুমের ওষুধ কিনে নিয়ে আসলাম, ওরা বলল – এটা বেশি পরিমাণে খেলে মানুষ অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। সে ওষুধটা আমি যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। তারপর ইন্টারকমে বিথীকে ফোন করলাম। স্বাভাবিক কুশল বিনিময়ের পর আমি তাকে আমার রুমে আসতে বললাম, বললাম যে তার পাসওয়ার্ড নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে - সেটা সার্ভারে বসে ঠিক করতে হবে। সে বলল যে সে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। আমি পিয়ন স্বপনকে দ্ইু কাপ চা দিতে বলে দুরু দুরু বুকে বিথীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আমার আসলে নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, আমি ভাবছিলাম - আগে ওষুধ খাইয়ে ওকে অজ্ঞান করি, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।
এটুক বলে সে থামল, তার কপাল ঘেমে উঠেছে। সে একগ্লাস পানি চাইল। আমার কাছে আলাদা কোন গ্লাস ছিলনা, আমি অর্ধেক হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে সেটা নিয়ে দুই ঢোক পানি খেল। সে একটু বিরতি নিচ্ছিল, আমিও তাকে সময় দিলাম। আমি ধারণা করলাম - সম্ভবত ভয়ংকর একজন অপরাধী আমার সামনে বসে আছে, যে একটু পরই তার অপরাধের কথা প্রথমবারের মত পৃথিবীর কাছে স্বীকার করবে।
একটু কেশে সে আবার শুরু করল তার কথা। আমি আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিলাম।
পাঁচ মিনিট না, বিথী এল প্রায় আধা ঘন্টা পর - সে নাকি কি একটা কাজে আটকে গিয়েছিল। এরমধ্যে চা এসে ঠান্ডাও হয়ে গেছে। আমি তাকে বসতে বললাম। পিয়নকে ডেকে আবার চা আনতে বললাম। সে বারবার বলল চা খাবে না, কিন্তু আমি বললাম - এটা টেকনিক্যাল সমস্যা, সময় লাগতে পারে, তাই আমি চা আনতে বলেছি। সে তখন চা খেতে রাজী হল।
সে যখন অপেক্ষা করছিল, আমি কম্প্যুটারের মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে সরিয়ে বার বার তাকে লক্ষ্য করছিলাম - অন্যান্য দিনের মতই আজও সে আটো-সাটো একটা ড্রেস পরেছে, জায়গায় জায়গায় সেটা তার চমৎকার শরীরটাকে জাপটে ধরে আছে। আমার মনে হচ্ছিল - একে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেও আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। তারপর যা হবার হোক, সেটা পরে দেখা যাবে।
এই বলে মিনহাজ আমার চোখের দিকে তাকাল - আপনি অবশ্যই আমাকে একজন ঠান্ডা মাথার ক্রিমিন্যাল ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন ডাক্তার সাহেব, আমি তখন যেন অন্য কোন মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি একজন চিকিৎসক, আর রোগ তো রোগই - আমি আবার তাকে আশ্বস্ত করলাম। সে মাথা নেড়ে আমার কথায় সম্মতি জানাল।
পিয়ন চা নিয়ে আসল, তখন আমি ওকে আমার সিটে বসতে বললাম। মনিটরে তার একাউন্টটা ওপেন করে দিয়ে পাসওয়ার্ডটা চেঞ্জ করতে বললাম। বললাম যে, সিকিউরিটির জন্য এটা করা হচ্ছে। আসলে কিন্তু এটা সে তার কম্প্যুটার বসে থেকেই করতে পারত।
আমার উদ্দেশ্য ছিল - সে যখন পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করতে শুরু করবে, তখন আমি তার কাপে ওষুধটা মিশিয়ে দেব। ততক্ষণে আমি ড্রয়ার থেকে ওষুধটা পকেটে নিয়ে নিয়েছি।
আমি তাকে বসতে দিয়ে নিজে টেবিলের এপাশে এসে বসলাম। বসে তার চেহারার দিকে একবার তাকালাম। মেয়েটা নিশ্চিন্ত মনে কম্প্যুটারে কাজ করে যাচ্ছে। ঠিক তখন আমার মাথার মধ্যে কি যেন একটা ঘটল - আমি এটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না, এটা সাহসের অভাব না, এটা কোন ভয় বা আশংকা না, কেমন যেন প্রচন্ড মন খারাপ করা একটা অনুভূতি।
আমার মনে হল, মেয়েটাকে আমি কি আসলেও এভাবে চাই? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে - না, এভাবে ওকে পেয়ে আমার মনের সাধ মিটবে না। যদি সে নিজে থেকে আমাকে না চায়, আমি কোনদিনই সেরকম আনন্দ পাব না যে আনন্দের জন্য তাকে আমি ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে চাচ্ছি। আর মেয়েটাই বা কি কারণে আমাকে তার জীবনে চাইবে? আমি একজন বিবাহিত পুরুষ, যদ্দূর জানি তারও একটা অ্যাফেয়ার আছে। আমি কোন ক্ষমতাধর লোক না, কোন আকর্ষনীয় ক্যারেকটারও না - এমন কোনকিছুই আমার মধ্যে নেই যে কারণে সে আমার সাথে প্রেম করতে চাইবে। আমি মূর্তির মত বসে ছিলাম ওর সামনে। কখন যেন সে কাজ শেষ করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বলতেও পারব না। আমার শুধু মনে আছে, আমি বিশেষ একটা সেন্টের গন্ধ পাচ্ছিলাম তার শরীর থেকে। আমি তার ঠোঁট দুটো নড়তে দেখছিলাম, কিন্তু সে কি কথা বলছিল তা আমার কানে যাচ্ছিল না।
তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমি আমার চেয়ারে এসে বসলাম। আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। ওষুধের প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করে কি মনে করে আবার ড্রয়ারে রেখে দিলাম যত্ন করে।
সেদিন কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বাসায় চলে এলাম। আমার ওয়াইফ আমাকে দেখে অবাক হল, কিন্তু কিছু বলল না। সারা সন্ধ্যা চুপচাপ বসে রইলাম ড্রইংরুমে আর টিভিতে একটার পর একটা চ্যানেল ঘোরালাম। রাতে বিছানায় যেয়ে ওকে চেপে ধরলাম, কিন্তু মনে হল আমি যেন একটা প্রাণহীন বালিশকে ধরে চাপাচাপি করছি।
অনেক রাত পর্যন্ত ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, তারপর একসময় ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমিয়ে বিথীকে স্বপ্নে দেখলাম, যেন সুন্দর একটা রুমে বসে আমি তার সাথে গল্প করছি। সকালে ঘুম থেকে উঠেও সে স্বপ্নের রেশ লেগে থাকল আমার মনে, যেন সত্যি সত্যিই আমি তার সাথে কোথাও গল্প করছিলাম।
এটুক বলে সে থামল, আমার মনে হল তার কাহিনী শেষ হয়েছে। আমি তাকে তার বিবাহিত জীবনে অশান্তি ঠিক কি নিয়ে সেটা জিজ্ঞেস করলাম।
আমি বিবাহিত জীবনে অসুখী, এটা আপনি কেন মনে করছেন?
এটা আমার একটা ধারণা, আপনার ঘটনা যা শুনলাম তার ভিত্তিতে আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আপনি একবারও আপনার ওয়াইফের নাম বলেননি, প্রথমে এটাও বলেননি যে আপনি বিবাহিত। কনজুগাল লাইফে সমস্যা থাকলে মানুষ এমন করে থাকে।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল - আমি বিয়ে করেছি বাইশ বছর বয়সে, প্রেমের বিয়ে। সবকিছু ঠিকই ছিল, কিন্তু বিয়ের আগে আমি ওর একটা সমস্যা ধরতে পারিনি। বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যে সেটা টের পাই। সে কথায় কথায় আমাকে সন্দেহ করত। আমি জানি, মেয়েরা তাদের হাজব্যান্ডের ব্যাপারে একটু সন্দেহপ্রবণ হয় - কিন্তু ওর ব্যাপারটা ছিল বাড়াবাড়ি। নিছক সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে সে ঘর-বাড়ি মাথায় তুলত চিল্লাচিল্লি করে। সন্দেহের তালিকায় আমার খালাতো বোন থেকে শুরু করে কাজের বুয়া পর্যন্ত সবাই ছিল।
সে যখন এগুলি নিয়ে কথা বলত, আমি মনে মনে খুব অপমান বোধ করতাম। আমার খুব খারাপ লাগত এটা ভাবতে যে আমাকে নিয়ে এতো কুৎসিত সব চিন্তা করছে কেউ। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমার সেই বিরক্তি আমি প্রকাশ করতে পারতাম না। চীৎকার করে করে একসময় যখন তার মাথা ঠান্ডা হয়ে যেত, তখন সে হঠাৎ করেই আবার খুব ভালো হয়ে যেত। তখন তার মত ভালো মানুষ আর হয়ই না, কিন্তু আমার মনের ভেতর বিরক্তিটা থেকেই যেত আর ভেতরে ভেতরে আমাকে কুরে কুরে খেত। দিনের পর দিন এসব ঘটেছে, অনেকবারই মনে হয়েছে যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাই, কিন্তু যেতে পারিনি - যেতে পারিনি মেয়েটার কথা চিন্তা করে। মেয়েটার জন্য আমার কেন যেন খুব মায়া হত।
এটা শুধু আপনার জীবনেই ঘটছে তা কিন্ত না - আমি তার কথার মাঝখানে বললাম - অনেক পরিবারই টিকে থাকে শুধু বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে। আর আপনার কথার ভেতরেই কিন্তু আপনার সমস্যাটির প্রায় পুরো ব্যাখ্যা রয়ে গেছে।
সে কথা বন্ধ করে আমার চোখে চেয়ে থাকল। আমি বলে চললাম - আপনি বিবাহিত জীবনে একজন অসুখী মানুষ, সে যার দোষেই হোক না কেন। আপনি দিনের পর দিন একটা সম্পর্ক মেনটেন করেছেন সম্পর্কটির প্রতি কোনরকম শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া। ফলে আপনার মন ছিল বিকৃতি বা বিকারের উর্বর ক্ষেত্র, আপনিতো লাকি যে সেদিন আপনি কোন দুর্ঘটনা ঘটাননি। যেকোন ধরণের অপরাধ ঘটা সেদিন খুবই সম্ভব ছিল। আর আপনি যে স্বপ্নটি দেখেছেন সেটাই প্রমাণ করে যে আপনি মেয়েটির মধ্যে কি প্রচন্ডভাবেই না মুক্তি খুঁজেছেন।
বিথী ছিল আপনার একটা অবসেশন, ভাগ্য ভালো এটা আপনাকে কোন ক্রাইমের দিকে নিয়ে যায় নি। আপনার বিবাহিত জীবনের হতাশা আপনাকে ডেসপারেট করে তুলেছিল। এটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এরকম হতে পারে। আর এই হচ্ছে আপনার ঘটনার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।
কিন্তু আসল ঘটনা তো আমি এখনো শুরু করিনি - সে গম্ভীর মুখে বলে।
আমি নড়ে-চড়ে বসি, আমার মাথাব্যথাটা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। তখন সে তার কাহিনী আবার শুরু করে।
আপনাকে যে স্বপ্নটার কথা বললাম, বিথীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সেটাই আমার শুরু। এরপর বহুবার বিথীকে স্বপ্নে দেখেছি আমি, সবরকম অবস্থায়। কিন্তু সেগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেইনি, ভেবেছি মনের অপূর্ণ ইচ্ছা থেকে এসব দেখছি আমি। কিন্তু যেদিন অফিসের আরো কয়জন কলিগের সাথে মেয়েটার বাসায় দাওয়াতে গেলাম, সেদিন তার বাসায় একটা জিনিস দেখে আমি বেশ অবাক হলাম।
আপনাকে বলেছি যে, যেদিন প্রথম আমি বিথীকে স্বপ্ন দেখি সেদিন একটা ড্রইংরুম দেখেছিলাম - যেন একটা ড্রইংরুমে বসে আমরা গল্প করছি। আমার স্মৃতিশক্তি মোটামুটি প্রখর। বিথীদের বাসায় যেদিন দাওয়াত খেতে গেলাম, ড্রইংরুমটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। আশ্চর্য, স্বপ্নে আমি ঠিক এই ড্রইংরুমটাই দেখেছি। আমি আগে কোনদিন বিথীদের ড্রইংরুম দেখিনি, এমনকি কোন ছবিতেও না। তাহলে স্বপ্নে আমি হুবহু একই ড্রইংরুম দেখলাম কিভাবে?
এর কোন ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই নি। তবে সেদিন বাসায় ফিরে আমি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভাবলাম। আমার মনে পড়ল, বিথীকে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো আমি এতোদিন ধরে দেখেছি সেগুলোর মধ্যে পরিষ্কার একটা সিকোয়েন্স ছিল। যেমন, প্রথমদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম ড্রইংরুমে বিথীর সাথে বসে গল্প করছি। পরেরবার দেখলাম যেন কোথাও বেড়াতে গেছি, ঢাকার বাইরে কোথাও, কোন একটা গ্রুপের সাথে। তারপর মাস তিনেক পরের একটা স্বপ্নের কথা বলি, যেন কোন একটা বাসায় ওর সাথে আমি একা - অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। যেন একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, দিন-ক্ষণ হিসাব করে করে।
এখনো কি এরকম দেখেন?
লোকটা হাসল - এখন তো ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট। আমি প্রতিদিন ওকে স্বপ্ন দেখি। ব্যাপারটা বলতে গেলে এরকম - আমি রাতে কাজ সেরে বাসায় এসে শুয়ে পড়ি, আর তখন ঘুমানোর পরই আমার আরেকটা জীবন শুরু হয়ে যায়। আর জানেন, আমার সে জীবনটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট - সেখানে পরিষ্কার ঘটনা আছে, সেখানে আমার একটা চাকরী আছে, বাসা আছে। একেকদিন একেক বাসা না, যেরকম সাধারণ স্বপ্নে ঘটে থাকে। এ স্বপ্নগুলোতে আমার বাসাটা প্রতিদিন একই বাসা। বাসার জন্য আজ রাতে যদি একটা ফুলদানি কিনি, পরেরদিনের স্বপ্নে সেটাকে আমি আমার স্বপ্নের বাসাটার কোথাও না কোথাও সাজানো দেখব। ঘটনাগুলো সব একের পর এক ঘটছে, যেন আরেকটা জীবন আমার . . .
কত বছর হয় আপনি এই স্বপ্নগুলো দেখছেন?
তিন-চার বছর তো হবেই। মজার ব্যাপার কি জানেন, আজ রাতে আমি যে স্বপ্নটা দেখব বিথীকে নিয়ে সেখানে তার সাথে আমার এনগেজমেন্ট হবার কথা। ফানি, তাই না?
আমি চুপ করে শুনছিলাম।
আপনার কাছে এর কোন ব্যাখ্যা আছে?
আমি একটু সময় নিয়ে তারপর বললাম - থিওরেটিক্যালি এটা অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু বাস্তবে এরকম ধারাবাহিক স্বপ্ন দেখার ঘটনা আমার জানা নেই। যাহোক, যেহেতু এটা আপনার কোন ক্ষতি করছেনা বা আপনার স্বাভাবিক জীবনকে কোনভাবে ব্যাহত করছে না, সেহেতু এটাকে আমি আসলে কোন সমস্যাও বলতে পারছিনা। আর যেহেতু এটা কোন মানসিক সমস্যা না, সেহেতু এখানে ডাক্তার হিসেবে আমার কোন ভূমিকা আছে বলেও আমি মনে করি না।
আমিও এটাকে কোন সমস্যা বলে মনে করছি না - সে বলল।
আমি লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ এই অস্বস্তিকর অবস্থা চলার পর লোকটা উঠে দাঁড়াল - তবে যাবার আগে একটা জিনিস আপনাকে বলে যাব, যেটাকে আপনি হয়তো থিওরেটিক্যালি সম্ভব বলে দাবী করতে পারবেননা।
আমি একইভাবে তাকিয়ে রইলাম।
সে টেবিলের ওপর ভর দিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল - আমি স্বপ্নের বিথীর কাছে তার একটা গোপন কথা জেনেছিলাম। গোপন কথাটা হল, সে ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পিঠে ব্যথা পেয়েছিল, পিঠে একটা দাগ এখনো রয়ে গেছে। আমি সত্যি সত্যি একদিন বিথীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সে ছোটবেলায় কখনো পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল কিনা।
বলে লোকটা থামল। আমি জানতে চাইলাম - তা উনি কি বললেন?
বিথী বলেছে সে আসলেও এরকম ব্যথা পেয়েছে, এমনকি তার পিঠে এখনো এর দাগ রয়ে গেছে। সে আমাকে এও জিজ্ঞেস করেছিল, আমি এটা জানলাম কি করে?
তা আপনি তখন কি বললেন?
লোকটা হেসে উঠল - আমি হেসে বলেছিলাম আমি স্বপ্নযোগে এটা জেনেছি, সে অবশ্য তামাশা ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সে কথা। সে ধরেই নিয়েছিল আমি অন্য কোন কলিগের কাছ থেকে এটা জেনেছি, বা সে নিজেই কখনো নিজের অজান্তে বলেছে সে কথা।
আমি চুপচাপ তার কথা শুনলাম, কিছু বললাম না।
জানেন ডাক্তার সাহেব, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন। আমার শুধু একটাই ভয়, যদি স্বপ্নটা দেখা কোনদিন শেষ হয়ে যায়! আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব, এটা কি সম্ভব - আমাদের আত্মা ঘুমের মধ্যে অন্য কোন পৃথিবীতে চলে যায়? সে পৃথিবীটাও সত্যি, এ পৃথিবীটার মতই? নরমালি আমরা একেকদিন একেক পৃথিবী দেখি স্বপ্নে, কিন্তু কোন কারণে আমি একটা পৃথিবীতেই চলে যাচ্ছি প্রতিদিন?
আপনি আপনার চমৎকার একটা স্বপ্নকে সত্যি মনে করতে চাচ্ছেন, আর আসলে আমার কাছে এসেছেন যাতে আমি আপনার সেই চিন্তাটাকে সাপোর্ট করি - আমি শান্তভাবে বললাম - কিন্তু দু:খিত, মিনহাজ সাহেব, এ ধরণের কোন আশ্বাস দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি একজন মনের ডাক্তার, আত্মার ব্যাপার-স্যাপার আমার কাজের বিষয় নয়।
লোকটা কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর উঠে পড়ল। বের হবার সময় কোনরকম বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত করল না। আমি মনে মনে হাসলাম - আমি তাকে কিভাবেই বা সাহায্য করতে পারি? আমি শুধু মনে মনে প্রার্থণা করলাম, তার এই স্বপ্ন দেখা যেন চলতে থাকে - যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, এটা অন্তত তাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য তো করছে।
বাইরে তখন কোথা থেকে যেন অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
২১৯৬ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পিলাচ
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন