সমাপ্তি [রহস্য গল্প]
লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ০১ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:৩৫:০৭ রাত
অয়ন খান
১
ঝিরি ঝিরি বাতাস বইছে। চারিদিকে তখনো বেশ অন্ধকার। মামুন একা দাঁড়িয়ে ছিল ছাদে।
ওর একটু অস্বস্তিই লাগছিল, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে একজন আধুনিক যুগের মানুষ হয়েও শুধু একটা স্বপ্নের কথা চিন্তা করে সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর বিশেষ একটা ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে।
অবশ্য স্বপ্নের ঘটনাটা একটু অদ্ভুতই - পর পর তিনদিন সে একই স্বপ্ন দেখল, হুবহু একই স্বপ্ন।
বিশাল একটা আগুনের চক্র, যেটার একপাশ চলে গেছে মেঘের ওপর - এরোপ্লেনের গতিতে বা তার চেয়েও বেশি জোরে ওটা এগিয়ে আসছে। ওটার পথের ওপর যা কিছু পড়ছে সমস্ত কিছু জ্বালিয়ে ছাই করতে করতে ওটা এগিয়ে আসছে - এগিয়ে আসছে ওর দিকেই। কিন্তু মামুনের কেন যেন কোন ভয় লাগছে না, নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে সে অবাক বিস্ময়ে দেখছে এ জগতের সমাপ্তিকে। শিশুর সারল্য নিয়ে সে একসময় চীৎকারও করে উঠল - কেয়ামত, কেয়ামত। সে এমনকি একবার হাতঘড়িটাও দেখে নিল - জুন মাসের ঊণত্রিশ তারিখ ২০১২ সাল, ভোর পাঁচটা সাত। ঠিক তখনই সেই আগুনটা ওর মাথার ওপর চলে আসলো। এটাই তাহলে সবকিছুর শেষ!
প্রতিবার স্বপ্নের ঠিক এ পর্যায়েই মামুনের ঘুম ভেংগে গেছে।
এমনিতে স্বপ্নটা দেখায় অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই, এমন একটা স্বপ্ন যে কেউই যেকোন সময় দেখতে পারে - মনের খেয়ালে। মামুনকে যে কারণে ওটা ভাবিয়ে তুলেছিল, সেটা হল পর পর তিনদিন সেটা দেখা। অবশ্য তারপরও বলা যায় না যে এর অর্থ জুন মাসের ঊণত্রিশ তারিখে সত্যি সত্যিই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। কই, আর কেউ তো এমন স্বপ্ন দেখল না! আর এমনও তো না যে, সে কোন বুযুর্গ ব্যক্তি - তাকে খোদা আগে আগে স্বপ্নটা দেখিয়ে দিয়েছে, যাতে সে ভালো লোকদেরকে সাবধান করতে পারে।
নাকি এ শহরের আরো অনেকেই এরকম স্বপ্ন দেখেছে, আর ওরাও তারই মত কাউকে বলতে পারেনি সেটার কথা - দ্বিধার কারণে! নিজের অজান্তেই মামুন আশেপাশের ছাদগুলোর দিকে তাকালো, তার মত কেউ কেউ একইভাবে অপেক্ষা করছে কিনা। তেমন কাউকে অবশ্য আশেপাশে দেখা গেল না, শুধু দূরে একটা নি:সংগ কুকুর করুণ সুরে ডাকতে লাগল।
এই পৃথিবীটা কিন্তু রহস্যে পূর্ণ। বিজ্ঞান নিজেই কি কম রহস্যের! সে কয়েকদিন আগে ফিসিক্সের একটা বিশেষ শাখার ওপর পড়াশোনা করছিল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে যে এই পৃথিবীটা কিরকম হবে সেটা দর্শকের ওপর নির্ভর করে। তুমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছো বলেই চাঁদটা আছে। তুমি যদি এর দিকে না তাকাও - তাহলে চাঁদ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। এটা কিন্তু কোন ফ্যান্টাসির কথা নয, এটা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। মোটকথা, আমি দেখি বলেই জগত সংসারের অস্তিত্ব আছে, আমি না দেখলে হয়তো এ জগতও থাকত না। কি অদ্ভুত কথা!
সে এসেছে ভোর চারটার দিকে, মসজিদে মসজিদে তখন ফজরের আজান দিচ্ছে কেবল। একবার মনে হল, নামাজটা পড়ে আসা উচিত ছিল। যদিও সে নিয়মিত নামাজ পড়ে না, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা - কে জানে, সত্যিই যদি আজকে কেয়ামত হয়ে যায়, তাহলে একটা ভালো কাজ দিয়ে জীবনটা শেষ হত।
তখনি আবার তার মনে হল, আসলে সে মনের গভীরে বিশ্বাস করে না যে আজ কেয়ামত হবে। যদি বিশ্বাস করতই, তাহলে সে এখানে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতনা - ওর অবস্থা হত ফাঁসির কাঠের সামনে দাঁড়ানো আসামীর মত, ভীত-বিহ্বল।
প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে। এখনো কোনদিকে কোন আলোড়ন দেখা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে ওর নিজেকে একটু বোকা বোকাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা নিয়ে সে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে।
বাড়াবাড়িই তো - সে ফখরুলকে বলল, বাবাকে ফোন করে জানালো। এমনকি গতকাল সন্ধ্যায় তাদেরকে ব্যাপারটা মনেও করিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য! নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে এখন।
ওদের কেউই অবশ্য এটা বিশ্বাস করে নি। ফখরুল ওর ছোটবেলার বন্ধু, হেসে বলেছে তাকে মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
ফখরুল সফল একজন ব্যবসায়ী। সে তুলনায় মামুন তেমন কিছুই করে না। বড় ফার্নিচার কোম্পানীর একটা আউটলেটে ম্যানেজার ছিল কয়েকদিন, শেষপর্যন্ত সে কাজটাও টেকাতে পারল না। ছোটবেলার বন্ধুত্বটা টিকে আছে, তারপরও কেয়ামতের ভবিষ্যদ্বানী করে বেড়ানোটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। নিজের ওপর চরম বিরক্তি নিয়ে সে সিড়িকোঠার দিকে পা বাড়ালো।
ঠিক তখনই তার কাছে ধরা পড়ল জিনিসটা। চারিদিকে কিছু একটা ঘটছে - খুব নীরবে সেটা ঘটে চলেছে বলে কি ঘটছে সেটা প্রথমেই বোঝা যায় না, কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায় ঘটনাটা। পশ্চিম দিকটায় ভালো করে তাকিয়ে ওর বিস্ময়ের সীমা রইল না, যখন সে বুঝতে পারল - একটা একটা করে তারা ভোরের আকাশ থেকে মুছে যাচ্ছে।
একটা তারা মানে একটা নক্ষত্র, হয়তো সে নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে একশগুণ বড়। সেরকম একটা নক্ষত্র মুহূর্তের মধ্যে মুছে যাচ্ছে আকাশের বুক থেকে, যেন কোনদিন সেটা আকাশে ছিলই না।
তারাগুলো উধাও হচ্ছে দূরতম নক্ষত্র থেকে শুরু করে। মহাকাশের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে এ মহাধ্বংস, একটু একটু করে ক্রমশই পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসবে সেটা।
আলোর সহস্রগুণ বেশি গতিতে এগিয়ে আসছে সর্বগ্রাসী এক অন্ধকার।
মামুন রূদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগল ভয়ংকর সুন্দর এ অপার্থিব দৃশ্য।
২
বাড়িওয়ালার কাজের মেয়ে প্রথম দেখতে পায় লাশটা। পরে যথাক্রমে ডাক্তার এবং পুলিশ আসে। স্বাভাবিক মৃত্যু, সম্ভবত হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।
একসময় মামুনের আত্মীয় স্বজন আসে, আসে ওর ছোটবেলার বন্ধু ফখরুলও। ফখরুল শুধু নিজের মনে বিড় বিড় করে বলল - অথচ সে ভেবেছিল, ঊণত্রিশে জুন সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে।
আসলে প্রত্যেকের জীবনই আলাদা। একজন মানুষ তার জীবনকে উপলদ্ধি করে মাত্র পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে, আর এভাবে তার জীবনটা যাপিত হয় মূলত তার মষ্তিষেকের ভেতরই। ফলে কে কিভাবে জীবন কাটাল আর কিভাবেই বা মারা গেল সেটা অন্যদের পক্ষে কোনদিনই পুরোপুরি জানা সম্ভব হয় না।
বিষয়: বিবিধ
২২২৫ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা প্রত্যেকেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ঘোরে অনুভুতির স্বাদ নিই। সেই সাথে আল্লাহকে সবসময় স্মরণ করা দরকার। যাতে অনুভূতি সতেজ থাকে এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সঠিক সময়ে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
রহস্য সমাপ্তি ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন