সিম্যুলেশন [বিজ্ঞান কল্পকাহিনী]
লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:২৮:৩৯ রাত
রাকিবের ভেতর ইদানিং একটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা হঠাৎ করে আসা কোন কিছু নয়, এটা হয়েছে আস্তে আস্তে অনেকদিন ধরে। কিন্তু সম্ভবত: পরিবর্তনটা স্থায়ী।
অল্পবয়সেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছিল রাকিব। পাশ করার পর সাথে সাথে প্রাইভেট একটা ফার্মে ভালো একটা চাকরী পেয়েছিল। এখন পর্যন্ত চাকরীতে ভালোই করছে সে, প্রোগ্রামার হিসেবেও শহরে যথেষ্ট সুনাম আছে তার। বছর চারেক আগে চমৎকার একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে সে, বিবাহিত জীবনেও সে সম্পূর্ণভাবে সফল ও সুখী। একটা মেয়ে আছে তার, দু’বছর বয়স - মেয়েটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু রাশেদের।
কিন্তু মানুষকে বাঁচার প্রেরণা দেয় তার প্রয়োজন, তার আকাংখ্যা। রাকিবের আকাংখ্যার সবই মোটামুটি সে পেয়ে গিয়েছিল। ফলে তার মধ্যে কিছুদিন যাবতই দেখা যাচ্ছিল একধরণের উদাসীনতা। প্রত্যেকটা দিন আসে একই ভাবে একই ছন্দে, সবকিছু ঘটে চমৎকারভাবে - যেভাবে সে চেয়েছিল। দুর্ঘটনাহীন এ জীবনকে তার খুব বেশীরকম নির্ভুল নিষ্কন্টক মনে হচ্ছিল। একপর্যায়ে তার এরকমও মনে হতে লাগল - এ জগৎটার কোথাও কোন সমস্যা আছে, নাহলে এটা তার জন্য এতোটা সুন্দর সাবলীল দুর্ঘটনাশূণ্য হতো না।
কিন্তু রাকিব কিছুতেই ধরতে পারছিল না, সমস্যাটা ঠিক কোথায়। ফলে সন্ধ্যার রাস্তায় রিক্সা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে হতাশায় তার মনটা ভরে যেত। কিন্তু এক সোমবার বিকেলে হঠাৎ করেই ওর জীবনের মোড় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে গেল।
রাকিব চাকরীর পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও কিছু কিছু প্র্রোগ্রামিংযের কাজ করত - অনেকটা কন্সাল্টেন্সির মত। সে বিকেলে এক ভদ্রলোক তার সাথে দেখা করল অফিসে, নিজেকে সে মনজুর বলে পরিচয় দিল। সে জানাল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি বিষয় নিয়ে তাকে একটা প্রোগ্রাম লিখে দিতে হবে। সে বাজারে রাকিবের সুনাম শুনেছে এবং তার বিশ্বাস একমাত্র রাকিবই এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারবে।
রাকিবের কাছে প্রস্তাবটা একটু অদ্ভুত মনে হল, কিন্তু কোন একটা অজানা কারণে সে লোকটার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। কথা হল, পরের শুক্রবার ঐ লোকের সাথে তার বাসায় কথা হবে।
রাকিব যথারীতি সেই শুক্রবার বিকেলে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ঐ লোকের বাসায় উপস্থিত হল। একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের তিনতলায় অফিস কাম বাসা ভদ্রলোকের। নক করামাত্র মনজুর সাহেব নিজেই এসে দরজা খুলে দিলেন। রাকিব ভেতরে গিয়ে বসল।
কিছু মনে করবেন না, তেমন আতিথেয়তা করতে পারছিনা, এখানে আমি একাই থাকি। - উনি বললেন।
তা আপনার প্রজেক্টটা কি? - রাকিব সরাসরি প্রসংগে চলে এল।
ভদ্রলোক বসলেন।
বলব, কিন্তু তার আগে আমার লম্বা একটা কাহিনী মন দিয়ে শুনতে হবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ওটার সাথে আপনার এখানকার ভূমিকাটা প্রাসংগিকই হবে। আচ্ছা, আপনি কি বাগ তৈরী করতে পারেন? এমন বাগ যা একটা পুরো প্রোগ্রামকে ধ্বসিয়ে দিতে পারে?
রাকিব শখের বশে এ ধরণের প্রোগ্রাম তৈরী করেছে। কিন্তু সে একজন ভদ্রলোক, সুতরাং এগুলো ব্যবহারের কথা চিন্তাও করেনি কখনো।
দেখুন, কোন আইনবিরোধী কাজে আমি নেই। - রাকিব তাকে জানিয়ে দিল।
লোকটা হাসল - আপনার এই আইনটা প্রয়োগ হবে কোথায়?
কেন? সমাজে!
আর যদি কোন কারণে সমাজটাই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়? - সে কথাগুলো বলছিল নাটকীয় ভংগীতে। হতে পারে তার ইচ্ছা ছিল তার কাহিনী শোনার ব্যাপারে রাকিবের আগ্রহ বাড়ানো।
আমার হাতে সময় অল্প। - রাকিব বলল।
ভদ্রলোক তাঁর কাহিনী শুরু করলেন।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও একটা সিম্যুলেশন প্রোগ্রাম তৈরির কাজে জড়িত ছিলাম। কোম্পানীর ডাইরেক্টার ছিলাম আমি আর আমারই এক বন্ধু - মামুন। আমাদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল দুই হাজারেরও বেশি প্রোগ্রামার। বুঝতেই পারছেন, খুব বড় ধরণের প্রজেক্ট ছিল ওটা। আসলে জার্মান সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের স্পন্সর করা প্রজেক্ট ছিল ওটা, আমরা শুধু আমাদের আইডিয়াটা নিয়ে কাজ করছিলাম। গবেষণার ব্যাপারেও চূড়ান্ত স্বাধীনতা ভোগ করেছি আমরা।
এই প্রোগ্রামটার জন্য আমাদের টিমটা পুরো পনরটা বছর প্রচুর খাটা-খাটুনি করেছি - সংসার ধর্ম সব ভুলে ছিলাম আমরা। আর এখন এই প্রজেক্ট পুরো মানবজাতির গর্ব। সিম্যুলেশনটা এমন যে, এটা বাস্তবের একটা সম্পূর্ণ মডেলকে পুরোপুরি তুলে আনবে একটা সুপার কম্প্যুটারে। তারপর যে কেউ শেয়ার করতে পারবে ঐ জগৎকে। এমনকি এতো পারফেক্ট সে সিম্যুলেশন যে, দর্শকের মনে হবে - সে ঐ জগৎটার মধ্যেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। সে সম্পূর্ণভাবে অনুভব করতে পারবে একটা ত্রিমাত্রিক জগৎকে। তাছাড়া সে অনুভব করবে স্পর্শ, গন্ধ, বর্ণ, ধ্বণি, স্বাদ - মস্তিষ্কে সরাসরি যুক্ত একটি ইন্টারফেসের মাধ্যমে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই ইন্টারফেসটিই আমার ডেভেলপ করা, আর এটাই এই সিম্যুলেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিউরোফিসিসিস্ট হিসেবে এটা যেকোন যুগে যেকোন পর্যায়ের গবেষকের জন্যই ঈর্ষনীয় একটা সাফল্য। কারণ ত্রিমাত্রিক সিম্যুলেশন মডেল হাজার হাজার তৈরী করা সম্ভব, ওটার ভেতর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের একটি স্বাধীন মানুষকে মডেল করে বসানোও সম্ভব - ঠিক যেমন করে গাড়ীর গেমে একটা নির্দিষ্ট রাস্তায় প্লেয়ারের গাড়ীটিকে বসানো হয়, কিন্তু কোন একটা মডেলের ভেতর নিজেই প্রজেক্টেড হয়ে সেই মডেলের মত ঐ জগতের সমস্ত কিছু অনুভব করা - সেটা আমার ইন্টারফেস ছাড়া সম্ভব না।
পনরটি বছর জীবন থেকে কিভাবে চলে গেল, টেরও পেলামনা। অবশ্য আফসোস করিনা, যখন ভাবি - আমি বাকী জীবনটা কাটাব নানা রকম সিম্যুলেশনের ভেতর বিচিত্র জীবন-যাপন করে।
যাহোক, সিম্যুলেশনটায় আমার অবদানের কথা সবাই স্বীকার করত। সুতরাং ওরা যখন আমাকে এটার প্রথম পরীক্ষামূলক সাবজেক্ট হতে অনুরোধ করল, আমি অবাক হইনি। ওরা আমার উৎসাহের কথা জানত।
পরীক্ষামূলক রাইডের দিন যথারীতি একটি বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে আমার বিশেষ কয়েকটি নার্ভ সেন্টারে কম্প্যুটার ইন্টারফেসটা যুক্ত করতে শুরু করল সার্জিক্যাল স্পেশালিস্ট রোবট। সূক্ষ্ম কতগুলো তার ঢুকে গেল আমার মাথার বিভিন্ন অংশ দিয়ে। সার্জারীর এ অংশটা শেষ হল বিনা ব্যথায়। আমি দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী অংশটার জন্য।
এক মুহূর্তের জন্য আমি সুইচবোর্ডে লাল একটা আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম। আমার মাথার ভেতর মনে হল ছোট-খাটো একটা বিস্ফোরণ হল। এরপরই আমার চোখের সামনে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার। মুহূর্তের জন্য আমি প্রবেশ করলাম আলোহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, শব্দহীন অসীম শূণ্যতার এক পৃথিবীতে। কিন্তু এরপরই আবার চোখের সামনে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো, বদলে গেল দৃশ্যপট।
একটি হোটেল বহুতল - তার চার কিংবা পাঁচতলার ব্যালকনিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি। একেবারে পাশেই সমুদ্র - সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি, আর সমুদ্রের লোনা বাতাস আমার চোখে-মুখে এসে লাগছিল। তখন চমৎকার সূর্যাস্ত হচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে - কমলা গোলাপি রং মেশানো গো-ধূলি আলো চারদিকে। আকাশ লালচে, সমুদ্র লালচে, লালচে হয়ে উঠেছে বারান্দার সাদা দেয়াল। আমি রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে নিচের দিকে তাকালাম। তখনই মনে হল পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে দেখলাম, লীনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমরা কথা বলছিনা, যখন ওর খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
হঠাৎ হারিয়ে গেল পুরো ঘটনাটা। আবার চোখের সামনে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার। মুহূর্তের জন্য আমি প্রবেশ করলাম শূণ্যতার এক পৃথিবীতে। এরপর আবার চোখের সামনে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো, অন্য একটি দৃশ্যপট।
পাহাড়ঘেরা ছোট্ট একটা জায়গা নির্জন। একটা জলার ঠিক মাঝখানে একটা বড় পাথরের ওপর বসে আছি আমি। সবুজ জলের ভেতর পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ছে সবুজ ঝরনা। ঝরনার ঝর ঝর শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি, পানির ঝাপটা এসে লাগছে গায়ে। জলাটা খুবই ছোট, আর বেরোবারও কোন পথ দেখা যাচ্ছেনা - এক আশ্চর্য শীতল একাকীত্ব। মনে হয় যেন চিরদিন এখানে আটকে আছি আমি - এ নিসর্গ কারাগারে।
হারিয়ে গেল এ দৃশ্যটাও। আবারও নেমে এলো অন্ধকার। শূণ্যতার এক অদ্ভুত অনুভূতি।
যখন জেগে উঠলাম, ঘরটা প্রথমে ঘোলাটে লাগছিল। দেখলাম, ওরা কয়েকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কেমন লাগছে? - কে যেন জিজ্ঞেস করল।
আমি কথা বলতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। মনে হল, জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আছে। ওরা আমাকে ধরাধরি করে পাশের ইন্টেনসিভ কেয়ার বেডে নিয়ে গেল। এ পর্যায়টা আমার জানা আছে, আমাকে এখন কড়া সিডাকটিভে টানা ছয় ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
পরদিন মামুনের সাথে দেখা হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, লীনার চেহারা ঢোকানোর আইডিয়াটা ওরই কিনা। মামুন মুখ টিপে হাসতে লাগল। ও ছাড়া আর কেউই এখানে লীনার কথা জানে না।
অবশ্য গতকাল আমি যে কয়টা অংশ দেখেছি, সেগুলো কয়েকটা ডেমো ভার্সন মাত্র। আমাদের আসল প্রোগ্রামটা অনেক বেশি জটিল। সেখানে সম্পূর্ণ একটা জগৎ আছে এবং আছে একটি শহরের সবগুলো প্রক্রিয়া, আছে এক হাজারেরও বেশি অধিবাসী এবং তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। শুধু এটা তৈরি করতেই আমাদের দশ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। এই শহরটির নাম দিয়েছিলাম আমরা ‘পৃথিবী’।
মামুনের কৃতিত্ব হল, সিম্যুলেশনের ভেতর যতগুলি মানুষের চরিত্র সে তৈরী করেছে - তার প্রতিটাই প্রোগ্রামের ভেতরের সেলফ অ্যাডাপটিভ অংশ। এরা শিখতে পারে এবং মেমোরি সেলে এদের যে অভিজ্ঞতা যোগ হয় তা থেকে এরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর ফলে অনেক মানবিক হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলো, প্রায় মানুষের মতই চিন্তা-ভাবনা করতে পারে তারা।
অবশ্য এতো জটিল একটি সিস্টেম না করে আরেকটা কাজ করা যায়, আমার ইন্টারফেসটা এক হাজার মানুষের মস্তিষ্কে বসিয়ে দেওয়া যায়, তাতে তারা সরাসরিই এই গেম খেলার কাজটি করতে পারত। কিন্তু তারওপর আমাদের মাথায় এলো আরো চমৎকার একটি সমাধান। আমাদের প্রয়োজন ছিল এক হাজারটি মস্তিষ্ক - তো সে মস্তিষ্ক যে জীবিত মানুষেরই হতে হবে এমনতো কোন কথা নেই। শুধু দরকার বিশেষ ব্যবস্থায় শারীরিক মৃত্যুর পরও মস্তিষ্কগুলোকে কৃত্রিমভাবে জীবিত রাখা।
আমরা এক হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক পেয়েছিলাম। এদের বেশিরভাগই ছিল বিভিন্ন বয়সের রোগী, যাদের মৃত্যুর কথা ডাক্তাররা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন - আর এদের সবাই আমাদের সফটওয়্যারের ভেতর বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। তাছাড়া কিছু সাধারণ মানুষও ছিল - লীনার মত। বিশেষ ফ্লুইডে বিশেষ ব্যবস্থায় এখনও মস্তিষ্কগুলো চালু আছে, শুধু শরীরের বদলে তারা যুক্ত আছে আমাদের সিম্যুলেশন শহরটার সাথে।
মার্চের মাঝামাঝি আমাদের প্রোগ্রামটা নিয়ে সবার সামনে হাজির হওয়ার কথা। সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হবে, কিন্তু তার আগে আমি নিজে অন্তত: একবার এ শহরটা ঘুরে দেখে আসব। ১লা মার্চ যখন জানতে পারলাম, আমরা সংবাদ সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত - আমি ওদের জানিয়ে দিলাম, আমি আগামীকালই ‘পৃথিবী’র ভেতর ঢুকতে চাচ্ছি।
সকালবেলা তৈরী হয়ে আমি চলে এলাম ল্যাবে। ওরাও সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমি স্ট্যাবিলাইজারটা মুখে দিয়েই চেয়ারে বসে পড়লাম। একইভাবে মাথা ঘুরে উঠল। অন্ধকার হয়ে এল চারদিক। চেতনা হারালাম যেন, কিন্তু তারপরই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা শহুরে রাস্তা। গাড়ি চলছে, রাস্তায় মানুষ হাটছে - ভোঁ করে একটা ট্যাক্সি চলে গেল আমার প্রায় গা ঘেষে। আমি চারদিকে তাকালাম, মনে মনে প্রশংসা না করে পারলাম না মামুনের। শীত শীত একটা বাতাস আমার গায়ে এসে লাগছিল, আশ্চর্যরকম বাস্তব মনে হচ্ছিল সেটাকে।
আমি রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলাম। মার্কেট আর অফিস প্রেমিসগুলোতে আলো জ্বলছিল নিভছিল। তখন আমার চোখে পড়ল একটা সাইবার ক্যাফে। মজার একটা পরীক্ষা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ওটাতে ঢুকে আমি ইন্টারনেটে লগ ইন করে আমার মেইল সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা করলাম। লগ ইন হল। এবার মেইল চেক করার জন্য আমার কোড নাম্বার দিলাম। এবং সেটাও করতে পারলাম। চমৎকার! সময় যত যাচ্ছে, মামুনের এই পৃথিবীটার সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করতে লাগল আরো বেশি করে।
আবার রাস্তায় বের হলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরোঘুরি করলাম কিছুক্ষণ। তারপর একটা পেপারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা পেপার হাতে নিয়েছি মাত্র, ঠিক এমন সময় কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। আমি চমকে ঘুরে তাকালাম। দেখি লীনা দাঁড়িয়ে আছে। মামুন তাহলে একে এখানেও রেখেছে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল আমার, বিশেষ করে যখন আমি একইসাথে জানি - লীনা মৃত, আবার সত্যিকার লীনারই চিন্তার একটা অংশকে আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে আমার চোখের সামনে।
মনজুর ভাই এখানে কি করছেন?
আমি হাসলাম। আমার এর মধ্যেই এই জগৎটা ভালো লাগতে শুরু করেছে।
আমি অনেকদূর থেকে আপনাকে দেখেছি। অনেকক্ষণ ধরে ডাকলাম। কি ভাবছিলেন আপনি?
যদি বলি, এই জগৎ সংসার নিয়ে ভাবছিলাম!
আপনি দার্শনিক হয়ে গেলেন নাকি? আচ্ছা, আজ যাই। কাল আবার অফিসে দেখা হবে।
সে চলে গেল। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভাবতে ভালো লাগছিল না যে, এটা শুধুই একটা স্বপ্ন।
আমি আবার উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, কারণ আমি জানিনা আমার বাসা কোথায়। কিন্তু নিশ্চয়ই আমি কোথাও থেকে কোন ইংগিত পাব। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর এক জায়গায় দাঁড়ালাম, তখন একটা গাড়ী এসে আমার সামনে দাঁড়াল।
স্যার, কি এখন বাসায় যাবেন? - গাড়ীর ভেতর থেকে কেউ বলল।
আমি গাড়ীতে উঠে বসলাম। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম দশতলা একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনে। কিন্তু কোন ফ্লোর - তা তো আমি জানিনা। ড্রাইভারকে বললাম - আমার দুর্বল লাগছে, আমাকে যেন সে অ্যাপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
সে আমাকে আটতলায় নিয়ে গেল। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, চাবি আছে। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট, বারান্দার টবে বড় বড় গাছ আছে, জানলাগুলোও বড় বড়।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু ওরা আমাকে এখনো তুলে নিচ্ছেনা কেন? নানান সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ইন্টারকমের শব্দে। নিচে আমাকে নিতে গাড়ী এসেছে। আমি অফিসে যাব। তৈরী হয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম। আমি ভুলে যেতে শুরু করেছি, এটা অবাস্তব একটা কাল্পনিক পৃথিবী - যেন আমারই আরেকটা জীবন এটা।
অফিসে ঢুকেই একপাশে আমার নাম লেখা একটি কিউবিকল দেখলাম। আমি জানি, প্রোগ্রামটায় লগ ইন করার সাথে সাথেই এগুলো সব আমার নামে বদলে গেছে। এখানে যদি এই চরিত্রে মামুন লগ ইন করত, তাহলে অফিসের ঐ কিউবিকলটায় মামুনের নামই লেখা থাকত।
সুপ্রভাত, মনজুর ভাই। - লীনা আমার পাশের কিউবিকলেই বসে আছে।
সুপ্রভাত।
স্বপ্ন যদি সুন্দর হয়, হোক সেটা মিথ্যা - অসুবিধা কি! আমি ওর সাথে লাঞ্চ করলাম, বিকেলে ওকে পৌঁছে দিলাম ওর বাসায়।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে চমৎকার দিনটির স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মনে পড়ল - চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় চলে গেছে, ওরা এখনো আমাকে তুলে নেয়নি। একটা আতংক ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে লাগল আমার মনে। আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যে চলে গেলাম কাছাকাছি একটা সাইবার ক্যাফেতে। ইন্টারনেট ব্রাউস করতে শুরু করলাম, বুঝতে পারলাম - বাস্তব জগতের ইন্টারনেটটাই এখানে সরাসরি যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো - আমি মামুনের মেইল অ্যাড্রেসে একটা ই-মেইল করে দিলাম জানতে চেয়ে, কেন সে আমাকে এখনো তুলে নিচ্ছেনা। মেইলটা ছেড়ে দিয়ে খুব অস্থিরভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম উত্তরের জন্য।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে উত্তর এলো। এবং উত্তরটা পড়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।
তোমাকে আর কোনদিনই এখান থেকে তুলে নেয়া হবে না।
কম্পিত হাতে আমি আবার মেইল করলাম - মামুন, এটা ঠাট্টার সময় না, আমি আতংকিত।
এবার উত্তর এলো একটা বড় চিঠিতে -
প্রিয় মনজুর, সিম্যুলেশনে অংশ নেয়ার সময় দুর্ঘটনাবশত: ব্রেইন হেমারেজে তোমার মৃত্যু ঘটেছে। সম্ভবত: ইলেকট্রিক ইম্পালসের অসমতাই এর জন্য দায়ী। আমরা সত্যিই দু:খিত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, তোমার এ মৃত্যুর দায়িত্ব তোমার একারই। তবে এ প্রোগ্রামে তোমার অবদানের কথা স্বীকার করে কৃতজ্ঞতাবশত: তোমার মস্তিষ্ককে আমাদের ‘পৃথিবী’র একজন বাসিন্দা হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। একারণেই মৃত্যুর পরও তুমি যোগাযোগ করতে পারছ আমাদের সাথে। অমরত্বের এ জগতে সুস্বাগতম। ইতি - তোমার বন্ধু - মামুনুর রশীদ।
আমি বুঝতে পারলাম, আমার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। প্রচন্ডভাবে হতাশ হয়ে পড়লাম আমি, যদিও মনে মনে ক্ষীণ একটা আশা কাজ করছিল যে - হয়তো এটা মামুনের স্রেফ একটি তামাশা। কিন্তু মনের গভীরে আমি জানতাম, এটা মামুনের পক্ষে করা খুবই সম্ভব - অর্থাৎ দুর্ঘটনাটি সে ইচ্ছা করেই ঘটিয়েছে। এখন আমার শেয়ারগুলো সে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেবে।
পরদিন সারাদিন আমার অ্যাপার্টমেন্টে কাটালাম। সন্ধ্যার পর দরজায় দু’টা টোকা পড়ল। খুলে দেখলাম, লীনা দাঁড়িয়ে আছে।
কি ব্যাপার মনজুর ভাই, অফিসে যাননি কেন?
আমি তাকে বসতে বললাম। আমার মন প্রচন্ড খারাপ ছিল। আটচল্লিশ ঘন্টা হয়ে যাবার পর আমি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছিলাম, আমার সত্যি সত্যিই দৈহিক মৃত্যু ঘটেছে এবং আমি এ সিম্যুলেশনের ভেতর চিরদিনের জন্য আটকা পড়েছি।
আমি আরো আগে আসতাম, রিশানকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসলাম।
রিশান কে?
লীনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল - আপনার কি হয়েছে বলেন তো?
কেন? রিশান কি তোমার ছেলে?
হ্যাঁ!
আর তোমার স্বামী?
আশ্চর্য, আপনি কি ঠাট্টা করছেন?
কোথায় আছে সে?
আপনি জানেন না?
মনে কর আমার স্মৃতি হারিয়ে গেছে।
সে যে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল - আপনার মনে পড়ছে না?
ও, ওরা ঘটনাটা এভাবেই সাজিয়েছে!
ওরা মানে? ওরা কারা?
আমার মন খারাপ হয়ে গেল - বেচারী জানেও না যে সে মৃত। আমার এখন মনে পড়ল - রোড অ্যাক্সিডেন্টে ওরা সবাই মারা গিয়েছিল, কিন্তু ওর স্বামীর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাম ছিলনা, নাম ছিল শুধু ওর আর ওর ছেলের - আর সেজন্যই ওর স্বামী এ জগতে অনুপস্থিত।
কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমি খুব আবেগাপ্লুত ছিলাম। সুতরাং লীনাকে সব ঘটনা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ও শুনল, খুব ঠান্ডা মাথায়ই শুনল। আমার কথা শেষ হলে পর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল - মনজুর ভাই, আপনি বিশ্রাম নিন, আমি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি। সে আমার কপালে হাত রাখল - টেম্পারেচার ঠিকই আছে, তবু আপনি প্লীজ বিশ্রাম নিন।
আমার অসহায় লাগছিল। এতো নি:সংগ লাগছিল যে মনে হচ্ছিল আমার ছায়া আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
লীনা একজন ডাক্তারকে ফোন করে আনাল। আমি কিছুই বললাম না, কেননা আমি জানতাম - কিছু বলে কোন লাভ নেই।
লীনা অনেক রাত্রে বাসায় ফিরে গেল, কিন্তু সে রাত্রে আমার এক ফোটা ঘুম হল না।
পরদিন সকালে কাপড় না বদলেই চলে গেলাম সাইবার ক্যাফেতে। প্রচন্ড শীত লাগছিল, ঠান্ডা কনকনে বাতাসের একটা প্রোগ্রাম করা আছে মনে হল - কিন্তু এসবই ছিল আমার কাছে অর্থহীন।
আমি মামুনকে মেইল করলাম, একটি শব্দ শুধু লিখলাম - কেন?
উত্তর আসতে এবার আধ ঘন্টা সময় লাগল। উত্তরটা অনেক বড়।
তুমি জানো, এই প্রজেক্টটার নাম ‘পৃথিবী’। কিন্তু আমার গবেষণা এখানেই শেষ নয়।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে একটা কথা ছিল - একটা নির্দিষ্ট সময় পর তোমাদের সবাইকে আমি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা দেব, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের।
এই সিম্যুলেশনের অধিবাসীদের জন্যও আমি একই রকম একটি ব্যবস্থা রেখেছি - এবং আমার এই দ্বিতীয় সিম্যুলেশনের নাম আমি রেখেছি ‘পরকাল’।
এখন তোমাদের মস্তিষ্কগুলোকে একসময় সাময়িকভাবে শাট ডাউন করা হবে, একটা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ব্যবস্থাও রেখেছি সেটাকে বোঝানোর জন্য। সুতরাং কয়েকদিনের মধ্যেই তোমরা দেখতে পাবে, তোমরা সবাই একটা বিশাল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মারা যাচ্ছো।
শাট ডাউন করার পর এই সিম্যুলেশন থেকে তোমাদের ডিসকানেক্ট করে অন্য সিম্যুলেশনটায় কানেক্ট করা হবে। তোমাদের ঐ ভার্চুয়াল মৃত্যুর পর তোমরা জেগে উঠবে আমার নতুন সিম্যুলেশনটায় - তোমাদের ভার্চুয়াল পরকালে।
ওহে, আমি তো ভার্চুয়াল ঈশ্বর হয়ে গেলাম।
এই পরকালে স্বর্গ থাকবে, নরক থাকবে। এই এক হাজার অধিবাসীর কেউ কেউ যাবে স্বর্গে, কেউ কেউ নরকে। আমি ঘটনাটাকে একেবারে ধর্মগ্রন্থগুলোর মত করার চেষ্টা করেছি। দীর্ঘ একটি রাত্রির পর সূর্য উদিত হবে পশ্চিম দিগন্তে।
আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। মামুন তাহলে প্রথম থেকেই একসাথে দুইটা সিম্যুলেশন নিয়ে কাজ করেছে। ও ধার্মিক ছেলে, কিন্তু ও যে ধর্মোন্মাদ তা আমি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাকে এখন ধৈর্য ধরতে হবে, কথা চালিয়ে যেতে হবে ওর সাথে - যোগাযোগ হারানো চলবে না। আমি ওকে আবার লিখলাম - কারা স্বর্গে যাবে?
উত্তর এলো এবারও।
যারা বিশ্বাস করে, তারাই স্বর্গে যাবে। আসলে আমার দ্বিতীয় সিম্যুলেশনটি একটি শূন্য সিম্যুলেশন। ওখানে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত সবাইকে বলা হবে, তোমরা যার যার মনের মত পৃথিবী তৈরী করে নাও। ওখানে তোমরা যা ভাববে, তাই সত্য হবে। ওখানে তোমাদের কল্পনা অনুযায়ী পরিবেশ তৈরীর ব্যবস্থা রেখেছি আমি। হোমবিল্ডার সফ্টওয়্যারগুলো থেকে আইডিয়াটা নিয়েছি আমি। ওখানে সব উপাদানই দেয়া থাকবে, তোমরা শুধু তৈরী করে নেবে নিজের মনের মত জগৎ, তারপর বাস করবে সে জগতে চিরকাল - স্বর্গ।
তুমি জানো, এরা সবাই সেলফ অ্যাডাপটিভ সিস্টেম - নিজে নিজে শিখতে পারে। এদের কাছে পাঠানো হবে নবী ও কিতাব। ঐ কিতাবে থাকবে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা, নবী তাদের ওটা বোঝানোর চেষ্টা করবে। যারা বিশ্বাস করবে নবীর কথা, তারাই সেদিন তৈরী করতে পারবে মনের মত জগৎ।
যারা বিশ্বাস করেনি, তারা সেদিন সক্ষম হবে না কোন জগৎ তৈরী করতে। ওরা তৈরী করতে পারবে না, কারণ ওরা বিশ্বাসকে চর্চা করেনি এবং এভাবে হারিয়ে ফেলেছে নিজস্ব জগৎ তৈরীর সামর্থ্য। সেদিন তাদের অস্তিত্ব ঝুলে থাকবে সন্দেহের একটা শূণ্যতায়। এটাই নরক - এটাতে ওরা সারাজীবন জ্বলবে।
চিঠি এখানেই শেষ। আমি শিউরে উঠলাম ওর লেখা পড়ে। সাথে সাথে লিখলাম - তোমার কোন অধিকার নেই কিছু মৃত মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে এধরণের খেলা খেলবার। আমি তোমার উদ্দেশ্য বানচাল করে দেব। সবাইকে জানিয়ে দেব সত্য। কেউ তোমার স্বর্গে ঢুকতে পারবেনা। তোমার প্রজেক্ট ব্যর্থ হবে।
এবার উত্তর এলো পাঁচ মিনিটে - তবে তাই হোক। তুমি এই এক হাজার লোককে বিভ্রান্ত করবে, তোমার ভূমিকা হবে শয়তানের। আর তোমার ভূমিকাকে প্রতিরোধ করবে আমার নবী। ধন্যবাদ তোমাকে, তোমার ভূমিকার ফলে আমার সিম্যুলেশনটা পূর্ণতা পেল।
রাগে ক্রোধে আমি ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু আমাকে এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমি আপাতত: অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তখন থেকে আমি অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। লীনা মাঝে মাঝে আসতো আমাকে দেখতে - ওর অফিসের পর। ও আমার জন্য খুব চিন্তা করত, আমিও ওর চমৎকার চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ - যদিও জানতাম, এ সবই অর্থহীন।
আমি জানিনা, লীনা আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছিল কিনা। তাকে আমি মামুনের ই-মেইলগুলো দেখিয়েছিলাম। সে চুপচাপ দেখেছিল। সে শুধু আমাকে বলেছিল - এটা যদি সত্যও হয়, তবুও যার ওপর আমার হাত নেই তা মেনে নেয়াই তো ভালো।
সে বিশ্বাস করত শেষপর্যন্ত তার ভাগ্যে ভালো কিছুই ঘটবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মামুনের তৈরী করা পরকালে স্বর্গই হবে ওর ঠিকানা - ওর বিশ্বাসের জোরে।
একদিন সন্ধ্যার বিষন্ন আলো লীনার মুখের ওপর এসে পড়ছিল। সে বলছিল - সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন আমার ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে তাকাই। এই জগৎ যদি একটা সিম্যুলেশন প্রোগ্রামই হয়, তাহলে আমাদের ভালোবাসাগুলোর কি অর্থ!
তুমি মানো বা না মানো, এটাই সত্য।
তাহলে আমাদের অস্তিত্বই কি অর্থহীন হয়ে ওঠে না!
এমনিতেও তো আমাদের অস্তিত্ব অর্থহীনই। মৃত্যু তো আমাদের অস্তিত্বের নিশ্চিত একটা সমাপ্তি - এমনিতেও।
লীনা চুপ করে ছিল।
কিন্তু আমার বিশ্বাস করারও কোন সুযোগ ছিলনা, কারণ আমি জানতাম প্রকৃত সত্য। আর আমি ছিলাম অবাধ্য বিদ্রোহী। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, সুযোগ পেলেই মামুনের এই প্রোগ্রাম আমি ক্রাশ করে দেব। আমাদের সবার অস্তিত্ব এতে ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মুক্তিতো পাব এই ভার্চুয়াল নরক থেকে।
আমার মাথা পুরোপুরি ঠান্ডা হতে আরো দিন কয়েক সময় লাগল। তখন আমি খুঁজতে শুরু করলাম, আমার হাতে কি কি অস্ত্র আছে। আমি এই সিম্যুলেশনটা সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানি, এখন কোনমতে যদি ল্যাবের ঐ সুপার কম্প্যুটারটায় হ্যাক করা যায়. তাহলেই আমি তার মধ্যে বাগ ঢুকিয়ে দিতে পারি। ঐ মুহূর্তে আমার মনে পড়ল, আমি ই-মেইলে এখনো মামুনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি - অর্থাৎ এই ইন্টারনেট সত্যিকার ইন্টারনেটই। তাহলে আমার পক্ষে কথা বলার ছলে ওর মেইলে ভয়ংকর কোন ভাইরাস পাঠানো খুবই সম্ভব।
তবে কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে, কারণ ও বুঝতে পারলে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। আবার এ ধরণের ভাইরাস তৈরিতে আমি খুব একটা দক্ষ নই, ফলে আমার কাজ হয়ে দাঁড়াল ঐ মৃত এক হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে এমন একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী খুঁজে বের করা - যিনি আমার হয়ে এ কাজটা করে দিতে পারবেন। তারপরই আপনার নাম শুনলাম এবং যোগাযোগ করলাম আপনার সাথে।
রাকিব এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনছিল মনজুর সাহেবের কাহিনী। এবার সে নড়ে-চড়ে বসল।
কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, সত্য এই যে - আপনিও দৈহিকভাবে মৃত এবং ঐ একহাজার জনের একজন।
এ হতেই পারেনা। - রাশেদ উঠে দাঁড়াল।
বসুন, প্লীজ। মাথা ঠান্ডা করুন। গত ডিসেম্বরে আপনার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, মনে আছে? অবশ্যই আছে। আপনি কি ওটাতে বেঁচে গিয়েছিলেন? আপনার অতীত ঘেটেছি আমি, ইন্টারনেটে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখের দৈনিক পত্রিকার কাটিং দেখাতে পারি আমি। আপনি তো এরপর থেকেই এখানে।
রাকিবের মনে পড়ল, কয়দিন যাবৎ এই জগৎটাকে খুব বেশি একঘেয়ে মনে হচ্ছিল তার।
বাইরে তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে।
বিষয়: বিবিধ
২০৯১ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Hope it is not finished yet...
একটু ধীরে ধীরে পড়তে হলেও অনেক দুর্দান্ত লিখেছেন।
বেশ ভালো লেগেছে।
শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সুন্দর ও আকর্ষনীয় গল্প, বলতে দ্বিধা নেই আপনার কল্পনাশক্তি প্রবল, আপনি ভাবুব প্রকৃতির, তবে সত্যকে উপলব্ধি করতেই ভাবেন, এখানে আপনার কৃতিত্ব। কল্পকাহিনী লিখার ক্ষেত্রে অন্য অনেকের চেয়ে আপনার ভাবনাটা অবশ্যই ভিন্ন ডাইমেনশনের। আল্রাহ আপনাকে রহম করুন। আরো লিখতে থাকুন। অনেক ধন্যবাদ
তবে আশঙ্কা হচ্ছে জাফ্রিকবাল কপি করে ফেলে কিনা!
ভাল মনে করলে পাঠাতে পারেন। ইমেইল-
মন্তব্য করতে লগইন করুন