পুনরুত্থান [বিজ্ঞান কল্পকাহিনী]

লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৪:৪৪:৪৪ রাত

১.

যতদূর চোখ যায় - মানুষ আর সাদা চাদর, সাদা চাদর আর মানুষ। উত্তর দিকে, দক্ষিণ দিকে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দিগন্ত পর্যন্ত খোলা প্রায়ান্ধকার মাঠে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ শুয়ে আছে - সার বেঁধে শুয়ে আছে। এগুলো কি লাশ! না, কারণ মাঝে মধ্যেই নড়ে উঠছে এরা, কারো কারো মুখে হঠাৎ করে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে হাসি - ঘুমের মধ্যেই।

এসবের মধ্যেই আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভেংগে জেগে উঠল রাফিজ ইমতিয়াজ। অবাক হয়ে তাকালো সে চারদিকে। অসংখ্য নগ্ন মানুষের ঘুমন্ত সারির মধ্যে সে একাই জেগে উঠেছে। সে নিজেও নগ্ন, শরীরটাকে অনুভব করতে পারছেনা যদিও।

শরীরের অসাড় ভাবটা যখন কেবল দূর হয়ে এসেছে, তখন সে অনুভব করল - কেউ একজন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে ফিরে তাকাল সে - যদিও একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ছাড়া কিছুই সে ওখানে দেখতে পেলনা। অবশ্য এ অবয়বটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। রাফিজ সেটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এটা কোন অদ্ভুত হাসপাতাল নয়তো! যদ্দূর ওর মনে পড়ে, সে মোটর সাইকেল করে আসছিল আর অন্যদিক থেকে একটা বাস অন্য একটা বাসকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এতো লোক কি একটা বাসে থাকে! আর একদিনে কি এতোগুলো দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব একটা এলাকায়!

আপনার যাবার সময় হয়েছে। - পাশ থেকে কেউ বলে উঠল। অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এতোক্ষণে। রাফিজ লক্ষ্য করল, আপাদমস্তক সাদা পোশাকে মোড়া ওটা।

আপনি কি চিকিৎসক? - রাফিজ জানতে চাইল।

অবয়বটা কোন উত্তর দিল না। শুধু ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল - নি:শব্দে।

আমি কি জীবিত? - হঠাৎ জেগে ওঠা সন্দেহ নিয়ে রাফিজ জিজ্ঞেস করে অবয়বটিকে।

জীবিতরা ঘুমন্ত, একমাত্র মৃত্যুই জাগাতে পারে মানুষকে। - এই প্রথম অবয়বের গম্ভীর কন্ঠস্বরটি শুনতে পেল রাফিজ।

ঘুমন্তরা কি জীবিত? - সে উল্টো প্রশ্ন করে।

অবয়বকে নিরুত্তর দেখে সে একসাথে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে - আমি কি ঘুমন্ত ছিলাম? এখন কি আমি জেগে উঠেছি? আর আপনিই বা কে?

তখন অবয়বটির মুখ দেখতে পেল রাফিজ। খুব সুশ্রী মুখমন্ডল ওটার - মেয়েদের মত কোমল, শিশুদের মত পবিত্র, এবং একজন পুরুষের মতই প্রখর।

আমি আপনার জন্য নিযুক্ত একজন ফেরেশতা, আর আপনি এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন - মৃত্যুর মাধ্যমে।

রাফিজ তখন বুঝতে পারল, সে একটা স্বপ্ন দেখছে। তাহলে কি কোন অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন কোমায় চলে গেছে সে! নাকি অ্যাক্সিডেন্টের চিন্তাও স্বপ্নের মধ্যেই ঘটেছে!

এরা সবাই তাহলে জীবিত, আর শুধু আমিই মৃত? - রাফিজ তীর্যকভাবে প্রশ্ন করল।

সবসময়ই কেউ না কেউ জেগে উঠছে, আমরা তাকে কেয়ামতের মাঠে নিয়ে যাই - মৃতকে ঐ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই আমার মত সৃষ্টির কাজ।

জীবিতরা এখানে কি করে? তাদের তো পৃথিবীতে ঘুরে-ফিরে বেড়ানোর কথা।

তারা পৃথিবীতেই ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে।

কিভাবে?

স্বপ্নে - তাদের সম্মিলিত স্বপ্নে।

এরা সবাই স্বপ্ন দেখছে? - রাফিজ অবাক হয়।

জগৎটা তো একটা স্বপ্ন, যেখানে এরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা করে। - ফেরেশতাবেশী উত্তর দেয়।

রাফিজ উত্তর শুনে চুপ হয়ে যায়।

ওরা দু’জন হাটতে হাটতে একসময় লাখো কোটি ঘুমন্ত মানুষকে পার হয়ে আসে। দুই বিশাল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে গেছে এক সরু পায়ে হাটা পথ। তার ওপাশে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল আরেকটি মাঠ। এ মাঠেরও কোন শেষ দেখা যায় না, আর সারা মাঠ জুড়ে গো-ধূলির বিষন্ন একটা আলো। সেই মাঠের মাঝামাঝি ওরা গিয়ে দাঁড়াল - রাফিজ, আর তার ডানপাশে ফেরেশতা। তারপর তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, অনেকক্ষণ - যেন হাজার বছর। শেষে রাফিজ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল - এখন আমরা কি করব?

সৃষ্টি করুন। - বলল ফেরেশতা।

রাফিজ কিছুই বুঝতে পারল না।

কি সৃষ্টি করব? - প্রশ্ন করে সে।

জগৎ।

আমি জগৎ সৃষ্টি করব কিভাবে? আমি তো স্রষ্টা নই।

আপনি যা চান, এখানে তাই হবে - আপনি যা ভাববেন, তাই এখানে সত্য।

কিভাবে এটা সম্ভব?

ফেরেশতা হাসল - এটা পৃথিবীর মত অন্যের তৈরী করা কোন স্বপ্ন নয়, ঐ স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এটা প্রকৃত বাস্তবতা। এখানে আপনার স্বপ্ন আপনি নিজেই তৈরী করে নেবেন, এবং সেই স্বপ্নের জগতে বাস করতে থাকবেন - অনন্তকাল।

মৃত্যু আপনাকে পৃথিবী থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, স্বপ্নের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন আপনি - এখন শুধু সৃষ্টি আর সৃষ্টি।

রাফিজ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ এভাবে, তারপর সে একটু মাথা খাটাতে শুরু করল। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হয়তো এ রহস্যের কোন কিনারা করা যাবে।

যদি আমি স্বর্গ তৈরী করতে চাই, তাহলে আমাকে কি করতে হবে?

যারা বিশ্বাস করে তারাই কেবল স্বর্গ তৈরি করতে পারে। - ফেরেশতা বলে।

পৃথিবীকে যারা সুন্দরভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, এইখানে তাদের স্বপ্ন তারা বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাবে।

আর যারা পৃথিবীতে কুৎসিৎ চিন্তা করেছে আর মানুষের ক্ষতি করেছে?

তারা চাইলেও স্বর্গ তৈরী করতে পারবে না। - বলে ফেরেশতাবেশী।

তারা পার্থিব জীবন কাটিয়েছে বিকৃতির ধ্যানে - এখানেও তারা যন্ত্রণাময় কুৎসিৎ একটা জগৎ ছাড়া আর কিছুই তৈরি করতে পারবে না। কারণ সুন্দর ভাবে চিন্তা করতে এমনকি স্বপ্ন দেখতেও তারা অভ্যস্ত নয়। এবং তাদের তৈরী করা যন্ত্রণাময় জগতে তারা থাকবে - চিরকাল।

আমি তো এদের কারো দলেই পড়ি না।

কিভাবে? - ফেরেশতা অবাক হয়, সম্ভবত: তার অপার্থিব জীবনে এই প্রথম।

আমি ছিলাম অবিশ্বাসী, স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ছিল না আমার, বিশ্বাস ছিল শুধু নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিতে। আমার বুদ্ধিতে যা আসে নি, তা বিশ্বাস করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না কোনদিন।

অর্থাৎ আপনি কোন স্বপ্নই দেখেন নি - না সুন্দর, না কুৎসিৎ!

পৃথিবীতে আমি বাস্তববাদী ছিলাম।

কিন্তু এটাই তো বাস্তব, আর পৃথিবীটাই তো স্বপ্ন।

তখন তো সেটা জানতাম না।

তাহলে তো আপনি কোন জগৎই তৈরি করতে পারবেন না। - ফেরেশতা তার আশংকা প্রকাশ করল।

কারণ কোন জগতের স্বপ্ন আপনি দেখেনই নি কোনদিন।

রাফিজ চুপ হয়ে গিয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। এভাবে কেটে গেল আরো এক হাজার বছর। রাফিজ লক্ষ্য করল, ওর আশে-পাশে কেউ নেই। ওকে এখানে পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই ছিল ফেরেশতার দায়িত্ব। এখন সে নিজেই তার নিজের একমাত্র সহায়।

রাফিজ খুব মন দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল একটি জগৎ তৈরী করতে। কিন্তু সে যতবারই চেষ্টা করতে যায় - তার মনে হয়, এটা একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না - যা একটু পরই শেষ হয়ে যাবে। সে যতবারই চেষ্টা করে - তার মনে হয়, মৃত্যুর পর মানুষের অস্তিত্বই সম্ভব নয়।

সুতরাং প্রতিবারই সে ব্যর্থ হল একটি স্বপ্ন তৈরী করতে - যেন ব্যর্থ হতে থাকবে অনন্তকাল। আর ওর মনে হল, এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তার চারপাশে বিরাজ করতে থাকবে অদ্ভুত এই শূণ্যতা - সীমাহীন।

২.

ডিউটি ডাক্তার ভিসিটিং প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল - কোমায় আর কতক্ষণ থাকবে বলে মনে হয়, স্যার?

প্রফেসর মলিন হাসলেন - এ অবস্থায় কি কোন মন্তব্য করা সম্ভব?

ডিউটি ডাক্তার অ্যাক্সিডেন্টে অজ্ঞান হয়ে থাকা রোগীটির রুটিন চার্ট পূরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিন্তু সে জানে, এধরণের কেসগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেষ ফলাফল মস্তিষ্কের মৃত্যুই হয়ে থাকে - আর সেক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং একেবারেই ফলাফলশূণ্য একটি প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

বিষয়: সাহিত্য

২০৬০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

266000
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫৯
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ, ভালো লাগলো।
এ ধরণের গল্প বেশ পড়েছি। আপনারটিও ভালো হয়েছে।
শুভেচ্ছা রইলো। Rose Rose Rose Good Luck
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৭
209904
অয়ন খান লিখেছেন : ধন্যবাদ মামুন ভাই।
266039
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:০৭
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৮
209905
অয়ন খান লিখেছেন : ভালো থাকবেন্।
266062
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:১৪
প্রবাসী আশরাফ লিখেছেন : হুমম...ভালো লেগেছে পড়তে।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৯
209906
অয়ন খান লিখেছেন : ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
266076
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৬
আহ জীবন লিখেছেন : অয়ন ভাই কাহিনীটি পড়লাম ভালো ও লেগেছে। কিন্তু আপনার আগের কাহিনীগুলোতে সব শেষে একটা চমক থাকতো। এই গল্পে ও আশা করেছিলাম। পাইনি মনে হচ্ছে। তবে একটা জবাব আছে।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১০
209908
অয়ন খান লিখেছেন : Happy বয়সের সাথে সাথে চমক কমে আসে।
266104
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩২
আনিস১৩ লিখেছেন : Nice one. Write more...
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১০
209909
অয়ন খান লিখেছেন : ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File