মাত্রা [বিজ্ঞান কল্পকাহিনী]
লিখেছেন লিখেছেন অয়ন খান ১৩ জুন, ২০১৪, ১১:০২:২৯ সকাল
দেশী একটা সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করত রাশেদ। ওদের কাজ ছিল বিভিন্ন গেম তৈরী করে দেশে কিংবা বাইরে বিক্রী করা। বেশ লাভজনক ব্যবসা, দেশের বাইরের বাজারও মন্দ নয়। রাশেদ স্পেশালিস্ট প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করত ওখানে। ওর বাইরে থেকে ট্রেনিং করা ছিল, ও ভিস্যুয়াল ইফেক্টের কাজ করত। এই যেমন, রেসিং গেমের মধ্যে গাড়ী কিংবা রাস্তা ছাড়াও আশ-পাশের পরিবেশের ছবি বানাতে হয় - ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি। ওর কাজ ছিল ওগুলোকে অন্যান্য দেশের সফটওয়্যারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মত মানসম্পন্ন করে তৈরী করা।
এবং রাশেদ তার ক্যারিয়ারে ছিল সফল একজন প্রোগ্রামার। তার হাতের কাজ ছিল অসাধারণ, তার মেধার ওপর কোম্পানীর আস্থা ছিল ষোল আনারও বেশী। বরং সহকর্মীরা তাকে আধ-পাগল লোক হিসেবেই জানত, কেননা সে নিজের কাজ ছাড়া আর সব ব্যাপারে ছিল উদাসীন, অন্যমনস্ক।
নিজের কাজের ব্যাপারে সে একটু বেশী রকমই আগ্রহী ছিল, প্রায় অবসেশনের পর্যায়ে পড়ত ওটা। ওটা আর ওর পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নেশা হয়ে গিয়েছিল। ও সারাদিন পড়ে থাকত তার ল্যাপটপ নিয়ে, আর সারারাত পড়ে থাকত ভিস্যুয়াল ইফেক্ট বিষয়ক পড়াশুনায়। সে চূড়ান্তরকম অসামাজিকও হয়ে পড়েছিল এসব কারণে।
কিন্তু ২০০৪ এর মার্চ মাসে একটা নতুন খেয়াল চাপে তার মাথায়। ও সবসময়ই চেয়েছে এমন কিছু করতে যা অন্য কেউ কোনদিন করেনি। এবার সে গেমকে বাস্তবতার আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাইল। আসলে সে বাস্তবতার সাথে গেমের জগতের তুলনা করছিল। সে চিন্তা করে দেখল, গেমের জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল - গেম দ্বিমাত্রিক, আর বাস্তব জগত ত্রিমাত্রিক। গেমের দুইটি মাত্রা স্ক্রীনের দুই মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর বাস্তব জগতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছাড়াও গভীরতা বলে আরেকটি মাত্রা আছে। এখন গেমকেও যদি ত্রিমাত্রিক করা যায়, তাহলে তা অনেক বেশী ব্যবসা সফল হবে। এমনিতে ত্রিমাত্রিক মুভি আছে, যা বিশেষ চশমা পরে দেখতে হয়। আমাদের গেম ইন্ডাস্ট্রীতেও এমন কিছু করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
এসব নিয়েই সে পড়াশুনা করছিল, বিশেষ করে ত্রিমাত্রিক ভিডিওগেমের লেটেস্ট ভার্সনগুলো নিয়ে সে কাজ করছিল। এরমধ্যেই সে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মাথায় ঢুকে গেল, আমাদের জগৎটা যদি ত্রিমাত্রিক হয়, আর ত্রিমাত্রিক গেম মানুষই তৈরী করতে পারে - তাহলে অসম্ভব কি যে, আমাদের দৃশ্যমান এ জগৎটা অন্য কারো তৈরী করা ত্রিমাত্রিক গেম না!
খুব ভালোভাবে আইডিয়াটা ঢুকে যায় তার মাথায়। আর যেহেতু সে ছিল অসামাজিক, তাকে তার বিচ্ছিন্ন চিন্তা কিংবা ধারণা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনারও কেউ ছিলনা। সে সমস্ত কাজ-কর্ম ফেলে ওটা নিয়েই মেতে রইল কয়েকদিন।
এরমধ্যে এপ্রিলের ১০ তারিখে সে দু:সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে সিদ্ধান্ত নিল যে সে পরীক্ষা করে দেখবে, এই পুরো জগৎটা ত্রিমাত্রিক জটিল একটা গেম কিনা। আর এটা পরীক্ষা করার পথ একটাই - মৃত্যু। সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল।
রাত ১২ টার সময় সে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ঘুমের বড়ি খেয়ে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল এবং একসময় সত্যি সত্যিই ঢলে পড়ল এক গভীর অতল ঘুমে।
সে যখন জেগে উঠল, তখন দেখল - চারিদিক অন্ধকার।
তাহলে সে মারা যায়নি! কিন্তু এতো অন্ধকার যে কিছুই এর ভেতর আঁচ করা যাচ্ছিলনা। আর তার শরীরটাও সম্ভবত: অবশ হয়ে গেছে, সে কোন কিছু অনুভব করতে পারছিলনা। শুধু চিন্তা করতে পারছিল।
অনেকক্ষণ ছিল সে এভাবে, মনে হল অনন্তকাল। তারপর দু’টা খুব ছোট আলোর বিন্দুকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। ওগুলো উড়ছিল, অনেকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার মত, কিন্তু ওগুলো ঝিঁ ঝিঁ পোকা ছিল না।
স্বাগতম।
কেউ কথা বলছে শূণ্যের ভেতর থেকে। না, মনে হল আলো দু’টার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে।
আমি এখন কোথায়? - রাশেদ জিজ্ঞেস করল।
তুমি এখন চতুর্মাত্রায়।
আমি কি মৃত?
ঘটনাটাকে এভাবে বলা যায় যে, ত্রিমাত্রিক জগতে তোমার মৃত্যু ঘটেছে এবং তুমি প্রবেশ করেছ একটি চতুর্মাত্রিক জগতে।
এতক্ষণে রাশেদ বুঝতে পারল, ওর আসলে কোন শরীরই নেই। সম্ভবত: ওর আত্মাটা একটা শূণ্যতার ভেতর ঝুলে আছে।
তোমরা কারা?
আমাদের তুমি বুঝবে না।
তবুও বল।
তুমি ধার্মিক হলে বলতাম, আমরা ফেরেশতা। কিন্তু তুমি তা নও, তুমি বিজ্ঞানমনস্ক লোক। যদি বলি, আমরা চতুর্মাত্রিক জীব - তাহলে হয়তো কিছুটা ধারণা করতে পারবে আমাদের সম্পর্কে।
চতুর্থ মাত্রাটা কি? - রাশেদের এগুলো জানতেই হবে, জানার জন্যই তো মৃত্যুকে বেছে নেয়া।
সময়। - ওরা দু’জন একটি মাত্র কন্ঠে কথা বলছিল।
তাহলে কি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ পাশাপাশি রাখা আছে?
অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এখানে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিকের মত, এর বেশি কিছু নয়। - কন্ঠ দু'টো উত্তর দিল, একসাথে।
ভাগ্য তাহলে পূর্বনির্ধারিত! - রাশেদ আবার প্রশ্ন করে।
তাই কি স্বাভাবিক নয়!
তাহলে বেহেশতে কে যাবে, আর কে দোযখে - তাও তো পূর্বনির্ধারিত। - রাশেদ শ্লেষ্মার সাথে বলে, এবং বলে আরাম পায়; সম্ভবত: এই আপাত: আধ্যাত্মিক স্বত্তাকে সে যুক্তির জালে আটকাতে পেরেছে শেষপর্যন্ত।
কন্ঠগুলো নিরুত্তর থাকে।
কি? তোমাদের বক্তব্য অনুযায়ী তো বেহেশত-দোযখ পূর্বনির্ধারিত! তাই না!
সমস্ত কিছুই পূর্বনির্ধারিত।
তাহলে আর আমাকে পৃথিবীতে পাঠানোর দরকার কি ছিল? সরাসরি জায়গা মত পাঠিয়ে দিলেই হতো। - নিজের রসিকতার ক্ষমতায় রাশেদ নিজেই অবাক হয়।
তোমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে তোমার নিজের কাছেই প্রমাণ করার জন্য - তুমি কোন জায়গার উপযুক্ত।
রাশেদ চুপ করে যায়। সময় পার হয়ে যাচ্ছে - যেন অনন্তকাল। তারপর সে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে - আমি কোন জায়গার উপযুক্ত?
কন্ঠযুগল এবার নিরুত্তর থাকে। আবার নীরবতার কিছুক্ষণ।
ত্রিমাত্রিক জগতে আমি ভ্রমণ করতাম এখান থেকে ওখানে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। - রাশেদ এবার বৈজ্ঞানিক সত্যের দিকে হাত বাড়ায়।
তার মানে চতুর্মাত্রিক এই জগতে আমি ইচ্ছা করলেই অতীত বা ভবিষ্যতে যেতে পারব?
সময় এখানে একটি আলাদা মাত্রা। সুতরাং ত্রিমাত্রিক ঐসব অতীত বা ভবিষ্যৎকে এখান থেকে অবশ্যই দেখা সম্ভব।
কেন, যেতে পারব না ওগুলোতে?
ত্রিমাত্রিক জগতের সব জায়গা - যা তুমি দেখেছ - তার সবগুলোতে কি তুমি গিয়েছ?
ত্রিমাত্রিক জগৎ কি আলাদা?
জগৎ একটাই, মাত্রা ভেদে অস্তিত্ব ভিন্ন হয়। অনেকটা বায়ুমন্ডলের মত, এক স্তরের ওপর অন্য স্তর।
তারপর রাশেদ সেই প্রশ্নটি করে, যেটি সারা ত্রিমাত্রিক জীবন সে মনে পুষে রেখেছিল - ঈশ্বর বলে কি কেউ আছেন?
অবশ্যই আছেন।
উনি কোন মাত্রার অস্তিত্ব?
কোন উত্তর এলো না এবার।
উনি কি অসীমতম মাত্রায় অবস্থান করেন?
উনি মাত্রার ঊর্ধ্বে, মাত্রার স্রষ্টাই তো উনি। মাত্রার ভেতরে থেকে তিনি কিভাবে মাত্রা আর জগৎ সৃষ্টি করবেন!
মাত্রা কয়টি?
আমরা সত্তর হাজার পর্যন্ত মাত্রার কথা জানি। ধর্মগ্রন্থগুলোতেও সত্তর হাজার পর্দার কথা বলা আছে। এদিকে ‘সাত’ শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ ‘অসীম’।
মাত্রার প্রয়োজন কি?
মাত্রা না থাকলে আমাদের অস্তিত্বগুলো কোথায় থাকতো! সেক্ষেত্রে অস্তিত্ব বলেই কিছু থাকতো না। তোমাদের মুসা নবীর জন্য মাত্র একটি মাত্রার পার্থক্য কমিয়ে দেয়া হয়েছিল, এতেই তূর পাহাড় জ্বলে গিয়েছিল।
রাশেদের মনে এখনো আরেকটা মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গেছে - আচ্ছা, ধরে নিলাম ঈশ্বর আছেন। এখন সৃষ্টি, আমি এবং তুমি - আমরা সবাই স্রষ্টার বহি:প্রকাশ। তাহলে তার মানে কি এই নয় যে, সবকিছুর মধ্যেই স্রষ্টা আছেন!
বহি:প্রকাশ তো আয়নাতেও হতে পারে, কিন্তু সেই বহি:প্রকাশ বিমূর্ত।
তাহলে সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা নেই!
জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্মটি নিজে জয়নুল আবেদীন নয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের শরীরের কোন অংশ নেই। রবিঠাকুরের কাছে তাঁর কবিতাটি বিমূর্ত, এক অর্থে অবাস্তব। ঈশ্বরের তুলনায় তাঁর সৃষ্টি আরো বিমূর্ত এবং মূল্যহীন।
তার মানে, মানুষ বিমূর্ত! ত্রিমাত্রিক জগৎ বিমূর্ত জগৎ! মানবজীবন বিমূর্ত! - রাশেদ আর্তনাদ করে ওঠে।
স্রষ্টার তুলনায় সমস্ত সৃষ্টিই বিমূর্ত, এমনকি আমরা চতুর্মাত্রিকরাও।
রাশেদ নিশ্চুপ হয় - অনন্তকাল কেটে যায়, আর এখানেতো সময় একটি পরিবর্তনশীল মাত্রা ভিন্ন কিছু নয়।
এখন আমি সময়ের ভেতর ঘুরে-ফিরে দেখতে চাই। - সেই পরিচয়হীন কালেরই একপর্যায়ে রাশেদ বলে। সে একজন বৈজ্ঞানিক, তাকে তার প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতেই হবে।
আলো দু’টি উধাও হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল দৃশ্যপট, লোকজন একটা লাশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখটা খুব চেনা, ওটা রাশেদ প্রায় প্রতিদিনই আয়নায় দেখেছে।
রাশেদ অতীতের কথা ভাবল, তখন পেছনের দিকে ঘটতে শুরু করল ঘটনাটা। লাশ নিয়ে ওরা পেছনে হাটতে লাগল, রাশেদের মুখ থেকে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো বেরিয়ে এলো, রাশেদ কম্প্যুটারে কাজ করছে, বই পড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে - যখন আরো ছোট, রাশেদের বাবা-মা-দাদা।
এবার ভবিষ্যৎ দেখতে হবে। খুব দ্রুতগতিতে দৃশ্যপট বদলাতে লাগল, বসতিগুলোর ধরণ পাল্টে যেতে লাগল। আধুনিক অদ্ভুত সব আকৃতির স্থাপত্য দেখতে পেল রাশেদ। ও বুঝতে পারল, ওর সময় থেকে হাজার বছর এগিয়ে গেছে সে।
ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা - সেই মহাধ্বংস। ও দেখল পূর্বদিক থেকে আগুনের একটা হলকা দৌঁড়ে আসছে - কোন গ্রহাণুপুঞ্জ আঘাত করেছে ভূ-পৃষ্ঠে, কিংবা কোন অস্বাভাবিকরকম শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বোমা। সবাই মরে যাচ্ছে, শহরগুলোর পতন ঘটছে, লাখ লাখ বছরের মানবসভ্যতা তুলোর মত উড়ে উড়ে ঝরে পড়ছে - যেন এর কোন মূল্যই কখনো কারো কাছে ছিল না।
এই তাহলে সবকিছুর শেষ!
রাশেদ তখন হঠাৎ করে বুঝতে পারল - অতীত আর ভবিষ্যৎ আসলে কতগুলো স্ন্যাপশটের মত, একটার পর একটা সাজানো আছে এবং যা ঘটার তা ঘটবেই। অতীত বলো আর ভবিষ্যৎ বলো, জন্ম বলো আর মৃত্যু বলো - সব আসলে ঘটে গেছে।
ভাগ্য মানেই পূর্বনির্ধারিত, এবং মানুষ যথারীতি মূল্যহীন।
রাশেদ বুঝতে পারল, কেয়ামত ভবিষ্যতের কোন ঘটনা নয়।
কেয়ামত ঘটে গেছে।
সে গভীরভাবে প্রার্থণা করতে লাগল, যেন এটি একটি দু:স্বপ্ন হয় এবং একটু পরই যেন সে ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
১৯১৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই ধরনের বিষয় নিয়ে কিন্তু ১২৫০-৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে একটি বই লিখেছিলেন আল নাফিস। যাকে সাইন্স ফিকশনের প্রাচিনতম নিদর্শনগুলির একটি বিবেচনা করা হয়।
http://en.wikipedia.org/wiki/Al-Nafis
http://en.wikipedia.org/wiki/Theologus_Autodidactus
ঐই লিন্কগুলি তে পাবেন।
শুভ কামনা ও ভালো লাগা রেখে গেলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন